১৯২তম অধ্যায়
সূৰ্য্যবংশীয় পরীক্ষিৎ-নৃপতি-বৃত্তান্ত
জনমেজয় কহিলেন, হে বিপ্রাগ্রগণ্য বৈশম্পায়ন! মহাতপাঃ মার্কণ্ডেয় পাণ্ডবগণ-সমীপে যেরূপ ব্ৰাহ্মণগণের মাহাত্ম্য কীর্ত্তন করিয়াছিলেন, আপনি আমার নিকট তদ্রূপ পুনরায় কীর্ত্তন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডুনন্দন যুধিষ্ঠির মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে পুনরায় ব্রাহ্মণগণের মাহাত্ম্য কীর্ত্তন করিতে কহিলেন। তখন তিনি বলিলেন, “হে মহারাজ! এই অপূর্ব্ব ব্ৰাহ্মণ-চরিত কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করা।
“অযোধ্যা-নগরে ইক্ষ্বাকুবংশাবতংস পরীক্ষিৎ-নামে এক নরপতি ছিলেন। তিনি একদা অশ্বারোহণপূর্ব্বক মৃগয়ায় গমন করিয়া এক মৃগের অনুসরণক্ৰমে ক্ৰমে ক্রমে অতি দূরতর-প্রদেশে সমুপস্থিত হইলেন। ক্রমে পথশ্রম ও ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত অভিভূত হইয়া ইতস্ততঃ গমন করিতে করিতে এক নীলবর্ণ নিবিড় কানন নিরীক্ষণ করিলেন। তখন তিনি সেই কাননমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক তথায় এক পরমরমণীয় সরোবর অবলোকন করিয়া অশ্বের সহিত তাহাতে অবগাহন করিলেন। স্বেচ্ছানুরূপ জলক্রীড়ায় তাঁহার পরিশ্রমাপনোদন হইলে তিনি অশ্বসমভিব্যাহারে তীরে আগমনপূর্ব্বক অশ্বকে মৃণাল প্ৰদান করিয়া তথায় শয়ন করিলেন।
“মহারাজ পরীক্ষিৎ এইরূপে সুস্থান্তঃকরণে শয়ান আছেন, এমত সময়ে সুমধুর গীতধ্বনি তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। মহারাজ সেই নিবিড় অরণ্যানী-মধ্যে অকস্মাৎ সঙ্গীত-শব্দ-শ্রবণে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, “কি আশ্চৰ্য্য! এই অরণ্যে মনুষ্যের সমাগম নাই, তবে কোন ব্যক্তি এই সুমধুরস্বরে গান করিতেছে?” তিনি এইরূপ চিন্তাপরবশ হইয়া কিয়ৎক্ষণ পরেই দেখিলেন, অসামান্য রূপলাবণ্যসম্পন্না নিখিল-লোকললামভূতা এক ললনা সুমধুরস্বরে গান করিয়া পুষ্পবচয়ন করিতেছে। ঐ কামিনী ক্রমে ক্রমে তাঁহার সমীপবর্ত্তনী হইলে তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ভদ্রে! তুমি কে? কাহার রমণী?’ কন্যা কহিল, “আমি অদ্যাপি কন্যাকাবস্থায় আছি, আমার বিবাহ হয় নাই।” রাজা কহিলেন, “হে বরবর্ণিনি! তবে আমাকে বরণ কর।” কন্যা কহিল, “মহাশয়! আমার পাণিগ্ৰহণাভিলাষী হইলে আপনাকে এক প্ৰতিজ্ঞা পালন করিতে হইবে।” রাজা কহিলেন, “কি?” কন্যা কহিল, “আপনি আমাকে বারি প্রদর্শন করিবেন না।” রাজা কন্যার বাক্যে সম্মত হইয়া তাহার পাণিগ্রহণপূর্ব্বক পরমহ্লাদে তাহাকে লইয়া তথায় ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। পরে সৈন্য-সমুদয় রাজার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিকে দণ্ডায়মান হইল।
“তখন মহারাজ পরীক্ষিৎ পরমহ্লাদে সেই কামিনীকে শিবিকায় আরোহণ করাইয়া স্বনগরে আনয়নপূর্ব্বক নির্জ্জনে তাহার সহিত ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। সেই ক্রীড়াসক্ত রাজাকে কেহই অবলোকন করিতে পাইত না। একদা প্রধান-অমাত্য রাজসমীপচারিণী স্ত্রীগণকে তাহদের কর্ত্তব্যকর্ম্ম জিজ্ঞাসা করাতে তাহারা কহিল, ‘মহাশয়! মহারাজের বাসস্থানে জল লইয়া যাইতে নিষেধ আছে, এই নিমিত্ত আমরা এ স্থানে সতত নিযুক্ত আছি।’
“অমাত্য স্ত্রীগণের বাক্য-শ্রবণানন্তর বহুবিধ পাদপসম্পন্ন পুষ্পফলযুক্ত জলশূন্য এক কৃত্রিম কানন নির্ম্মাণ করাইলেন। ঐ কাননমধ্যে এক গূঢ় বাপীও প্রস্তুত করিয়াছিলেন। ঐ বাপী মুক্তাজালজড়িত, সুধাধবল ও নির্ম্মলজলসম্পন্ন। কানন প্রস্তুত হইলে অমাত্য রাজাকে উহা প্রদর্শন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! এই বন বরিশুন্য; ইহাতে স্বচ্ছন্দে ক্রীড়া করুন।” রাজা পরীক্ষিৎ অমাত্যের বাক্যানুসারে স্বীয় প্রণয়িনী-সমভিব্যাহারে সেই কাননে প্রবেশ করিয়া ক্রীড়া কৌতুকে কালযাপন করিতে লাগিলেন।
“একদা মহারাজ পরীক্ষিৎ ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় একান্ত অভিভূত হইয়া তত্ৰত্য এক মাধবীলতা-গৃহ অবলোকনপূর্ব্বক প্রিয়াসমভিব্যাহারে তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই সুধাধবলিত সলিলপূর্ণ বাপী দেখিতে পাইলেন ও প্রণয়িনীর সহিত তাহার তীরে সমুপবিষ্ট হইলেন।
“দৈবনির্ব্বন্ধ অখণ্ডনীয়। রাজা কিয়ৎক্ষণ পরে স্বীয় বনিতাকে সেই বাপীসলিলে অবতীর্ণ হইতে কহিলে, সে তাঁহার বাক্যানুসারে বাপীমধ্যে নিমগ্ন হইল; কিন্তু আর সমুত্থিত হইল না। তখন রাজা তাহার অন্বেষণার্থ গমন করিয়া সেই বাপীও দেখিতে পাইলেন না।
“অনন্তর প্রত্যাবর্ত্তনকালে তথায় গর্ত্তমুখে এক মণ্ডুক অবলোকন করিয়া ক্রোধান্বিতচিত্তে অনুমতি করিলেন যে, মণ্ডূক দেখিলে বধ করিবে ও যে ব্যক্তি আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করিতে ইচ্ছা করে, সে যেন আমাকে মৃত মণ্ডূক উপহার প্রদান করে।
“রাজার এইরূপ আজ্ঞানুসারে চতুর্দ্দিকে দারুণ মণ্ডূক-বধ আরম্ভ হইলে পর সমুদয় মণ্ডূক ভীত হইয়া মণ্ডূকরাজের সমীপে গমনপূর্ব্বক সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। মণ্ডূকরাজ তাহাদিগের বাক্য-শ্রবণানন্তর তাপসবেশে রাজা পরীক্ষিতের সমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিল, “হে রাজন! তুমি ক্ৰোধপরবশ হইও না; প্রসন্ন হও; নিরপরাধ মণ্ডূকদিগের সংহার করা তোমার নিতান্ত অকর্ত্তব্য। হে মহারাজ! আমি যাহা কহিতেছি, সাবধানে শ্রবণ কর। তুমি আর মণ্ডূক বিনাশ করিও না; কোপ সংহার কর। মণ্ডূকবধ করিলে ধনক্ষয় হয়। এক্ষণে প্রতিজ্ঞা কর যে, আর মণ্ডূকবধ করিয়া প্রিয়াবিয়োগজ শোকের প্রতিবিধান করিবে না। কেন বৃথা ভেকবধদ্বারা অধর্ম্মাচরণ করিতেছ?”
“ইষ্টজনবিয়োগজনিত-শোকসাগরনিমগ্ন রাজা পরীক্ষিৎ ব্রাহ্মণরূপধারী মণ্ডূকরাজের বাক্য-শ্রবণানন্তর তাঁহাকে কহিলেন, আমি কখনই ক্ষমা করিব না, অবশ্যই ভেকগণকে সংহার করিব; ঐ দুরাত্মারাই আমার প্রণয়িনীকে ভক্ষণ করিয়াছে; অতএব আপনি আমাকে ভেকবধ করিতে নিষেধ করিবেন না।”
“ভেকরাজ রাজার বাক্য-শ্রবণে সাতিশয় বিষণ্নমনাঃ হইয়া কহিলেন, “হে মহারাজ! আমার নাম আয়ু, আমি ভেকগণের অধিপতি। আর আপনার যে প্রণয়িনী ছিল, সে আমারই কন্যা, উহার নাম সুশোভনা। সেই দুঃশীলা কুস্বভাব্যবশতঃ পূর্ব্বে অন্যান্য অনেক ভূপতিকে বঞ্চনা করিয়াছে।” তখন রাজা কহিলেন, “হে ভেকরাজ! আমি আপনার কন্যাকে প্রার্থনা করিতেছি, আপনি আমাকে কন্যা প্ৰদান করুন।” ভেকরাজ রাজবাক্যশ্রবণানন্তর তাঁহাকে স্বীয় তনয়া প্ৰদানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘সুশোভনে! তুমি আজি অবধি নিরন্তর মহারাজের শুশ্রূষা করিবে।” এবং সক্ৰোধ-চিত্তে এই বলিয়া তাহাকে অভিসম্পাত করিলেন যে, অরে দুঃশীলে! তুই যেমন বিনা কারণে অনেকানেক ভূপতিকে বঞ্চিত করিয়াছিস, সেই অপরাধে তোর অপত্যগণ ব্রাহ্মণহিতসাধনে পরাঙ্মুখ হইবে।”
“মহারাজ পরীক্ষিৎ ভেকরাজপুত্রীর প্রতি একান্ত অনুরক্ত ছিলেন, এক্ষণে তাহাকে প্রাপ্ত হইয়া তিলোকৈশ্বৰ্য্যলাভ হইল বোধে পরম পরিতুষ্টচিত্তে ভেকরাজকে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক হর্ষজনিত বাষ্পগদগদম্বরে কহিলেন, “মহাশয়! আমি অনুগৃহীত হইলাম।” অনন্তর ভেকরাজ স্বীয় দুহিতাকে সম্ভাষণপূর্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।
“কিয়ৎকাল পরে রাজার ঔরসে ভেকরাজতনয়া সুশোভনার গর্ভে তিন পুত্ৰ জন্মিল;—শল, দল ও বল। মহারাজ পরীক্ষিৎ কিয়দ্দিনানন্তর উপযুক্ত সময়ে স্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্ৰ শলকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া তপানুষ্ঠান নিমিত্ত অরণ্যে গমন করিলেন।
“একদা মহারাজ শল রথারোহণে মৃগয়ায় গমন করিলেন। তিনি তথায় এক মৃগকে লক্ষ্য করিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া সারথিকে অধিকতর বেগে রথ-চালন করিতে আজ্ঞা করিলেন। সারথি কহিল, “মহারাজ! কেন বৃথা ব্যগ্র হইতেছেন? ঐ মৃগকে ধৃত করিতে পরিবেন না। যদি আপনার রথে বামীদ্বয় যোজিত থাকিত, তাহা হইলে আপনি ঐ মৃগ আক্রমণ করিতে সমর্থ হইতেন।” তখন রাজা সারথিকে কহিলেন, “তুমি আমাকে বামীদ্বয়ের বিষয় বিশেষ বল, নচেৎ তোমাকে সংহার করিব।” সারথি এদিকে রাজভয়, ওদিকে বামদেবের শাপভয়, এই উভয় ভয়ে সাতিশয় ভীত হইয়া প্রথমতঃ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিল। রাজা তদর্শনে খড়্গ উত্তোলনপূর্ব্বক কহিলেন, “শীঘ্ৰ বল, নতুবা তোমার প্রাণ বিনাশ করিব।” তখন সারথি প্রাণভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া কহিল, “হে রাজন! মহর্ষি বামদেবের বায়ুবেগগামী দুই অশ্ব আছে; উহাদিগের নাম বামী।”
বিপ্ৰপ্ৰশংসাপ্রসঙ্গে বামদেব-ঋষি শলনৃপ-বৃত্তান্ত
“মহারাজ শল সারথির বাক্য-শ্রবণানন্তর তাহাকে বামদেবের আশ্রমাভিমুখে রথ-চালনা করিতে আদেশ করিলেন। পরে অতি অল্পকালমধ্যে তথায় সমুপস্থিত হইয়া মহৰ্ষিকে কহিলেন, ‘ভগবান! এক মৃগ আমার শাণিত-শরে বিদ্ধ হইয়া পলায়ন করিতেছে; অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে আপনার বামীদ্বয় প্রদান করুন।” মহর্ষি কহিলেন, “হে রাজন! আমি আপনাকে বামীদ্বয় প্ৰদান করিতেছি, কিন্তু আপনার কর্ম্মসমাপন হইলে শীঘ্র আমাকে প্ৰত্যপণ করিবেন।”
“মহারাজ শল মহর্ষির বাক্য স্বীকার করিয়া বামীদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক রথে যোজনা করিয়া মৃগাভিমুখে ধাবমান হইলেন। গমন করিতে করিতে সারথিকে কহিলেন, ‘এই অশ্বরত্নদ্বয় ব্ৰাহ্মণগণের অনুপযুক্ত, অতএব ইহা ঋষিকে প্রত্যপণ করিব না।” অনন্তর বাণবিদ্ধ মৃগকে আক্রমণ ও গ্রহণ করিয়া আপনার নগরে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক মহর্ষির বামীদ্বয়কে স্বীয় অন্তঃপুরে সংস্থাপন করিলেন।
“এদিকে মহর্ষি বামদেব কতিপয় দিবস অতীত হইলে মনে মনে চিন্তা করিলেন, “কি উৎপাত! যুবা রাজকুমার আমার সেই উত্তম বাহন দুইটি লইয়া স্বচ্ছন্দে ক্রীড়া করিতেছে; প্রত্যপণ করিতে চাহে না।” পরে একমাস পরিপূর্ণ হইলে তিনি আপনার শিষ্যকে কহিলেন, “হে আত্ৰেয়! তুমি শলরাজের নিকট গমনপূর্ব্বক তাহাকে কহিবে, যদি আপনার কাৰ্য্যসমাপন হইয়া থাকে, তবে উপাধ্যায়ের বামীদ্বয় প্রদান করুন।’ আত্ৰেয় উপাধ্যায়ের আদেশানুসারে রাজার সমীপে গমনপূর্ব্বক অশ্বদ্বয় প্রত্যাৰ্পণ করিতে কহিলে তিনি প্ৰত্যুত্তর করিলেন, “হে বিপ্ৰ! এবংবিধ বাহন রাজগণেরই উপযুক্ত; ব্রাহ্মণগণের অশ্বে প্রয়োজন কি? আপনি আশ্রমে প্রস্থান করুন।’ আত্ৰেয় রাজার বচনশ্রবণানন্তর স্বীয় উপাধ্যায়ের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া সমুদয় নিবেদন করিলেন।
“মহর্ষি বামদেব শিষ্যমুখে শলরাজের অশ্বপ্রদানে অসম্মতি শ্রবণ করিয়া ক্রোধান্বিতচিত্তে স্বয়ং রাজসমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অশ্ব প্রত্যাৰ্পণ করিতে কহিলে তিনি তাহাতে অসম্মত হইলেন। তখন মহর্ষি কহিলেন, “হে পার্থিব! তোমার দুরূহ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, এক্ষণে আমাকে বামীদ্বয় প্রত্যপণ কর, নচেৎ তোমার অসদাচরণ নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয়গণ তোমাকে পরিত্যাগ করিলে ভগবান বরুণ অতি ভীষণ পাশদ্বারা তোমাকে সংহার করিবেন।”
“রাজা কহিলেন, ‘হে বামদেব! সুশিক্ষিত বৃষভদ্বয় ব্রাহ্মণগণের উপযুক্ত ও শাস্ত্ৰবিহিত বাহন, অতএব আপনি উহাদ্বারা যথেচ্ছ গমন করুন। ভবাদৃশ ব্যক্তিরা বেদবিহিত বিধির কদাচ অন্যথাচরণ করেন না।”
“বামদেব কহিলেন. ‘মহারাজ! মাদৃশ ব্যক্তিরা পরলোকে শাস্ত্রোক্ত বাহন বৃষভে গতিবিধি করিয়া থাকে; কিন্তু ইহলোকে কি আমার, কি আপনার, সকলেরই অশ্ববাহন নিৰ্দ্ধারিত আছে।’
“রাজা কহিলেন, ‘তবে এক্ষণে ক্ষত্ৰিয়ের বাহন গর্দ্দভ, অশ্বতরী বা শীঘ্রগামী অশ্বচতুষ্টয়ে আরোহণ করিয়া গমন করুন। আর মনে করুন, সেই বামীদ্বয় আমার, আপনার নাহে।’
“বামদেব কহিলেন, “তুমি নিতান্তই বামী প্ৰদান করিতে অনিচ্ছুক হইয়াছ, অতএব লৌহময় ঘোররূপ শূলধারী চারিজন রাক্ষস আমার নির্দেশানুসারে তোমাকে চারিখণ্ড করিয়া বিদীর্ণ করিবে, কারণ, জীবিত ব্যক্তিকে বধ করা ব্রাহ্মণের পক্ষে অতি গর্হিত কর্ম্ম।”
“রাজা কহিলেন, “যাহারা তোমাকে ব্ৰাহ্মণ বলিয়া অবগত আছে, তাহারাই আমার আদেশানুসারে তোমাকে ও তোমার শিষ্যমণ্ডলীকে কায়িক, মানসিক ও বাচনিক দণ্ডদ্বারা শাস্তি প্ৰদান করিবে।”
“বামদেব কহিলেন, “যিনি তপোবলে ব্ৰহ্মাসাক্ষাৎকার লাভ করেন, তিনিই জীবলোকে শ্রেষ্ঠ; সেই ব্ৰাহ্মণ কায়িক, মানসিক ও বাচনিক দণ্ডে দণ্ডনীয় হইতে পারেন না। যাহা হউক, তুমি প্রত্যপণ করিবে স্বীকার করিয়া আমার বামীদ্বয় গ্রহণ করিয়াছ; অতএব যদি জীবিত থাকা তোমার অভিপ্ৰায় হয়, তবে শীঘ্র আমাকে সেই বামীদ্বয় প্রদান কর।”
“রাজা কহিলেন, “যাহারা মৃগয়াচরণ করে, অশ্ব তাহাদিগের আবশ্যক; কিন্তু মৃগয়া ব্রাহ্মণগণের পক্ষে নিষিদ্ধ; অতএব আপনার অশ্বে প্রয়োজন কি; আমি সত্য কহিতেছি, অদ্য হইতে আপনি অন্যান্য যে-সকল বিষয়ের অনুমতি করিবেন, আমি তাহা প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইব না, ইহাতেই আমার পুণ্যলোকপ্ৰাপ্তি হইবে।”
“বামদেব কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ দণ্ডার্হ নহে, যে ব্ৰাহ্মণসেবী, সেই ব্যক্তি জীবিত থাকে, অন্যথা বিনাশপ্ৰাপ্ত হয়।”
“ভগবান বামদেব এই কথা কহিবামাত্ৰ তথায় ঘোররূপী শূলধারী রাক্ষসচতুষ্টয় সমুপস্থিত হইয়া রাজাকে সংহার করিতে উদ্যোগ করিলে তিনি তখন চীৎকার করিয়া কহিলেন, “যদি ইক্ষ্বাকুগণ, দল ও বৈশ্যগণ আমার বশবর্ত্তী হয়, তবে বামদেবকে কখনই বামীদ্বয় প্ৰদান করিব না। বামদেবের ন্যায় লোকেরা কখনই ধার্ম্মিক হয় না।” তিনি এই কথা বলিবামাত্র রাক্ষসগণ তাহাকে সংহার করিল।
“অনন্তর ইক্ষ্বাকুগণ রাজা বিনষ্ট হইয়াছেন দেখিয়া তাঁহার কনিষ্ঠ দলকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিল। তখন মহর্ষি বামদেব দলের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে রাজন! ব্ৰাহ্মণগণকে দান করা যে অবশ্যকর্ত্তব্য ইহা সর্ব্বধর্ম্মেই প্রসিদ্ধি আছে। যদি তুমি অধর্ম্মপরায়ণ না হও, তবে অবিলম্বেই আমার সেই বামী যুগল প্রত্যপণ কর।”
“মহারাজ দল বামদেবের বাক্য-শ্রবণানন্তর ক্রোধান্ধচিত্তে সারথিকে কহিলেন, “হে সূত! তুমি আমাকে এক বিষদিগ্ধ সায়ক আনিয়া দাও; আমি তদ্বারা বামদেবকে সংহার করিয়া কুকুরগণের সম্মুখে নিক্ষেপ করিব।”
“বামদেব কহিলেন, “হে রাজন! আমি জানি, তোমার এই দশবর্ষবয়স্ক শোনজিৎনামে এক পুত্র আছে, আমার বচনানুসারে এই বিষাক্ত বাণ তাহাকেই সংহার করিবে।” মহর্ষি এই কথা কহিবামাত্র দলবিসৃষ্টি বাণ অন্তঃপুরে গমনপূর্ব্বক রাজপুত্রকে সংহার করিল। দল সেই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে ইক্ষ্বাকুগণ! আমি অদ্য এই ব্ৰাহ্মণকে নিধন করিয়া তোমাদিগের প্রিয়ানুষ্ঠান করিব; তোমরা শীঘ্র আর একটি সুতীক্ষ্ণ বাণ আনয়নপূর্ব্বক আমার প্রভাব অবলোকন কর।”
“বামদেব কহিলেন, “হে রাজন! তুমি ঐ বিষদিগ্ধ বাণ আমার প্রতি সন্ধান করিতেছ, কিন্তু কদাচ উহা পরিত্যাগ-করিতে সমর্থ হইবে না।”
“তখন রাজা মুনির বাক্যপ্রভাবে বাণ-মোক্ষণে অক্ষম হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ইক্ষ্বাকুগণ! দেখ, আমি শরসন্ধান করিয়াছি, কিন্তু কোনমতেই পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইতেছি না, অতএব এক্ষণে বামদেবকে বিনষ্ট করিতে আমার আর অভিলাষ নাই; এই বামদেব স্বচ্ছন্দে অবস্থিতি করুন।”
“তখন বামদেব কহিলেন, “হে রাজন! তুমি এই বাণদ্বারা মহিষীকে স্পর্শ করিলে এই পাপ হইতে বিমুক্ত হইবে।” রাজা দল মুনির বাক্যশ্রবণে তদনুসারে কাৰ্য্য করিলেন।
“অনন্তর রাজমহিষী কহিলেন, “হে বামদেব! আমি যেন এই নৃশংস স্বামীকে প্রতিদিন কল্যাণকর উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক ব্ৰাহ্মণগণের নিকট হইতে সত্য ধর্ম্ম উপার্জ্জন করিয়া চরমে পুণ্যলোক লাভ করিতে পারি।
“বামদেব কহিলেন, “হে শুভে! তুমি এই রাজকুল পরিত্রাণ করিলে, এক্ষণে ইচ্ছানুরূপ বর প্রার্থনা কর। সমুদয় স্বজন ও এই বিস্তীর্ণ ইক্ষ্বাকুরাজ্য শাসন কর।”
“রাজমহিষী কহিলেন, “হে ভগবন! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে এই বর প্রদান করুন যে, আমার স্বামী পাপ হইতে বিমুক্ত হউন এবং পুত্র ও অন্যান্য বান্ধবগণের মঙ্গল হউক।”
“মহর্ষি বামদেব রাজমহিষীর বাক্য-শ্রবণানন্তর ‘তথাস্তু।’ বলিয়া বর প্রদান করিলে মহারাজ দল পাপবিমুক্ত হইয়া পরমপরিতুষ্টচিত্তে মহিষীকে প্ৰণামপূর্ব্বক বামীদ্বয় প্রদান করিলেন।”