১৯তম অধ্যায় – কৌরব–পলায়নে পাণ্ডবগণের জয়োল্লাস
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ। নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ মহারথ মদ্রনাথ নিপাতিত হওয়াতে আপনার পক্ষীয় বীরবর্গ ও আপনার পুত্রগণ প্রায় সকলেই সমরে পরাঙ্মুখ হইলেন। অগাধ সাগরে নৌকা ভগ্ন হইলে বণিকেরা যেমন পারলাভের প্রত্যাশা করে, তদ্রূপ তাঁহারা মদ্ররাজের নিধনানন্তর আশ্রয়লাভের অভিলাষ করিতে লাগিলেন। অনন্তর আমরা সকলেই সেই মধ্যাহ্নকালে শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত, নিতান্ত ভীত ও পরাজিত হইয়া, সিংহনিপীড়িত মৃগযূথের ন্যায়, ভগ্নশৃঙ্গ বৃষভের ন্যায়, শীর্ণদন্ত মাতঙ্গের ন্যায় প্রতিনিবৃত্ত হইলাম। তৎকালে কোন যোদ্ধাই সৈন্যসন্ধান ও বিক্রম প্রকাশ করিতে সাহসী হইলেন না। মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ ও সূতপুত্র নিহত হইলে যোদ্ধাদিগের যেরূপ দুঃখ ও ভয় উপস্থিত হইয়াছিল, এক্ষণে মদ্ররাজ শল্য কলেবর পরিত্যাগ করিলে তাঁহাদের তদ্রূপ ভয় ও শোক উপস্থিত হইল। তখন তাঁহারা জয়লাভে এককালে নিরাশ হইয়া ক্ষতবিক্ষতকলেবরে ভীতচিত্তে কেহ কেহ অশ্বে, কেহ কেহ গজে, কেহ কেহ রথে ও কেহ কেহ বা পাদচারে মহাবেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। অনেকে শত্রুশরে সমাহত হইয়া সমরশয্যায় শয়ন করিলেন। পতাকার দ্বিসহস্র মাতঙ্গ অঙ্কুশপ্রহার ও অঙ্গুষ্ঠের তাড়নে সঞ্চালিত হইয়া মহাবেগে গমন করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে আপনার পক্ষীয় বীরগণ বিপক্ষের শরজালে সমাহত হইয়া ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।
“তখন পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ কৌরবগণকে পরাজিত, হতোৎসাহ ও ছিন্নভিন্ন দেখিয়া বিজয়াভিলাষে ধাবমান হইলেন। ঐ সময় ঘোরতর শরশব্দ, সিংহনাদ ও শঙ্খধ্বনি সমুত্থিত হইল। পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ কৌরবসৈন্যদিগকে ভয়বিহ্বল ও পলায়ন পরায়ণ অবলোকন করিয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন, আজ সত্যসন্ধ রাজা যুধিষ্ঠির শত্রুহীন হইলেন। আজ ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুর্য্যোধন রাজশ্রীবিহীন হইল। আজ রাজা ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের মৃত্যুসংবাদ-শ্রবণে নিতান্ত বিহ্বল ও বিমোহিত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইবেন। আজ তিনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ধনুর্ধরগণের অগ্রগণ্য বলিয়া বিবেচনা এবং আপনাকে মন্দবুদ্ধি বলিয়া অবজ্ঞা করিবেন। আজ তাঁহাকে বিদুরের বাক্য সত্য বলিয়া অবধারণ করিতে হইবে। আজ অবধি তিনি যুধিষ্ঠিরের নিকট ভৃত্যভাবে অবস্থান করিয়া পাণ্ডবেরা যেরূপ দুঃখ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তদ্রূপ দুঃখপরম্পরা অনুভব করিবেন। আজ তিনি কৃষ্ণের মাহাত্ম এবং অর্জুনের অতি ভীষণ গাণ্ডীবনিম্বন, অস্ত্রবল ও ভুজবীৰ্য্য সম্যক অবগত হইবেন। আজ কৌরবগণ দেবরাজ-নিহত বলাসুরের ন্যায় দুর্য্যোধনকে বিনষ্ট দেখিয়া ভীমের ভয়ঙ্কর বাহুবলের পরিচয় পাইবে। মহাবীর বৃকোদর দুঃশাসনবধকালে যেমন ভীষণ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, আর কেহই তদ্রূপ কাৰ্য্য করিতে সমর্থ নহে। আজ কৌরবগণ দেবগণেরও নিতান্ত দুঃসহ মদ্ররাজকে নিহত শ্রবণ করিয়া পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পরাক্রম বিদিত হইবেন। আজ রাজা ধৃতরাষ্ট্র মহাবল সুবলনন্দন ও অন্যান্য গান্ধারগণকে বিনষ্ট শ্রবণ করিয়া মাদ্ৰীতনয় নকুল ও সহদেবকে নিতান্ত দুঃসহ বলিয়া স্থির করিবেন। দেখ, মহাবীর ধনঞ্জয়, সাত্যকি, ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, নকুল, সহদেব, শিখণ্ডী ও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যাঁহাদিগের যোদ্ধা, ত্রিলোকীনাথ বাসুদেব যাঁহাদিগের একমাত্র আশ্রয় এবং নিরন্তর ধর্মানুষ্ঠানই যাঁহাদিগের অভিপ্রেত, তাঁহাদিগের কি নিমিত্ত জয়লাভ হইবে না? মহাত্মা বাসুদেব যাঁহার নাথ, সেই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ব্যতিরেকে আর কোন বীর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, মদ্ররাজ ও অন্যান্য অসংখ্য মহাবলপরাক্রান্ত নৃপতিকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন?
দুর্য্যোধনের বিজয়ী পাণ্ডবসৈন্য অনুসরণ
“হে মহারাজ! পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ আপনার যোদ্ধাদিগকে ছিন্নভিন্ন দেখিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে পরস্পর এইরূপ কহিতে কহিতে তাঁহাদিগের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় রথসৈন্যের এবং মহাবল নকুল, সহদেব ও সাত্যকি শকুনির প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন রাজা দুর্য্যোধন ভীমভয়ে স্বীয় সৈন্যগণকে ধাবমান দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে সারথিকে কহিলেন, “হে সূত! ধনুর্দ্ধর ধনঞ্জয় আমাকে অতিক্রম করিবার চেষ্টা করিতেছে; অতএব তুমি এক্ষণে সৈন্যগণের পশ্চাদ্ভাগে অশ্বসঞ্চালন কর। আমি পশ্চাদ্ভাগে যুদ্ধ করিলে মহাসাগর যেমন তীরভূমিকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় না, তদ্রূপ ধনঞ্জয় কিছুতেই আমাকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইবে না। ঐ দেখ, পাণ্ডবেরা আমার সৈন্যগণের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইতেছে। সৈন্যগণের চরণসমুত্থিত ধূলিজাল নভোমণ্ডলে উড্ডীন হইয়াছে এবং বীরগণ ভয়ঙ্কর সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতেছেন, অতএব তুমি সৈন্যগণের পশ্চাদ্ভাগ রক্ষা করিবার নিমিত্ত মন্দভাবে অশ্বসঞ্চালন কর। আমি সমরে অবস্থান করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে আমার সৈন্যগণ নিশ্চয়ই প্রতিনিবৃত্ত হইবে।
“কুরুরাজসারথি তাঁহার সেই বীরজনোচিত বাক্য শ্রবণ করিয়া সুবর্ণমণ্ডিত অশ্বগণকে মন্দ মন্দ সঞ্চালন করিতে লাগিল। তখন হস্তী, অশ্ব ও রথবিহীন একবিংশতিসহস্র পদাতি প্রাণ পৰ্য্যন্ত পণ করিয়া যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইল এবং নানাদেশীয় অন্যান্য যোধগণ যশোলোলুপ হইয়া সংগ্রামে মনোনিবেশ করিলেন।
‘অনন্তর সেই হৃষ্টচিত্ত সৈন্যগণ অরাতিগণের সহিত সমবেত হইলে উভয়পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। মহাবীর ভীমসেন ও ধৃষ্টদ্যুম্ন চতুরঙ্গবল সমভিব্যাহারে সেই বিবিধ ভজনপদবাসী কৌরবপক্ষীয় যোধগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। বীরলোকগমনাভিলাষী পদাতিগণও সিংহনাদ ও আস্ফোটশব্দ করিয়া পরম আহ্লাদে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইল। আপনার পুত্রগণ বৃকোদরকে প্রাপ্ত হইয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক হইতে তাহাকে পরিবেষ্টন করিয়া প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর ভীমসেন সমরাঙ্গনে পদাতিগণকর্ত্তৃক পরিবৃত এবং বারংবার সমাহত হইয়াও মৈনাকপৰ্ব্বতের ন্যায় অবিচলিতভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ রোষভরে অন্যান্য যোধগণকে প্রহার করিয়া নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন ভীমপরাক্রম ভীমসেন ক্রোধভরে দণ্ডপাণি কৃতান্তের ন্যায় এক সুবর্ণমণ্ডিত ভীষণ গদা গ্রহণপূর্ব্বক রখ হইতে ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া সেই একবিংশতিসহস্র পদাতি সৈন্যকে বিপোথিত করিয়া ফেলিলেন এবং অবিলম্বে ধৃষ্টদ্যুম্নকে অগ্রসর করিয়া তথা হইতে তিরোহিত হইলেন। পদাতিগণ নিহত হইয়া রুধিরাক্তকলেবরে বায়ুবিধাটিত পুস্পিত কর্ণিকারের ন্যায় সমরশয্যায় শয়ন করিল।
পলায়িত সৈন্যগণের প্রতি দুর্য্যোধনের আশ্বাস
“হে মহারাজ! এইরূপে ঐ যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রধারী কুণ্ডলালঙ্কৃত নানাদেশীয় নানাজাতীয় লোকসকল নিহত হইল। ধ্বজপতাকা সম্পন্ন পদাতিসৈন্য নিপতিত হওয়াতে সমরাঙ্গন অতি ভয়ানক হইয়া উঠিল। তখন যুধিষ্ঠির প্রভৃতি মহারথগণ কৌরবপক্ষীয় মহাধনুর্ধরগণকে সমরসরাঙ্মুখ অবলোকন করিয়া সসৈন্যে আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধনের প্রতি ধাবমান হইলেন। ঐ সময় আমরা দুর্য্যোধনের অতি অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিলাম। পাণ্ডবগণ একত্র সমবেত হইয়াও সেই একমাত্র বীরকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না। অনন্তর কুরুরাজ ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হইয়া অনতিদূরপ্রস্থিত স্বীয় সৈন্যগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে যোধগণ! তোমরা পৃথিবী বা পৰ্বতমধ্যে যে কোন প্রদেশে গমন কর, কোন স্থানেই পাণ্ডবদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণলাভে সমর্থ হইবে না; তবে বৃথা পলায়ন করিবার প্রয়োজন কি? দেখ, পাণ্ডবগণের অতি অল্পমাত্র সৈন্য অবশিষ্ট আছে এবং কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন অত্যন্ত ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে; অতএব যদি এ সময় আমরা সকলে সমরস্থলে অবস্থান করি, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমাদিগের জয়লাভ হইবে। হে বীরগণ! তোমরা পলায়নে প্রবৃত্ত হইলে পাণ্ডবেরা নিশ্চয়ই তোমাদের অনুগমনপূর্ব্বক তোমাদিগকে সংহার করিবে; অতএব তাহা অপেক্ষা রণস্থলে মৃত্যুই শ্রেয়ঃকল্প। হে সমাগত ক্ষত্রিয়গণ! আমি যাহা বলিতেছি, শ্রবণ কর। সর্বান্তকারী কৃতান্ত, বীরই হউক আর ভীরুই হউক, সকলকেই বিনাশ করেন; অতএব ক্ষত্রিয়ের সমরপরাঙ্মুখ হওয়া নিতান্ত মূর্খতার কাৰ্য্য। এক্ষণে ক্রোধাবিষ্ট ভীমসেনের সম্মুখে অবস্থান করাই আমাদিগের শ্রেয়ঃকল্প। ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে যুদ্ধ করিয়া প্রাণত্যাগ করা যারপরনাই সুখজনক। দেখ, মানবগণ গৃহে অবস্থান করিলেও কদাচ মৃত্যুকে অতিক্রম করিতে পারে না। অতএব ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়াই অবশ্য কর্তব্য। যুদ্ধে জয়লাভ হইলে ইহলোকে সুখভোগ এবং মৃত্যু হইলে পরলোকে স্বর্গলাভ হয। হে কৌরবগণ! যুদ্ধ অপেক্ষা স্বর্গলাভের আর কোনও উৎকৃষ্ট উপায় নাই। যুদ্ধে নিহত হইলে অবিলম্বেই অতি দুর্লভ লোকলাভে সমর্থ হয়।
“হে মহারাজ! ভূপালগণ দুৰ্য্যোধনের সেই বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক উহার প্রশংসা করি পুনরায় সেই বধোদ্যত পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন; তখন জয়াভিলাষী পাণ্ডবগণও ক্রোধভরে সমাগত কৌরবপক্ষীয় বীরগণকে আক্রমণ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় ত্রিলোকবিখ্যাত গাণ্ডীবশরাসনে টঙ্কার প্রদান করিয়া সমরস্থলে সমুপস্থিত হইলেন। নকুল, সহদেব ও মহাবলপরাক্রান্ত সাত্যকি মহাবেগে আপনার সৈন্যমধ্যে শকুনির প্রতি গমন করিতে লাগিলেন।”