১৯৯তম অধ্যায়
জাপক দ্বিজবৃত্তান্ত—কাল যম মৃত্যু নৃপসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি যে ইতিপূৰ্ব্বে কাল, যম, মৃত্যু ও ব্রাহ্মণের ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিবেন বলিয়াছেন, তাহা বিস্তারিতরূপে কীৰ্ত্তন করুন।’
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ইক্ষ্বাকু, যম, ব্রাহ্মণ, কাল ও মৃত্যু ইঁহাদিগের কথোপকথন উপলক্ষে যে পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে হিমালয়ের পার্শ্বদেশে এক পরমধাৰ্ম্মিক, মহাযশস্বী, ষড়দর্শনবেত্তা, অশ্বত্থদণ্ডধারী জাপক ব্রাহ্মণ ছিলেন। বেদে উহার দৃঢ়তর ভক্তি জন্মিয়াছিল। উনি নিয়ত গায়ত্র্যাদি জপ করিয়া ব্রহ্মের আরাধনারূপ কঠোর তপানুষ্ঠান করিতেন। এইরূপ নিয়মে তাঁহার সহস্র বৎসর অতীত হইলে একদা ভাবতী সাবিত্রীদেবী তাঁহার সমক্ষে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘বৎস! আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছি।’ ব্রাহ্মণ বেদমাতাকে দর্শন ও তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়াও তৎকালে তাঁহাকে কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন না, তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূৰ্ব্বক জপই করিতে লাগিলেন। সাবিত্রীদেবী ব্রাহ্মণের জপে একাগ্রতা দেখিয়া যারপরনাই প্রীত হইয়া তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ব্রাহ্মণের জপ সমাধা হইলে তিনি অবনতমস্তকে দেবীর পাদপদ্মে নিপতিত হইয়া কহিলেন, “ভগবতি! আজ আমার ভাগ্যক্রমে আপনি আমাকে দর্শন প্রদান করিয়াছেন। যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে এই বর প্রদান করুন, যেন আমার মন জপানুষ্ঠানে নিরত থাকে।’
জাপকের সাবিত্রীবরলাভ-ধৰ্ম্মকর্ত্তৃক পরীক্ষা
“সাবিত্রী কহিলেন, ‘দ্বিজবর! এক্ষণে তোমার কি ইষ্টসাধন করিতে হইবে, বল। তুমি যাহা প্রার্থনা করিবে, আমি তাহাই পরিপূর্ণ করিব।’ সাবিত্রী এই কথা কহিলে, ধৰ্ম্মবেত্তা ব্রাহ্মণ পুনরায় কহিলেন, ‘দেবি! আমার জপানুষ্ঠানবাসনা ও সমাধি যেন অহরহঃ পরিবর্দ্ধিত হয়।’ তখন সাবিত্রী সুমধুরবচনে ‘তথাস্তু’ বলিয়া দ্বিজবরের হিতার্থ পুনরায় কহিলেন, ‘ব্রহ্ম! তোমাকে অন্যান্য ব্রাহ্মণের সালোক্য লাভ করিতে হইবে না। তুমি অনায়াসে অত্যুৎকৃষ্ট ব্রহ্মলোকগমনে সমর্থ হইবে। তুমি আমার নিকট যাহা প্রার্থনা করিলে, আমি উহা সম্পাদনে সবিশেষ যত্ন করিব। তুমি একাগ্রচিত্তে জপানুষ্ঠান কর। ধৰ্ম্ম, কাল, মৃত্যু ও যম তোমার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তোমার সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হইবেন, তুমি তাঁহাদের কথায় ভীত হইও না।’
“ভগবতী সাবিত্রী এই কথা কহিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। মহাত্মা ব্রাহ্মণও সত্যপ্রতিজ্ঞ ও রাগদ্বেষবিহীন হইয়া জপানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। ক্রমে দৈব শতবৎসর অতিক্রান্ত হইলে একদা ধৰ্ম্ম প্রীতমনে সেই জপপরায়ণ ব্রাহ্মণের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘ব্রহ্মন! আমি ধৰ্ম্ম; তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য এই স্থানে উপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি জপানুষ্ঠানের যে ফল প্রাপ্ত হইয়াছ, আমি তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি জপপ্রভাবে সমুদয় মর্ত্ত্যলোক ও দেবলোক পরাজয় করিয়াছ; অতএব এক্ষণে কলেবর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আপনার অভিলষিত লোকে গমন কর।’ তখন ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহাত্মন! আমার কোন লোক লাভ করিবারই ইচ্ছা নাই; আপনি পরমসুখে স্বস্থানে প্রস্থান করুন। আমি এই বিবিধ সুখদুঃখভোগভাজন কলেবর পরিত্যাগ করিতে অভিলাষী নহি।’
“ধৰ্ম্ম কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! তোমার কলেবর পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্ত্তব্য; অতএব তুমি তনুত্যাগপূৰ্ব্বক স্বর্গ বা অন্য কোন অভিলষিত লোকে গমন কর।’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহাত্মন্! আমার শরীর পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গবাস করিবার বাসনা নাই। আপনি স্বস্থানে প্রস্থান করুন।’
“ধৰ্ম্ম কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! এক্ষণে তোমার শরীরধারণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। তুমি দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক রজোগুণবিহীন স্বর্গলোকে গমন করিয়া সুখী হও। তথায় গমন করিলে আর তোমাকে শোকার্ত্ত হইতে হইবে না।’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহাভাগ! আমি জপানুষ্ঠানে পরম পরিতুষ্ট আছি, আমার সনাতনলোকলাভে প্রয়োজন কি? আমি সশরীরে স্বর্গগমন করিতেও উৎসুক নহি।
“ধৰ্ম্ম কহিলেন, ‘মহাত্মন্! তোমার কিছুতেই দেহপরিত্যাগে বাসনা হইতেছে না; কিন্তু ঐ দেখ, যম, কাল ও মৃত্যু তোমার নিকট আগমন করিতেছেন।’
যম, কাল ও মৃত্যুকর্ত্তৃক জাপকদ্বিজের পরীক্ষা
“মহাত্মা ধৰ্ম্ম এই কথা কহিবামাত্র যম, কাল ও মৃত্যু ইঁহারা তিনজন সেই ব্রাহ্মণের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন যম সেই দ্বিজবরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! আমি তোমাকে কহিতেছি যে, তুমি তপস্যা ও সচ্চরিত্রের মহৎ ফল লাভ করিবে।’ কাল কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! আমি কাল। আমি কহিতেছি যে, তুমি আপনার জপানুষ্ঠানের নিমিত্ত অত্যুকৃষ্ট ফল লাভ করিবে। অচিরাৎ স্বর্গে গমন কর। এই তোমার স্বর্গারোহণের প্রকৃত সময়।’ মৃত্যু কহিলেন, দ্বিজবর! আমি মৃত্যু। আজ আমি কালকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া স্বয়ং স্বীয় মূৰ্ত্তি পরিগ্রহপূর্ব্বক ইহলোক হইতে তোমায় লইয়া যাইবার জন্য আগমন করিয়াছি। যম, কাল ও মৃত্যু এই কথা কহিলে পর ব্রাহ্মণ তাঁহাদের সকলকে পৃথক পৃথক্ স্বাগতপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও সাধ্যানুসারে পাদ্য-অর্ঘ্য প্রদান করিয়া কহিলেন, ‘হে মহাশয়গণ! এক্ষণে আমাকে আপনাদিগের কি কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিতে হইবে, তাহা আদেশ করুন।’
“এইরূপে সেই ধর্ম্ম প্রভৃতি দেবগণ ব্রাহ্মণের নিকট
আগমনপূর্ব্বক তথায় একত্র হইয়া অবস্থান করিতেছেন, এমন সময় মহারাজ ইক্ষ্বাকু তীর্থপৰ্য্যটনপ্রসঙ্গে তথায় সমুপস্থিত হইলেন -এবং তাঁহাদিগকে অবলোকনপূৰ্ব্বক যারপরনাই প্রীত হইয়া তাঁহাদিগের সকলকেই প্রণাম ও পূজা করিয়া অনাময় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন সেই ব্রাহ্মণ রাজর্ষি ইক্ষ্বাকুকে পাদ্য অর্ঘ্য ও আসন প্রদানপূর্ব্বক কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! আপনি ত’ নির্ব্বিঘ্নে আগমন করিয়াছেন? বলুন, আমি স্বীয় সামর্থ্যানুসারে আপনার কোন্ অভিলষিত কাৰ্য্য করিব?’
দ্বিজের স্বধৰ্ম্মনিষ্ঠাবিষয়ে ইক্ষ্বাকুর পরীক্ষা
“ইক্ষ্বাকু কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! আমি মহীপাল; আপনি ষট্কর্ম্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ। অতএব আপনি আজ্ঞা করুন, আমি আপনাকে কি পরিমাণে অর্থ প্রদান করিব?’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, মহারাজ! ব্রাহ্মণ দুই প্রকার কৰ্ম্মনিরত ও কর্ম্মবিরত। ধৰ্ম্মও দ্বিবিধ-প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি। আমি এক্ষণে প্রতিগ্রহধৰ্ম্ম হইতে নিবৃত্ত হইয়াছি। যে ব্রাহ্মণেরা প্রতিগ্ৰহ করিয়া থাকেন, আপনি তাঁহাদিগকেই গিয়া অর্থদান করুন। আমি কখনই প্রতিগ্ৰহ করিব না। এক্ষণে আপনার যেরূপ অভিলাষ হয়, প্রার্থনা করুন, আমি তপঃপ্রভাবে তাহা প্রদান করিব। ভূপাল কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! আমি ক্ষত্রিয়, প্রার্থনা করা আমার অভ্যস্ত নহে। আমি প্রার্থনার মধ্যে কেবল “আমার সহিত যুদ্ধ কর” এইরূপ প্রার্থনা করিয়া থাকি।’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! আপনি স্বধৰ্ম্ম রক্ষা করিয়া সন্তোষলাভ করিতেছেন। আমি স্বধর্ম্ম প্রতিপালনপূৰ্ব্বক অপূৰ্ব্ব আনন্দ লাভ করিতেছি। এক্ষণে আমাদিগের আর কিছুমাত্র প্রার্থনীয় নাই; তথাচ আপনার যাহা অভিলষিত হয়, আমার নিকট প্রার্থনা করুন।
“তখন ভূপতি কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! আপনি পূৰ্বেই কহিয়াছেন যে, আমি স্বশক্তি অনুসারে দান করিব। এক্ষণে আমি আপনার সেই বাক্যানুসারে এই প্রার্থনা করিতেছি যে, আপনি আমাকে আপনার জপক্রিয়ার ফল প্রদান করুন।’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! ‘যুদ্ধ ব্যতিরেকে আমার আর কিছুই প্রার্থনীয় নাই” এই বলিয়া আপনি শ্লাঘা প্রকাশ করিতেছিলেন, কিন্তু এক্ষণে আমার সহিত যুদ্ধ করিতে কি নিমিত্ত প্রার্থনা করিলেন না?’
“রাজা কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয়েরাই বাহুবলসহকারে সংগ্রাম করেন। ব্রাহ্মণেরা তাহা করেন না; উহারা কেবল বাক্যবাণ নিক্ষেপপূৰ্ব্বক যুদ্ধ করিয়া থাকেন। সেই নিমিত্তই আমি এক্ষণে আপনার সহিত ঘোরতর বা-যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছি।’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! সে যাহা হউক, আমি যেরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, কদাচ তাহার অন্যথাচরণ করিব না। এক্ষণে আমি স্বশক্তি অনুসারে অবিলম্বে আপনাকে কি প্রদান করিব, অনুজ্ঞা করুন।’
“ভূপাল কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! আপনি যদি নিতান্তই আমার মনোরথ পরিপূর্ণ করিবার অভিলাষ করিয়া থাকেন, তবে আপনি একাদিক্রমে দৈব শতবর্ষ জপানুষ্ঠান করিয়া যে ফল সঞ্চয় করিয়াছেন, আমাকে তাহাই প্রদান করুন।’
ইক্ষ্বাকু-প্রার্থনায় জপফলপ্রদানে দ্বিজের অঙ্গীকার
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, মহারাজ! আমি জপানুষ্ঠান করিয়া যে ফল সঞ্চয় করিয়াছি, আপনি অবিচারিতমনে তাহার অর্ধেক ফল লাভ করুন অথবা আপনার যদি অভিলাষ হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনি উহা সম্পূর্ণ গ্রহণ করুন।’
“ভূপাল কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! আপনার জপের সম্পূর্ণ ফল গ্রহণ করিতে আমার অভিলাষ নাই। এক্ষণে আমি যে ফল প্রার্থনা করিয়াছি, সেই ফল কি, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! আমি আমার জপের ফলপ্রাপ্তির বিষয় কিছুই জানি না। এই ধৰ্ম্ম, কাল ও যম তাহা বিলক্ষণ অবগত আছেন।
“ভূপাল কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! যদি আপনি জপের ফল নির্দেশ করিতে না পারেন, তাহা হইলে ঐ অজ্ঞাত-ফলে আমার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। এক্ষণে উহা আপনারই অধিকৃত থাকুক। আমি চলিলাম, আপনার মঙ্গল হউক।’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘রাজন্! আমার আর দ্বিরুক্তি করিতে বাসনা নাই। আপনি জপের ফল প্রার্থনা করাতে আমি আপনাকে উহা প্ৰদান করিয়াছি। এক্ষণে আমার ও আপনার বাক্য সপ্রমাণ হউক। আমি পূর্ব্বাবধি এ পর্য্যন্ত কখনই কোন অভিসন্ধিপূৰ্ব্বক জপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হই নাই; তবে কিরূপে উহার ফলপ্রাপ্তি-বিষয় অবগত হইতে সমর্থ হইব? আপনি আমার নিকট জপানুষ্ঠানের ফল প্রার্থনা করিয়াছেন, আমিও আপনাকে ফল প্রদান করিলাম। বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছি; এক্ষণে কিরূপে তাহার অন্যথা হইতে পারে? অতএব আপনি স্থিরচিত্তে সত্যপ্রতিপালন করুন। যদি আপনি এক্ষণে আমার বচন রক্ষা না করেন, তাহা হইলে আপনাকে অসত্যনিবন্ধন নিশ্চয়ই ঘোরতর অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হইবে। আপনার ও আমার মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করা কখনই বিশুদ্ধ যুক্তির অনুমোদিত নহে। অতএব যদি আপনি সত্যপ্রতিজ্ঞ হয়েন, তাহা হইলে ইতিপূৰ্ব্বে আপনি আমার নিকট আগমন করিয়া প্রার্থনা করিতে আমি আপনাকে যাহা প্রাদন করিয়াছি, আপনি অবিচারিতচিত্তে তাহা গ্রহণ করুন। মিথ্যাবাদী হইলে তাহার ইহলোক বা পরলোক কিছুই শ্রেয়স্কর হয় না এবং তাহার পূর্ব্বপুরুষদিগকে উদ্ধার করিবার ক্ষমতাও থাকে না। সত্যবলে ইহলোক ও পরলোক হইতে যেমন পরিত্রাণলাভ হয়, যজ্ঞ, দান ও নিয়মদ্বারা সেরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই। সহস্র সহস্র বৎসরের তপস্যাও সত্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট নহে। সত্য অক্ষয় ব্রহ্ম, অক্ষয় তপস্যা, অক্ষয় যজ্ঞ ও অক্ষয় বেদস্বরূপ। বেদশাস্ত্রে সত্য জাগরূক হইয়া অবস্থান করিতেছে। সত্যপ্রভাবে অতি উৎকৃষ্ট ফললাভ হইয়া থাকে। তপস্যা, ধৰ্ম্ম, দমগুণ, যজ্ঞ, তন্ত্র, মন্ত্র, সরস্বতী, স্বর্গ, বেদ, বেদাঙ্গ, বিদ্যা, বিধি, ব্রতচৰ্য্যা, ওঙ্কার এবং জীবগণের জন্ম ও সন্তানসন্ততিসমুদয়ই সত্যে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। সত্যপ্রভাবে বায়ু গমনাগমন, সূৰ্য্য তাপপ্রদান এবং অগ্নি দাহকাৰ্য্য সাধন করিয়া থাকেন। সত্য এবং ধর্ম্মকে তুলাদণ্ডে আরোপিত করিলে সত্যেরই গৌরব লক্ষিত হয়। ধৰ্ম্ম সত্যের অনুগামী; সত্যবলে সমুদয় কার্য্যের উন্নতিসাধন হইয়া থাকে। তবে আপনি কি নিমিত্ত অনৃতকার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে বাসনা করিতেছেন? এক্ষণে সত্যপ্রতিপালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হউন। জপের ফল প্রার্থনা করিয়া কি নিমিত্ত তাহা গ্রহণে পরাঙ্মুখ হইতেছেন? যদি আপনি মদ্দত্ত জপফল গ্রহণ না করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আপনাকে ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়া ইহলোকে বিচরণ করিতে হইবে। যে ব্যক্তি অঙ্গীকার করিয়া তাহা প্রতিপালন এবং যিনি প্রার্থনা করিয়া তাহা গ্রহণ না করেন, তাঁহারা উভয়েই মিথ্যাবাদী হয়েন। এক্ষণে আপনার মিথ্যাবাদী হওয়া উচিত হইতেছে না।
জপফল-প্রত্যাখ্যানে নৃপ-দ্বিজের উক্তি-প্রত্যুক্তি
“রাজা কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয়েরা যোদ্ধা, রক্ষিতা ও দাতা বলিয়া প্রসিদ্ধ আছেন; ফলতঃ যুদ্ধ, লোকরক্ষা ও দানই ক্ষত্রিয়দিগের প্রধান ধর্ম্ম; অতএব আমি কিরূপে আপনার নিকট প্রতিগ্ৰহ করিব?’
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! আমি “গ্রহণ করুন” বলিয়া পূৰ্ব্বে আপনাকে অনুরোধ করি নাই, আপনার আবাসেও উপস্থিত হই নাই! আপনি স্বয়ং এই স্থানে আগমন ও আমার নিকট প্রার্থনা করিয়া এক্ষণে কি নিমিত্ত গ্রহণে অস্বীকার করিতেছেন?’
“এইরূপে ব্রাহ্মণ ও ইক্ষ্বাকুরাজ পরস্পর ঘোরতর বাগবিতণ্ডা উপস্থিত করিলে মহাত্মা ধৰ্ম্ম তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘তোমরা আর বিবাদ করিও না। আমি স্বয়ং ধৰ্ম্ম এখানে উপস্থিত রহিয়াছি। এক্ষণে ব্রাহ্মণ দানের এবং রাজা সত্যের অখণ্ড ফলভাগী হউন।’
“ঐ সময় স্বর্গ মূৰ্ত্তিমান্ হইয়া তথায় আগমনপূর্ব্বক ব্রাহ্মণ ও ভূপতিকে কহিলেন, ‘ধাৰ্মিকদ্বয়! এই আমি স্বয়ং স্বৰ্গদেহ পরিগ্রহপূর্ব্বক আসিয়াছি। অতঃপর আর তোমাদিগের বিবাদের আবশ্যকতা নাই; তোমরা উভয়েই তুল্যফলভাগী হও।’ তখন ভূপাল কহিলেন, স্বর্গ! আমি তোমাকে প্রার্থনা করি না। এক্ষণে তুমি স্বস্থানে প্রস্থান কর। যদি এই ব্রাহ্মণ তোমাকে প্রার্থনা করেন, তাহা হইলে ইনি মদাচরিত [আমার অনুষ্ঠিত] পুণ্যের ফল গ্রহণপূৰ্ব্বক তোমাকে লাভ করুন।
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! আমি শৈশবাবস্থায় অজ্ঞানবশতঃ প্রতিগ্ৰহ করিয়াছিলাম; কিন্তু এক্ষণে আমি গায়ত্ৰাদিজপপরায়ণ হইয়া নিষ্কামধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতেছি, অতএব আপনি কি নিমিত্ত আমাকে স্বর্গলাভের প্রলোভন প্রদর্শন করিতেছেন? আমি স্বয়ং আপনার কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়া ফল লাভ করিব। আমি তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন ও অপ্রতিগ্রাহী। আপনার আচরিত পুণ্যের ফল লাভ করিতে আমার কিছুতেই ইচ্ছা হইতেছে না।
“রাজা কহিলেন, “ব্রাহ্মণ! যদি আপনি নিতান্তই আমাকে আপনার জপানুষ্ঠানের ফল প্রদান করিবেন, তবে উহার অর্দ্ধফল প্রদান করিয়া আমার আচরিত ধর্ম্মের অর্দ্ধফল গ্রহণ করুন; তাহা হইলে আমরা উভয়েই তুল্যফলভাগী হইব। ব্রাহ্মণেরা প্রতিগ্রহপরায়ণ ও রাজবংশীয়েরা দাতা হইয়া থাকেন। এই ধৰ্ম্ম যদি আপনার পরিজ্ঞাত থাকে, তবে আমার ধর্ম্মের অর্দ্ধফল গ্রহণপূর্ব্বক আমার তুল্যফলভাগী হওয়াই আপনার উচিত। আর যদি আপনি আমার তুল্যফলভাগী হইতে বাসনা না করেন, তবে আমার ধৰ্ম্মের সমুদয় ফলই গ্রহণ করুন। ফলতঃ যদি আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা আপনার অভিপ্রেত হয়, তবে মদনুষ্ঠিতধৰ্ম্মের ফল গ্রহণ করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য।
বিবদমান বিপ্র-ভূপমধ্যে মূর্ত্তিদ্বয় আবির্ভাব
“তাহারা উভয়ে এইরূপ বাদানুবাদ করিতেছেন, এমন সময় দুইজন বিকৃতবেশ পুরুষ পরস্পর পরস্পরের স্কন্ধাবলম্বনপূর্ব্বক তথায় সমুপস্থিত হইল। ঐ উভয় পুরুষের মধ্যে একের নাম বিরূপ ও অন্যের নাম বিকৃত। বিকৃত বিরূপকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘ভাই! তুমি নিশ্চয়ই আমার নিকট ঋণী নহ।’ বিরূপ কহিল, ‘হাঁ, আমি তোমার নিকট ঋণী আছি।’ তখন বিকৃত কহিল, ‘তবে তোমার সহিত আমার কলহ উপস্থিত হইল। এক্ষণে এ স্থলে এই প্রজাদিগের শাসনকর্ত্তা রাজা সমুপস্থিত আছেন, আমি ইহার সমক্ষে সত্যই কহিতেছি, তুমি আমার নিকট ঋণী নহ।’ বিরূপ কহিল, তু‘মি মিথ্যা কহিতেছ, আমি তোমার নিকট ঋণী রহিয়াছি।’ এইরূপে তাহারা উভয়ে বাগবিতণ্ডা করিয়া একান্ত ক্রোধাবিষ্টচিত্তে ভূপতিকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, ‘মহারাজ! এক্ষণে যাহাতে আমরা উভয়েই পাপদূষিত হইয়া না থাকি, আপনি এইরূপ উপায়-বিধান করিয়া দিন।’
“তখন বিরূপ কহিল, ‘মহারাজ! আমি বিকৃতের নিকট গোদানফল গ্রহণ করিয়া ঋণী হইয়াছি, এক্ষণে ঋণ পরিশোধ করিতে বাসনা করিতেছি; কিন্তু উনি তাহা লইতে চাহেন না।’ বিকৃত কহিল, “মহারাজ! এই বিরূপ আমার নিকট ঋণী নহেন। এক্ষণে উনি আপনার নিকট সত্যের ভাণ করিয়া স্পষ্টই মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিতেছেন।’ ‘তখন নরপতি বিরূপকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘বিরূপ! তুমি কিরূপে ইহার নিকট ঋণী হইয়াছ, অকপটে বল; আমি তাহা শ্রবণ করিয়া যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহার অনুষ্ঠান করিব।’
রাজার জিজ্ঞাসায় বিরূপ-বিকৃতের অভিযোগ
‘বিরূপ কহিল, ‘মহারাজ! আমি বিকৃতের নিকট যেরূপে ঋণী রহিয়াছি, তাহা আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, আপনি অবহিতমনে শ্রবণ করুন। পূৰ্ব্বে এই বিকৃত ধর্ম্মোপার্জ্জনের নিমিত্ত কোন তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রাহ্মণকে এক সুলক্ষণা ধেনু প্রদান করিয়াছিলেন; আমি ইহার নিকট সেই ধেনুদানের ফল প্রার্থনা করাতে ইনি বিশুদ্ধচিত্তে আমাকে তাহা প্রদান করেন। পরে আমি আত্মবিশুদ্ধির নিমিত্ত পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক দুইটি বহুদুগ্ধবতী সবৎসা কপিলা ক্রয় করিয়া শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট বিধি অনুসারে শ্রদ্ধাপূৰ্ব্বক এক উঞ্ছবৃত্তিপরায়ণ ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছি। আমি পূৰ্ব্বে বিকৃতের নিকট যাহা প্রতিগ্ৰহ করিয়াছিলাম, এক্ষণে সেই প্রতিগ্রহের দ্বিগুণ ফলপ্রদানে আমার অভিলাষ হইয়াছে। অতঃপর আমাদিগের মধ্যে কে দোষী আর কেই বা নির্দোষ হইবে, আমরা এই কথা লইয়া বিবাদ করিতে করিতে আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। আপনি আমাদিগের মধ্যে শান্তিস্থাপন করিয়া দিন। বিকৃত পূৰ্ব্বে যেরূপ দান করিয়াছেন, এক্ষণে তদনুরূপ প্রতিদান প্রতিগ্রহে অস্বীকার করিতেছেন; অতএব আপনি স্থিরচিত্তে আমাদিগকে ধর্ম্মপথে সংস্থাপিত করুন।’
“ভূপতি কহিলেন, ‘বিকৃত! বিরূপ তোমাকে ঋণ প্রত্যর্পণ করিতেছেন, তুমি কি নিমিত্ত উহা প্রতিগ্ৰহ করিতেছ না? এক্ষণে অবিলম্বে দানের অনুরূপ প্রতিদান প্রতিগ্রহ করা তোমার অবশ্য কৰ্ত্তব্য।
“বিকৃত কহিল, ‘মহারাজ! এই বিরূপ আমার নিকট ঋণী রহিয়াছেন বলিয়া আমার ঋণ পরিশোধ করিতে বাসনা করিতেছেন; কিন্তু বস্তুতঃ উনি আমার নিকট ঋণী নহেন, অতএব এক্ষণে যথা ইচ্ছা গমন করুন।’
“রাজা কহিলেন, ‘বিকৃত! বিরূপ তোমায় ঋণ পরিশোধ করিবার অভিলাষ করিতেছেন, কিন্তু তুমি উহার বাক্য স্বীকার করিতেছ না। এই বিষয়টি আমার নিতান্ত বিসদৃশ বোধ হইতেছে। এক্ষণে আমার মতে তোমাকে সমুচিত দণ্ড প্রদান করাই কর্ত্তব্য, সন্দেহ নাই।’
“বিকৃত কহিল, ‘মহারাজ! আমি একবার যাহা প্রদান করিয়াছি, তাহা পুনরায় কিরূপে প্রতিগ্ৰহ করিব? অতএব এই বিষয়ে আমার যেরূপ অপরাধ হয়, তদনুসারে দণ্ডবিধান করুন।’
বিরূপ কহিল, ‘বিকৃত! আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করিতেছি, কিন্তু তুমি ঋণগ্রহণে অভিলাষ করিতেছ না। এক্ষণে এই ধৰ্ম্মরক্ষক রাজা অবশ্য তোমার দণ্ডবিধান করিবেন।’ বিকৃত কহিল, ‘বিরূপ! তুমি প্রার্থনা করাতে আমি তোমাকে গোদানফল প্রদান করিয়াছি, এক্ষণে তাহা পুনরায় কিরূপে গ্রহণ করিব? অতএব আমি তোমাকে অনুমতি করিতেছি, তুমি যথায় ইচ্ছা গমন কর।’
বিচারব্যাপারে রাজার চৈতন্য—দ্বিজের দানগ্রহণ
“ঐ সময় সেই ব্রাহ্মণ ভূপতিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! বিরূপ ও বিকৃতের বাদানুবাদ শ্রবণ করিলেন। এক্ষণে আমি আপনাকে যাহা প্রদান করিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আপনি অবিচারিতচিত্তে তাহা গ্রহণ করুন।’ তখন ভূপতি মনে মনে চিন্তা করিলেন, এই দুই ব্যক্তির ন্যায় এই ব্রাহ্মণের কথাও নিতান্ত দুরবগাহ। ইনি যেরূপ আগ্রহাতিশয় প্রদর্শন করিতেছেন, তাহাতে যদি আমি ইহার পুণ্যফল গ্রহণ না করি, অবশ্যই আমাকে ঘোরতর পাপে লিপ্ত হইতে হইবে। ধর্ম্মপরায়ণ ভূপাল মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া বিকৃত ও বিরূপকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘তোমরা রাজনীতি অনুসারে কৃতকার্য্য হইয়া গমন কর। আমি রাজা বলিয়া তোমরা আমার নিকট উপস্থিত হইয়াছ, সুতরাং এক্ষণে রাজধৰ্ম্ম নিতান্ত নিষ্ফল করা আমার বিধেয় নহে। শাস্ত্রে নির্ণীত আছে যে, রাজধৰ্ম্ম প্রতিপালন করা রাজার অবশ্য কৰ্ত্তব্য; কিন্তু ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম নিতান্ত দুরবগাহ; আমি তাহার কিছুমাত্র অবগত নহি; এক্ষণে সেই ধৰ্ম্ম আমাকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতেছে।’
“তখন জাপক ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! এক্ষণে আপনি প্রার্থনা করাতে আমি আপনাকে যাহা দান করিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আপনি রাজধৰ্ম্মানুসারে অচিরাৎ তাহা গ্রহণ করুন। নচেৎ আমি আপনাকে নিশ্চয়ই অভিশাপ প্রদান করিব।
“ভূপতি কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ! যে ধৰ্ম্মানুসারে এইরূপ কাৰ্য্য নিশ্চয় করিতে হয়, সেই রাজধৰ্ম্মকে ধিক! যাহা হউক, এক্ষণে। আমি আপনার তুল্যফলভাগী হইব বলিয়াই আপনার জপের ফল গ্রহণ করিব। আমি পূৰ্ব্বে আর কখন প্রতিগ্রহের নিমিত্ত হস্ত প্রসারণ করি নাই, এক্ষণে কেবল আপনার অনুরোধেই ঐ কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইলাম। আপনি আমার নিকট যে বিষয়ে ঋণী হইয়াছেন, অবিলম্বে তাহা প্রদান করুন।
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, মহারাজ! আমি সংহিতা [বেদের সংক্ষিপ্তসার-সংগ্রহ—প্রণব] জপ করিয়া যে কিছু ধৰ্ম্ম সঞ্চিত করিয়াছি, আপনি তৎসমুদয় গ্রহণ করুন।’
“তখন রাজা কহিলেন, ‘ভগবন্! আমিও হস্তে জলগণ্ডুষ গ্রহণ করিয়াছি। আপনি আমার প্রতিদান প্রতিগ্রহ করুন; তাহা হইলে আমরা উভয়েই তুল্যফলভাগী হইব।’
পুরুষরূপী কাম-ক্রোধের আত্মজ্ঞান দান
“তাহারা উভয়ে এইরূপ আদান-প্রদান করিতেছেন, ইত্যবসরে বিরূপ কহিল, ‘মহারাজ! আমরা উভয়ে কাম ও ক্রোধ। আমরাই তোমাকে ব্রাহ্মণের জপফলগ্রহণে প্রবর্ত্তিত করিয়াছি। এক্ষণে তোমার বাক্যানুসারে তোমরা উভয়েই তুল্যলোক লাভ কর। বিকৃত বস্তুতঃ আমার নিকট ঋণী নহে; তোমার বোধসাধনের নিমিত্তই আমরা উভয়ে প্রত্যর্থিভাবে এ স্থানে উপস্থিত হইয়াছিলাম। আমরা উভয়ে এবং কাল, ধৰ্ম্ম ও মৃত্যু আমরা সকলেই তোমাকে বিলক্ষণরূপে পরীক্ষা করিলাম। এক্ষণে তুমি স্বধৰ্ম্মনির্জ্জিত [স্বধৰ্ম্মলব্ধ] লোকে স্বেচ্ছানুসারে গমন কর।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! এই আমি তোমার নিকট জাপকদিগের ফললাভবিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। তাঁহারা যে মুক্তি, ব্রহ্মলোক ও উৎকৃষ্ট স্থানসমুদয় লাভ করিতে সমর্থ হয়েন, তাহা তোমার বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম হইল। সংহিতাধ্যায়ী মহাত্মারা পরমেষ্ঠী ব্রহ্মাকে প্রাপ্ত হইতে অথবা অগ্নি বা সূৰ্য্যলোক লাভ করিতে পারেন। যদি তিনি ঐ সমস্ত লোকে অনুরাগী হইয়া বিহার করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে বিমোহিত হইয়া ঐ সমুদয় লোকেরই গুণসকল প্রাপ্ত হইতে হয়। অনুরাগ লোকের পার্থিব শরীরের ন্যায় চন্দ্র, বায়ু ও আকাশাত্মক শরীরেও অবস্থান করিয়া গুণসমুদয় প্রকাশ করে। যদি জাপক ব্যক্তি ঐ সকল লোকে রাগবিহীন হইয়া মোক্ষলাভের নিমিত্ত নিতান্ত যত্ন করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাঁহার অভিলাষ পূর্ণ হয়। ফলতঃ রাগবিহীন জাপক চেষ্টা করিলে, অনায়াসে ক্রমে পরমেষ্ঠিভাব হইতে কৈবল্য লাভ করিয়া পরিশেষে জরাদুঃখবিহীন অক্ষয় ব্রহ্মলোক অধিকারপূৰ্ব্বক সেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা-শোকমোহাদিবর্জ্জিত চিন্ময় পুরুষে লীন হইতে পারেন। যে জাপক অনুরাগের বশীভূত হইয়া চিন্ময় পুরুষে লীন হইতে অভিলাষ না করেন, তিনি অন্যান্য যে যে লোকে গমন করিবার বাসনা করেন, তাহার তাহাই লাভ হয়। আর যিনি সমুদয় লোকই নরক বলিয়া জ্ঞান করেন এবং যাঁহার কোন বিষয়েই স্পৃহা না থাকে, তিনি সৰ্ব্বতোভাবে মুক্ত ও নিগুণ পুরুষে লীন হইয়া অলৌকিক সুখসম্ভোগ করেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! এই আমি তোমার নিকট জাপকদিগের গতির বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। অতঃপর যাহা তোমার শ্রবণ করিতে বাঞ্ছা হয়, ব্যক্ত কর।”