১৮শ অধ্যায় – সমস্ত মদ্ৰকবধে কৌরব–পলায়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর মদ্ররাজ নিহত হইলে তাঁহার অনুচর সপ্তশত রথী সংগ্রামার্থ ধাবমান হইল। ছত্র ও চামরপরিশোভিত রাজা দুর্য্যোধন অচলসন্নিভ হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণপূর্ব্বক মদ্রদিগকে বারংবার নিষেধ করিলেন, কিন্তু তাঁহারা তাঁহার বাক্যে অনাস্থা করিয়া যুধিষ্ঠিরকে বিনাশ করিবার মানসে পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক শরাসনে টঙ্কার প্রদান করিয়া অরাতিগণের সহিত সংগ্রাম করিতে লাগিল। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় মদ্ররাজ শল্য নিহত ও যুধিষ্ঠির নিপীড়িত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া গাণ্ডীবনিস্বন ও রথনির্ঘোষে দশদিক পরিপূর্ণ করিয়া সংগ্রামে সমাগত হইলেন।
“অনন্তর অর্জ্জুন, ভীমসেন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র এবং পাঞ্চাল ও সোমকগণ যুধিষ্ঠিরের সাহায্যার্থ তাঁহার চতুর্দ্দিকে অবস্থানপূর্ব্বক মকর যেমন সাগরকে ও মহাবাত যেমন বৃক্ষসকলকে কম্পিত করে, তদ্রূপ কৌরবসৈন্যগণকে বিক্ষোভিত করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহারথ মদ্রকগণ পাণ্ডবসেনাগণকে পুনরায় আলোড়িত করি। ‘রাজা যুধিষ্ঠির ও তাহার ভ্রাতৃগণ কোথায়, এই বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। তখন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পাঁচপত্র ও পাঞ্চালণ সেই মদ্ররাজের অনুচরদিগকে, নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মদ্রদেশীয় বীরগণ কেহ কেহ ছিন্নমহাধ্বজ ও কেহ কেহ চক্রের আঘাতে বিমথিত হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিল। অবশিষ্ট মদ্রকগণ পাণ্ডবগণকে অবলোকন পূর্ব্বক মহাবেগে তাঁহাদের প্রতি ধাবমান হইলে মহারাজ দুর্য্যোধন তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা করিয়া বারংবার নিবারণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহারা কোনক্রমেই তাঁহার শাসন রক্ষা করিল না।
“অনন্তর গান্ধাররাজপুত্র শকুনি কুরুরাজকে কহিলেন, “হে দুর্য্যোধন! ভূমি সংগ্রামে বর্তমান থাকিতে এই মদ্ৰকসৈন্যগণ নিহত হইতেছে, ইহা কোনরূপেই যুক্তিসিদ্ধ নহে। তুমি পূৰ্ব্বে নিয়ম করিয়াছলে যে, সকলে সমবেত হইয়া যুদ্ধ করিবে, তবে এক্ষণে কি নিমিত্ত অরাতিগণকে সৈন্য-সংহার করিতে দেখিয়াও নিশ্চিন্ত রহিছ?’ দুর্য্যোধন শকুনির বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে মাতুল! অমি ইহাদিগকে সমরে প্রবৃত্ত হইতে বারংবার নিষেধ করিয়াছি; কিন্তু ইহারা তাহা অগ্রাহ্য করিয়াছে। ইহারা আমার বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক পাণ্ডবসৈন্যগণকে আক্রমণ করিয়াই নিহত হইতেছে, ইহাতে আমার অপরাধ কি?” তখন শকুনি কহিলেন, ‘কুরুরজ! বীরগণ ক্রুদ্ধ হইলে প্রভুর শাসন রক্ষা করিতে পারে না। অতএব তুমি কোপ সংবরণ কর; এক্ষণে উপেক্ষা করিবার সময় নহে। চল, আমরা সকলেই রথ, কুঞ্জর ও অশ্বগণকে সমভিব্যহারে করিয়া পরস্পরের রক্ষায় কৃতনিশ্চয় হইয়া মদ্রকগণের পরিত্রাণার্থে গমন করি।’
“হে মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন এইরূপ অভিহিত হইয়া অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে সিংহনাদে মেদিনী কম্পিত করিয়া গমন করিতে লাগিলেন; অন্যান্য বীরগণও মদ্রকদিগের রক্ষার্থে ধাবমান হইলেন। তথন কৌরবসৈন্যমধ্যে ‘নিহত কর, বিদ্ধ কর, আক্রমণ কর, প্রহার কর, ছেদন কর’ ইত্যাকার তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইতে লাগিল। ঐ সময় পাণ্ডবগণ মদ্ররাজের অনুচরগণকে দর্শনপূর্ব্বক মধ্যম ব্যূহে অবস্থান করিয়া তাঁহাদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। মদ্রকগণ মূহুৰ্তকাল বাহুযুদ্ধ করিয়া নিহত হইল। এইরূপে পণ্ডবগণ কৌরবপক্ষীয় বীরগণের সমক্ষেই মদ্রকদিগকে নিপাতিত করিয়া আনন্দিতচিত্তে কোলাহল করিতে লাগিলেন। ঐ সময় চতুর্দ্দিক হইতে কবন্ধসমূহ সমুত্থিত ও সূৰ্য্যমণ্ডল হইতে উল্কাজাল নিপতিত হইল। ভগ্ন রথ, যুগ, অক্ষ, নিহত মহারথ ও নিপতিতঅশ্বগণে পৃথিবী সমাকীর্ণ হইল। বায়ুতুল্য বেগশালী তুরঙ্গমগণ সারথিবিহীন হইয়া যদৃচ্ছাক্রমে যোধগণকে ইতস্ততঃ সমানীত করিতে লাগিল এবং কোন কোনটা ভগ্নচক্র রথ বহন ও কোন কোনটা রথার্দ্ধ লইয়া দশদিকে পরিভ্রমণ করিতে লাগিল। রথীগণ ক্ষীণপুণ্য স্বর্গচ্যুত সিদ্ধগণের ন্যায় রথ হইতে ভূতলে পতিত হইলেন।
“হে মহারাজ! এইরূপে মদ্ররাজের অনুচরগণ নিহত হইলে জয়গৃধ্নু মহারথ পাণ্ডবগণ শঙ্খনিধন ও শরশব্দ করিয়া মহাবেগে সমাগত কৌরবসৈন্যের সম্মুখীন হইয়া চাপ নির্ঘোষ ও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ মহাবীর মদ্ররাজের সৈন্যসমুদয়কে নিহত দেখিয়া পুনরায় সমরে পরাঙ্মুখ ও জয়শীল পাণ্ডবগণের শরে দৃঢ়তর নিপীড়িত হইয়া প্রাণভয়ে দশদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।”