উনিশ – ওমর শেখের কীর্তি
আকাশে তখন ‘ঝুঝকি’ তারার উদয়, হিন্দু মতে ব্রাহ্মমুহূর্ত, আর মুসলিম মতে ‘সোবেহ সাদেক’—জুহা মৌলবি নামাজের জন্যে তৈরি হয়েছেন, সেই সময় কোথাও ঢোল বেজে উঠল ডিম ডিম ডিমা ডিম!
জুহা কান পাতলেন। ঢেঁড়রা দেওয়া হচ্ছে এই অসময়ে—কীসের? মানুষের জেগে ওঠার সময় হয়নি, সবে কিছু কাক বাঁশবনের ডগায় বসে চাপা কণ্ঠস্বরে ও সংশয়ে একটি দিনের কথা ঘোষণা করছে, হালকা কালো একটা রঙ খোদাতালার দুনিয়া জুড়ে রহস্যের শেষ খেলা চলেছে। আর, এসময় কি চরণ চৌকিদারের মাথা খারাপ হল হঠাৎ? জুহা মনে মনে হেসে বলেন, ব্যাটা উল্লুক নেশাখোর শয়তান! নেশার ঘোরে সময় ভুল করেছে নির্ঘাৎ।
তারপরই যথারীতি শোনা গেল চরণের গলা : এই হেঁদুমোছলমান
ছোটবড় তাবৎ পোজা সব্বসাধারণকে কহা যায় কী…
হঠাৎ চরণের গলা ডুবিয়ে অতিশয় হেঁড়ে বিকট ধরনের একটি কণ্ঠস্বর জাগল যে আওয়াজ শুনে সারা গাঁয়ের ঘুম মুহূর্তে ভেঙে গেল নির্ঘাৎ।
কার গলা চিনতে পারলেন না জুহা। ‘আজ থেকে সমুদায় লোক যত খুশি রাঙামাটি ঝিলে নামিবা, যাহা প্রাণ চায় করিবা, শাকশামুক তুলিবা, গুগলি ও মৎস্য ধরিবা, ফাদার সাইমন সাহেবের তাহাতে আপত্তি নাই—তিনি তাবৎ প্রজাসাধারণের জন্য ঝিল ছাড় দিয়েছেন—নন—ন—ন!’
পাঁচিল থেকে মুণ্ডু বাড়িয়ে দিলেন জুহা। খুব ঢ্যাঙা একটা লোক, একটু কুঁজোও বটে, গায়ে হাতকাটা ফতুয়া, পরনে থানের লুঙি, চুল ছোট করে ছাঁটা, পায়ে কাঁচা চামড়ার ভারী পাম্পসু জুতো, কাঁধে ঝোলা আর হাতে একটি ছোট্ট মোটা লাঠি। সে আকাশে মুখ তুলে কথাগুলো ছড়াচ্ছে।
তার চিনতে ভুল হয় না। সেই ওমর শেখ! সেই গীতা—বাইবেল—কোরান—পুরাণওয়ালা কিম্ভূত প্রাণীটি—যাকে আসন্ন বিদ্রোহের নায়ক ভেবে সারারাত ধরে খুশি ও বিস্ময় অনুভব করেছেন জুহা, যার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আজ সকালে ঝিলে গিয়ে যার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পুলিশের ও পাদরি লাঠিওয়ালাদের ঘায়ে শহিদ হবার সংকল্প করেছেন, সেই ওমর!
নিজের চোখ—কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। রি রি করে সারা শরীর জ্বলে উঠল।
ওমর শেখ মৌলবির মুণ্ডুটি দেখামাত্র ঘোষণা থামিয়ে বলে উঠল, ‘আস—সালামু আলাইকুম মওলানা সাহেব!’
জুহা মুণ্ডু সরিয়ে আনলেন। উঠোন থেকে বেগমসায়েবা রুদ্ধশ্বাসে বললেন, ‘কী? কী হয়েছে?’
মৌলবি গর্জে বললেন, ‘চোপরাও!’ তারপর গটগট করে বেরিয়ে গেলেন মসজিদের দিকে। এখন রাত শেষ—সুতরাং বাড়ির বাইরে যেতে সরকার আটকাবেন না! ঘোষকদের পিছনে ততক্ষণে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। হনহনিয়ে ভিড়কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন জুহা। ওমর সেখ ফের দ্বিগুণ জোরে ঘোষণাটা করতে করতে গাঁয়ের শেষদিকে এগোল।
মসজিদের ভিতরে আবছা অন্ধকারে সেরাজুল হাজি বসে রয়েছে একা। বাইরে জনা তিন মুরুব্বিগোছের লোক বদনায় জল ঢেলে ‘অজু’ (প্রার্থনার আগে প্রক্ষালন) করছে। জুহা নিঃশব্দে ‘অজু’ করে ভিতরে ঢুকলে হাজি সায়েব বলল, ‘পাদরি ঝিল ছেড়ে দিয়েছে। কাল রাতে আমাদের সব ডেকেছিল। ওমরও ছিল।’
বাধা দিয়ে জুহা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘খোদার ঘরে কাফেরদের সম্পর্কে কথা বলা হারাম হাজি সাহেব!’ সেরাজুল হাজি নিশ্চয় মুচকি হাসল, স্পষ্ট দেখা গেল না।….
ওখানে স্বর্ণও ধুড়মুড় করে উঠে বসেছিল। তখন বেশ ফরসা হয়েছে। ঢেঁড়রার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। একটা নতুন ধরনের দিন তার সামনে—তাই নিয়ে সারারাত অস্থির থেকেছে সে। শেষরাতে ঘুম এসে গিয়েছিল, তখন স্বপ্নেও নিজেকে দেখেছে রাঙামাটির ঝিলে সাঁতার কাটছে আর কীসব ঘটনাও ঘটছিল—হঠাৎ এই আওয়াজ।
স্বর্ণ বেরিয়ে এসে সব শুনে ভীষণ অবাক হল।
ওমর শেখ তাকে দেখে এগিয়ে এসে নমস্কার করল প্রথম। তারপর চরণ ও ঘগা বায়েনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাবাসকল! এবার আমাকে ছুটি দাও। তিনখানা গাঁ ঘুরলাম সেই ঝুঝকি ভোরবেলা থেকে—এখন ওই দ্যাখ, মামা লাল হয়ে উঠছে। এবার মামার গুণের ভাগ্নে হয়ে বাকি তিনখানা তোমরাই সারো।’ বলে সে আঙুলের গিট গুণে গ্রামগুলোর নামও বলে দিল—’এক গোবিন্দপুর, দুই মধুপুর, তিন যদুপুর। তারপরে গিয়ে ফাদার সাইমনকে বলবা কী, শেখদাদা তেনার সঙ্গে দুপুরবেলা সাক্ষাৎ করবে। কেমন?’
চরণ একগাল হেসে বলে, ‘লিচ্চয়।’
ঘগা মাথা নুইয়ে বলে, ‘তবে যেতে আজ্ঞে হয় শেখদাদা?’
‘হু—তোমরা এগোও।’
নকীবদ্বয় হনহন করে রেল লাইন ধরে উত্তরে আপের দিকে এগিয়ে চলে। এবং শূন্য স্টেশনের সামনে কেন কে জানে ঘগা ঢোলে বার দুই আওয়াজ তুলে যায় ‘চাকুম চাকুম।’ আওয়াজটা দেওয়ালে জোরে প্রতিধ্বনিত হয়।
স্বর্ণ ওমরের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ওমর বারান্দায় উঠে বলে—’সে অনেক কথা মা স্বর্ণময়ী। আপনি ধীরে সুস্থে বসে শুনুন। আমি যদি দোষ করে থাকি, আপনার পায়ের লাথি মারুন ছেলের মাথায়—আর যথার্থ কাজ করে থাকলে এক পেয়ালা চা খাওয়ান।’
স্বর্ণ শুনতে চায়। সে নিঃশব্দে ডাক্তারখানায় ঢোকে। ওমর তার পিছনে পিছনে ঢোকে। তারপর ওমর তার শাস্ত্রভরতি ভারী ঝোলাটা সসম্ভ্রমে টেবিলে রেখে একটা চেয়ারে বসে।
স্বর্ণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
ওমর একটু কেসে তার চীনা ছাঁদের মুখ ও মাকুন্দে চিবুকে হাত বুলিয়ে বলে,…’আপনার সঙ্গে সেই তো কাল সন্ধেবেলা কথা—তারপর এক কাণ্ড। মতি বায়েনকে তো ভালোই চেনেন। মিটিং তো আপনিও ভিতরে ভিতরে খুব করলেন কদিন, আমিও করলাম—কিন্তু মতির সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, সব ব্যানাবনে মুক্তো ছড়ানো হয়েছে।
স্বর্ণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
‘মানে খুব সহজ। আপনাকে এলাকার ছোটবড় সবাই মুখে মান্য করে বটে, ভিতরে অন্যরকম। স্বার্থটা নিজেদের—তাই খুব আগ্রহ দেখাল, হ্যাঁ—সবাই মিলে কথামতো ঝিলে নামব দেখি কী করতে পারে ওনারা, এদিকে ভেতরে—ভেতরে কেউ কেউ বলে, ডাক্তারবাবুর মেয়ের কথায় হুট করে ঝাঁপিয়ে পড়া কি ভালো হবে? এইরকম অকথা—কুকথা সব উঠল ওদের মধ্যে। সেসব শুনলে আপনি কষ্ট পাবেন মনে। শালারা কি মানুষ মা? যদি মানুষই হবে, তাহলে চিরকাল পড়ে মার খায়? মতি আমাকে সব খুলে বললে। বললে যে কাল সকালবেলা কজন কথামতো যায় দেখো শেখদাদা! হুঁ—যেত, যদি অন্য কেউ এসে সামনে দাঁড়াত। ডাক্তারবাবুর মেয়েকে আমরা বিশ্বাসই করি না।…মা স্বর্ণময়ী, রাগ করবেন না আমার ওপর। ছোটলোকের ছোট মুখ—সামনে এক বলে, পিছনে বলে অন্যরকম। তাই গতিক বুঝে আমি করলাম কী, সোজা ফাদারের কাছে গেলাম। ব্যাটা আমাকে খুব খাতির করে। বাইবেল নিয়ে কথাবার্তা বলি কি না—খুব ভাব আমার সঙ্গে। তা, ফাদার সাহেবও দেখলাম ব্যাপারটা আগেই জানতে পেরেছে। একথা ওকথার পর আমাকে বললে, দেখ ব্রাদার ওমর, আমি চাই না সবাই আমাকে মন্দ ভাবুক।…’
স্বর্ণ বাধা দিয়ে বলে, ‘থাক। বসুন, চা খাবেন।’
ওমর হেসে উঠল! অমন প্রচণ্ড হাসি সচরাচর শোনা যায় না।
একটু পরে চা খেতে খেতে হঠাৎ সে বলল, ‘স্বদেশিবাবুদের সঙ্গে আমার ইদানীং চেনাজানা হয়েছে। চারদিক দেখেশুনে আমার মনটা ক্রমে ক্রমে ওদিকেই ঢলে পড়ছে, বুঝলেন মা? আমি ভাবছি কথাটা—কিছুদিন থেকেই ভাবছি—আমি স্বদেশি করব। চরকাও কিনে রেখেছি একখানা। দেখি, কী হয়।’
স্বর্ণ কোনো মন্তব্য করল না!
‘হ্যাঁ মা। ওই আমার রাস্তা। ধর্ম ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে তো জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। কিছুই পেলাম না। এখন একটা কাজের মতো কাজ তো করতে হবে। জীবনটা আবাদ করতেই হবে। মহাত্মাজী নন—কো—অপারেশনের ডাক দিয়েছেন। বেলডাঙায় আমার সহপাঠি বন্ধু আছে—সত্যবাবু। তার জেল হয়েছে।’—চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ওমর ফের বলে, ‘আপনি কিছু বলছেন না মা!’
স্বর্ণ অস্ফুট স্বরে বলে, ‘কী বলব?’
ওমর তার দিকে একটুখানি তাকিয়ে থাকার পর বলে, ‘আজ তাহলে যাই, স্বর্ণময়ী।’
স্বর্ণ মাথা নাড়ে।
ওমর শেখ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যাবার মুখে ঘুরে সে একবার বলে, ‘বাবার খবর ভালো তো? চিকিৎসা কেমন চলছে?’
‘ভালো।’
ওমর বারান্দা থেকে নেমে স্টেশনের দিকে যায়। সূর্য উঠেছে। হেমন্তের শিশির আর কুয়াসা এখনও স্পষ্ট। সামনের মাঠে শিকারিদের তাঁবু, সেদিকে এগিয়ে যায় সে। হয়তো বাঘের খবরটা জানতে চায়।…
স্বর্ণ চুপচাপ ভাবছিল। এ কী জীবন তাকে ঈশ্বর দিয়েছেন! কোনো কাজে লাগে না, লাগানো যায় না। একটার পর একটা পতনের শব্দ। পরাজিত হয়ে পিছু হটা। এ জীবন কাম্য নয়। বলেই একদিন ডিসট্যান্ট সিগনালের কাছে মরতে গিয়েছিল। হয়তো সেদিন আজকের মতো এত স্পষ্ট করে কিছু বুঝত না—কিন্তু এটুকু অন্তত জেনেছিল যে এই বিরাট পৃথিবীতে তার অস্তিত্বটা বড় গোঁজামিল।
তবে কি ওমর শেখের মতো স্বদেশি করতে ছুটে যাবে? ক্রমশ চারদিক থেকে যে উত্তাল ঝড়ের শব্দ তার কানে ভেসে আসছে, সেই ঝড়ের গতিতে নিজেকে ভাসিয়ে দেবে?
এলাকায় শিক্ষিত লোক নেই বললেই চলে। তাই এখনও এখানে ঝাপটা এসে লাগেনি। তাছাড়া স্বর্ণের পক্ষে ওখানে কিছু করাও কঠিন—একটা প্রমাণ তো সদ্য পেল। তার কথার কেউ আসলে সত্যিকার মূল্য দেয় না। সবাই তাকে জানে চরিত্রহীনা—একটা নচ্ছার প্রকৃতির মেয়ে। কমপয়সার ওষুধ পায় বলেই যেটুকু ভক্তি। এ কোন সৃষ্টিছাড়া জায়গায় বাবা এসে ঘর বেঁধেছিলেন!
অথচ এখান থেকে যেতেও ইচ্ছে করে না কোথাও। এত ভালো লাগে ওই স্টেশন, ‘ধূলিউড়ির’ মাঠ, সুন্দর নদী ভাগীরথী, রাঙামাটির পথগুলো, স্বপ্নভরা ওইসব ঐতিহাসিক টিলা! চৈতক তাকে কী একটা দিয়ে গেছে—কত ক্ষণ ও মুহূর্তের ভালো লাগার স্মৃতি। কত সন্ধ্যা ও জ্যোৎস্নার রাতে ওই মাঠটাতে ঘোড়ার পিঠে ছুটে চলার সময় আবছা কী অনুভূতি তার চেতনায়—ধরা দিত—যেন কী ঘটবে এখানেই, অন্য কোথাও নয়।
স্বর্ণ আনমনে বসে থাকে।
এদিকে তিনপাহাড়ি যাওয়া দরকার, পা ওঠে না। সুধাময়ের কথা ভাবতেই ঘৃণায় তার মনে জ্বালা ধরে যায়। হেরুর ছেলেটারও একটা সদগতি করা খুবই দরকার ছিল। ইয়াকুব ওকে নষ্ট করে ফেলছে দিনে দিনে।…
কয়েকদিন পরেই স্বর্ণ ঠিক করল, তিনপাহাড়ি যাবে।
সেই সময় একটা বড় খবর পেল—ওমর শেখকে স্বদেশি করার অপরাধে জেলে ঢোকানো হয়েছে।
জুহা মৌলবির কাছে গিয়েই খবরটা পায় স্বর্ণ। সে গিয়েছিল কীভাবে যেতে হবে তিনপাহাড়ি, উন্মাদ আশ্রমটা কোথায়—এইসব ঠিকঠিকানা জানতে।
সব জানিয়ে জুহা বলেছেন, ওমর ঠিক রাস্তাই ধরেছে। এই জাহেল (সূর্য) ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ করা ছাড়া আমারও বাঁচার রাস্তা নেই।
কিন্তু ওমর শেখের জেহাদটা কীরকম? জুহা মৌলবি তাও বলেছেন স্বর্ণকে। মৌলবির মনে যেন একটা হীনমন্যতার বোধ জেগে গেছে এ ব্যাপারে—স্বর্ণের তাই মনে হয়। তুই ব্যাটা শেখের বাচ্চা, বুনো, অল্পবুদ্ধি, নাদান ওমর! তুই বিনা ইংরেজের চোখে রীতিমতো একজন ‘দুশমন’ বনে যেতে পারলি! তৌবা, তৌবা। এই ইংরেজ জাতটার মতো বেঅকুফ আর নেই দুনিয়ায়।
মৌলবি দুঃখের মধ্যে হেসে খুন। ….আরে, ওই জংলীনি—জেতে লোকটাকেও ইংরেজ বাহাদুরের ভয়—যার কলিজা একটা বিল্লির মতো, যার ফুসফুস একটা চুহার মাফিক। ও পারেটা কী?
এইসব বলে জুহাসাহেব ওমরের স্বদেশি ও গ্রেফতার হওয়ার কিছু বিবরণও দিয়েছেন। সেদিন স্বর্ণের বাড়ি থেকে সোজা নাকবরাবর হেঁটে ওমর শিকারিদের তাঁবুতে যায়। বাঘটার খবরাখবর নেয়। তারপর তাকে দেখা গেছে ধুলোউড়ির মাঠ পেরিয়ে সিধে গঙ্গার দিকে যেতে। সেখানে শম্ভু ঘেটেল তাকে পার হতে দেখেছে। তারপর গেছে ব্যাটা বেলডাঙার বাজারে। একটা বড়সড় সভা হচ্ছিল সেখানে। এক নেতা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে শুনতে শুনতে ওমরের রক্ত গেল গরম হয়ে! অমনি সে লাফিয়ে সোজা উঠে পড়ল সভাপতির সামনের টেবিলে। আচমকা ইংরেজের মা—মাসি তুলে গাল দিতে শুরু করল।
ওমর নেচে নেচে যা সব বলেছে, জুহা তাও বর্ণনা করেন। ওমরের বক্তৃতা অনুকরণ করেন তিনি : ওরে ভাই দেশবাসী, ওরে ভাই চাষি, তোদের আখের ভুঁয়ে যোগ হয়েছে, সেই যোগ (ছেঁদা বা গর্ত) তুই পায়ে করে মার (বন্ধ কর)—সেই ঘোগের নাম ইংরেজ, সেই ঘোগের নাম ব্রিটিশ, সেই ঘোগের নাম সাদা চামড়া। আর, ওরে ভারতবাসী, তোরা তেত্রিশ কোটি মুখে ভাত খেয়ে একবার কুলকুচো করলে সেই এঁটো জলে তামাম ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ভেসে যায়!…লোকে ওমরকে জোর হাততালি দিলে। কারা মালা পরালে। তারপর এক দারোগা (আফতাব খানেরই কোনো স্যাঙাত) কোত্থেকে এসে ওমরের হাত ধরে বললে—আসুন, জেয়াফৎ (নেমন্তন্ন) খাবেন শ্বশুরবাড়ি। আর সঙ্গে সঙ্গে সভা ছত্রখান। লালটুপি গজিয়ে উঠল চারদিকে। হইচই পড়ে গেল। ওমর আর আরও কজনকে পুলিশ বাজারের পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—এদিকে তাদের মাথার ওপর মেয়েরা খই ছিটোচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে বাড়ির ছাদে, উলু দিচ্ছে!
হুঁ, ওমর ওই একটুতেই প্রচণ্ড নাম কিনলে! মৌলবি ঈর্ষায় ভিতরে—ভিতরে জ্বলেপুড়ে মরছেন। বারবার দাঁত ঘষে বলছেন, ‘আমিও বেরিয়ে পড়ব, আমিও বেরিয়ে পড়ব। শুধু এই নাবালোকগুলোর জন্যে একটুখানি পিছুটান! ওমর পারবে না কেন? ওর তো কোনো পিছুটান নেই! ব্যাটা যথার্থ স্বাধীন প্রাণীবিশেষ। সেজন্যেই তো ওকে হিংসে করি! সত্যিসত্যি ওমর একটা কীর্তি করেছে বটে।’
জুহাসাহেব সেই কীর্তির হিংসেয় ছটফট করে একটা পথ খুঁজছেন। খোদাতালা তাঁকে একটা বিরাট সম্ভাবনাপূর্ণ জীবন দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ কাজে লাগাতে পারছেন না। ওর জন্য আখেরাতে (পরলোকে) তাঁকে খোদাতালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হবে—অ্যাই বান্দা শামসুজ্জোহা! দুনিয়ার কী শ্রেষ্ঠ কাজ করেছিস, হিসাব দে! তখন কী বলবেন জুহা? মাথা হেঁট করে থাকতে হবে তাঁকে। তাঁর কাঁধের দুই সাক্ষী ফেরশতা (দেবদূত) নীরব থাকবে—কারণ, এই মনুষ্যটি পাপ বা পুণ্য কিছুই করেননি। ইনি এক অদ্ভুত আত্মা! ইনি ঈশ্বরকেও সমস্যায় ফেলেছেন।
এরপর আচমকা হা হা করে কেঁদে ওঠেন জুহা মৌলবি। তাঁর স্ত্রী রান্নাঘরের দাওয়ায় ঝুঁকে অবাক চোখে চান। সন্তানসন্ততিও কাঠ হয়ে দাঁড়ায়। স্বর্ণ কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করে, আর সেইসময় পশ্চিমে উঁচু রেলব্রিজ পেরিয়ে যেতে থাকে একটা রেলগাড়ি, তার বিকট শব্দ ফুরোতে চায় না এবং শব্দসমূহের মধ্যে সকলেরই মনে হয় লাইনের ওপারে আরোয়ার জঙ্গলে বুড়ো রোগা সেই বাঘটা যেন একবার দুবার অথবা তিনবার ডেকে উঠল।…