১৯৩তম অধ্যায়
রাজর্ষি বক-দালভ্য-ঋষির বৃত্তান্ত
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নৃপবর! তদনন্তর মহর্ষিগণ, ব্ৰাহ্মণসকল ও রাজা যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবান! মহাতপাঃ বক কি কারণে দীর্ঘায়ু হইয়াছিলেন?” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “সেই মহাতপাঃ রাজর্ষি বক কি কারণে দীর্ঘায়ু হইয়াছিলেন তাহার বিচারণার আবশ্যকতা নাই।”
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা শ্রবণ করিয়া আগ্রহাতিশয়সহকারে পুনর্ব্বার মার্কণ্ডেয়কে কহিলেন, “মহর্ষে! শুনিয়াছি, বক ও দালভ্যনামে দুইজন ঋষি ছিলেন; তাঁহারা চিরজীবী ও ইন্দ্রের সখা, লোকে তাহাদিগের বিস্তর প্রশংসা করিয়া থাকে। অতএব আমি সেই সুখদুঃখসংযুক্ত বক-শক্রিসমাগম শ্রবণ করিতে বাসনা করিয়াছি; আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক অবিকল কীর্ত্তন করুন।”
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! দেবাসুরের সংগ্রাম হইলে পর দেবরাজ ত্ৰিলোকীর অধিপতি হইলেন। তখন পয়োধরমণ্ডলী পৰ্য্যাপ্তপরিমাণে বারিবর্ষণ করিতে লাগিল, উত্তমোত্তম শস্য উৎপন্ন হইতে লাগিল এবং প্রজারা ধর্ম্মপরায়ণ ও নিরাময় হইল। বলনিসূদন দেবরাজ সকলকেই হৃষ্ট ও ধর্ম্মনিষ্ঠ নিরীক্ষণ করিয়া ঐরাবতে আরোহণপূর্ব্বক নদ, নদী, বাপী, তাড়াগ, উদপান [ক্ষুদ্র জলাশয়], প্রপাত, ব্রতসমাচরণসম্পন্ন-দ্বিজোত্তম-পরিষেবিত সরোবর, সুসমৃদ্ধ নগর, জনপদ, খেট [নগর], বিচিত্ৰ আশ্রমসকল ও প্রজাপালন দক্ষ ভূপতিগণকে অবলোকন করিয়া ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন। অনন্তর পূর্ব্বদিকে সাগরসন্নিহিত বহুবিধ পাদপশোভিত প্রদেশে মৃগপক্ষিগণনিষেবিত এক রমণীয় আশ্রমপদ সন্দর্শন করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক মহাতপাঃ বককে অবলোকন করিলেন। মহাতপাঃ বক ইন্দ্ৰকে নয়নগোচর করিয়া সাতিশয় প্রীত হইয়া পাদ্য, আসন, অর্ঘ্য ও নানাবিধ ফলমূল প্ৰদানপূর্ব্বক তাঁহার পূজা করিলেন।
“দেবরাজ সৎকৃত ও সুখাসীন হইয়া ঋষিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! আপনি সহস্ৰ বৎসর জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন, অতএব চিরজীবীর দুঃখ বৰ্ণন করুন।”
“বক কহিলেন, “হে ত্ৰিদশনাথ! চিরকাল জীবিত থাকিলে অপ্রিয় ও অসদ্ব্যক্তির সংসৰ্গ এবং প্রিয়তমের বিরহজনিত দুঃখভোগ করিতে হয়; পুত্র, কলাত্র, জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধবগণের বিনাশ দেখিতে হয় এবং দুর্ব্বিষহ অধীনতাশৃঙ্খলে বদ্ধ হইতে হয়, ইহার পর দুঃখ আর কি আছে? চিরজীবিত দরিদ্রের কেশের পরিসীমা নাই, অর্থবহীন ব্যক্তিকে সকলেই পরাভব ও ঘৃণা করে। চিরজীবী হইলে কুলনের কুলক্ষয়, অকুলনের কুলভাব, কাহারও সংযোগ ও কাহারও বা বিয়োগদর্শন করিয়া সাতিশয় দুঃখভোগ করিতে হয়।
“হে দেব শতক্ৰতো! অকুলীন সমৃদ্ধ ব্যক্তির কিরূপে কুলবিপৰ্য্যয় হইতেছে, তাহা আপনি প্রত্যক্ষ করিতেছেন। দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, মনুষ্য, উরাগ ও রাক্ষস ইহারা সকলেই বৈপরীত্য প্রাপ্ত হইতেছে। সৎকুলোদ্ভব ব্যক্তি দুষ্কুলীনের বশংবদ হইয়া যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইতেছে, ধনবান নির্ধনের অবমাননা করিতেছে; বিলক্ষণজ্ঞানসম্পন্ন হইয়াও ক্লেশভোগ করিতেছে; নিতান্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিও পরমসুখে রহিয়াছে। হে ত্ৰিদশনাথ। লোকে এইরূপ বিস্তর অন্যায়, মনুষ্যের বহুবিধ দুঃখ ও নানা ক্লেশ দৃষ্ট হয়। ইহা অপেক্ষা অধিকতর দুঃখ আর কি হইতে পারে?”
“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে মহাভাগ! আপনি পুনর্ব্বার চিরজীবীর সুখের বিষয় বর্ণন করুন।” বক কহিলেন, ‘সুরনাথ! যে ব্যক্তি কুমিত্র পরিহারপূর্ব্বক দিবসের অষ্টম বা দ্বাদশ ভাগে গৃহে শাক পাক করিয়া ভোজন করে, যাহাকে লোকে ঔদরিক বলে না, যে ব্যক্তি দিবসগণনায় উদ্বিগ্ন হয় না, সেই চিরজীবীই যথার্থ সুখী; যে ব্যক্তি অন্যের আশ্রয় না লইয়া স্বীয় ক্ষমতায় অজ্জিত শাক আপন গৃহে পাক করিয়াও জীবিকা নির্ব্বাহ করে, তাহার অপেক্ষা সুখী আর কে আছে? ফলতঃ আপন গৃহে ফল, মূল ও শাকান্ন ভোজন করাও শ্রেয়স্কর, তথাপি পরগৃহে প্রতিদিন তিরস্কৃত হইয়া নানাবিধ মিষ্টান্ন ভোজন করাও সুখকর নহে। যে অধম কুক্কুরের ন্যায় পরান্নপ্রতিপালিত হিইতে ইচ্ছা করে, তাহাকে ধিক্! যে ব্যক্তি অতিথি-অভ্যাগত প্রাণী ও পিতৃগণকে প্রদানপূর্ব্বক অবশিষ্ট অন্ন ভোজন করে, সে পরমসুখী এবং সেই অবশিষ্ট অন্ন অতিপবিত্র ও পরমোৎকৃষ্ট বলিয়া গণ্য। অতিথি ব্রাহ্মণ যতগুলি অন্নপিণ্ড ভোজন করেন, প্ৰদাতার তত সহস্ৰ গোদানের ফললাভ হয় এবং তাহার যৌবনকালকৃত সমস্ত পাপ একবারে বিনষ্ট হইয়া যায়। ব্রাহ্মণকে ভোজন করাইয়া দক্ষিণা প্রদানপূর্ব্বক তাহার করতলস্থিত জলস্পর্শ করিলে তৎক্ষণাৎ পাপ হইতে মুক্ত হয়।” এবংবিধ নানাপ্রকার কথোপকথনান্তে ত্ৰিদশনাথ ইন্দ্ৰ মহামুনি বকের নিকট বিদায়গ্ৰহণপূর্ব্বক দেবলোকে প্রস্থান করিলেন।”