১৯০তম অধ্যায়
সত্যে প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মের স্বরূপ
“ভৃগু বলিলেন, ‘হে তপোধন! ব্রহ্মই সত্য, সত্যই তপ এবং সত্য প্রজাসৃষ্টি ও প্রজাপালন করিয়া থাকে। লোকসমুদয় সত্যপ্রভাবেই স্বর্গলাভে সমর্থ হয়। মিথ্যা অন্ধকারের স্বরূপ। ঐ অন্ধকারপ্রভাবে লোকের অধঃপাত হইয়া থাকে। লোকে ঐ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইলে সত্যরূপ আলোক নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় না। স্বৰ্গই সত্য ও আলোক এবং নরকই মিথ্যা ও অন্ধকারস্বরূপ। মনুষ্যেরা স্ব স্ব কৰ্ম্মফলে ঐ উভয়ই প্রাপ্ত হইয়া থাকে। সত্য ও অনৃতে ধৰ্ম্ম, অধৰ্ম্ম, প্রকাশ, অপ্রকাশ, দুঃখ ও সুখ প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। তন্মধ্যে যাহা সত্য, তাহাই ধর্ম্ম; যাহা ধৰ্ম্ম, তাহাই প্রকাশ এবং যাহা প্রকাশ, তাহাই সুখ। আর যাহা অসত্য, তাহাই অধৰ্ম্ম; যাহা অধৰ্ম্ম, তাহাই অপ্রকাশ; যাহা অপ্রকাশ, তাহাই অন্ধকার এবং যাহা অন্ধকার, তাহাই দুঃখ। বিজ্ঞ লোকেরা এই জগতে শারীরিক ও মানসিক দুঃখ এবং অসুখ নিদানভূত সুখ জীবলোককে অভিভূত করিয়া রাখিয়াছে বুঝিতে পারিয়া কদাচ বিমোহিত হয়েন না। সতত দুঃখ-বিমুক্তির নিমিত্ত যত্নবান্ হওয়াই উচিত। লোকের ঐহিক সুখ অনিত্য; চন্দ্র রাহুগ্রস্ত হইলে তাহার জ্যোৎস্না যেমন প্রকাশিত হয় না, সেইরূপ অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হইলে তাহার অন্তরে সুখ থাকিলেও উহা প্রকাশিত হইতে পারে না। সুখ দুই প্রকার—শারীরিক ও মানসিক। লোকে সুখের নিমিত্তই বিবিধ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। সুখ অপেক্ষা ত্রিবর্গের উৎকৃষ্টতর ফল, আর কিছুই নাই। সুখই সকলের প্রার্থনীয়। উহা আত্মার গুণবিশেষ। ধর্ম্মার্থ উহার মূলস্বরূপ। উহার উদ্দেশেই ধর্ম্মার্থ অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে।
মিথ্যার অভিনিবেশে সুখদুঃখের অনুভব
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘হে তপোধন! আপনি যে সুখকে উৎকৃষ্ট বলিয়া কীৰ্ত্তন করিলেন, আমি উহার তাৎপৰ্য্য কিছুই অনুধাবন করিতে পারিলাম না। দেখুন, মহাত্মা মহর্ষিগণ এই আত্মার উৎকৃষ্ট গুণবিশেষ সুখের প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়াই ধ্যানে মনোনিবেশ করিয়া থাকেন। এইরূপ জনশ্রুতি আছে যে, ভূতভাবন ভগবান্ ব্রহ্মা ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক একাকী তপানুষ্ঠান করিতেন। তিনি কামজনিত সুখে কদাচ মনোনিবেশ করিতেন না। ভগবান্ উমাপতি রতিপতিকে সম্মুখীন দেখিয়া ভস্মাবশেষ করিয়াছিলেন। এই সমস্ত দৃষ্টান্তদ্বারা বোধ হইতেছে যে, সুখ মহাত্মাদিগের অভিপ্রেত নহে, সুতরাং ইহা আত্মার উৎকৃষ্ট গুণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইতে পারে না। অতএব আপনি যে কহিলেন, সুখ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই, এই বাক্যে আমার তাদৃশ বিশ্বাস হইতেছে না; আর পুণ্য হইতে সুখ ও পাপপ্রভাবে যে দুঃখের উৎপত্তি হয়, ইহাও কেবল লোকপ্রবাদমাত্র বোধ হইতেছে।
“ভৃগু কহিলেন, ‘ভরদ্বাজ! অনৃত হইতে অন্ধকার প্রাদুর্ভূত হয়। যাহারা সেই অন্ধকারপ্রভাবে ক্রোধ, লোভ, হিংসা ও মিথ্যায় জড়িত হইয়া ধৰ্ম্মকাৰ্য্যে জলাঞ্জলি প্রদানপূৰ্ব্বক অধর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, তাহাদিগকে নিরন্তর বিবিধ ব্যাধি, জরা, বধ, বন্ধন, পিপাসা, বর্ষা, উত্তাপ, শীত, বন্ধুবিয়োগ ও ধননাশজনিত দুঃখে অভিভূত হইতে হয়। সুতরাং তাহাদের সুখলাভের সম্ভাবনা কি? যে ব্যক্তির ঐসমুদয় শারীরিক ও মানসিক দুঃখ নাই, তিনিই সুখানুভব করিতে সমর্থ হয়েন। দেবলোকে এই সমস্ত দুঃখ কখনই অনুভূত হয় না, তথায় নিরন্তর সুখস্পর্শ সমীরণ প্রবাহিত ও উৎকৃষ্ট গন্ধ সঞ্চারিত হইতেছে; ক্ষুধা, পিপাসা, শ্রান্তি, জরা ও পাপের লেশমাত্র নাই, ফলতঃ দেবলোকে প্রতিনিয়ত সুখই রহিয়াছে; নরলোকে কেবল দুঃখই রহিয়াছে; নরলোকে কেবল দুঃখই অবস্থান করিতেছে এবং এই সংসারে সুখদুঃখ উভয়ই বিদ্যমান আছে; অতএব সুখ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। স্ত্রীলোক সৰ্ব্বভূতজননী পৃথিবীস্বরূপ, পুরুষ প্রজাপতিস্বরূপ এবং শুক্র তেজঃস্বরূপ। ভগবান্ ব্রহ্মা স্ত্রী-পুরুষের সহযোগে শুক্রপ্রভাবে লোকসৃষ্টি হইবার নিয়ম করিয়া দিয়াছেন। মনুষ্যগণ তাঁহার সেই নিয়মানুসারে কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ করিয়া স্ব স্ব কৰ্ম্মানুসারে সুখদুঃখ ভোগ করিতেছে।”