১৯৪তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের নিকট যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধবিষয়ক প্রশ্ন
বৈশম্পায়ন কহিলেন মহারাজ! ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির শক্রগণের এইসমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া নির্জ্জনে ভ্রাতৃগণকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! আমি যেসকল চরকে ধার্ত্তরাষ্ট্রসৈন্যগণমধ্যে প্রেরণ করিয়াছিলাম, তাহারা প্ৰাতঃকালে আসিয়া আমাকে কহিল, “মহারাজ! দুৰ্য্যোধন মহাব্ৰত ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কত দিনের মধ্যে পাণ্ডবসৈন্যগণকে বিনাশ করিবেন? ভীষ্ম কহিলেন, “আমি একমাসমধ্যে সমুদয় বিনাশ করিব।” পরে দ্রোণাচাৰ্য্যকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কহিলেন, “আমি একমাসে সমস্ত সংহার করিব।” কৃপাচাৰ্য্য অঙ্গীকার করিয়াছেন, “আমি দুইমাসে পাণ্ডবসৈন্যসংহারে কৃতকাৰ্য্য হইব।” অশ্বত্থামা প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছেন, “আমি দশরাত্রিমধ্যে সমুদয় বিনাশ করিব।” তৎপরে দিব্যাস্ত্ৰবিৎ কর্ণ কুরুসভায় জিজ্ঞাসিত হইয়া কহিয়াছেন, “আমি পাঁচদিবসে পাণ্ডবসৈন্যসংহারে সমর্থ হইব।” হে অর্জ্জুন! এক্ষণে তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কতদিনে কৌরবসৈন্য সংহার করিবে, ইহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইতেছে।”
অর্জ্জুনের আশ্বাসবাণী
তখন অর্জ্জুন বাসুদেবের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহারাজ! এইসমস্ত শিক্ষিতাস্ত্ৰ চিত্ৰযোধী মহাত্মাগণ আমাদের সৈন্যসংহারে সমর্থ হইবেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু আপনি তন্নিমিত্ত চিন্তিত হইবেন না। আমি এক্ষণে সত্যই কহিতেছি, বাসুদেবের সাহায্যে একমাত্র রথে আরোহণ করিয়া আমি নিমেষমধ্যে [পক্ষ-প্রতিপক্ষের বীরেন্দ্ৰগণ যুদ্ধে স্পৰ্দ্ধাপ্রদর্শনের জন্য যেসকল উক্তিপ্রত্যুক্তি করিয়াছেন, তাহাতে দম্ভপ্রকাশের অবকাশ আছে; এবং এই দম্ভপ্রকাশও অসম্ভব নহে। কিন্তু একান্ত ভক্তিভাজন অগ্রজ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের বাক্যের উত্তরে অর্জ্জুনের অযথা স্পদ্ধাপ্রকাশ কোন মতেই সম্ভব নহে। সমরসজ্জা পরিসমাপ্তির পর দুৰ্য্যোধন ভীষ্মাদি প্রত্যেককে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,-কে কত দিনের মধ্যে সমস্ত শত্রুসৈন্য ধ্বংস করিতে সমর্থ? তদুত্তরে ভীষ্ম এক মাস, দ্রোণাচাৰ্য্য এক মাস, কৃপাচাৰ্য্য দুই মাস, অশ্বত্থামা দশ দিন এবং কর্ণ পাঁচ দিন মেয়াদ দিলেন। চরমুখে সংবাদ পাইয়া যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকেও সমবেত শত্রুসৈন্যনাশের অনুরূপ প্রশ্ন করিলেন। অর্জ্জুন নিমেষমাত্র সময় নির্দ্ধারণ করিলেন। বলা বাহুল্য পাণ্ডবসৈন্য অপেক্ষা কৌরবসৈন্য অনেক বেশী—— শিক্ষানৈপুণ্যে তাঁহাদের শক্তি প্ৰায় তিনগুণ। অর্জ্জুন তাহার সেই বীরত্বের হেতু নির্দ্দেশ করিলেন-কেশবের সাহায্য ও শিবদত্ত পাশুপত-অস্ত্রের প্রভাব। সে কি ভীষণ অস্ত্র। বর্ত্তমান জার্ম্মান-যুদ্ধেও এরূপ ধবংসশক্তিসমন্বিত অতীব তীব্র আলোকরশ্মি আবিষ্কারের সংবাদ প্ৰকাশ পাইয়াছে। ইহাও নাকি সর্ব্বসংহারী কিন্তু সে অস্ত্ৰও অন্তিম সময়ে প্রযুক্ত হইবার কথা। অর্জ্জুনের পাশুপত সম্বন্ধেও শিবের আদেশ ছিল,— “সহজ-সরল যুদ্ধে উহার প্রয়োগ হইবে না; উহাও সঙ্কটকালের সম্বল।” স্বয়ং শিবও সর্ব্বসংহারার্থ প্ৰলয়কালেই পাশুপাতের প্রয়োগ করিতেন। যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নে অর্জ্জুনের ঐ উক্তি বৃথা দম্ভপ্রকাশ নহে; সেই পাশুপত-অন্ত্র নিমেষমধ্যে সর্ব্বধ্বংসী সন্দেহ নাই। যুরোপের পূর্বোক্ত সংবাদ গুজব বা ধাপ্পাবাজী হইতে পারে সত্যও হইতে পারে। সত্য হইলেও বিস্ময়ের বিষয় নহে। কারণ, পাশুপতই তাহার আদর্শ-তাহার পথপ্রদর্শক।] স্থাবরজঙ্গমাত্মক [অচেতন চেতনময় বৃক্ষপর্ব্বতপ্রাণীসমাকীর্ণা] ত্ৰিলোক ও ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান সমুদয় বিনাশ করিতে সমর্থ হইব। ভগবান শূলপাণি কৈরাতদ্বন্দ্বযুদ্ধে [কিরাতরূপী শিবের সহিত বাহুযুদ্ধে] আমাকে এক ভয়ানক অস্ত্ৰ প্ৰদান করিয়াছেন। তিনি যুগান্তকালে সর্ব্বভূত সংহার করিতে ঐ অস্ত্র প্রয়োগ করিতেন। কর্ণের কথা দূরে থাকুক, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এবং অশ্বত্থামাও তাহা জ্ঞাত নহেন। হে মহারাজ! দিব্যাস্ত্রদ্বারা প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিনাশ করা বিধেয় নহে; সুতরাং আৰ্জবযুদ্ধ[সহজ—সরল]দ্বারা শক্ৰগণকে পরাজিত করিব। আর এই সমস্ত দিব্যাস্ত্রবেত্তা সমর্যাভিলাষী পার্থিবেরা আপনার সহায়। ইহারা সকলেই দারক্রিয়াকালে [বিবাহসময়ে] যোগানুষ্ঠান করিয়াছেন; শিখণ্ডী, যুযুধান, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীমসেন, যমজ নকুলসহদেব, যুধামন্যু, উত্তমৌজা, ভীম [উক্ত নামীয় অপর ভীম], দ্রোণত্যুল্য বিরাট, দ্রুপদ, শঙ্খ, মহাবল পরাক্রান্ত হৈড়িম্বেয় [হিড়িম্বাতনয় ঘটোৎকচ], তাহার আত্মজ অঞ্জনপর্ব্ব, পরমসহায় রণপণ্ডিত শৈলেয়, অভিমনুষ্ঠু ও দ্ৰৌপদীর পঞ্চপুত্ৰ—ইঁহারা সকলে দেবসেনাগণকেও বিনাশ করিতে সমর্থ। আপনিও ত্ৰৈলোক্য উৎসন্ন করিতে পারেন এবং রোষকষায়িতলোচনে যাহাকে একবার নিরীক্ষণ করেন, আমার বোধ হয়, তাহাকে এককালে জীবিতাশা [বাঁচিবার ভরসা] বিসর্জ্জন করিতে হয়।”