ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

১৯. অসি বাজে ঝন্‌ ঝন্

১৯. অসি বাজে ঝন ঝন্

গুহার মধ্যস্থলে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্তাভ আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে… আলোছায়ার খেলায় কয়েকটা ভৌতিক ছায়া লাফিয়ে উঠছে উপবিষ্ট তিনটি মানুষের মুখের উপর, দেহের উপর… অদুরে গুহাতলে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ… একটি মৃতদেহের মস্তক বিদীর্ণ করে আড়াআড়িভাবে অবস্থান করছে একটি শাণিত তরবার এবং গুহাতলে শুষ্ক মৃত্তিকা ও কঠিন প্রস্তরের বুক ভাসিয়ে ছুটছে বিদারিত ক্ষতস্থান থেকে তপ্ত রক্তের ধারা…

সেই ভয়াবহ পরিবেশের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জাগল পরন্তপের কণ্ঠস্বর, কিছুদিন ধরেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি। শুধু রাত্রে নয়, দিবালোকেও জাগ্রত অবস্থায় ওই স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে ফিরছে। এতদিন বলতে পারি নি। কিন্তু এবার বলার সময় হয়েছে। মনে হয়, বন্ধুবর শশক আমাকে এই দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্ত করতে পারবে।

একটু থেমে শশকের দিকে রহস্যময় ভঙ্গিতে কটাক্ষ করল পরন্তপ। বিভ্রান্তের মতো একবার পরন্তপ আর একবার শশকের মুখের দিকে চাইল কর্ণদেব পরন্তপের ইঙ্গিত তার বোধগম্য হচ্ছে না, কিন্তু কি যেন এক দুর্বোধ্য রহস্যের আভাস রয়েছে দস্য দলপতির কণ্ঠস্বরে।

শশকের মুখ পাথরের মত নির্বিকার। তার চোখের দৃষ্টি সঞ্চরণ করছে গুহার বাইরে অন্ধকার বনভূমির বুকে;- পরন্তপের দিকে না তাকিয়েই সে উদাস স্বরে বলল, প্রিয়বন্ধু পরন্তপকে দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্তি দেওয়া আমার সাধ্য নয়। আমি জ্যোতিষী নই– যোদ্ধা।

বন্ধুবর শশকের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির উপর আমার অগাধ আস্থা, পরন্তপ সহাস্যে বলল, আর সে যে কী, আর কী সে নয়- তা আমি এখনও বুঝতে পারি নি তবে বুঝতে চেষ্টা করছি। যাই হোক, দুঃস্বপ্নের বৃত্তান্ত তোমাদের বলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাব।

কর্ণদেবের মুখে ফুটল বিরক্তির আভাস, পরন্তপ! তোমার চিত্ত দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুঃস্বপ্ন দেখে বিচলিত হওয়ার মতো দুর্বল মানুষ তো তুমি ছিলে না।

হয়তো তোমার কথা সত্য, পরন্তপের মুখের হাসি রহস্যময়, তবু অনুগ্রহ করে আমার কথা শোন। আমার বিশ্বাস, সকল বৃত্তান্ত শ্রবণ করলে তোমরা দুজনেই আমার চিত্তের দুর্বলতা দূর করতে সমর্থ হবে।

শশক পূর্বের মতোই নীরব। কর্ণদেব বলল, বেশ, শুনি তোমার দুঃস্বপ্নের বৃত্তান্ত।

পরন্তপ বলতে লাগল, একদিন স্বপ্ন দেখলাম এক পার্বত্যপথের উপর দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ে গা মিলিয়ে বসে আছে এক অনার্য প্রহরী! তার সম্পূর্ণ দেহ আমার দৃষ্টি সীমার মধ্যে ধরা না পড়লেও লোকটির অস্তিত্ব আমার কাছে গোপন রইল না। আমি জানি, ওরা এককভাবে থাকে না; আশে-পাশে নিশ্চয়ই অন্যান্য যোদ্ধারা অপেক্ষা করছে পাহাড় ও অরণ্যের অন্তরালে লুক্কায়িত হয়ে। চিৎকার করে তোমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করলাম না। কারণ, তাহলে তারা আমাদের চারদিকে থেকে বেষ্টন করবে; আর একবার পরিবেষ্টিত হলে আত্মসমর্পণ অথবা যুদ্ধ ছাড়া নিষ্কৃতি লাভের অন্য উপায় থাকবে না। আত্মসমর্পণ করলে অনার্যরাজের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে এবং সেই কৈফিয়ত সন্তোষজনক না হলে সীমান্ত অভিমুখে আমাদের চলার পথ বন্ধ হয়ে যাবে অনার্যরাজের আদেশে। যুদ্ধের কথা ভাবলাম, ফল খুব আশাপ্রদ হবে বলে মনে হল না। সঙ্কীর্ণ গিরিপথে দুর্ধর্ষ অনার্য সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করে যদি তাদের বহভেদ করতে পারি, তাহলেও আমরা সকলে অক্ষতদেহে মুক্তি পাব কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে শশকের কিছু হলে সমূহ বিপদ- কারণ, নরমুণ্ডের পাহাড়ের অবস্থিতি সে ছাড়া আর কারও জানা নেই। অনার্যদের সঙ্গে একবার যুদ্ধ করার পর তাদের অধিকারভুক্ত অঞ্চলে চলাফেরা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সেই অবস্থায় অনুসন্ধান করে করোটি পাহাড়কে আবিষ্কার করা শুধু দুঃসাধ্য নয়, প্রায় অসম্ভব। ভাবলাম, ধীরে ধীরে এক এক করে তোমাদের পাশে গিয়ে নতস্বরে সকলকে সাবধান করে দেব। একবার সমতল ভূমিতে পড়লে বিপদের আশঙ্কা কম– অন্তত পলায়নের পথ কিছুটা সহজ হবে। কিন্তু তোমাদের কাছে গিয়ে কিছু বলার দরকার হল না;- হঠাৎ দেখলাম বন্ধুবর শশকের সঙ্গে ওই অনার্য প্রহরীর দৃষ্টি বিনিময় ঘটল। আমি অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করলাম। শশক জানতেও পারল না আমি তাকে লক্ষ্য করেছি। তারপর

বাধা দিয়ে উত্তেজিত স্বরে কর্ণদেব বলল, এই ঘটনার একটাই অর্থ হতে পারে। শশকের সঙ্গে নিশ্চয়ই অনার্যদের যোগযোগ আছে। আর্যযোদ্ধা শশকের সঙ্গে অনার্য-প্রহরীর এমনকি সম্প্রীতির কারণ থাকতে পারে?… শশক! তুমি কি অনার্যরাজের গুপ্তচর?

শশক কিছু বলার আগেই পরন্তপ বলে উঠল, আহা! এটা তো স্বপ্ন। অত্যন্ত দুর্বিষহ এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু যদি এটা স্বপ্ন না হয়ে বাস্তব সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে অনার্যদের সঙ্গে এমন সম্প্রীতির একটাই কারণ থাকতে পারে।

কর্ণদেব প্রশ্ন করল, কি কারণ?

পরন্তপ বলল, এই পথে বারংবার যাতায়াতের ফলে শশকের সঙ্গে অনার্যদের বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু যত বন্ধুত্বই থাক, চারটি সশস্ত্র মানুষকে শশকের সঙ্গে সীমান্তের দিকে যেতে দেখলে অনার্য-প্রহরী তাদের পথরোধ করবেই করবে। অনার্যরাজ মূলক এই অঞ্চলে অধিক সংখ্যক অস্ত্রধারী ব্যক্তির অস্তিত্ব পছন্দ করে না। কারণ, রাজদ্রোহী প্রজা অথবা শত্রুপক্ষের গুপ্তচরের পক্ষে এই অঞ্চলের কোনো ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়, এবং সেই রকম কিছু ঘটলে শ্রাবস্তী রাজ্য হবে বিপন্ন। আমরা জানি মহারাজ রুদ্রদমনের অন্তরঙ্গ সুহৃদ এই অনার্যরাজ শ্রাবস্তীর আপদ-বিপদ সম্পর্কে অতিশয় সচেতন। তাই এই অঞ্চলে অধিক সংখ্যক সশস্ত্র পুরুষ চলাফেরা করলেই প্রচলিত প্রথা অনুসারে তার প্রহরীরা আগন্তুকদের পথরোধ করে প্রশ্ন করবে- প্রশ্নের উত্তর সন্তোষজনক না হলে তাদের নিয়ে যাবে রাজ সকাশে। শশকের সান্নিধ্য যদি এই নিয়মের অন্যথা হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচর, অনার্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। গুপ্তধন আবিষ্কারের পরেই সম্ভবত অনার্যরা আমাদের বন্দি করবে।

দারুণ উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে কর্ণদেব বলল, কি নিদারুণ বার্তা! শশক! তুমি মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচর?

শান্ত স্বরে শশক বলল, তাহলে তো বহু পূর্বেই আমার ইঙ্গিতে অনার্য সেনা তোমাদের বন্দি করত।

আশ্বস্ত হয়ে কর্ণদেব বলল, হ্যাঁ, এটা যুক্তিসঙ্গত কথা।

পরন্তপ বলল, আমাদের বন্দি না করার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অনার্যদের হাতে বন্দি হলে দৈবক্রমে আমাদের মধ্যে কেউ গুপ্তধনের সংবাদ বলে ফেলতে পারে এই সম্ভাবনার বিষয় চিন্তা করেই হয়তো শশক আমাদের বন্দি করতে দেয়নি। অথবা আরও গাঢ় গোপন উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

বিচলিত হয়ে কর্ণদেব বলল, আরও গুঢ় উদ্দেশ্য?… নাঃ! যা শুনলাম, তাতেই আমি চমকিত হয়েছি। এখন তো তাহলে

বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে সে শশকের দিকে দৃষ্টিপাত করল, দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত হল তরবারির হাতলের দিকে।

শশক বাক্য ব্যয় করল না। অটল হয়ে বসে রইল। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি এখন দুরমনস্কের মতো নয়, নিবিষ্টচিত্তে সে সঙ্গীদের লক্ষ্য করছে তার দেহের ভঙ্গি লক্ষন-উদ্যত ব্যাঘ্রের ন্যায় ঈষৎ সঙ্কুচিত- স্থির, কিন্তু প্রতীক্ষায় ভয়ঙ্কর।

সেইদিকে একবার তাকিয়েই কর্ণদেবের দিকে ফিরল পরন্তপ, শান্ত হও কর্ণদেব। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন হলেও স্বপ্ন; তার সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ নেই।

ভ্রূ কুঞ্চিত করে কর্ণদেব বলল, কিন্তু তোমার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ আছে মনে হয়।

আহা! তুমি অনর্থক উত্তেজিত হচ্ছ, পরন্তপ বলল, স্বপ্নের কথা শুনে যদি কেউ উত্তেজিত হয়, তাহলে আমি তাকে দুর্বলচিত্ত মানুষ বলব। তুমিও একটু আগে আমকে দুর্বলচিত্ত বলে দোষারোপ করেছ- নয় কি কৰ্ণদেব?

-সত্য। কিন্তু তোমার দুঃস্বপ্ন যে আমাকেও ভীত করে তুলেছে।

অথচ আমাদের বন্ধু শশক কেমন নির্বিকার দেখেছ? আমার দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক তাকে স্পর্শমাত্র করেনি। শশক আদর্শ পুরুষ। দেহের মত তার মনও বলিষ্ঠ।

শশক কোনো কথা বলল না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। কিন্তু তার বসার ভঙ্গি শিথিল নয়- শ্বাপদের ন্যায় ঋজু, সতর্ক।

একবার সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে পরন্তপ কর্ণদেবের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, আর একটি স্বপ্ন বৃত্তান্ত বলছি, শোনো। দেখলাম সন্ধ্যাকালে তির নিক্ষেপ করে শশক একটি বন্য বরাহকে হত্যা করল। তারপর সেই মৃত পশুকে স্কন্ধে বহন করে সে যখন ফিরে আসছে, সেই সময় অরণ্য ভেদ করে তার সামনে এসে দাঁড়াল কয়েকজন অস্ত্রধারী অনার্য সেনা। তাদের সঙ্গে শশকের কথাবার্তা আমি শুনতে পাইনি। দেখলাম, একটু পরেই সে ফিরে এল তোমাদের কাছে। তোমরা একটি নদীতটে বিশ্রাম করছিলে। শশকের স্কন্ধে বরাহ দেখে সকলেই আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় সোল্লাসে অভিনন্দন জানালে। তারপর কি হল মনে নেই, কারণ, তখনই আমার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল।

কর্ণদেব উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, আমার মনে আছে একদিন সন্ধ্যায় আমরা যখন নদীতটে বসেছিলাম, সেই সময় সত্যই তিরবিদ্ধ এক বরাহের মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল শশক এবং সেই মাংসে আমরা ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছিলাম। আমার একথাও মনে আছে–শশক মৃগয়ার জন্য বনমধ্যে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি হঠাৎ ফলাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করলে এবং সুমিষ্ট ফলের সন্ধানে অদৃশ্য হলে অরণ্যগর্ভে। শশক বরাহ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করার একটু পরেই শুন্য হাতে ফিরে এসে তুমি জানিয়েছিলে ফলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেদিন হঠাৎ অরণ্যজাত ফলের উপর তোমার অস্বাভাবিক আকর্ষণ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তুমি গোপনে শশককে অনুসরণ করেছিলে। সম্ভবত তার আগেই অনার্য প্রহরীর সঙ্গে শশকের দৃষ্টিবিনিময় তোমাকে শশকের গতিবিধি সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলেছিল।… কিন্তু কি ভয়ানক ব্যাপার! শশক। পরন্তপের অভিযোগ শোনার পর তোমার কি বলার আছে?

শশক নির্বিকার স্বরে বলল, কিছু না। কারও স্বপ্ন-বৃত্তান্ত নিয়ে মতামত প্রকাশ করতে আমি রাজি নই।

কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, তুমি গুপ্তচর!

শশক কিছু বলার আগেই পরন্তপ বলে উঠল, ভুল ধারণা। আমি জানি শশক গুপ্তচর নয়।

পরস্পর বিরোধী মন্তব্যে হতচকিত কর্ণদেব বিহ্বল স্বরে বলল, গুপ্তচর নয়?

দৃঢ়স্বরে পরন্তপ বলল, না। শশক যে গুপ্তচর নয় এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

স্তম্ভিত কর্ণদেব জিজ্ঞাসা করল, তবে সে কী? তুমি এতক্ষণ যা যা বললে তাতে তো তাকে, গুপ্তচর বলেই সন্দেহ হয়।

পরন্তপ হাসল, বন্ধুবর শশক যা বলল, আমি সেই কথারই পুনরুক্তি করব। স্বপ্ন-বৃত্তান্ত শুনে কোনো ব্যক্তিকে দোষারোপ করা যায় না।

কর্ণদেব কি যেন বলতে গেল, কিন্তু তাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়ে পরন্তপ বলে উঠল, শ্রাবস্তী রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মহারাজ রুদ্রদমনের গতিবিধি সম্পর্কে তোমার কি মনে হয় কর্ণদেব?

কর্ণদেব রুষ্টস্বরে বলল, আমার মনে হয় মদ্যপান না করেও তুমি আজ নেশাগ্রস্ত হয়েছে। স্বপ্নবৃত্তান্ত ছেড়ে হঠাৎ মহারাজ রুদ্রদমন আর শ্রাবস্তী রাজ্যের প্রসঙ্গ তোমার মাথায় এল কেন? এমন অসংলগ্ন কথাবার্তার অর্থ কি?

অসংলগ্ন নয় হে, অসংলগ্ন নয়, পরন্তপ হাসল, আমার স্বপ্ন-বৃত্তান্তের সঙ্গে মহারাজ রুদ্রদমন আর শ্রাবস্তী রাজ্যের প্রসঙ্গ জড়িত আছে। কণ! তুমি নিশ্চয়ই জানো, যখন কোনো ব্যক্তিকে রাজদরবার থেকে সমাজবিরোধী আখ্যা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়, তখন সেই ব্যক্তি যদি রাজাদেশ পালন না করে, অথবা দেশান্তরী না হয় তাহলে

বাধা দিয়ে কর্ণদেব বলল, তাহলে একদিন সেই সমাজবিরোধী ব্যক্তির মৃতদেহ রাজ্যের মধ্যেই কোনো এক স্থানে আবিষ্কৃত হয় এবং দেখা যায় ওই মৃতদেহের ললাটে বা বক্ষে আঁকা আছে রক্তাক্ত শায়ক চিহ্ন। লোকে বলে দেবরাজ বাসব স্বহস্তে ওই দুবৃত্তের প্রাণদণ্ড দিয়ে তার দেহে শায়ক চিহ্নের প্রতীক অঙ্কিত করেন। যে কথা এই রাজ্যের শিশুরাও জানে, এই মুহূর্তে সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছ কেন?

পরন্তপ বলল, জানা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে কখনো কখনো অজানা রহস্যেরও সমাধান হয়। কর্ণদেব। তুমি শিক্ষিত সাধারণ শিক্ষা নয়, পণ্ডিত পিতার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন শাস্ত্র ও দর্শন অধ্যয়ন করেছ তুমি কি বিশ্বাস করো দেবরাজ ইন্দ্র স্বহস্তে রাজশত্রুকে হত্যা করে সেই ব্যক্তির ললাটে বা বক্ষে প্রতীক চিহ্ন অঙ্কন করেন?

ক্ষণকাল চিন্তা করে কর্ণদেব বলল, না। ও কথা আমি বিশ্বাস করি না।

পরন্তপ আবার প্রশ্ন করল, তাহলে শায়ক চিহ্নে কেন চিহ্নিত হয় নিহত ব্যক্তির ললাট বা বক্ষ? সকলের অজ্ঞাতে ওই দুরূহ কর্মটি কে সমাধা করে?

চিন্তিত স্বরে কর্ণদেব বলল, তা বলতে পারি না। তবে কোনো অদৃশ্য দৈবশক্তি যে এই সকল ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। যে ভাবেই হোক কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে দুর্বৃত্তদের সন্ধান নিয়ে তাদের সম্মুখীন হয়, তারপর গোপনে তাদের হত্যা করে চলে যায়। তবে যে ব্যক্তি এই কাজ করে, সে যেমন চতুর, রণবিদ্যায় তেমনই দক্ষ। কারণ, জনারণ্যে লুক্কায়িত দুৰ্বত্তের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। তারপর তাকে সম্মুখযুদ্ধে হত্যা করাও সহজ কাজ নয়। নিহত ব্যক্তিদের যে অতর্কিতে আক্রমণ করে গুপ্তভাবে হত্যা করা হয় না, সেই প্রমাণও আছে। ওই সকল নিহত ব্যক্তির দেহে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন পরীক্ষা করে অভিজ্ঞ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে ওই ধরনের ক্ষতচিহ্নের উৎপত্তি হতে পারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলে– গুপ্তঘাতকের আঘাতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার ধরন অন্যরকম। তাছাড়া, গুপ্তঘাতক সাধারণত ছুরিকা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু শায়ক চিহ্নিত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে অধিকাংশ সময়েই তারা মৃত্যুবরণ করেছে তরবারির আঘাতে। মৃত্যুর পর হন্তারক নিহতের দেহে অঙ্কন করেছে শায়ক চিহ্ন। দুই একটা ব্যতিক্রম আছে। প্রায় তিন বৎসর আগে রাজধানীর পথপ্রান্তে দস্যু বিলোমের যে মৃতদেহ ছিল, তাতে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন ছিল না। ললাটে ও বক্ষে উভয় স্থানেই ছিল রক্তাক্ত শায়ক চিহ্ন। কিন্তু এই সকল আলোচনার প্রয়োজন কি পরন্তপ?

কর্ণদেবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পরন্তপ বলল, বিলোমের মৃত্যু আমার মনে আছে। আরও কয়েক বৎসর আগে কল্মষপাদ নামে এক দস্যুর মৃতদেহ দেখেছিল আমার এক অনুচর। তার মুখে শুনেছি ওই দস্যর ললাটে ছিল শায়ক চিহ্ন আঁকা, কিন্তু তার দেহে ছিল না অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন। এখন বলো তো কর্ণদেব– শুধু মাত্র ললাটে রক্তাক্ত একটি চিহ্ন ধারণ করে কোনো ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে দেবরোষে তার মৃত্যু ঘটেছে একথা বলা যায় কিনা?

কর্ণদেব বলল, না। আমি যুক্তিবাদী, প্রত্যক্ষ যুক্তি ছাড়া কিছু বিশ্বাস করি না। আমি জানি প্রচণ্ড শক্তিশালী কোনো পুরুষের মুষ্ট্যাঘাতের ফলে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আহত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে; কিন্তু সেই আঘাতের চিহ্ন মৃতের দেহে লক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। খুব সম্ভব ওই ভাবেই দস্যু বিলোম আর কল্মষপাদ প্রাণ হারিয়েছে। হত্যার পর হন্তারক নিহতদের শায়ক চিহ্নে চিহ্নিত করে স্থান ত্যাগ করেছে।

ঠিক বলেছ, পরন্তপ বলল, এখন বলো তো নিহত ব্যক্তির ললাটে বা বক্ষে শায়ক চিহ্নের উৎপত্তি কি করে হতে পারে?

একটু চিন্তা করে কর্ণদেব বলল, বলতে পারছি না।

আরও একটি বিষয় ভেবে দেখা উচিত, পরন্তপ বলল, শায়ক চিহ্নে চিহ্নিত মৃতদেহ যখন দেখা যায়, সেই সময় রুদ্রদমন রাজ্যে উপস্থিত থাকেন না। আরও বিশদভাবে বললে বলতে হয়, মহারাজের রাজবপু যতক্ষণ সিংহাসনে শোভা পায়, ততক্ষণ অবাঞ্ছিত দস্য নিরাপদ। মহারাজ সিংহাসন ত্যাগ করে রাজ্য থেকে অন্তর্হিত হওয়ার পরেই অপরাধীর প্রাণসংশয় ঘটে। কর্ণদেব। মহারাজের সিংহাসন ত্যাগ করে অন্তর্ধান করার সঙ্গে অপরাধীর মৃত্যু আর শায়ক চিহ্নের রহস্য জড়িত আছে। এইবার সব রহস্যের মীমাংসা করো। দেখি, তুমি কেমন বুদ্ধিমান?

কিছুক্ষণ নীরব থেকে কর্ণদেব বলল, না, পরালাম না।

পারবে, পরন্তপ বলল, বন্ধুবর শশকের বামহস্তের অঙ্গুরীয়টি পরীক্ষা করলেই রহস্যের সমাধান করতে পারবে।

নিকটেই উপবিষ্ট শশকের বামহস্তের অনামিকাতে পরিহিত অঙ্গুরীয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে কর্ণদেব বলল, অঙ্গুরীয়টির মধ্যে আমি কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি না। অধিকাংশ ব্যক্তি অবশ্য স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত অঙ্গুরীয় পরিধান করে থাকে, তবে অন্যান্য ধাতুতে গঠিত অঙ্গুরীয় মাঝে মাঝে দৃষ্টিগোচর হয়। তবে অঙ্গুরীয়ের মধ্যস্থলে প্রস্তর বা রত্ন না থাকলেও সাধারণত ওই অংশটি চতুষ্কোণ বা বৃত্তাকারে স্ফীত হয়ে থাকে। কিন্তু শশকের অঙ্কুরীয়তে কোথাও চতুষ্কোণ বা বৃত্তাকার স্ফীতি নেই, আগাগোড়া সুগোল। ওই ধরনের অঙ্গুরীয় সংখ্যায় কম হলেও একেবারে বিরল এ কথা বলা যায় না। বিশেষত শ্রমজীবী দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আঙুলে ওই প্রকার ধাতুনির্মিত অঙ্গুরীয় অনেক সময়েই চোখে পড়ে। আমি তো শশকের অঙ্গুরীয়তে কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি না।

কর্ণদেব! হাতের উপরিভাগে কোনো বৈশিষ্ট্য তুমি দেখতে পাবে না, পরন্তপ বলল, কিন্তু বন্ধুবর শশক যদি করতল প্রসারিত করে, তাহলে আমার বিশ্বাস অঙ্গুরীয়তে কিছু বৈশিষ্ট্য তুমি আবিষ্কার করতে পারবে। 

তাই নাকি? কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলল, দেখি! দেখি! শশক স্থির হয়ে বসে রইল, হাত উলটিয়ে কর্ণদেবের কৌতূহল নিবারণের চেষ্টা করল না।

পরন্তপ বলল, উঁহু, বন্ধুবর তোমার সম্মুখে করতল প্রসারিত করতে রাজি হবে মনে হয় না। অঙ্গরীয়টি আদৌ সলোল বা সড়োল নয়, মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি সযত্নে ঘরিয়ে করতলে আবৃত আছে- পাছে তোমাদের দৃষ্টি ওদিকে পড়ে।

কর্ণদেব বলল, আমাদের দৃষ্টি পড়লে ক্ষতি কি? মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি ঢেকে রাখার চেষ্টাই বা কেন?

ক্ষতি আছে বৈকি, পরন্তপ বলল, মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি ঢেকে রাখার কারণ ঐখানেই খোদিত আছে শায়ক চিহ্ন।

শায়ক চিহ্ন! প্রায় চিৎকার করে উঠল কর্ণদেব, ওই চিহ্ন তো সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। শায়ক চিহ্নই তো রাজশক্তির প্রতীক। শশক তাহলে সত্যই মহারাজ রুদ্রদমনের বিশ্বস্ত গুপ্তচর!

পরন্তপ বলল, তুমি নিতান্তই মূর্খ। তুমি দেখেছ শল্যের উদ্ধারপর্বে আর নেকড়েবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এই ব্যক্তি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেছে; দূর থেকে একাধিক অশ্বের বলগা বাণাঘাতে ছিন্ন করে এবং আক্রমণোদ্যত হস্তীর দুই চক্ষুকে অব্যর্থ সন্ধানে তিরবিদ্ধ করে অত্যাশ্চর্য ধনুর্বিদ্যার পরিচয় দিয়েছে– সর্বশেষে গুহাগাত্রে খোদিত আদ্য-অক্ষরের জটিল রহস্য ভেদ করে গুপ্তধন আবিষ্কার করেছে অনায়াসে। দেহে-মনে এমন অসাধারণ শক্তিধর উচ্চাভিলাষী না হয়ে গুপ্তচরের ঘৃণ্য ও তুচ্ছ বৃত্তি অবলম্বন করবে?… কর্ণদেব! তুমি নির্বোধ!… তোমার সম্মুখে শশক নামে অভিহিত মানুষটি হলেন মহারাজ রুদ্রদমন।

বিস্ময়-অভিভূত কণ্ঠে কর্ণদেব বলে উঠল, তুমি– আপনি, মহারাজ রুদ্রদমন?

মৃদুহাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করে শশক বলল, না, কর্ণদেব আমি মহারাজ রুদ্রদমন নই। আমার মতো সামান্য ব্যক্তিকে মহারাজ সম্বোধনে সম্মান প্রদর্শন করলে শ্রাবস্তীর অধিপতি মহারাজ রুদ্রদমনকে অপমান করা হয়। তাই রাজভক্ত প্রজার কর্তব্য অনুসারে প্রতিবাদ জানিয়ে বলছি- আমি শশক, মহারাজ রুদ্রদমন নই। যোদ্ধার ছদ্মবেশে ভ্রাম্যমাণ এক গুপ্তচর পরন্তপের শ্যেনদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে একথা স্বীকার করলেই বন্ধুবর পরন্তপের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ শক্তিকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু গুপ্তচর শশককে ছদ্মবেশী মহারাজ মনে করলে বন্ধুবরের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে যে-কোনো ব্যক্তি সন্দেহ প্রকাশ করবে।

দ্বিধাজড়িত স্বরে কর্ণদেব বলল, শশক! স্বীকার করছ তুমি।

শশক বলল, আমি মহারাজের নিযুক্ত গুপ্তচর। পরন্তপের সন্ধানে বিচরণ করছি দেশের বিভিন্ন স্থানে। আমার বুদ্ধি, শক্তি ও অস্ত্রচালনার দক্ষতায় প্রশংসা করে পরন্তপ বলেছে আমার ন্যায় দেহে-মনে অসাধারণ শক্তির অধিকারী কোনো ব্যক্তি উচ্চাভিলাষী না হয়ে গুপ্তচরের তুচ্ছ বৃত্তিতে আত্মনিয়োগ করতে পারে না। বন্ধুবর পরন্তপের উক্ত মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিনীত প্রতিবাদ জানিয়ে বলছি, উচ্চাভিলাষী বিশেষণটি নিতান্তই আপেক্ষিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে গুপ্তচরবৃত্তিকে ঘৃণ্য বা তুচ্ছ মনে করি না। দেশের শুভঅশুভ জানার জন্যে এবং অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ রোধ করার জন্যে গুপ্তচরের প্রয়োজন আছে। বীরযোদ্ধাকে দেশের মানুষ শ্রদ্ধা করে দেশের কার্যে আত্মনিয়োগ করে যে যোদ্ধা নিহত হয়, সে সমগ্র দেশবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র; কিন্তু যে গুপ্তচর দেশবাসীর কল্যাণের জন্য মৃত্যুবরণ করে, তার উদ্দেশে একটি সহানুভূতির বাক্য পর্যন্ত উচ্চারিত হয় না। অথচ লোকচক্ষুর অন্তরালে ওই গুপ্তচরবৃন্দ প্রতি মুহূর্তে প্রাণ বিপন্ন করছে দেশেরই কল্যাণ কামনায়। এই নীরব আত্মদান, এই নীরব দেশসেবা যদি ঘৃণ্য ও তুচ্ছ হয়, তাহলে মহৎ কার্য কাকে বলব?… না, কর্ণদেব! গুপ্তচরবৃত্তি ঘৃণ্য নয়, তুচ্ছ নয়। আমার সামান্য শক্তি দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে আমি এইভাবেই দেশসেবা করে যাব– এই আমার অভিলাষ। এই অভিলাষকে যদি কেউ উচ্চ-অভিলাষ আখ্যা দিতে রাজি না হয়, তবে সেটা ব্যক্তিগত মতামতের ব্যাপার। কিন্তু রণক্ষেত্রে সহস্র মানুষের বাহবার সম্মুখে স্ফীতবক্ষ প্রশংসালুব্ধ কোনো উচ্চাভিলাষী বীরপুরুষের তুলনায় আমি নিজেকে কোনো অংশে হীন মনে করি না। গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আমি লজ্জিত নই কিছুমাত্র। লজ্জা এই যে, আমার চাইতে অধিকতর বুদ্ধিমান এক ব্যক্তির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে গেছে।

কর্ণদেব বিব্রতস্বরে বলল, শশক! তুমি যে গুপ্তচর একথা তাহলে সত্য। আমাদের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। তোমাকে হত্যা করাই এখন আমাদের কর্তব্য।

শশক হেসে বলল, যদি কোনো সীমান্তরক্ষী বা নগররক্ষী তোমাদের হাতে প্রাণ হারায়, তাহলে দেশের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবে দস্যুকে বন্দি করতে গিয়ে যে রক্ষী মৃত্যুবরণ করে, তার কর্তব্যবোধের তুলনা হয় না। কিন্তু দেখ, আজ তোমাদের হাতে প্রাণ হারালে আমার নাম পর্যন্ত কোথাও উচ্চারিত হবে না। অথচ রক্ষীদের মতো আমিও তোমাদের বন্দি করার জন্যই প্রাণ বিপন্ন করছি। অতএব দেখছ, গুপ্তচরের দেশপ্রেমের কোনো পুরস্কার নেই।

কর্ণদেব বলল, গুপ্তচরবৃত্তি ভালো কি খারাপ সেটা নিয়ে আদৌ চিন্তা করছি না। আমি চিন্তিত হয়েছি আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে মনে হয় তোমাকে হত্যা করতে পারলে আমরা নিরাপদ কিন্তু ওই চিন্তাকে কার্যে পরিণত করার প্রবৃত্তি হচ্ছে না।

শশক বলল, তোমাদের নিরাপত্তা আদৌ বিপন্ন নয়। মহারাজ রুদ্রদমনের কাছে আমি এমন বার্তা নিয়ে যাব না, যাতে তোমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। এই ধনভাণ্ডার থেকে পরন্তপ যদি তার প্রাপ্য অংশ নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য রাজ্যে পলায়ন করে, তবে আমি তাকে বাধা দেব না। অতএব, নিরাপত্তা সম্পর্কে তোমাদের ভীত হওয়ার কারণ নেই।

–তুমি বাধা না দিলেও অনার্যসেনা আমাদের বন্দি করতে পারে।

-করবে না। বন্ধুবর পরন্তপের স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ওই প্রহরীদের উপর আমার কিছু প্রভাব আছে। সুতরাং, মাভৈঃ!

পরন্তপ হেসে বলল, আমার কিশোর বন্ধু কর্ণদেব নিশ্চয়ই মহারাজের আশ্বাসবাক্যে আশ্বস্ত হয়ে নিরাপদ বোধ করছে। কিন্তু আমি পুরাতন পাপী, আমার মনোভাব ভিন্ন। এই বিপুল সম্পদের ভিতর থেকে আমাদের প্রাপ্য অংশ নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে কৌশাম্বী রাজ্যে পদার্পণ করা বর্তমানে আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ, আমাদের সঙ্গে অশ্ব নেই। কিছু অর্থ নিয়ে কৌশাম্বীতে গিয়ে সেখান থেকে অশ্ব ক্রয় করে এখানে আমরা ফিরে আসতে পারি, কিন্তু সেটা হবে পণ্ডশ্রম। ততক্ষণে এই সম্পত্তি যে মহারাজ রুদ্রদমনের অধিকারভুক্ত হবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তাছাড়া, বর্তমানে শশকের ছদ্মবেশে মহারাজ রুদ্রদমন আমাদের নিরাপদে দেশান্তরী হওয়ার সুযোগ দিলেও পরবর্তীকালে সীমান্ত অতিক্রম করে পুনরায় এইস্থানে প্রত্যাবর্তন করলে তিনি আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে মনে হয় না। কি বলেন মহারাজ?

শশক বলল, মহারাজ রুদ্রদমন তার রাজ্যসীমার মধ্যে তোমার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় মনে করেন না, ভবিষ্যতেও করবেন না। কিন্তু তার অযোগ্য সেবক শশকের ধারণা পরন্তপের মতো মানুষ দস্যুবৃত্তি করলেও সে অনন্যসাধারণ ব্যক্তি– অতএব, উক্ত পরন্তপকে শ্রাবস্তীর বাইরে সভাবে জীবনযাপনের একটা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাই পুনরায় প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা ত্যাগ করে মূল্যবান কিছু রতন নিয়ে পরন্তপের কাল প্রত্যূষেই পলায়ন করা কর্তব্য। রত্নাদি বহন করার জন্য অশ্বের প্রয়োজন হবে না। কৌশাম্বী রাজ্যে গিয়ে ওই সকল রত্ন বিক্রয় করে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা দিয়ে একটি বা দুটি মানুষ নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারে অনায়াসে। এই চিন্তা বোধহয় অনেক আগেই পরন্তপের মনে এসেছে, তাই কারও পরামর্শ ছাড়াই মূল্যবান কিছু রত্ন সে এর মধ্যেই হস্তগত করেছে। প্রত্যূষে পরন্তপের নিরাপদে সীমান্ত অতিক্রম করার ব্যবস্থা এই অধম করে দিতে পারবে বলেই মনে হয়।

ঊর্ধ্বাঙ্গ নত করে অভিবাদন জানিয়ে পরন্তপ বলল, মানুষ নিজের অবস্থায় সর্বদাই অসন্তুষ্ট। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অযাচিত ভাবে আহার্যের সন্ধান পেলেও সুখী হয় না, তৎক্ষণাৎ শয়নের ব্যবস্থা করার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানব-চরিত্রের ওই চিরন্তন দুর্বলতা থেকে আমিও মুক্ত নই। একটু আগেও বন্ধুবর শশক যা বলল, সেই রকম আমার পরিকল্পনাই ছিল। আর সেইজন্যই কয়েকটি মহার্ঘ রত্ন নিয়ে আমি প্রত্যূষে সকলের অজ্ঞাতসারে কর্ণদেবের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করার সঙ্কল্প করেছিলাম। পরিবেশের এখন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, তাই বর্তমানে পূর্ব-সঙ্কল্প ত্যাগ করাই উচিত মনে করছি। শশকের যথার্থ পরিচয় শায়ন ও বল্লভের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো কি না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই— তাদের অমতে তাদেরই সম্মুখে শশক অর্থাৎ মহারাজ সম্পর্কে স্বাধীন ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। সেইজন্যই কোনো কথা না বলে আমি স্থানত্যাগের পরিকল্পনা করেছিলাম। আকস্মিকভাবে ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ায় পরিবেশ পরিবর্তিত; এবং আমিও পূর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করে নতুন এক সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছি। ইহজীবনে বহু কুকর্ম করায় প্রাণান্তে নরকবাস আমার নিশ্চিত কিন্তু স্বর্গাধিপ ইন্দ্রের প্রিয়পাত্র মহারাজ রুদ্রদমনের হস্তে যুদ্ধে নিহত হলে নিশ্চয়ই স্বর্গে আরোহণের সুযোগ পাব। অতএব, মহারাজ! অসি নিষ্কাষিত করে আমাকে উদ্ধার করুন।

কথা শেষ করেই সশব্দে তরবারি কোষমুক্ত করল পরন্তপ। কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলে উঠল, পরন্তপ। এই ব্যক্তি মহারাজ রুদ্রদমন অথবা গুপ্তচর শশক তা আমি জানি না। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে তুমি যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইছ কেন? আমাদের যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন, অনর্থক এই ব্যক্তির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

পরন্তপ বলল, প্রয়োজন আছে কিনা সেটা আমি বুঝব। তুমি চুপ করো।

কর্ণদেব বলল, না। শশকের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারি নি। কিন্তু এই ব্যক্তি আমাদের বন্ধুস্থানীয়। এই ভয়ঙ্কর যাত্রাপথে সে ছিল আমাদের অপরিহার্য সঙ্গী। আজ প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলেই তাকে তুমি হত্যা করতে চাও?… না। আমি তোমাকে এমন অসঙ্গত কাজ করতে দেব না, পরন্তপ।

পরন্তপ রূঢ়স্বরে বলল, কর্ণদেব! মনে রেখো– আমি তোমাকে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের গ্রাস থেকে রক্ষা করেছি। শ্রাবস্তীর আতঙ্ক দস্যু পরযুপের বিরুদ্ধাচরণ করতে আজ তুমি ভীত নও- কিন্তু কার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তোমার এত সাহস? কে তোমায় অস্ত্রচালনার শিক্ষা দিয়েছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর? কার শিক্ষার গুণে এক ভীরু বালক কৈশোরে পদার্পণ করে ব্যাঘ্রবৎ বিক্রমের অধিকারী?

তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল পরন্তপের উগ্র কণ্ঠ, কর্ণদেব! আজ আমার জন্যই তোমার এই রূপান্তর। মেষশাবক আজ আমারই শিক্ষার গুণে ব্যাঘশাবকে পরিণত- কিন্তু কর্ণদেব! আমার গুরুদক্ষিণা কোথায়?… নীরব কেন কর্ণদেব?… আচ্ছা, তুমি নীরব ও নিরপেক্ষ হয়ে অবস্থান করলেই আমার গুরুদক্ষিণা দেওয়া হবে। মহারাজ! প্রস্তুত হন, আমি আপনাকে আক্রমণ করছি।

পরন্তপ এক পা অগ্রসর হয়ে অসি উদ্যত করতেই শশক বলল, আমি রুদ্রদমন নই, আমি নিতান্তই শশক। পরন্তপ! অকারণ যুদ্ধে পরস্পরের প্রাণ বিপন্ন করার কি প্রয়োজন?

মহারাজ রুদ্রদমন! আপনার বাগজালে কিশোর কর্ণদেব বিভ্রান্ত হতে পারে, পরন্তপ বলল, কিন্তু আমি আপনার কথায় ভুলব না। দীর্ঘ এই পদযাত্রায় আপনার গতিবিধি আমি লক্ষ করেছি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এমন নির্ভীক রাজোচিত পদক্ষে, সিংহাবলোকনে দৃষ্টিপাত এবং উদ্ধত গ্রীবাভঙ্গির এমন অপূর্ব সমন্বয়ের অধিকারী হবে ছিদ্রান্বেষী এক গুপ্তচর?… অসম্ভব। আর অকারণ যুদ্ধের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব কারণ-অকারণে বিচার নিতান্তই আপেক্ষিক একের বিচারে যেকর্ম অবশ্য করণীয়, অপরের বিচারে তা নিরর্থক।

ক্ষান্ত হও পরন্তপ, গম্ভীর স্বরে শশক বলল, আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না।

কিন্তু আমি আপনাকে হত্যা করতে চাই, পরন্তপের ওষ্ঠাধরে কঠিন হাসির রেখা, মহারাজ রুদ্রদমন আর দস্যু পরন্তপের একই রাজ্যে স্থান হতে পারে না। আমি এই রাজ্যেই বাস করতে চাই। অতএব, আপনাকে হত্যা করতে আমি সচেষ্ট হব। প্রস্তুত হন মহারাজ এই আমি আক্রমণ করলাম।

তরবারিকে অগ্রবর্তী করে আক্রমণ করল পরন্তপ বিদ্যুৎ শিখার ন্যায় ছুটে এল শাণিত অস্ত্র শশকের বক্ষ অভিমুখে! সঙ্গে সঙ্গে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে ঘুরে গেল শশকের দেহ- ক্ষিপ্র আকর্ষণে কোষ হতে অর্ধ-উত্থিত তরবারিতে ঘর্ষিত হয়ে লক্ষ্যস্থল থেকে সরে গেল পরন্তপের অস্ত্র ব্যর্থ আক্রোশে শূন্যে দংশন করল শোণিত পিপাসায় অতৃপ্ত তরবার!

পরক্ষণেই শশকের কোষ থেকে অর্ধ-উত্থিত তরবারি সম্পূর্ণ বহির্গত হয়ে ঝলসে উঠল!

এমন ক্ষিপ্র আক্রমণ, আর এমন চকিত প্রতিরোধের ক্ষিপ্রতর সঞ্চালন আগে কখনও দেখে নি কর্ণদেব! বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে সে দেখতে লাগল এক ভয়ংকর দ্বৈরথ যুদ্ধ!

অগ্নিকুণ্ডের রক্তিম আলোতে বিদ্যুৎবর্ষণ করে সশব্দ সংঘাতে পরস্পরকে বারংবার আলিঙ্গন করল দুটি ঘূর্ণিত তরবারি তবু যুযুধানদের অস্ত্রের ফলকে পড়ল না রক্তের রেখা, ব্যর্থ আক্রোশে ঘুরতে লাগল দুটি শাণিত তরবারি হিংস্র আক্রোশে বিকশিত শ্বাপদ-দন্তেরমতো!….

পরন্তপের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করার সময়ে বহুদিন তার অস্ত্রচালনার কৌশল দেখেছে কর্ণদেব, একাধিকবার তাকে ব্যাপৃত হতে দেখেছে দ্বন্দ্বযুদ্ধে কিন্তু আজকের লড়াই দেখে সে বুঝল অস্ত্রগুরুর আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় সে আগে কখনও পায় নি! প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রচণ্ড আক্রমণকে অপূর্ব কৌশলে বার বার বিফল করে দিচ্ছে পরন্তপ!

নিজের ক্ষমতার উপর কর্ণদেবের আস্থা ছিল, ক্রমে ক্রমে সেই আস্থার উপর অহঙ্কারের প্রলেপ পড়েছিল, ধারণা হয়েছিল অসিযুদ্ধে আজ তার ক্ষমতা বুঝি গুরুর চাইতেও বেশি কিন্তু আজ সে বুঝল পরন্তপের কাছে সে নিতান্ত শিশু মাত্র!

ব্যাঘ্রের ন্যায় ক্ষিপ্র এবং হস্তীর ন্যায় বলশালী শত্রুর আক্রমণ এড়িয়ে বারংবার প্রতি আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরন্তপ! অপরপক্ষ কম নয়- দুই-দুইবার পরন্তপের ভয়ংকর আঘাত ব্যর্থ করে দিল শশক, তরবারির ক্ষিপ্র সঞ্চালনে…

আচম্বিতে দুটি তরবারির হাতল প্রচণ্ড সংঘাতে মিলিত হল। পরন্তপ তাড়াতাড়ি নিজের তরবারি টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। গুহার দেয়ালে তাকে সজোরে চেপে ধরে শশক বলে উঠল, পরন্তপ! আত্মসমর্পণ না করলে এইবার আর রক্ষা নেই। যদি বাঁচতে চাও, অস্ত্রত্যাগ করো।

পরন্তপের মুখ ঘর্মাক্ত হল। প্রচণ্ড পেষণে তার দেহ তখন গুহাগ্ৰাত্রে নিষ্পিষ্ট। শশক আবার বলল, আত্মসপৰ্মণ করো। পরন্তপ উত্তর দিল না। তার মুখের ভাব কঠিন হয়ে উঠল। শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ বর্ধিত হল…

হঠাৎ যে কি ঘটল বুঝতে পারল না কর্ণদেব– যোদ্ধাদের দেহ দুটি পাক খেযে ছিটকে গেল- পরক্ষণেই সে দেখল গুহার দেয়াল থেকে ছিটকে গুহার প্রায় মধ্যস্থলে এসে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী!

হা হা শব্দে হেসে উঠল পরন্তপ, মহারাজ! আমার ললাট বা বক্ষ শায়ক চিহ্ন গ্রহণ করতে রাজি নয়।

অকস্মাৎ পরন্তপের তরবারি শত্রুর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েই বিদ্যুচ্চমকের মতো বামদিকে সঞ্চালিত হল– মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে উঠল শশকের দক্ষিণ জানু।

এতক্ষণে, অট্টহাস্য করে উঠল পরন্তপ, এতক্ষণে রাজরক্ত দর্শন করলাম।

শত্রুর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করেই স্তব্ধ হয়ে গেল পরন্তপ শশকের ওষ্ঠাধরে ভয়াবহ হাসি, চক্ষে আহত শার্দুলের ক্রুদ্ধ জিঘাংসা!

স্তম্ভিত বিস্ময়ে কর্ণদেব দেখল অগ্নিকুণ্ডের আলোকে জীবন্ত তড়িৎশিখার মতো জ্বলে জ্বলে উঠল শশকের তরবার সামনে, পিছনে, দক্ষিণে, বামে প্রতিদ্বন্দ্বীর অসিতে প্রতিহত হয়ে ঝনৎকার তুলল বারংবার সেই তীব্র আক্রমণের ঝড়ে বিপর্যস্ত বিহ্বল পরন্তপ পিছিয়ে গেল দ্রুতপদে!

এই প্রথম পরন্তপের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া দেখতে পেল কৰ্ণদেব!

 ক্রমাগত পশ্চাৎপদ হতে হতে গুহার মুখে এসে পড়ল পরন্তপ, তারপর হঠাৎ এক প্রচণ্ড লক্ষে গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল।

তৎক্ষণাৎ উদ্যত তরবারি হাতে ঝড়ের বেগে গুহার প্রবেশপথে লঙ্ঘন করল শশক। গুহার ভিতর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের আর দেখতে পেল না কর্ণদেব কেবল কানে ভেসে এল। সংঘাতমুখরিত অসির ঝনৎকার!

একমুহূর্ত নিশ্চল থেকে তাড়াতাড়ি শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল কর্ণদেব। গুহার মুখে দাঁড়াতেই মুহূর্তের জন্য দ্বৈরথ-রণে ব্যাপৃত দুই যোদ্ধার দেহ তার দৃষ্টিগোচর হল, পরমুহূর্তেই তার পায়ের তুলায় দুলে উঠল পৃথিবী এবং ভারসাম্য হারিয়ে সে লম্বমান হল ভূমির উপর সঙ্গে সঙ্গে তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে প্রায় বধির করে জাগল এক ভয়ংকর শব্দ, তারপরই মাথায় প্রচণ্ড আঘাত।

মুহূর্তের জন্য কর্ণদেব অনুভব করল তার দেহকে বেষ্টন করছে দুটি বলিষ্ঠ বাহু, পরক্ষণেই তার চেতনাকে লুপ্ত করে নামল মূৰ্ছার অন্ধকার…