কহেন গঙ্গার পুত্র কুম্ভীর পুত্রেরে।
আর কিছু ব্রতকথা কহিব তোমারে।।
একাদশী ব্রতকথা সর্ব্বব্রত সার।
অবধান কর শুন ধর্ম্মের কুমার।।
পূর্ব্বে কহিয়াছি একাদশী অনুষ্ঠানে ।
পারণাদি অতঃপর শুন একমনে।।
শুদ্ধচিত্তে এই ব্রত কর আচরণ।
সর্ব্বদুঃখে তরে সেই পাপ বিমোচন।।
প্রাতঃকালে স্নান করি একাদশী দিনে।
ধৌত বস্ত্র পরি তৈল গ্রহণ বর্জ্জনে।।
সেইরূপে জনার্দ্দন করিয়া স্থাপন।
ত্রিকোণ করিয়া করি আসন রচন।।
পূর্ব্বমুখ হয়ে ব্রতী বসিবে আসনে।
শুদ্ধচিত্তে আরাধিবে দেব নারায়ণে।।
ন্যসমন্ত্র পড়ি স্নান জপ নমস্কার।
মূলমন্ত্র জপি ধ্যান করি আরবার।।
তদন্তরে নানা পুষ্পে পূজিবে বিধানে।
হৃদয় কমলোপরি স্মরি নারায়ণে।।
তদন্তরে নৈবেদ্যাদি নানা উপহারে।
তাহা দিয়ে পুনরপি পূজিবে আচারে।।
নৈবেদ্য তুলসী দিয়া করি নিবেদন।
পূজা অনুসারে তবে করি বিসর্জ্জন।।
অবশেষে বাঁটিয়া দিবেক ভক্তগণে।
শিরে কর ধরি করি পূজা সমাধানে।।
পরদিন প্রাতঃকালে স্নান দান করি।
নানাবিধ উপহারে পূজিবে শ্রীহরি।।
পূজা সমাপন করি দিয়া বিসর্জ্জন।
তদন্তরে দ্বিজগণে করাবে ভোজন।।
নিজ বন্ধু বান্ধব যতেক জ্ঞাতিগণ।
সবাকারে আনিবে করিয়া নিমন্ত্রণ।।
পারণ করিবে তবে বন্ধুগণ লয়ে।
ব্রত সমর্পিবে পরে সাবধান হয়ে।।
এইরূপে পূজা করি যে সেবে শ্রীহরি।
সর্ব্ব পাপে মুক্ত হয়ে যায় বিষ্ণুপুরী।।
পূর্ব্ব ইতিহাস কথা কহিনু তোমাতে।
একাদশী দিনে উপবাস হৈল যাতে।।
গালব মুনির পিতা পুত্রের সংবাদ।
একাদশী করি তার ঘুচিল প্রমাদ।।
কহিনু তোমারে রাজা ধর্ম্মের নন্দন।
পুরাণ সম্মত কথা ব্যাসের বচন।।
মুনি বলে অবধানে শুন জন্মেজয়।
এতেক শুনিয়া কথা ধর্ম্মের তনয়।।
চিত্তগত ভ্রান্তি গেল শান্ত হৈল তনু।
পুনরপি জিজ্ঞাসেন কুন্তী অঙ্গজনু।।
কোন প্রকারেতে ভক্তি সাধি দামোদরে।
কিবা ভক্তি সাধিলে কি ফল পায় নরে।।
বিষ্ণুর মন্দির যেবা করয়ে মার্জ্জন।
দাস্যভাব করিয়া যে ভজে নারায়ণ।।
তাহার কি ফল হয় কহ মহাশয়।
নিতান্ত উদ্বেগ চিত্ত খণ্ডাহ সংশয়।।
ভীষ্ম কন ভাল জিজ্ঞাসিলা নৃপমণি।
অবধান কর কহি পূর্ব্বের কাহিনী।।
দেবমালী নামে বিপ্র ছিল শান্তিপুরে।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ বিদিত সংসারে।।
যজন যাজন কৃষি বাণিজ্য ব্যাপারে।
করিল সঞ্চয় ধন বিবিধ প্রকারে।।
এইরূপে নানাসুখে বঞ্চে তপোধন।
অপত্যবিহীন দ্বিজ সদা দুঃখীমন।।
একদিন ভার্য্যা সহ বসি তপাধন।
পুত্রাভাবে নানারূপ করয়ে শোচন।।
পুত্রহীন বৃথা জন্ম বেদের বচন।
ইহকালে দুঃখ অন্তে নরকে গমন।।
দুগ্ধহীন গাভী যেন পুত্রহীন তেন।
এইরূপে দ্বিজ বহু করিল শোচন।।
পুত্রহীন চিন্তায় আকুল তপোধন।
নারদ জানিয়া দেখা দিলেন তখন।।
নারদে দেখিয়া মুনি কৈল আরাধন।
পাদ্য অর্ঘ্যে করিলেন চরণ বন্দন।।
দেবমালী দ্বিজেরে জিজ্ঞাসে তপোধন।
কহ মুনিবর কেন বিরস বদন।।
করযোড় করিয়া করিল নিবেদন।
সর্ব্ব তত্ত্ব জ্ঞাত তুমি মহা তপোধন।।
চরাচরে হইয়াছে যেবা হইবেক।
ভূত ভাবী বর্ত্তমান জানহ প্রত্যেক।।
নারদ কহেন মন বুঝিয়া তাহার।
সন্দেহ না কর দ্বিজ হইবে কুমার।।
অচিরে হইবে তব যুগল নন্দন।
এত বলি স্বস্থানে গেলেন তপোধন।।
দেবমালী মহাযজ্ঞ কৈল আরম্ভন।
যজ্ঞভেদী হল আসি দুইটি নন্দন।।
পরম সুন্দর শিশু অতি সুলক্ষণ।
দেখি আনন্দিত মন ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণ।।
যজ্ঞেতে জন্মিল নাম যজ্ঞমালী হৈল।
সুমালী কনিষ্ঠপুত্র পাপীষ্ঠ জন্মিল।।
কতদিনে যোগ্য দুই হইল নন্দন।
তদন্তরে দেবমালী দৃঢ় করি মন।।
সংসারে বাসনা মন ছাড়িতে ইচ্ছিল।
আপনার সঞ্চিত যতেক ধন ছিল।।
সমান করিয়া ভাগ দিল দুই সুতে।
অরণ্যে প্রবেশ কৈল ভার্য্যার সহিতে।।
জানন্তি নামেতে তথা মহা তপোধন।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ ত্রিকালজ্ঞ বিচক্ষণ।।
বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ হরিনামে রত।
চতুর্দ্দিকে শিষ্ট যত শিষ্য অগণিত।।
তাঁর কাছে গিয়া উত্তরিল তপোধন।
দেখিয়া জানন্তি মুনি কৈল অভ্যর্থন।।
অতিথি বিধানে পূজা করিয়া সাদরে।
জানন্তি জিজ্ঞাসে সেই অভ্যাগত নরে।।
কোথা হতে আইলেন কোথায় নিবাস।
কোন প্রয়োজনেতে আইলা মম পাশ।।
এত শুনি বলে ঋষি করিয়া প্রণাম।
ভৃগুবংশে জন্ম মম দেবমালী নাম।।
যোগ সাধিবারে আইলাম তব স্থান।
কৃপা করি মোরে দেব দেহ তত্ত্বজ্ঞান।।
কিরূপে তরিব আমি এ ভব সংসার।
কাহা হতে সংসার বন্ধনে হব পার।।
কহ মুনিবর মোরে যদি কর দয়া।
তোমার প্রসাদে যেন তরি ভব মায়া।।
এত শুনি কহিতে লাগিল তপোধন।
ত্রিদশের নাথ বিষ্ণু এক সনাতন।।
তাঁহার আশ্রয় কৈলে সর্ব্ব পাপ খণ্ডে।
সংসার হইতে তরে ঘোর যমদণ্ডে।।
তাঁহার আশ্রয় বিনা গতি নাহি আর।
সেই ব্রহ্ম সনাতন জগতের সার।।
তাঁহারে ভজহ পূজ তাঁরে কর স্তুতি।
তাঁর সেবা কর তাঁরে করহ ভকতি।।
নাম শুন শ্রবণ করিহ অনুক্ষণ।
সংসার তরিতে এই কহিনু লক্ষণ।।
এত শুনি আনন্দিত হৈল দেবমালী।
প্রদক্ষিণ করি বিপ্র তথা হৈতে চলি।।
ভার্য্যা সহ উত্তরিল যমুনার তাঁরে।
স্তুতি ভক্তি করিয়া পূজিল দামোদরে।।
একান্ত ভকতি করি কৃষ্ণে আরাধিল।
যোগে তনু ছাড়ি বিষ্ণুপুরে প্রবেশিল।।
চিতা করি তার ভার্য্যা জ্বালিল আগুণি।
পতি সঙ্গে বিষ্ণুপুরে গেল সুবদনী।।
যজ্ঞমাপলী সুমালী যুগল পুত্র তার।
মহামতী যজ্ঞমালী ধর্ম্ম অবতার।।
পিতার যতেক ধন সঞ্চিত আছিল।
নানাবিধ দান দিয়া পুণ্যকর্ম্ম কৈল।।
তড়াগাদি জলাশয় দিল স্থানে স্থানে।
তড়াগাদি জলাশয় দিল স্থানে স্থানে।।
বিচিত্র মন্দির ঘর দিল নারায়ণে।
নানাবিধ ধ্যানযোগে দেবে আরাধিল।।
দাস্যভাব করি কৃষ্ণচরণ সেবিল।
দেখিয়া সকল জীব আত্মার সমান।।
নিজ হস্তে কৈল হরি মন্দির মার্জ্জন।
এইরূপে যজ্ঞমালী পুণ্য উপার্জ্জিল।
পুত্র পৌন্ত্র বৃদ্ধি হয়ে আনন্দে রহলি।।
সুমালী পাপিষ্ঠ বড় কৈল অনাচার।
পিতার সঞ্চিত ধন যত ছিল তার।।
অসৎপাত্রে মজাইল সতে নাহি দিল।
বৃষলীর বশ হয়েসব মজাইল।।
অবশেষে চুরি হিংসা পরিবাদ কৈল।
যত ধন ছিল এইরূপে মজাইল।।
তার দুষ্টকর্ম্ম দেখি যত বন্ধুগণ।
জ্যেষ্ঠ যজ্ঞমালী সহ মিলে জ্ঞাতিগণ।।
এক দিন যজ্ঞমালী নিভৃতে বসিয়া।
বিধিমতে বুঝাইল অনেক কহিয়া।।
শুনিয়া তাহার কথা ক্রুদ্ধ হৈল মনে।
চুলে ধরি সহোদরে কৈল প্রহারণে।।
হাহাকার শব্দ উঠে পুরীর ভিতরে।
যতেক নগরবাসী আইল সত্বরে।।
তার দুষ্টকর্ম্মদেখি সবে ক্রুদ্ধ হৈল।
মহাপাশে সুমালীরে বান্ধিয়া ফেলিল।।
তর্জ্জন গর্জ্জন বহু করিল তাড়ন।
অনেক প্রকার কৈল নগরের জন।।
দয়াশীল যজ্ঞমালী দয়া উপজিল।
ভ্রাতৃস্নেহ হেতু তারে মুক্ত করি দিল।।
দুঃখিত দেখিয়া তারে ক্ষমা দিল চিত্তে।
কুলের বাহির তারে করিল দুবৃর্ত্তে।।
এইরূপে কতকাল করিল বঞ্চন।
হেনকালে দোঁহাকার হইল নিধন।।
ধর্ম্ম আত্মা যজ্ঞমালী ধর্ম্মপরায়ণ।
পাঠাইয়া বিমান দিলেন নারায়ণ।।
দুই দূত আইলেন শরীর সুন্দর।
বিমান লইয়া তারা আইল সত্বর।।
রথে তুলি যজ্ঞমালী নিল সেইক্ষণ।
গন্ধর্ব্বেতে গীত গায় নর্ত্তকে নাচন।।
এইরূপে বৈকুণ্ঠেতে করিল গমন।
পথে সুমালীর সঙ্গে হৈল দরশন।।
ভয়ঙ্কর যমদূত বিকৃতি আকার।
পাশে বান্ধি লয়ে যায় করিয়া প্রহার।।
দেখি সবিস্ময় চিত্ত যজ্ঞমালী হয়ে।
দূতেগণে নিবেদিল বিনয় করিয়ে।।
এই দুষ্ট দূত হৈল কাহার কিঙ্কর।
কাহারে প্রহার করে কেবা এই নর।।
কোথাকারে লয়ে যায় কিসের কারণে।
বান্ধিয়া লইয়া যায় কোন্ প্রয়োজনে।।
যদি দূত জান তবে কহিবা আমারে।
এত শুনি বিষ্ণুদূত কহিল তাহারে।।
এই দুই জন হয় যমের কিঙ্কর।
এই যে দেখিছ পাপী তব সহোদর।।
যতেক অর্জ্জিল পাপ না হয় এড়ান।
বান্ধিয়া লইয়া যায় যম বিদ্যমান।।
এত শুনি যজ্ঞমালী মানিল বিস্ময়।
পুনরপি জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।।
যদি জান দূতগণ কহ বিবরণ।
কোন প্রকারেতে এই হয়ত মোচন।।
দূতগণ বলে এই পাপী দুরাচার।
আছয়ে উপায় এক মুক্তি করিবার।।
তোমার সদনে আছে যদি কর দান।
পূর্ব্বের কাহিনী কহি কর অবধান।।
কৌশল নগরে পূর্ব্বে কামিলা নামেতে।
বেশ্যাকুলে জন্ম এক ছিল দুষ্টচিতে।।
গো ব্রাহ্মণ বিনাশিয়া হয় দুষ্ট চোর।
তাহার পাপের কথা কি কহিব ঘোর।।
চুরি হিংসা করে আর বেশ্যাপরায়ণ।
নানারূপ কুকর্ম্ম অধর্ম্মি দুষ্টজন।।
তার দুষ্টকর্ম্ম দেখি যত বন্ধুজন।
নগর বাহির করি দিল সেইক্ষণ।।
বন্ধুগণ তাড়নেতে ভয় পেয়ে মনে।
ক্ষুধা তৃষ্ণাযুক্ত হয়ে প্রবেশিল বনে।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে শ্রম হইল শরীর।
দৈবেতে পাইল এক কেশব মন্দির।।
মন্দির সমীপে এক সরোবর ছিল।
স্নান দান নিত্যকর্ম্ম তাহাতে করিল।।
শ্রম দূরে গেল শান্ত হৈল কলেবর।
আশ্রয় লইল সেই মন্দির ভিতর।।
যত ভস্ম অঙ্গার আছিল ভাঙ্গা ঘরে।
পরিষ্কার যে সব করিল নিজ করে।।
শ্রমযুক্ত হয়ে তাহে শয়ন করিল।
আয়ুশেষে আসি কাল উপনীত হৈল।।
গৃহের ভিতর মহাকাল সর্প ছিল।
দংশিয়া বৈশ্যেরে সেই বনান্তরে গেল।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ খণ্ডে যোগ্যতা কাহার।
সর্পের দংশনে মৃত্যু হইল তাহার।।
দুই দূত সেখানে আইল সেইক্ষণ।
মহাপাশে বৈশ্যপুত্রে করিল বন্ধন।।
জানিয়া যমের দুষ্ট কর্ম্ম গদাধর।
আমা দোঁহে পাঠাইয়া দিলেন সত্বর।।
সেইক্ষণে করিলাম মোচন তাহার।
যমদূতে করিলাম বহু তিরস্কার।।
সেই পুণ্যে বিষ্ণুর সাহায্যে মুক্তি পায়।
পূর্ব্বের কাহিনী এই জানাই তোমায়।।
গোচর্ম্ম প্রমাণ বিষ্ণু মন্দির মার্জ্জনে।
উদ্ধারহ নিজ ভ্রাতা দিয়া পুণ্যদানে।।
এত শুনি যজ্ঞমালী আনন্দিত মনে।
সুমালীরে পুণ্যদান দিল সেইক্ষণে।।
পুণ্যের প্রভাবে সব পাপ হৈল ক্ষয়।
যমদূত প্রতি তবে বিষ্ণুদূত কয়।।
ভ্রাতৃ পুণ্যফলে এই পাইল নিস্তার।
ছাড়হ ইহারে তোরা আরে দুরাচার।।
ইহার উপরে তোর নাহিক শাসন।
এত বলি মুক্তি করি দিল সেইক্ষণ।।
যজ্ঞমালী শুনি তবে স্তব্ধচিত্ত হৈয়া।
উভয়ে বৈকুণ্ঠে গেল বিমানে চাপিয়া।।
সুমালীর কথা যমদূত নিবেদিল।
শুনিয়া সকল দূতে যম প্রবোধিল।।
সেইক্ষণে যজ্ঞমালী নির্ব্বাণ পাইল।
বিষ্ণুর সাহায্যে মুক্তি সুমালী পাইল।।
সেই পুণ্যফলে সেই গেল স্বর্গবাস।
ধর্ম্ম সনে গঙ্গাপুত্র কন ইতিহাস।।
শ্রদ্ধাভক্তি হয়ে যেই দাস্যভাব করি।
মন্দির মার্জ্জন করি ভজয়ে শ্রীহরি।।
তাহার পুণ্যের কথা কে কহিতে পারে।
অবহেলে এ ভব সংসার সুখে তরে।।
কহিলাম তোমারে এ ধর্ম্মের নন্দন।
পূর্ব্বের কাহিনী এই ব্যাসের বচন।।
একচিত্তে একমনে শুনে যেই জন।
তাহার পুণ্যের কথা না হয় কথন।।
এ ভব সংসার সুখে তরে অবহেলে।
তাহার পাপের পীড়া নাহি কোন কালে।।
নাহিক সংশয় ইথে ব্যাসের বচন।
কাশীরাম কহে ভাবি গোবিন্দ চরণ।।