কামনা ও যাদুবিশ্বাস
যাদুবিশ্বাস থেকেই সংগীতের জন্ম। যাদুবিশ্বাএর মূল কথা হলো, কোনো এক কামনা। এই কামনাকে কল্পনায় সফল করে প্রাচীন মানুষ মনে করেছে যে বাস্তবিকই তা বুঝি সফল হতে চললো।
উপনিষদের ঋষিদের স্মৃতি থেকেও এই আদিম সত্যের উপলব্ধি সত্যিই মুছে যায়নি। ছান্দোগ্য-উপনিষদে বলা হচ্ছে :
তস্মাদু হৈবংবিদুদ্গাতা ব্রূযাত্ ।।১।৭।৮।।
কং তে কামমাগাযানীত্যেষ হ্যেব কামাগানস্যেষ্ঠে য এবং বিদ্বান্সাম গাযতি সাম গাযতি ।।১।৭।৮।।
অর্থাৎ,…সেই জন্য এই প্রকার জ্ঞানসম্পন্ন উদ্গতা বলিবেন : ‘তোমার কোন্ কাম্যবস্তুকে গান করিব’? কেননা, যিনি এই প্রকার জানিয়া সামগান করেন তিনি কামগানকে শাসন করেন। হিউম্-এর তর্জমা অনুসারে : For truly he is the lord of the winning of desires by singing…(১১৪)
মূলে রয়েছে, ‘কামগানস্য’। শব্দটার মানে কী? মূলে রয়েছে, ‘কামম্ আগায়ানি’। কথাগুলির মানে কী? যদি গান সম্বন্ধে আধুনিক যুগের ধ্যানধারণাকেই একমাত্র সম্বল করে উপনিষদের এই ধরনের উক্তিগুলি বোঝবার চেষ্টা করা হয় তাহলে সে-চেষ্টা সফল হবার সম্ভবনা নেই। অপরপক্ষে, আজো পৃথিবীর আনাচে-কানাচে সে-সব মানুষের দল সমাজ-বিকাশের প্রাচীন পর্যায়ে আটকে পড়ে রয়েছে তাদের সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে জানতে-পারা তথ্যকে অবলম্বন করে যদি এ-জাতীয় উক্তি বোঝবার চেষ্টা করা যায় তাহলে তার তাৎপর্য উদ্ধার করা এতোটুকুও কঠিন হবে না। কেননা, সমাজ-বিকাশের ওই প্রাচীন পর্যায়ে পড়ে-থাকা মানুষগুলির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় গানের উৎসে যাদুবিশ্বাস। এবং এই যাদুবিশ্বাসের প্রাণ হলো তীব্র কামনার আবেগ।
গানের সঙ্গে যাদুবিশ্বাসের যোগ যে কতো নিবিড় তার স্মৃতি উপনিষদের ঋষিদের মন থেকে মোটেই মুছে যায় নি। ছান্দোগ্য থেকেই অনেক দৃষ্টান্ত আহরণ করা যায় :
বৃষ্টৌ পঞ্চবিধং সামোপাসীত পুরোবাতো হিঙ্কারো মেঘো জায়তে স প্রস্তাবো বর্ষতি স উদ্গীথো বিদ্যোততে স্তনয়তি স প্রতিহারঃ উদ্গৃহ্ণাতি তন্নিধনং ।।২।৩।১।।
বর্ষতি হাস্মৈ বর্ষযতি হ য এতদেবং বিদ্বান্ বৃষ্টৌ পঞ্চবিধং সামোপাস্তেন ।।২।৩।২।।
অর্থাৎ, বৃষ্টিতে পঞ্চবিধ সামকে উপাসনা করিবে : বৃষ্টির পূর্বে যে বায়ু উত্থিত হয় তাহাই হিঙ্কার, মেঘ উৎপন্ন হয় তাহাই প্রস্তাব, বৃষ্টি পতিত হয় তাহাই উদ্গীথ, বিদ্যুৎ চমকায় ও গর্জন করে তাহাই প্রতিহার, বৃষ্টিপাত শেষ হয় তাহাই নিধন। যিনি ইহাকে এইরূপ জানিয়া বৃষ্টিতে পঞ্চপ্রকাস সামের উপাসন করেন তাঁহার জন্য মেঘ বর্ষণ করে এবং বর্ষণ করাইতে পারেন।
‘উপাসীত’ কথাটার আদি অর্থ কী তা নিয়ে নিশ্চয়ই সুদীর্ঘ আলোচনা তোলবার অবকাশ আছে(১১৫)। কিন্তু সে-আলোচনা বাদ দিলেও অন্তত এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে উপনিষদের এখানে প্রাচীন সমাজে ভূয়ঃ-প্রচলিত বৃষ্টিযাদুরই স্বাক্ষর। সামগানের উৎসে যে যাদুবিশ্বাস তার প্রমাণ এর চেয়ে আর কতো স্পষ্ট হবে?
উপনিষদের ঋষিদের ধারণায় অন্ন প্রভৃতি একান্ত পার্থিব বস্তু লাভের সঙ্গে গানের—সামগানের—সম্পর্ক কতো ঘনিষ্ঠ তার আরো কয়েকটি নমুনা ছান্দোগ্য থেকেই উদ্ধৃত করা যাক। এই নমুনাগুলি মনে রাখলে বুঝতে পারা যাবে, কুকুরদের মুখে ‘অন্নং নঃ ভগবান আহায়তু’ কথাটি খাপছাড়া তো নয়ই, ঋষিদের চিন্তাধারার সঙ্গে এর সঙ্গতি খুবই স্পষ্ট :
…অন্নবানন্নাদো ভবতি য এতান্যেবং বিদ্বানুদ্গীথাক্ষরাণ্যুপাস্ত…।।১।৩।৭।।
অর্থাৎ, যিনি এই প্রকার জানিয়া উদ্গীথের অক্ষরসমূহকে উপাসনা করেন তিনি অন্নবান ও অন্নভোক্তা হন।
কিংবা,
তং হৈতমতিধন্বা শৌনক উদরশাণ্ডিল্যাযোক্ত্বোবাচ যাবত্ত এনং প্রজাযামুদ্গীথং বেদিষ্যন্তে পরোবরীযো হৈভ্যস্তাবদস্মিঁল্লোকে জীবনং ভবিষ্যতি ।।১।৯।৩।।
অর্থাৎ, শৌনক অতিধন্বা উদ্গীথবিষয়ে উপদেশ দিয়া উদরশাণ্ডিল্যকে বলিয়াছিলেন, যে-পর্যন্ত তোমার সন্তানদের মধ্যে এই উদ্গীথবিষয় জানা থাকিবে সেই-পর্যন্ত তাহাদিগের জীবন এই পৃথিবীতে এই সমুদয় লোকের অপেক্ষা সর্বশ্রেষ্ঠবস্তু-সম্পন্ন হইবে।
কিংবা,
পশুষু পঞ্চবিধং সামোপাসীত…।।২।৬।১।।
ভবন্তি হাস্য পশবঃ পশুমান্ ভবতি য এতদেবং বিদ্বান্ পশুষু পঞ্চবিধং সামোপাস্তে ।।২।৬।২।।
অর্থাত, পশুসমূহে পঞ্চবিধ সাম উপাসনা করিবে।…যিনি ইহাকে এই প্রকার জানিয়া পশুসমূহে পঞ্চবিধ সামের উপাসন করেন, পশুসমূহ তাঁহার ভোগ্যবস্তু হয় এবং তিনি পশুমান (পশুশালী) হন।
কিংবা,
দুগ্ধেঽস্মৈ বাগ্দোহং যো বাচো দোহোঽন্নবানন্নাদো ভবতি য এতদেবং বিদ্বান্ বাচি সপ্তবিধং সামোপাস্তে ।।২।৮।৩।।
অর্থাৎ, যিনি ইহাকে এইরূপ জানিয়া বাক্যে সপ্তবিধ সামের উপাসনা করেন, তিনি অন্নবান ও অন্নভোক্তা হন। বাক্যের যাহা দুগ্ধ বাক্য স্বয়ং তাহা তাঁহার জন্য দোহন করে। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
উপনিষদের ঋষিরা আর যাই হোন, Art for Art’s sake-এর থিয়োরি শেখেন নি। তাঁদের স্মৃতিতে সংগীতের আদি-উদ্দেশ্যের কথা রীতিমতো স্পষ্টভাবেই টেকে ছিলো। অবশ্যই, অনেক সময় ওই আদি-উদ্দেশ্যের সঙ্গে রকমারি পরবর্তী-সমাজের ধারণাকে মিশেল হতে দেখা যায়। কিন্তু সেইটেই বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হলো, তাঁদের চেতনা থেকে সংগীতের ওই আদি-উদ্দেশ্যের কথা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয় নি। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, উপনিষদের স্থান-বিশেষে,—যেখানে যেখানে সমাজ-বিকাশের অতি-প্রাচীন পর্যায়ের স্পষ্টতর স্মারক পাওয়া যায়, সেখানে-সেখানে,—সংগীতের ওই আদি-উদ্দেশ্যের স্মৃতিটুকুকেও স্পষ্টতরভাবেই টিকে থাকতে দেখা যায়। যেমন, সামগানরত ওই টোটেম্-গোষ্ঠীটির বেলায়। তারা গান চাইলো,—মনের আনন্দ মেটাবার জন্যে নয়, পেটের জ্বালা মেটাবার কামনায়, অতএব অন্নের কামনাতেই।
—————-
১১৪. R. E. Hume TPU 184.
১১৫. আধুনিক আধ্যাত্মিক অর্থে উপাসনা নয়। এই গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।