১৯৮তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের করুণায় ভীমের কটুক্তি
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। অর্জ্জুন এইরূপ কহিলে মহারথগণ তাহা শ্রবণ করিয়া ভালমন্দ কিছুই কহিলেন না। তখন মহাবাহু ভীম ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অর্জ্জুনকে বিস্মিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, হে পার্থ! অরণ্যগত মুনি ও জিতেন্দ্রিয় শংশিতব্রত ব্রাহ্মণ যেমন ধর্মোপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন, তদ্রূপ তুমিও ধর্মোপদেশ প্রদান করিতেছ। দেখ, যে ক্ষত্রিয় অন্যকে ক্ষত হইতে পরিত্রাণ করেন, ক্ষতত্রাণই যাঁহার জীবনোপায় এবং যিনি দেব, দ্বিজ ও গুরুর প্রতি ক্ষমাশীল, তিনিই অবিলম্বে রাজ্য, ধর্ম্ম, যশ ও শ্রীলাভ করিয়া থাকেন। তুমি সমগ্র ক্ষত্রিয়গুণে সমলঙ্কৃত আছ; অতএব এখন মূর্খের ন্যায় বাক্যপ্রয়োগ করা তোমার সমুচিত হইতেছে না। হে কৌন্তেয়! তুমি ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্রের ন্যায় পরাক্রমশালী। মহাসাগর যেমন বেলাভুমি অতিক্রম করে না, তদ্রূপ তুমিও ধর্ম্মপথ অতিক্রমে প্রবৃত্ত হও না। তুমি যে এক্ষণে ত্রয়োদশবর্ষসঞ্চিত ক্রোধে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়া ধৰ্মলাভের অভিলাষ করিতেছ, এই গুণে কে না তোমাকে প্রশংসা করিবে? এক্ষণে ভাগ্যক্রমে তোমার মন সততই ধর্ম্মপথে ধাবমান হইতেছে এবং তোমার বুদ্ধিও নিরন্তর অনৃশংসতার অনুসরণ করিতেছে; কিন্তু তুমি এইরূপ ধর্ম্মপরায়ণ হইলেও বিপক্ষেরা অধর্ম্মাচরণপূর্ব্বক তোমার রাজ্যাপহরণ ও প্রিয়তমা দৌপদীকে সভায় আনয়নপূর্ব্বক পরাভব করিয়াছিল। আমরা বনবাসের নিতান্ত অনুপযুক্ত হইয়াও তাহাদের নিকৃতিপ্রভাবে বল্কল ও অজিন ধারণপূর্ব্বক ত্রয়োদশ বৎসর অরণ্যে বাস করিয়াছি। হে ধনঞ্জয়! এই সকল স্থলে ক্রোধপ্ৰকাশ করিতে হয়; কিন্তু তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম্মাবলম্বী হইয়া তৎসমুদয় সহ্য করিয়াছ। অদ্য আমি তোমার সহিত সমবেত হইয়া বিপক্ষগণকে সেই অধর্মের প্রতিফলপ্রদানে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এক্ষণে সেই রাজ্যাপহারী ক্ষুদ্রাশয় বিপক্ষগণকে বন্ধুবান্ধবের সহিত সংহার করিব।
‘পূর্ব্বে তুমি কহিয়াছিলে, আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া সাধ্যানুসারে জয়লাভের চেষ্টা করিব; কিন্তু এক্ষণে ধর্ম্মানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া আমাদিগকে নিন্দা করিতেছ; সুতরাং তুমি পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছিলে, উহা এক্ষণে আমার মিথ্যা বলিয়া বোধ হইতেছে। এক্ষণে আমরা বিপক্ষদিগের গর্জ্জনে অতিশয় ভীত হইয়াছি এবং তুমিও ক্ষতে ক্ষারপ্রদানের ন্যায় বাকশল্যদ্বারা আমাদিগের মর্ম্ম বিদ্ধ করিতেছ। আমার হৃদয় তোমার বাকশল্যে পীড়িত হইয়া বিদীর্ণ হইতেছে, তুমি ধার্মিক হইয়াও ধর্ম্মতত্ত্ব সম্যক্ অবগত হইতেছ না। হে অর্জ্জুন! তুমি স্বয়ং প্রশংসার ভাজন এবং আমরা সকলেও প্রশংসনীয়; কিন্তু তুমি আপনাকে ও আমাদিগকে প্রশংসা করিয়া, যে তোমার ঘোড়শ অংশেরও উপযুক্ত নহে, বাসুদেব বিদ্যমান থাকিতে সেই অশ্বত্থামাকে প্রশংসা করিতেছ। তুমি স্বয়ং আত্মদোষ কীৰ্ত্তন করিয়া কি নিমিত্ত লজ্জিত হইতেছ না? আমি ক্রোধভরে এই সুবর্ণমালিনী গুর্ব্বী গদা উদ্যত করিয়া ভূমণ্ডল বিদীর্ণ, পর্ব্বতসকল বিক্ষিপ্ত ও অচলসদৃশ বৃক্ষসকল ভগ্ন এবং শরনিকরে অসুর, রাক্ষস, উরগ, মানব ও ইন্দ্রের সহিত সমাগত দেবগণকেও বিদ্রাবিত করিতে পারি। হে অমিতবিক্ৰম ধনঞ্জয়! তুমি আমাকে এইরূপ অবগত হইয়াও কি নিমিত্ত অশ্বত্থামা হইতে ভীত হইতেছ? অথবা তুমি অবস্থান কর, আমি গদা গ্রহণপূর্ব্বক হরি যেমন ক্রোধাবিষ্ট গর্জ্জনশীল হিরণ্যকশিপুকে জয় করিয়াছিলেন, তদ্রূপ অন্যান্য বীরবর্গের সহিত অশ্বত্থামাকে পরাজিত করিব।
ধৃষ্টদ্যুম্নের নির্দোষিতা খ্যাপন
“অনন্তর পাঞ্চালরাজতনয় ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন, দান ও প্রতিগ্রহ—এই ছয়টি ব্রাহ্মণের কাৰ্য্য, কিন্তু দ্রোণ ইহার কিছুই অনুষ্ঠন করিতেন না। অতএব আমি তাঁহাকে সংহার করিয়াছি বলিয়া তুমি কি নিমিত্ত আমার নিন্দা করিতেছ? তিনি স্বধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্ষত্রিয়ধৰ্ম প্ৰতিগ্ৰহ করিয়াছিলেন এবং নীচকাৰ্য্যপরতন্ত্র হইয়া অমানুষ অস্ত্রদ্বারা আমাদিগকে বিনাশ করিতেছিলেন। সেই মহাবীর ব্রাহ্মণবাদী ও অতিশয় মায়াবী, তিনি মায়াবলেই আমাদিগের সংহারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার প্রতি কোন কার্য্যের অনুষ্ঠানই অনাৰ্য্য বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে পারে না। এক্ষণে যদি অশ্বত্থামা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভয়ঙ্কর সিংহনাদ পরিত্যাগ করেন, তাহাতেই বা ক্ষতি কি? তিনি বৃথা গর্জ্জনদ্বারা কৌরবপক্ষীয়গণকে সমরে প্রবর্ত্তিত করিয়া তাহাদিগের রক্ষণে অসমর্থ হইয়া সংহারের কারণ হইবেন। হে ধনঞ্জয়! তুমি ধার্মিক হইয়া আমাকে তোমার গুরুঘাতী বলিয়া নিন্দা করিতেছ; কিন্তু আমি দ্রোণবিনাশার্থই হুতাশন হইতে প্রাদুর্ভূত হইয়াছি। আর দেখ, সংগ্রামকালে যাঁহার কাৰ্য্য ও অকাৰ্য্য উভয়ই সমান জ্ঞান ছিল, তাঁহাকে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলিয়া কিরূপে নির্দেশ করিব? যিনি ক্রোধে অধীর হইয়া ব্রহ্মাস্ত্রদ্বারা অস্ত্রানভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বিনাশ করেন, তাঁহাকে যেকোন উপায়দ্বারা হউক না কেন, বধ করাই অবশ্য কর্ত্তব্য।
‘হে অর্জ্জুন! ধার্মিকেরা অধার্মিককে বিষতুল্য বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন; অতএব তুমি ধর্ম্মার্থতত্ত্বজ্ঞ হইয়াও কি নিমিত্ত আমার নিন্দা করিতেছ? আমি ক্রূরকর্ম্মপরায়ণ আচাৰ্য্যকে রথোপরি আক্রমণপূর্ব্বক বিনাশ করিয়াছি। তাহাতে আমার কোনরূপেই নিন্দার কাৰ্য্য করা হয় নাই, কিন্তু তুমি আমাকে কি নিমিত্ত অভিনন্দন করিতেছ না? আমি দ্রোণাচার্য্যের সেই কালানল, অর্ক ও বিষসদৃশ ভীষণ মস্তক ছেদন করিয়া সাতিশয় প্রশংসাভাজন হইয়াছি; কিন্তু তুমি কি নিমিত্ত আমার প্রশংসা করিতেছ না? দ্রোণ আমারই বন্ধুবান্ধবগণের বধসাধন করিয়াছেন; অতএব তাঁহার শিরচ্ছেদন করিয়াও আমার ক্ষোভ দূর হয় নাই। আমি যে জয়দ্রথের মস্তকের ন্যায় তাঁহার মস্তক চণ্ডালসমক্ষে নিক্ষেপ করি নাই, এই নিমিত্তই—আমার অতিশয় মর্ম্মপীড়া উপস্থিত হইয়াছে। হে ধনঞ্জয়! আমি শুনিয়াছি, শত্রুবিনাশ না করিলে অধর্ম্মস্পৃষ্ট হইতে হয়। হয় শত্রুকে বিনষ্ট করা, না হয় স্বয়ং তাহার হস্তে বিনষ্ট হওয়াই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম। আচাৰ্য্য আমার শত্রু ছিলেন; অতএব তুমি যেমন পিতৃসখা মহাবীর ভগদত্তকে সংহার করিয়াছিলে, তদ্রূপ আমি ধর্ম্মানুসারে দ্রোণকে সংহার করিয়াছি। তুমি যখন স্বীয় পিতামহকে বিনাশ করিয়া আপনাকে ধাৰ্মিক বলিয়া প্রতিপন্ন করিতেছ, তখন আমি পাপস্বভাব শত্রুকে বিনাশ করিয়াছি বলিয়া কেন আমাকে অধাৰ্মিক বিবেচনা করিবে? হে পার্থ! আমি সম্বন্ধনিবন্ধন স্বগাত্ৰকৃত সোপাননিষণ্ন [২] কুঞ্জরের ন্যায় তোমার নিকট অবনত হইয়া আছি; অতএব আমার প্রতি এইরূপ বাক্য প্রয়োগ করা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে না। যাহা হউক, এক্ষণে আমি কেবল দ্রৌপদী ও দ্রৌপদীর পুত্রগণের নিমিত্ত তোমার এই সমস্ত বাক্যদোষ সহ্য করিয়া তোমার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করিলাম। আচার্য্যের সহিত শত্রুতা যে আমাদিগের কুল পরম্পরাগত, ইহা সকলেই অবগত আছেন; তোমাদের কি ইহা বিদিত নহে? হে অর্জ্জুন! যুধিষ্ঠির মিথ্যাবাদী নহেন এবং আমিও অধার্মিক নহি। আচাৰ্য্য শিষ্যদ্রোহী ও পাপস্বভাব ছিলেন বলিয়া আমি তাহাকে বিনষ্ট করিয়াছি। এক্ষণে তুমি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, তোমার জয়লাভ হইবে।’ ”