প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৮. সমাজ-বিকাশের ধারা

লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হয়ে আমরা সমাজ-বিকাশের কোনো এক প্রাক্‌-সভা পর্যায়ে গিয়ে পড়েছি। কিন্তু সে-কথার তাৎপর্য ঠিক কী? তার মানে কি এই যে প্রাচীন সমাজের সেই মানুষেরা বুদ্ধিশুদ্ধির দিক থেকে এমনই খাটো বা নিকৃষ্ট ধরনের ছিলো যে অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারার মহিমাটা তারা বুঝতেই পারে নি? এক কথায় প্রশ্ন হলো,—এর কারণটা কি এই যে তাদের মগজের গড়নটাই বাজে রকমের ছিলো, তাই তারা ইহলোক ছাড়া আর কিছুই সত্যি বলে ভাবতে পারেনি? তাদের লোকায়তিক চেতনাটা কি শুধুই স্থূলবুদ্ধির পরিচায়ক?

তা নয়। আসল কারণটা মগজের গড়ন নয়, সমাজের গড়ন। সমাজের গড়নটা বদলেছে বলেই মানুষের মাথায় এক ধরনের ধ্যানধারণার বদলে আর এক ধ্যানধারণার উদয় হয়েছে।

আধুনিক বিজ্ঞান(৬০) অনুসারে গত হাজার তিন-চার বছরের মধ্যে মাপ বা গড়ন কোনো দিক থেকেই মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের খুব উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। তবুও তার চিন্তাচেতনায় আকাশ-পাতাল তফাত দেখা দিয়েছে। কী করে তা সম্ভব হলো? তার কারণ, যদিও মানুষের চিন্তাচেতনা তার স্নায়ুতন্ত্রের উপরই নির্ভরশীল, তবুও এই স্নায়ুতন্ত্রের উপরই পারিপার্শ্বিকের যে-অবিরাম ঘাত-প্রতিঘাত চলেছে তার কথা বাদ দিলে স্নায়ুতন্ত্রের স্বরূপটাই বুঝতে পারা সম্ভব নয়। এ-কথায় যাঁদের মনে সন্দেহ আছে তাঁরা পাভ্‌লভের(৬১) রচনাবলী থেকে প্রমাণগুলি দেখে নেবেন।

লোকায়তিক ধ্যানধারণাকে পিছনে ফেলে মানুষ যে এককালে অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণা্র আওতায় এসে পৌঁছেছিলো তার আসল কারণ তার স্নায়ুতন্ত্রে কোনো রকম আকস্মিক পরিবর্তন নয়,—আসলে তার সমাজ-সংগঠনের ক্ষেত্রে এ আমূল পরিবর্তন। অধ্যাত্মবাদের জন্মবৃত্তান্ত জানতে হলে এই পরিবর্তনটাকে ভালো করে বোঝা দরকার।

মানবসমাজের ইতিহাসটা একবার আগাগোড়া দেখবার চেষ্টা করা যাক।

আজ পর্যন্ত মানবসমাজের যে-ইতিহাস তাকে আমরা মোটের উপর তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি :

এক : আদিম প্রাক-বিভক্ত সমাজ
দুই : বর্তমান শ্রেণী-সমাজ
তিন : আগামী কালের শ্রেণীহীন সমাজ

প্রাক-বিভক্ত সমাজটাকে বলা হয় আদিম সাম্যসমাজ। তার কারণ, এ-সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিচয় নেই, পরিচয় নেই রাষ্ট্রব্যবস্থার। শোষক নেই, শোষিত নেই, শাসক নেই, শাসিত নেই। সবাই স্বাধীন, সবাই সমান, মানুষে-মানুষে সত্যিই ভাই-ভাই ভাব। এ-রকম সমাজ যে কল্পনা নয়, বাস্তব—তার প্রমাণ? প্রমাণ হলো, আজো পৃথিবীর নানান জায়গায় এ-রকম সমাজ সত্যিই রয়েছে, তাই সে-সমাজ স্বচক্ষে দেখা যায়। লুইস্‌ হেনরি মর্গান এ-সমাজ সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান পাবার জন্যেই জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই এ-হেন সমাজের মধ্যে কাটিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এ-কয়জাও তিনি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করলেন যে পৃথিবীর যে-কোনো দেশের মানুষ আজ সভ্যতার যতো উচ্চ-স্তরেই পৌঁছোক না কেন, কোনো এক অস্পষ্ট অতীতে তারাও এই সমাজেই বাস করেছিলো।

এ-হেন প্রাচীন সমাজ সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য কেন? কেননা, এ-অবস্থায় মানুষের উৎপাদন-শক্তি এতো অনুন্নত যে সকলে মিলে প্রাণপণ পরিশ্রম করে দলের সকলের জন্যে কোনোমতে নিছক প্রাণ-ধারণের উপাদানগুলি প্রকৃতির কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে। হাতিয়ার যদি উন্নত হয় তাহলে একজন মানুষের পক্ষে প্রচুর পরিমান জিনিস উৎপাদিন করা সম্ভব। কিন্তু হাতিয়ার যখন স্থূল ও প্রাকৃত তখন একজন মানুষ প্রাণপাত পরিশ্রম করে যেটুকু জিনিস উৎপাদন করতে পারে তাই দিয়ে কোনোমতে শুধু নিজেকে বাঁচানো সম্ভব। এ-অবস্থায় মানুষের শ্রম উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে শেখে নি, তাই এ-সমাজ উদ্বৃত্তজীবী বলে কোনো শ্রেণীর আবির্ভাবও সম্ভব নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সমানে-সমান সম্পর্ক। শুধু তাই নয়। এ-অবস্থায় কারুর পক্ষে একা একা বাঁচবার চেষ্টাও অসম্ভব : প্রকৃতিরাজ্যে বিঘ্ন বিপর্যয়ের অন্ত নেই, স্থূল হাতিয়ার হাতে দুর্বল মানুষদের একমাত্র ভরসা হলো সংখ্যা। মানুষের চেতনারও তাই ঝোঁকটা একের উপরে নয়, ব্যক্তির উপরে নয়, ব্যষ্টির উপরে নয়। তার বদলে, পুরো দলের উপর, সকলের উপর, সমষ্টির উপর। সমষ্টির চেষ্টাতেই মানুষের পক্ষে এ-অবস্থায় বাঁচা সম্ভবপর। তাই শ্রমে অংশ গ্রহণ করবার দিক থেকে সকলের সঙ্গে সকলের সমান, শ্রমের ফল ভোগ করবার দিক থেকেও সকলের সঙ্গে সকলে সমান।

কিন্তু মানুষের উৎপাদন-কৌশল চিরকার একই অবস্থায় টেকে থাকে নি। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতেই মানুষের হাতিয়ার শানিত হয়েছে, উন্নত হয়েছে। এবং এইভাবে উন্নত হতে হতে একটা অবস্থায় পৌঁছে দেখা গেলো মানুষকে কোনোমতে টায়েটুয়ে বাঁচিয়ে রাখবার পক্ষে যতটুকু দরকার তার চেয়েও বেশি জিনিস মানুষ উৎপাদন করতে পারছে। এই অবস্থাতেই প্রথম দেখা দিলো শ্রম-বিভাগ : কিছু মানুষ শুধুমাত্র কারিগরি কাজ নিয়ে থাকবে, অন্ন-উৎপাদনের প্রত্যক্ষ দায়িত্বটা আর তাদের নিজেদের উপর থাকবে না, কেননা বাকি মানুষের উৎপন্ন অন্নের উদ্বৃত অংশটুকু থেকে তাদের খাবার যোগান দেওয়া হবে। এই শ্রমবিভাগের দরুনই মানুষের উৎপাদন-কৌশল দ্রুত উন্নত হতে লাগলো, কেননা, অন্ন উৎপাদনের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থেকে যারা মুক্তি পেলো তারা উন্নততর উৎপাদন-যন্ত্র উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করতে পারলো।

তারপর এইভাবে এগোতে এগোতে মানুষ এসে পৌঁছলো একেবারে নতুন ধরনের এক অবস্থায়। শ্রমবিভাগের এমন এক নতুন পর্যায় দেখা দিলো যার সঙ্গে আগেরকার শ্রমবিভাগের গুণগত ও মৌলিক প্রভেদ। নতুন পরিস্থিতিটা কী রকম? একদিকে উৎপাদন-কর্মের সংগঠন আর একদিকে যারা বাস্তবিকই উৎপাদিন করবে তারা। যারা সংগঠক তারা নিজেরা উৎপাদনকাজে অংশগ্রহণ করবে না, নিজেরা পরিশ্রম করবে না, গতর খাটাবে না। তার বদলে তারা মাথা খাটাবে—সংগঠনের জন্যে শুধু মাথা খাটানোরই প্রয়োজন।

এই সংগঠকশ্রেণী থেকেই ক্রমশ দেখা দিলো পুরোহিত-শ্রেণী(৬২)। শুরুতেই তারা নিশ্চয়ই উৎপাদনের উপায়গুলির মালিক হয়ে বসে নি : তার বদলে তাদের দায়িত্ব ছিলো উৎপাদন কাজের তদারক করা এবং উৎপাদনের ওই উপায়গুলির রক্ষণাবেক্ষন করা—মাথা খাটিয়ে, ভেবেচিন্তে, পুতো সমাজের উৎপাদন কাজটির পরিচালনা করা। এ-দায়িত্ব তাদের স্বভাবতই অনেকখানি কর্তৃত্বের অধিকারী করেছিলো। কর্তৃত্বশক্তি না থাকলে পুরো সমাজটার কাজকর্ম পরিচালনা করা সম্ভবপর নয়।

এই কর্তৃত্বশক্তির প্রভাবেই কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত আর উৎপাদিন কাজের পরিচালক রইলো না, উৎপাদিনের উপায়গুলির শুধুমাত্র রক্ষক রইলো না। তারা ক্রমশই এগুলির মালিক হয়ে দাঁড়ালো। আর এইভাবেই আদিম প্রাক-বিভক্ত সাম্যসমাজ ভেঙে গিয়ে দেখা দিলো নতুন ধরনের সমাজ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। একদিকে মালিক-শ্রেণী,—তারা মাথা ঘামাবে, কিন্তু গতর খাটাবে না। অপর দিকে শ্রমিক-শ্রেণী,—তারা শুধুই গতর খাটাবে, কিন্তু মাথা ঘামাবার সুযোগ-সুবিধে তাদের জন্যে নয়(৬৩)।

অর্থাৎ কিনা, সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার দরুন শুধুই যে মালিকে-শ্রমিকে তফাত দেখা দিলো তাই নয়, তারই অনিবার্য অঙ্গ হিসাবে দেখা দিলো শ্রমের সঙ্গে চিন্তার বিচ্ছেদ, গতর খাটানোর সঙ্গে মাথা খাটানোর বিচ্ছেদ, কায়িক শ্রমের সঙ্গে মানসিক শ্রমের বিচ্ছেদ।

আর এই তথ্যটুকু মনে না রাখলে অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণার জন্মকাহিনী সত্যই বুঝতে পারা যাবে না। এঙ্গেলস্‌(৬৪) বলছেন :

With each generation, labour itself different, more perfect, more diversified. Agriculture was added to hunting and cattle-breeding, then spinning, weaving, metal-working, pottery, and navigation. Along with trade and industry, there appeared finally art and science. From tribes there developed nations and states. Law and politics arose, and with them the fantastic reflection of human things in the human mind: religion. In the face of all these creations, which appeared in the first place to be products of the mind, and which seemed to dominate human society, the more modest productions of the working hand retreated into the background, the more so since the mind that plans the labour process already at a very early stage of development of society (e.g. already in the simply family), was able to have the labour that had been planned carried out by other hands than its own. All merit for the swift advance of civilisation was ascribed to the mind, to the development and activity of the brain. Men became accustomed to explain their actions from their thoughts, instead of from their needs – (which in any case are reflected and come to consciousness in the mind) – and so there arose in the course of time that idealistic outlook on the world which, especially since the decline of the ancient world, has dominated men’s minds.

অর্থাৎ, বংশপরস্পরায় শ্রমের রূপান্তর হতে লাগলো; শ্রম আরো নিখুঁত আরো বিচিত্র হয়ে উঠতে লাগলো। শিকার ও পশুপাওনের সঙ্গে সংযুক্ত হল কৃষি; তারপর সুতোকাটা, কাপড় বোনা, ধাতুর কাজ। মৃৎশিল্প, নৌচালনা। বাণিজ্য ও শিল্পের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত আবির্ভাব  হলো চারুকলা ও বিজ্ঞানের। গোষ্ঠী বদলে দেখা দিলো জাতি ও রাষ্ট্র। আইন এবং রাজনীতির আবির্ভাব হলো, আর সেই সঙ্গে মানব-মনে মানব-ব্যাপারেরই কাল্পনিক প্রতিবিম্ব : ধর্ম। এইসব সৃষ্টির পাশে,—যেগুলি কিনা মুখ্যত মনের সৃষ্টি বলেই প্রতীয়মান হয়েছিলো এবং মানবসমাজ নিয়ন্ত্রণে যেগুলির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছিলো,—মানবহাতের অপেক্ষাকৃত সাদাসিধে কীর্তিগুলি পিছিয়ে পড়তে লাগলো, এবং ততোই বেশি পিছিয়ে পড়তে লাগলো যতোই কিনা যে-মন শ্রমের পরিকল্পনা করেছে সেই মনই নিজের হাত ছাড়াও অপরের হাতের সাহায্যে এই পরিকল্পিত শ্রমকে সফল করিয়ে নিতে শিখেছে—সমাজবিকাশের খুব পুরোনো পর্যায় থেকেই এ-ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়েছে। সভ্যতার দ্রুত অগ্রগতির সমস্ত কৃতিত্ব গিয়ে পড়তে লাগলো মনের উপর, মগজের বিকাশ ও ক্রিয়ার উপর। প্রয়োজনের দিক থেকে চিন্তার ব্যাখ্যা করবার বদলে মানুষ ধ্যানধারণা দিয়েই চিন্তার ব্যাখ্যা করতে শিখলো (শেষ পর্যন্ত যদিও প্রয়োজনই ধ্যানধারণা হিসেবে মনের উপর প্রতিবিম্বিত হয়েছে ও চেতনায় ধরা দিয়েছে);—এইভাবেই কালক্রমে প্রকৃতি সম্বন্ধে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হলো, এবং বিশেষ করে প্রাচীন যুগ শেষ হবার পর থেকে দৃষ্টিভঙ্গিই মানবমনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

ভাববাদ ও অধ্যাত্মবাদের জন্মকাহিনী আর কোথাও এর চেয়ে স্পষ্ট ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিনা খুবই সন্দেহের কথা। এবং, ভবিষ্যতে “বরুণ” নামের পরিচ্ছেদে আমরা দেখতে পাবো ভারতীয় দর্শনের দলিলপত্র কতো অভ্রান্তভাবে এই কথাগুলিই প্রমাণিত করে : আমাদের দেশে সমাজের সদরমহল থেকে কায়িক শ্রমের মর্যাদা যতোই মুছে গিয়েছে ততোই মানুষের চেতনায় জন্ম হয়েছে ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার।

তাই এ-কথা মনে করলে ভুল করা হবে যে সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার আগে পর্যন্ত মানুষের মাথায় অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী ধ্যানধারণার আবির্ভাব হবে কোনো অবকাশ ছিলো। শ্রম বা কর্ম বস্তুতন্ত্র। শঙ্করাচার্যের(৬৫) সমস্ত শক্তির যুক্তি সত্ত্বেও তাই। এ-কথা পরে প্রতিপন্ন করবার অবকাশ পাবো। আপাতত, যে-প্রশ্ন সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সেটা হলো আদিম সাম্যসমাজের—প্রাক-বিভক্ত সমাজের—মানুষদের ধ্যানধারণার কথা।

যে-সমাজে উৎপাদন-কর্মের সঙ্গে,—শ্রমের সঙ্গে,—সমস্ত মানুষেরই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সে-সমাজের চিন্তাচেতনাটা,—যতোই মুক ও অস্ফুট হোক না কেন,—প্রাক-অধ্যাত্মবাদী, অতএব  লোকায়তিকই হওয়া স্বাভাবিক নয় কি? ভারতীয় দর্শনের দলিলপত্র তো তাই-ই প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু এখানে সমস্ত দলিল পেশ করবার অবকাশ নেই। তার বদলে সমস্যাটাকে আর একদিক থেকে দেখবার চেষ্টা করা যাক।

মানুষের উৎপাদন পদ্ধতিই তাকে আদিম প্রাক-বিভক্ত সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজের আওতায় নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতি সেইখানেই শেষ হয় নি। এই উন্নতিই মানুষকে শ্রেণীসমাজের কাঠামোর মধ্যেই একের পর এক পর্যায় পার করে গিয়ে নিয়ে চলছে : দাস-সমাজ, সাম্নত-সমাজ, ধনতান্ত্রিক-সমাজ। ধনতান্ত্রিক-সমাজের পূর্ণ বিকাশই শ্রেণীবিভাগের শেষ সীমানা। কেননা, এই অবস্থায় পৌঁছে মানুষ দেখছে তার উৎপাদন শক্তি এমন অবিশাস্য হয়ে উঠেছে যে শ্রেণীসমাজের কাঠামোত মধ্যে একে আর কিছুতেই ধরে রাখা সম্ভব নয়। মানুষের উৎপাদন শক্তি যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে মানুষে-মানুষে বর্তমান সম্পর্কের বিরুদ্ধে, শ্রেণী-সম্পর্কের বিরুদ্ধে(৬৬)। আজকের দিনে ধনতান্ত্রিক সমাজে যে সংকট প্রকট হয়েছে তার সমাধান আগামীকালের শ্রেণীহীন সমাজ। এই শ্রেণীহীন সমাজের কথা আজ আর স্বপ্নকথা নয়, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ আজ সচেতনভাবে সেইদিকে এগিয়ে চলেছে।

এই হলো মানব সমাজের তিনটি মূল স্তর : অতীতের প্রাক-বিভক্ত সমাজ, বর্তমানের শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, আগামীকালের শ্রেণীহীন সমাজ।

অতীতের সেই প্রাক-বিভক্ত সমাজের সঙ্গে আগামীকালের শ্রেণীহীন সমাজের সম্পর্কটা কী রকম? আজকের মানুষ কি শ্রেণীসমাজের জ্বালায় যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অতীতের প্রাক-বিভক্ত সমাজে ফিরে যেতে চাইবে নাকি?

—দাও ফিরে সে-অরণ্য, লও এ-নগর?

নিশ্চয়ই নয়।

আদিম সাম্যসমাজের আসল ভিত্তি ছিলো দারিদ্র্যের। সবাই সমান, কেননা, সবাই সমান গরিব। আর সবাই সমান গরিব, কেননা, উৎপাদনের পদ্ধতি তখন এমনই করুণ যে সবাই মিলে প্রাণপাত পরিশ্রম করে কোনোমতে সবাইকে টায়ে-টুয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

আগামীকালের সাম্যসমাজের ভিত্তিতে প্রাচুর্য। কেননা, গত কয়েক হাজার বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় মানুষ তার উৎপাদন শক্তিকে এমন অবিশ্বাস্য ভাবে বাড়িয়ে ফেলেছে যে তারই সাহায্যে আজ অভাবনীয় ধনসম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। তা সত্ত্বেও আজকের দিনে মানুষের দুঃখদৈন্য ঘুচছে না। তার কারণ ওই ধনসম্পদ আজ মানুষের অভাবমোচনে নিযুক্ত নয়। লাভ বিক্রি করবার জন্যেওই এগুলি তৈরি করা হয়। তার বদলে, মানুষের অভাব মোচনের উদ্দেশ্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা অনুসারে এই অবিশ্বাস্য উৎপাদন শক্তিকে কাজে লাগালে আজ যার-যা-দরকার তাই পাওয়া সম্ভব হবে। অভাব বলে কথাটিকে মানুষ ভুলে যাবে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা তোলবার সময় আমরা দেখবো, ঠিক এই প্রসঙ্গেই কার্ল মার্কস্‌ বলছেন, finding what is newest in what is oldest,—যা কিনা সবচেয়ে পুরোনো তারই মধ্যে যা সবচেয়ে নতুন তাকে দেখতে পাওয়া। সবচেয়ে নতুন মানে?—ব্যক্তিগত সম্পত্তির অভাব। শ্রেণীশোষণের অভাব। সবচেয়ে পুরানোর মধ্যেও—আদিম সাম্যসমাজেও—তাই-ই চোখে পড়ে।

কার্ল মার্কস্‌-ই প্রথম প্রমাণ করলেন, মানুষের ধ্যানধারণার চরম উৎদ হলো তার সমাজ-ব্যবস্থায়। তার তাই, সমাজ-বিকাশ সম্বন্ধে যে-কথা ধ্যানধারণার ইতিহাস সম্বন্ধেও তাই হওয়াই শুধু স্বাভাবিক নয়, অনিবার্যও।

তার মানে?

আগামীকালের সাম্যসমাজ অতীতের সাম্যসমাজটার দিকে ফিরে যাবার চেষ্টা নয়। কিন্তু তবুও অতীত যুগের সেই সমান-সহজ সম্পর্কটাকে ফিরে পাবার চেষ্টা নিশ্চয়ই : অভাবের ভিত্তিতে নয়, প্রাচুর্যের ভিত্তিতে; নিচুস্তরে নেমে গিয়ে নয়, অতীত যুগের সমান সম্পর্কটাকে উচ্চস্তরে তুলে এনে। মর্গান(৬৭) বলছেন :

It will be a revival, in a higher form, of the liberty, equality and fraternity of the ancient gentes.
অর্থাৎ, সেই প্রাচীন সমাজের গোষ্ঠীগুলিতে যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা ছিলো আগামী কালের সমাজে, উচ্চতর পর্যায়ে, তার পুনরাবির্ভাব হবে।

দার্শনিক ধ্যানধারণার আলোচনায় ফিরে আসা যাক।

মানুষের কথা বাদ দিয়ে মানুষের ধ্যানধারণাকে বোঝবার অবকাশ যদি সত্যিই থাকতো তাহলে দর্শনের ইতিহাস প্রসঙ্গে সমাজ ইতিহাসের এই বহিঃরেখার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হতো। কিন্তু অবান্তর নয়। ধ্যানধারণার কথা জানতে গেলে যাদের মাথায় ধ্যানধারণার আবির্ভাব হয়েছে তাদের কথাও জানা দরকার।

শ্রেণীবিভক্ত সমাজের গণ্ডি ছেড়ে আজকের মানুষ শ্রেণীহীন সমাজের দিকে এগিয়ে যাবার সময় সচেতনভাবে অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণাকে পরিত্যাগ করে বস্তুবাদী দর্শনে প্রতিষ্ঠা খুঁজছে। ওই শ্রেণীহীন সমাজের ভিত্তিতে কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রম,—কর্ম আর জ্ঞান,—দু’-এর ভিতরকার হারানো সম্পর্ক আবার ফিরে আসবে, আর সেই সঙ্গেই দূর হবে ভাববাদের বাস্তব ভিত্তি। মানুষ আর অধ্যাত্মবাদের আলেয়ায় ভুলে প্রবঞ্চনার জলাভূমিতে গিয়ে ডুবে মরবে না, ভাববাদের কথায় মোহগ্রস্ত হয়ে অবাস্তবের পায়ে মাথা কুটতে কুটতে বাস্তব সুখদুঃখগুলোকে ভুলে থাকবে না। তার বদলে, বাস্তব দুনিয়াকে একমাত্র সত্য বলে জেনে দিনের পর দিন একে এমন ভাবে বদল করে চলবে যাতে মানুষের সামনে খুলে যায় প্রকৃত কল্যাণের অসীম দিগন্ত।

আর এই দিক থেকে ভারতীয় দর্শনের দলিলপত্রগুলিকে সত্যিই পরমাশ্চর্য মনে হয়। কেননা, সেগুলি থেকে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই, সমাজ ইতিহাসের আবর্তনের সঙ্গে দার্শনিক চেতনার আবর্তনটি কতো ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত : কেননা, প্রাক-বিভক্ত সমাজের ধ্যানধারণা যে প্রাক-অধ্যাত্মবাদীই এ-কথা ভারতীয় দার্শনিক পুঁথিপত্রের মধ্যে স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট দেখতে পাওয়া যায়।

আগামীকালের নিঃশ্রেণীক সমাজের মধ্যে অতীতের সাম্যসম্পর্ককে অনেক উন্নত পর্যায়ে তুলে আনবার পরিচয়; আগামীকালের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদও সেই রকমই প্রাক্‌-বিভক্ত সমাজের লোকায়তিক চেতনাকেই উচ্চতর পর্যায়ে ফিরিয়ে আনবে,—অবশ্যই মূক ও অচেতন দেহতত্ত্ব হিসেবে নয়, সচেতন ও সমৃদ্ধ বস্তুবাদী দর্শন হিসাবে!

জানি, সমাজ-ইতিহাসের সঙ্গে দর্শনের ইতিহাসকে ইতিভাবে মিলিয়ে বোঝবার চেষ্টার বিরুদ্ধে নানা রকম আপত্তি উঠবে। বিশেষত এই কারণে উঠবে যে শ্রেণীসমাজের কাঠামোর মধ্যেই বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঐতিহাসিক ভাবে ঘটেছে। ভবিষ্যতে এই আপত্তি নিয়ে আলোচনা তোলবার অবকাশ পাবো। আপাতত, লোকায়ত-দর্শনের আলোচনায় এগিয়ে যে-অভিজ্ঞতাটিকে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়েছে সেটুকুই বর্ণনা করা যাক।

ভাববাদী চিন্তার জন্মবৃত্তান্ত প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে এঙ্গেল্‌স্‌-এর যে-উক্তিটি উদ্ধৃত করেছি তার থেকেই একটা সমস্যার সূত্রপাত হয় : সমাজের সদরমহল থেকে শ্রমনিরত মানুষগুলির মর্যাদা ক্ষোয়া যাবার দরুনই যদি ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার জন্ম হয় তাহলে প্রাগ-বিভক্ত সমাজের,—যৌথ শ্রমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের—মানুষদের মাথায় নিশ্চয়ই ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণা বিকশিত হবার কোনো অবকাশই ছিলো না। আর তা যদি না থাকে তাহলে সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণাগুলি বস্তুবাদী হওয়াই সম্ভবপর,—এ-বস্তুবাদ যতো মূক ও অব্যক্তই হোক না কেন। কেননা, সাম্প্রতিক দার্শনিকদের হাজার রকম বাঙময় বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও মানতেই হবে, ভাববাদ বা অধ্যাত্মবাদের একমাত্র পাল্টা-চেতনা হলো বস্তুবাদ।

লোকায়তিক চেতনার উৎস সন্ধানে এগিয়ে দেখা গেলো, সত্যিই তাই। নানান দিক থেকে এ-বস্তুবাদের দারিদ্র অসহ্য ও এমন কি অভাবনীয়। তবুও এ-চেতনা প্রাক-অধ্যাত্মবাদী, কেননা, এর উৎসে প্রাগ-বিভক্ত যৌথ শ্রমের সমাজ!

————————
৬০. B. H. Kirman TMM 29.
৬১. I. P. Pavlov LCR Chapters 11, 20, 21 ইত্যাদি।
৬২. G. Thomson R 7.
৬৩. K. Marx and F. Engels GI 20 : “Division of labour only becomes truly such from the moment when a division of material and mental labour appears. (The first form of ideologists, priests, is concurrent.) From this moment onwards consciousness can really flatter itself that it is something other than consciousness of existing practice, that it really represents something without representing something real; from now on consciousness is in a position to emancipate itself from the world and to proceed to the formation of “pure” theory, theology, philosophy, ethics, etc. But even if this theory, theology, philosophy, ethics, etc.”
৬৪. F. Engels DN 288-9.
৬৫. শঙ্করমতে জ্ঞান বস্তুতন্ত্র, কর্ম পরুষতন্ত্র। ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১.১.৮।
কালীবর বেদান্তবাগীশের তর্জমা ১:১০৫-৮ দ্রষ্টব্য।
৬৬. F. Engels SUS (Karl Marx, Selected Works 1:179)
৬৭. H. L. Morgan AS 562.