হয়তো বেঁচে আছে জো। কেননা তার মতো চটপটে, চতুর আর পাকা সাঁতারু নিশ্চয়ই ঐ হ্রদে ড়ুবে মরবে না। খানিকক্ষণ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছুলেন দু-জনে। অন্তত এইভাবেই নিজেদের আশ্বাস দিতে চাচ্ছিলেন তারা। মুখে কিন্তু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলে কী হবে, মোটেই কোনোরকম ভরসা ছিলো না কারু। বাঁচলে তারা সুখী হন, এইজন্যেই এটা তারা মনে-মনে ভেবে নিলেন। অনেকটা ইচ্ছাপূরণকারী দিবাস্বপ্নের মতো। যা হলে ভালো হবে, যা হলে বিবেক একটু সান্ত্বনা পায়, তাই তারা ভাবলেন। সত্য নিষ্ঠুর বলে অনেক সময়েই মানুষ তার দিকে চোখ বুঝে এক অলীক স্বর্ণ বানিয়ে নেয়। কিন্তু সে বেঁচে আছে এই ভেবে তো আর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা যায় না, তন্নতন্ন করে চারদিকে অনুসন্ধান করতে হবে। দৈব দয়া করলে হয়তো ফিরেও পাবেন জো-কে। কিন্তু তাকে খুঁজতে বেরুবার আগে আরেকটি জরুরি কাজ সাঙ্গ করতে হবে তাদের। দুটি বেলুনের মধ্যে যেটি বাইরে ছিলো, ঈগলদের দুর্বিনীত হিংস্রতার চিহ্ন স্বরূপ সেটির নানা স্থানে কতগুলি ছিদ্র হয়ে গেছে। ওটাকে খুলে ফেলতে হবে প্রথমে, তাহলে অন্তত সাড়ে ছ-শো পাউণ্ড হালকা হবে বেলুন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই হ্রদের তীরে একটু ঘুরে দেখে-শুনে এলেন দুজনে, তারপর কাজে লেগে গেলেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টার গলদঘর্ম পরিশ্রমের পর বেলুনের বাইরের ঢাকাটা খোলা গেলো। বাইরের খোলটা না-থাকায় অবশ্য বেলুনটির ভেসে-থাকার ক্ষমতা পাঁচভাগের এক ভাগ কমে গেলো, কিন্তু তা নিয়ে এখন আর আপশোশ করে কোনো লাভ নেই, কেননা ঐ অকেজো সাড়ে ছ-শো পাউণ্ড বেলুনে রেখে তাকে অক্ষম করে রাখার চাইতে এটা তবু কিছুটা মন্দের ভালো হলো। কেনেডি একবার প্রশ্ন করেছিলেন, এর ফলে সবাইকে নিয়ে বেলুনটা উড়তে পারবে তো? ফার্গুসন তার জবাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন তাকে, সে-বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকো। জিনিশপত্র সব আমি এমনভাবে উলটেপালটে সাজিয়ে নেবো যে জো ফিরে এলেও আমরা সবাই একসঙ্গে উড়তে পারবো।
বেলুনের বাইরের খোলটা খুলে ফেলার পর ফার্গুসনের পরামর্শমতো কেনেডি বন্দুক হাতে বেরিয়ে পড়লেন। অভিপ্রায় : যদি কোনো শিকার মেলে। যাবার আগে ফার্গুসন তাক বারেবারে বারণ করে দিলেন বেশি দূরে যেয়ো না কিন্তু। এ-জায়গা সম্বন্ধে আমার কোনোই আন্দাজ নেই। কখন কী হয়, তার কিছুই ঠিক নেই।
কেনেডি শিকারে বেরিয়ে যাবার পর ফার্গুসন একাই বেলুনের সব জিনিশপত্র নতুন করে সাজালেন। জো-র ওজন অনুযায়ী দোলনায় কিছু নুড়ি-পাথরও তোলা হলো, যাতে বেলুনের ভারসাম্য বজায় থাকে। এইসব করতে-করতেই বেলা গেলো। একসময় কেনেডি ফিরে এলেন! কতগুলি বুনো হাঁস আর নানা ধরনের পাখি মেরে এনেছেন ছররা-গুলি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সেগুলিকে রোস্ট করে ভবিষ্যতের খাদ্য হিশেবে তুলে রাখা হলো।
এইসব করতে-করতে সেই দিনটা কেটে গিয়ে রাত করে এলো। খাওয়া-দাওয়ার পর পালা করে দু-জনে ঘুমিয়ে নিলেন। শরীর যদি চাঙা ও সক্ষম না-থাকে, তাহলে কোনো কাজই হবে না।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দু-জনে পরামর্শ করতে বসলেন, কী করে জোর তল্লাশ করা যায়। অন্তত জো-কে এটুকু তো জানানো উচিত, তারা কোথায় আছেন। কিন্তু জো যে কোথায় আছে, তা না-জানলে সে-খবর তার কাছে পৌঁছে দেয়া যায় কী করে? শেষটায় ফাণ্ডসন বললেন, বড় অসহায় আমরা, ডিক। দৈবের হাতে সব সমর্পণ করে দেয়া ছাড়া প্রায় কিছুই আমাদের করার নেই। তবে—এখন তো বাতাস ফের উলটো দিকে বইছে। আমরা ইচ্ছে করলে ফের হ্রদের দিকে যেতে পারি। তাই করি বরং, কী বলো? তাতে অনুসন্ধানেরও সুবিধে হবে-তাছাড়া এমনও তো হতে পারে যে জো কোথায় আছে তা পথেই আমাদের নজরে পড়ে গেলো?
এটা ফার্গুসন নিশ্চিত করে জানতেন যে, কোনো বিপদে না-পড়ে থাকলে জো এসে তাদের দেখা দেবেই। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে জংলিরা তাকে বন্দী করে রেখেছে। এমন অবস্থায় আকাশে বেলুন দেখে সে হয়তো একটু আশ্বস্ত হবে। একটি তথ্য ফার্গুসন জানতেন, সেটাই এখন তাঁর সৌভাগ্য বলে মনে হলো : এই অঞ্চলের জংলিরা বন্দীকে নাকি উম্মুক্ত স্থানে বেঁধে রাখে। তার সব ধারণা তিনি বন্ধুর কাছে খুলে বললেন। দু-জনেই তক্ষুনি রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
নোঙর খুলে আকাশে তোলা হলো ভিক্টরিয়াকে, অমনি বিপরীত হাওয়ায় প্রায় কুড়ি মাইল বেগে হ্রদের ভেতর দিকে চলতে লাগলো বেলুন। ফার্গুসন তাপ নিয়ন্ত্রণ করে বেলুনকে দুশো থেকে পাঁচশো ফিট উচ্চতায় রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। কেনেডি মাঝে-মাঝে ফাঁকা আওয়াজ করতে লাগলেন বন্দুক দিয়ে; যদি কোনোরকমে সেআওয়াজ জো-র কানে গিয়ে পোঁছোয়, তাহলে সে হয়তো সাড়া দিতে পারবে-অন্তত সাড়া দিক বা না-দিক, তাদের অবস্থান বুঝতে পারবে।
জো যেখানে লাফিয়ে পড়েছিলো সে-জায়গা অতিক্রম করে গেলেন তারা, কিন্তু জো-র কোনো চিহ্নই দেখা গেলো না। কেনেডি একেবারে নিরাশ হয়ে পড়লেন। ফার্গুসনও যে হতাশ হননি তা নয়, কিন্তু মুখে সে-ভাব প্রকাশ না-করে বন্ধুকে তিনি আশা দিলেন, অত তাড়াতাড়ি মুষড়ে পড়ো কেন? অমন হুতুশে স্বভাব ভালো না। একটু ধৈর্য ধরে থাকো—এত সহজে হতাশ হলে চলে না।
বেলা যখন প্রায় এগারোটা বাজে, তখন ফার্গুসন হিশেব করে দেখলেন যে এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা প্রায় নব্বই মাইল অতিক্রম করেছেন। এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই অতর্কিতে আবার আরেক বিপদ। আচমকা প্রায় সমকোণের মতো করে হাওয়ার গতি ঘুরে গেলো। ফার্গুসন বিচলিত হয়ে পড়লেন। এভাবে গেলে আবার তাহলে সেই ভীষণ মরুভূমির খপ্পরে গিয়ে পড়তে হবে। উঁহু, সেদিকে আরকিছুতেই যাওয়া চলবে না। যে-করেই হোক হ্রদের আশপাশেই থাকতে হবে তাদের। অনুকূল বাতাসের আশায় বেলুনকে অনেক ওপরে তুলে নেবার ব্যবস্থা করলেন তিনি
অবশেষে অনেকটা ওপরে ওঠবার পর উত্তর-পশ্চিম এক হাওয়ার স্তর পাওয়া গেলো; সেই হাওয়া তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেলো গত রাতে তারা যেখানে ছিলেন সেইদিকে। শেষে একসময়ে যথারীতি তীরভূমি দেখা দিলে, বেলুন নিচে নামিয়ে সেখানেই রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হলো।
সকালবেলায় আচমকা হাওয়া এমন প্রবল হয়ে উঠলো যে নোঙরের বাধা নামেনে বেলুন প্রচণ্ডভাবে দুলতে লাগলো। বেশ বোঝা গেলো যে এখানে থাকা আর মোটেই নিরাপদ নয়। শিগগির দু-জনে বেলুনে উঠে পড়লেন।
কেনেডি অবশ্য একটু আপত্তি তুলেছিলেন, এভাবে আমরা চলে গেলে জোর কী হবে? .
ওকে আমরা নিশ্চয়ই ছেড়ে যাবো না, ডিক। কিন্তু এখানে থাকলে কারুই কোনো উপকার হবে না, মাঝখান থেকে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা হবে। বেলুনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর তাহলে জো-কে উদ্ধার করবার আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সেটা নিই আমাদের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
কিন্তু যাওয়ার আগে এক মুশকিলে পড়তে হলো। নোঙরটা মাটির ভিতর এতটা সেঁধিয়ে গিয়েছিলো যে অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তাকে টেনে তোলা গেলো না। শেষকালে কোনো উপায় না-দেখে ফার্গুসন নোঙরের দড়ি কেটে দিতে বাধ্য হলেন। যেই দড়ি কেটে দেয়া হলো, অমনি তড়াক করে প্রায় তিনশো ফিট ওপরে উঠে গেলো বেলুন, সোজা চললো উত্তরমুখো, তীরের মতো। এই প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার হাতে নিজেদের সমর্পণ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। স্তব্ধ হয়ে রইলেন ফার্গুসন, বিষণ্ণ। ক্রমেই বেলুন একটু একটু করে তার সব ক্ষমতা হারাচ্ছে। ফেলে দেয়া হয়েছে জলের পিপে ও অন্য অনেক সরঞ্জাম, তার বাইরের খোলটাও চলে গেছে, এখন গেলো তার নোঙর। আর, শুধু তা-ই নয়, সর্বোপরি, তার এতকালের এত অভিযানের সঙ্গী প্রিয় ভৃত্য জো-ও কিনা সঙ্গে নেই-হয়েতো তাকেও চিরকালের মতো হারাতে হলো। এ-কথা ভাবতে ফার্গুসনের বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। অসীম নীলিমার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি উদগত অশ্রুকে গোপন করলেন।
কাঁটাঝোপ আর বন্য গুল্ম-ভরা সুদান সীমান্তের টিবাউস মরুভূমি অঞ্চল পেরিয়ে এলো ভিক্টরিয়া। শোঁ-শোঁ করে বেলুন তিন ঘণ্টায় প্রায় ষাট মাইল পথ পেরিয়ে এলো। নোঙর নেই বলে এখন বেলুনের ওপর কোনো কর্তৃত্বও নেই আরোহীদের। ফাণ্ডসন দেখলেন তাঁর নিজের হাতে গড়া জিনিশ এখন আর তার ইচ্ছেকে সম্মান করে না। এমন বিপদ, যে নামাও যাচ্ছে না, থামাতেও পারছেন না। এমনকী কোনো গাছ বা টিলাও নজরে পড়ছে না যে কোনোরকমে তার গায়ে গিয়ে বেলুন ঠেকবে। এমনিভাবে যদি খানিকক্ষণ চলে তো সাহারা মরুভূমিতে গিয়ে পৌঁছোত হবে তাদের। সাহারার কথা ভাবতেই ফার্গুসনের শরীর শিউরে উঠলো। ঈশ্বর করুন কিছুতেই যাতে সাহারায় গিয়ে না-পৌঁছুতে হয়—একবার সাহারার পাল্লায় পড়লেই সব আশা শেষ হয়ে যাবে।
এদিকে ঝড়ের গতিও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। প্রবল ঘূর্ণি হাওয়ার প্রচণ্ড দাপটে ভয়ানকভাবে দুলতে লাগলো বেলুনের দোলনা-আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে অসহায় আরোহী দু-জন রেলিঙ আঁকড়ে নিরুপায়ভাবে বসে রইলেন। আর, এমনভাবে কতক্ষণ চলবার পর, আবার এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। হঠাৎ থমকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো বেলুন, সব হাওয়া মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পরক্ষণেই এলো আরেক ঝোড়ো হাওয়া, এবারে উলটো দিক থেকে। যেমন প্রচণ্ড গতিতে এতক্ষণ তাদের তাড়িয়ে এনেছিলো, তেমনি প্রচণ্ডভাবে আবার বেলুনকে আগের জায়গায় টেনে নিয়ে চললো। বাতাস যেন নতুন খেলনা পেয়েছে তার হাতে, তাই তাকে নিয়ে বাচ্চাদের মতো লোফালুফি খেলছে এখন।
এ আবার কোথায় চলেছি?
ঈশ্বরের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখো, ডিক। আবার দক্ষিণ দিকেই চলেছি আমরা। এতক্ষণ আমি সেদিকেই যেতে চাচ্ছিলুম। হয়তো শেষ অব্দি আমরা বরনু এলাকার কুকা শহরে গিয়ে পৌঁছুবো।
মনে হচ্ছে ঝড় শিগগিরই কমে যাবে। আকাশ তো বেশ পরিষ্কার হয়ে এলো।
ভালোই তো। দুরবিন নিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো চারদিকে—কোনকিছুই যেন আমাদের নজর এড়িয়ে চলে যেতে না-পারে।