১৯৩তম অধ্যায়
বিবিধ সদাচার অনুষ্ঠান
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনার অবিদিত কিছুই নাই। এক্ষণে আপনার মুখে আচারের বিষয় শ্রবণ করিতে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছি, আপনি উহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! দুরাচার, দুশ্চেষ্ট, দুর্বুদ্ধি ও সাহস [দুঃসাহস হঠকারিতা] প্রিয় লোকেরা অসাধু বলিয়া বিখ্যাত আছে। সাধুদিগকে আচারপূত দেখিতে পাওয়া যায়। সাধুব্যক্তিরা কখনই রাজমার্গ, গোষ্ঠ ও ধান্যমধ্যে বিষ্ঠামূত্র পরিত্যাগ করেন না। যাঁহারা সাধুজনোচিত আচারনিষ্ঠ হইতে অভিলাষ করেন, তাঁহাদের অবশ্যকর্ত্তব্য শৌচাদি ক্রিয়াসম্পাদনের পর আচমন করিয়া অবগাহন ও অবগাহনের পর তর্পণ করা বিধেয়। সৰ্ব্বদা সূর্য্যের উপাসনা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। সূৰ্য্য সমুদিত হইলে আর নিদ্রাসুখ অনুভব করা উচিত নহে। প্রাতঃকালে ও সায়ংকালে সাবিত্রীর উপাসনা করা আবশ্যক। হস্ত, পদ ও মুখ প্রক্ষালন করিয়া পূর্ব্বমুখীন হইয়া মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক ভোজন করা বিধেয়। অন্নাদি ভোজনদ্রব্যের নিন্দা করা কর্ত্তব্য নহে। পদপ্রক্ষালন করিয়া তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান ও রজনীযোগে আর্দ্রপদে [ভিজাপায়ে] শয়ন করা উচিত নহে। দেবর্ষি নারদ এই সমুদয় আচার-লক্ষণ কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। প্রতিদিন যজ্ঞশালা, বৃষ, দেবতা, গোষ্ঠ, চতুষ্পথ, ধার্ম্মিক ব্রাহ্মণ ও চৈত্যবৃক্ষ প্রদক্ষিণ করা সাধুব্যক্তির কর্ত্তব্য। কি অতিথি, কি প্ৰেষ্যবর্গ [ভৃত্যাদি], কি আত্মপরিবার সকলকেই আপনার তুল্য ভোজন প্রদান করা উচিত। প্রাতঃকাল ও সায়ংকাল এই দুই কালই মনুষ্যদিগের ভোজনের প্রকৃত সময় বলিয়া নিরূপিত হইয়াছে। এতদ্ভিন্ন অন্য সময়ে ভোজন করা বিধেয় নহে। পূৰ্ব্বোক্তরূপ নিরূপিত সময়ে ভোজন করিলে উপবাসের ফললাভ হয়। হোমকালে হোমানুষ্ঠান এবং অন্য স্ত্রীসংসর্গ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ঋতুকালে স্বীয় পত্নীতে গমন করিলে ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠানের ফললাভ হয়। ভগবান্ বিধাতা ব্রাহ্মোণোচ্ছিষ্টকে জননীহৃদয়ের ন্যায় [মায়ের মন যেমন সন্তানের সুখশান্তির জন্য সতত নিযুক্ত, ব্রাহ্মণের ভুক্তাবশেষও তদ্রূপ লোকের হিতকর] হিতকর বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। যাহারা ঐ উচ্ছিষ্ট ভোজন করে, তাহারা শাশ্বত ব্রহ্মপদবী [অক্ষয় ব্রহ্মপদ] প্রাপ্ত হয়।
“যাহারা যজ্ঞবেদীনিৰ্ম্মাণার্থ মৃত্তিকা মর্দ্দন,[ মাটী ছানিয়া মাখিয়া দেয়] অগ্নি আহরণার্থ তৃণচ্ছেদন, যজ্ঞাবশিষ্ট মাংস নখদ্বারা ছেদনপূর্ব্বক ভোজন ও নিত্য সোমরস পান করে, তাহাদিগকে অধিককাল সংসারযন্ত্রণা ভোগ করিতে হয় না। যিনি মাংস পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনি কোন মাংস যজুৰ্ব্বেবেত্তা ব্রাহ্মণকর্ত্তৃক সংস্কৃত হইলেও তাহা ভক্ষণ করিবেন না। বৃথামাংস ও পৃষ্ঠমাংসও ভক্ষণ করা কাহারও কৰ্ত্তব্য নহে। কি স্বদেশ, কি বিদেশ, কুত্রাপি অতিথিকে উপবাসী রাখা বিধেয় নহে। ভিক্ষাবৃত্তিদ্বারা অন্নাদি যাহা লাভ হয়, তাহা পিত্রাদি গুরুজনদিগকে অর্পণ করা উচিত। গুরুজনদিগকে আসনদান, অভিবাদন ও অর্চ্চনা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। উহা করিলে আয়ুঃ, যশ ও শ্রীবৃদ্ধি হইয়া থাকে। উদয়োন্মুখ সূৰ্য্য ও বিবস্ত্রা পরবনিতাকে অবলোকন করা কদাপি বিধেয় নহে; ঋতুকালীন স্ত্রীসংসর্গ ধৰ্ম্মানুগত বটে, কিন্তু উহা গোপনে রাখাই কৰ্ত্তব্য। তীর্থসমুদয়ের মধ্যে গুরু এবং পবিত্র বস্তুসমুদয়ের মধ্যে অগ্নিই শ্রেষ্ঠ। সাধুব্যক্তিরা গোপুচ্ছসংস্পর্শ প্রভৃতি যেসকল কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তৎসমুদয়ই প্রশস্ত। পরস্পর সাক্ষাৎ হইলেই স্ব স্ব কুশলবাৰ্ত্তা জিজ্ঞাসা করা উচিত। সায়ংকাল ও প্রাতঃকালে ব্রাহ্মণদিগকে অভিবাদন করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। দেবালয়, গোষ্ঠ এবং ব্রাহ্মণগণের ধর্ম্মানুষ্ঠান, বেদাধ্যয়ন ও ভোজনস্থলে। দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করা শাস্ত্রসম্মত। সায়ংকাল এবং প্রাতঃকাল ব্রাহ্মণগণের অভিবাদন করিলে পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদিগের পুণ্যবৃদ্ধি, কৃষিজীবীদিগের কৃষিকার্য্যের উন্নতি এবং অন্যান্য ব্যক্তিদিগের ইন্দ্রিয়ভোগ্য দিব্যবস্ত্র ও অন্নাদি লাভ হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণগণকে ভোজ্যবস্তুপ্রদানের সময় ‘সম্পন্নং’ [সম্পূর্ণ হইয়াছে], পানীয়-প্রদানের সময় ‘তর্পণং’ [তৃপ্তি হইয়াছে] এবং পায়স, যবাগূ [যবমণ্ড—যবের পায়স] ও তিলোদন [তিলের নাড়ু] প্রদানের সময় ‘সুশৃতং’ [সুসিদ্ধ হইয়াছে] বলিয়া জিজ্ঞাসা করা বিধেয়। ব্যাধিত ব্যক্তিদিগের ক্ষৌরকাৰ্য্য, ক্ষুৎপরিত্যাগ [হাঁচি দেওয়া], স্নান ও ভোজনের পর ব্রাহ্মণদিগকে বন্দনাদিদ্বারা পরিতুষ্ট করা নিতান্ত আবশ্যক। উহা করিলে ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিরা অনায়াসে সুদীর্ঘ আয়ুঃ লাভ করিতে পারে। সূৰ্য্যাভিমুখে মূত্র পরিত্যাগ এবং আপনার পুরীষ [বিষ্ঠা] দর্শন করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। স্ত্রীলোকের সহিত একত্র শয়ন ও একত্র ভোজন এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদিগকে ‘তুমি’ বলিয়া সম্ভাষণ বা নামোল্লেখ করিয়া সম্বোধন করা উচিত নহে। কনিষ্ঠ বা সমবয়স্ক ব্যক্তির প্রতি ‘তুমি’ বাক্য প্রয়োগ করিলে উহা দোষাবহ হয় না। পাপাত্মা ব্যক্তিদিগের অঙ্গবিকার অবলোকন করিলেই মনোগত ভাব বুঝিতে পারা যায়। মূর্খ ব্যক্তিরা জ্ঞানপূৰ্ব্বক পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া উহা গোপন করিতে অভিলাষ করে; কিন্তু পরিশেষে সেই পাপগোপননিবন্ধনই তাহাকে বিনষ্ট হইতে হয়। কারণ পাপকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া উহা কোনক্রমে মনুষ্যের অগোচর রাখা যায়, কিন্তু দেবতারা উহা অবশ্যই অবগত হয়েন; পাপানুষ্ঠান করিয়া গোপন করিলে উহাদ্বারা পাপ এবং ধর্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া গোপন করিলে তদ্দারা ধর্ম্ম পরিবর্দ্ধিত হয়। মূঢ় ব্যক্তিরা পাপানুষ্ঠান করিয়া আর তাহা চিন্তাও করে না, কিন্তু রাহু যেমন সময়ক্রমে চন্দ্রের সমীপে সমুপস্থিত হয়, তদ্রূপ পাপও যথাসময়ে সেই মূঢ় ব্যক্তিদিগের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই। আশার অধীন হইয়া দ্রব্যসঞ্চয় করিলে তাহা উপভোগ করা নিতান্ত সুকঠিন। কারণ, মৃত্যু কাহাকেও অপেক্ষা করে না। এই নিমিত্তই পণ্ডিত ব্যক্তিরা ঐরূপ সঞ্চয়ের নিন্দা করিয়া থাকেন। বিদ্বান্ ব্যক্তিরা কহেন যে, মনই মানবগণের ধৰ্ম্মোপার্জ্জনের মূল; অতএব মনোমধ্যে সতত পরের মঙ্গলচিন্তা করাই সাধুব্যক্তির সর্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। ধৰ্ম্মানুষ্ঠানসময়ে অন্যসাহায্য-নিরপেক্ষ হইয়া নিয়মানুসারে একাকীই ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করা বিধেয়। ধৰ্ম্মই মনুষ্যদিগের উৎপত্তির কারণ ও দেবতাদিগের অমৃতস্বরূপ। ধর্ম্মপ্রভাবে মানবগণ পরলোকে অনন্ত সুখ সম্ভোগ করিয়া থাকে।”