১৮. য়ুহা চোখ খুলে তাকালো

য়ুহা। য়ুহা–

য়ুহা চোখ খুলে তাকালো। কেউ একজন তাকে ডাকছে, ক্লান্তিতে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছিল তার মাঝে সে কোনোভাবে চোখ খুলে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল, আমরা কি বেঁচে আছি না মরে গেছি?

বেঁচে আছি।

তাহলে এ রকম লাগছে কেন?

কী রকম লাগছে?

মনে হচ্ছে মরে গেছি!

মনে হয় আমরা মরেই গিয়েছিলাম, আবার বেঁচে গেছি।

য়ুহা উঠে বসে, সমতল একটা জায়গায় বসে আছে–চারপাশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো বিচিত্র নক্সা। য়ুহা চারদিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়?

জানি না।

আমরা কী যেতে পারব?

সেটাও জানি না। প্রাণীটা আর কোনো কথা বলছে না।

য়ুহা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চারদিকে তাকায়, ঠিক কী কারণ জানা নেই সে নিজের ভেতরে এক ধরনের বিষঃ বেদনা অনুভব করে, মনে হয় কিছু একটা ঘটে গেছে, যেটা সে বুঝতে পারছে না।

রায়ীনা বলল, আমাদের এখন বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা দরকার।

প্রাণীটা যেতে দেবে?

কেন দেবে না? আমাদের শরীরের প্রত্যেকটা কোষ খুলে খুলে তার যেটা জানা দরকার জেনে গেছে। আমাদের সবকিছু সে জানে।

সবকিছু?

হ্যাঁ। সবকিছু। আমরা কী চিন্তা করি, কী ভাবি সব কিছু।

য়ুহা ক্লান্ত গলায় বলল, ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার শরীরটা কেমন যেন গুলিয়ে আসছে।

রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এসব নিয়ে ভাবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন চল, দেখি এখান থেকে বের হওয়া যায় কি না। আমার হিসেব অনুযায়ী আমার খোজে আমার দলের লোকজনের এতক্ষণে চলে আসার কথা।

য়ুহা আর রায়ীনা অস্ত্র হাতে সতর্ক পায়ে এগুতে থাকে। কেউ তাদেরকে বাধা দিল না-কেন বাধা দিল না সেই ভাবনাটি তাদের ভেতরে খচখচ করতে থাকে। তাহলে কি এমন কিছু ঘটেছে যেটা তারা জানে না?

বিধ্বস্ত মহাকাশযান থেকে বের হয়েই তারা স্কাউটশিপটা দেখতে পায়। মহাকাশযানের কাছাকাছি একটা বড় পাথরের ওপর একটা অতিকায় গুবরে পোকার মতো সেটা বসে আছে। রায়ীনা হাসিমুখে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছো? আমি বলেছি না? আমার খোঁজে আমার লোকজন চলে আসবে?

য়ুহা বলল, তোমাকে যতই দেখছি আমি ততই মুগ্ধ হচ্ছি!

মুগ্ধ হওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে, এখন চল। তাড়াতাড়ি।

য়ুহা রায়ীনায় পিছু পিছু দ্রুত হাঁটতে থাকে। রায়ীনা বলল, আমি বুঝতে পারছি না আমার দলের লোকজন স্কাউটশিপের ভেতর বসে আছে কেন? তারা আমাদের খুঁজছে না কেন?

হয়তো খুঁজেছে।

আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না কেন?

সেটা বুঝতে পারছি না। চেষ্টা করেছ?

হ্যাঁ করেছি।

হঠাৎ তারা একটা বিচিত্র ব্যাপার দেখতে পায়। স্কাউটশিপটা গর্জন করে উঠে থরথর করে কাঁপতে থাকে। দেখে মনে হয় উড়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। য়ুহা চমকে উঠে বলল, রায়ীনা! স্কাউটশিপটা কি চলে যাচ্ছে?

অসম্ভব! আমাদের না নিয়ে কিছুতেই যাবে না!

হয়তো অনেক খুঁজেছে। খুঁজে না পেয়ে চলে যাচ্ছে।

হতেই পারে না। আমাকে না নিয়ে যাবে না–

রায়ীনা পাথরের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে স্কাউটশিপের কাছে হাজির হয়, তখন সেটা নড়তে শুরু করেছে। রায়ীনা ইঞ্জিনের একটা অংশ ধরে জানালায় মুখ রাখে এবং মুহূর্তে তার মুখমণ্ডল রক্তহীন হয়ে যায়। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রায়ীনা? কী হয়েছে?

রায়ীনা কোনো কথা না বলে শূন্য দৃষ্টিতে য়ুহার দিকে তাকিয়ে রইল।

য়ুহা আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

রায়ীনা এবারেও তার প্রশ্নের উত্তর দিল না, শূন্য দৃষ্টিতে য়ুহার দিকে তাকিয়ে রইল। য়ুহা এগিয়ে গিয়ে রায়ীনাকে সরিয়ে জানালায় মুখ রেখে ভেতরে তাকালো, স্কাউটশিপে অনেকেই আছে, সবার সামনে দুজনতাদেরকে সে স্পষ্ট চিনতে পারল, একজন রায়ীনা, অন্যজন য়ুহা।

য়ুহা বিস্ফারিত চোখে রায়ীনার দিকে তাকালো, কঁপা গলায় বলল, ওরা কারা?

আমি আর তুমি।

আমরা কারা?

আমি জানি না।

য়ুহা আর রায়ীনা বিধ্বস্ত মহাকাশের পাশে দাঁড়িয়ে দেখল স্কাউটশিপটি গর্জন করে উপরে উঠে পেছনে তীব্র লাল আলোর একটা জ্বলন্ত শিখা বের করে উড়ে গেল, যতক্ষণ সেটা মিলিয়ে না গেল তারা দুজন সেদিকে তাকিয়ে রইল। যখন সেটা ছোট একটা আলোর বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল তখন য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এমন কী হতে পারে যে আমি আর তুমি আসল য়ুহা আর আসল রায়ীনা। আমাদেরকেই রেখে আমাদের অন্য দুজনকে নিয়ে গেছে?

রায়ীনা য়ুহার দিকে তাকালো, বলল, তুমিই বল? তুমি কি সত্যিকার য়ুহা?

য়ুহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, না, আমি আসল য়ুহা না।

কেন?

আসল য়ুহা একজন কবি। সে শব্দের পাশে শব্দ বসিয়ে কবিতা লিখতে পারত। আমি পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি আমি শব্দের পাশে শব্দ আর বসাতে পারি না।

রায়ীনা মাথা নাড়ল, বলল, আসল রায়ীনা মানুষের বুদ্ধিমত্তার ওপর গবেষণা করত। কুরিত্রা সমীকরণের সহগগুলো সে মনে মনে হিসাব করে বের করতে পারত। আমি পারি না।

য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের মতো দুঃখী আর কেউ নেই। তাই না রায়ীনা?

রায়ীনা মাথা নাড়ল। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব রায়ীনা।

মহাকাশের এই প্রাণীটা যেন আমাদের মতো কাউকে নিয়ে এ রকম নিষ্ঠুরত্ত করতে না পারে সেটা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। মহাকাশযানটি এখানে বিধ্বস্ত হয়েছিল বলে সে মহাকাশের সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমরা প্রাণীটিকে হত্যা করতে পারব না–কিন্তু সে যেন আর বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে সেটা তো নিশ্চিত করতে পারি।

আমরা কী পারব?

পারব। আগে আমরা কখনো আমাদের প্রাণের ঝুঁকি নিইনি। এখন আমাদের প্রাণের কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা এখন নিরাপদ স্কাউটশিপে করে মহাকাশযানে যাচ্ছি। আমাদের শুধু দুটি দেহ এই গ্রহে রয়ে গেছে। আমার আর তোমার এই দেহ দুটির কোনো মূল্য নেই।