লক্ষ্য : অবাচী
ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে ছুটে চলতে থাকে নটিলাস, লক্ষ্য তার অবাচী। আমরা পেরিয়ে এলুম সারাগোসা সাগর, পেরিয়ে এলুম তিমিজিলের দেশ, সিন্ধুতলের কয়লাখনি। ধীরে-ধীরে তুহিন অবাচীর দিকে এগোচ্ছি আমরা।
পঞ্চান্ন অক্ষরেখার কাছেই জলের উপর বরফের চাঙড় ভেসে থাকতে দেখে ছিলুম, ষাট অক্ষরেখার কাছে এসে দেখি সামনে এগোবার পথ বন্ধ। হঠাৎ কে যেন আঙুল তুলে চঞ্চল সমুদ্রকে তিষ্ঠ বলে থামিয়ে দিয়েছে এখানে, শুরু হয়ে গেছে ধূ-ধূ বরফের রাজ্য–শুভ্র, নিরেট, দিগন্তবিসারী।
ইচ্ছে করলেই নটিলাস-এর মুখ ঘুরিয়ে নেয়া যেতো, কিন্তু ক্যাপ্টেন নেমে কিছুতেই দমে যাবার মানুষ নন। খুঁজে খুঁজে ঠিক একটা সংকীর্ণ পথ বার করলেন তিনি, তারপর তার ভিতর দিয়েই আশ্চর্য কৌশলে নিজে চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন নটিলাস। চারপাশে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই-ঠাণ্ডা হিম শাদা মরুভূমি : উয়ে আছে দিগন্ত পর্যন্ত স্তব্ধ নিশ্চল পরিবর্তনহীন এই শূন্যতার সঙ্গে কিছুরই বোধ হয় তুলনা হয় না। বৈদ্যুতিক চুল্লি জ্বালিয়ে নটিলাস-এর ভিতরটা গরম রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল, পশুলোমের মোটা পোশাক চাপিয়েছিলুম আমরা গায়ে, তবু তারই মধ্যে ঠাণ্ডা তার লোভী দাত বসাতে চাচ্ছিলো বারেবারে।
মার্চ মাসের যোলো তারিখে আমরা কুমেরু বলয় পেরিয়ে এলুম। নির্ভয় ক্যাপ্টেন নেমোতুহিন প্রাচীরের মধ্য দিয়ে চালিয়ে নিয়ে এলেন নটিলাস কোনোদিকে দৃকপাত না-করে পাৎলা বরফের স্তর ভেদ করে এগিয়ে চললেন সামনে; যে-পথ দিয়ে আমরা আসছি, সে-পথ দেখতে দেখতে জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে–এখন আর ইচ্ছে হলেও ফেরবার পথ রুদ্ধ। এগোবার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ হলে আঠারোই মার্চ-কোনোক্রমেই আর এগোনো সম্ভব হলো না নটিলাস-এর পক্ষে। মন্ত সব তুহিন পাহাড় উঠেছে সামনে, আকাশ আড়াল করে স্তব্ধ ও হিম তারা দাঁড়িয়ে আছে, তাপমাত্রা নেমে এসেছে শূন্য থেকে পাঁচ ডিগ্রি নিচে। চারপাশের বরফের মধ্যে আমরা বন্দী হলুম এতদিনে, যেন আস্ত গিলে ফেলেছে আমাদের বরফেরা। এতদিন হাঁ করে ছিলো বরফের দেশ, এইবার আস্তে আস্তে আমাদের জঠরে পুরে ফেলেছে।
এটা কিন্তু ক্যাপ্টেন নেমোর গোয়ার্তুমি। বেপরোয়াভাবে এই বরফের মধ্য দিয়ে না-এলেই হতো!
আমি বড় বিমর্ষ আর মলিন হয়ে পড়েছিলুম, তাই ক্যাপ্টেন নেমো আমাকে জিগেস করলেন, এই যে মঁসিয় আরোনা, কী ভাবছেন অমন গম্ভীরভাবে?
ভাবছি সামনে যাওয়ার পথ তত বন্ধই, এবার ফিরে যাবার পথ পেলেই হয়তারও তো কোনো চিহ্ন দেখছি না।
নটিলাসকে অতটা অসহায় ভাববেন না, প্রফেসর, বিদ্রুপের হাসি খেলে গেলো ক্যাপ্টেনের মুখে, আমার তো ইচ্ছে একেবারে কুমেরুতে গিয়ে আমি।
কুমেরুতে? কিছুতেই আর অবিশ্বাস চেপে রাখতে পারলুম না আমি।
হ্যাঁ, কুমেরুতে-পৃথিবীর দক্ষিণতম বিন্দুতে যেখানে এখনো কোনো মানুষ পদার্পণ করেনি।
তাহলে কি দক্ষিণ মেরু আবিষ্কার করেছেন নাকি আপনি?
না, এখনো করিনি-তবে আমি আর আপনি, আমরা দুজনে মিলে করবো। বরফের বাধা কোনো বাধাই নয়। আমরা এই বরফের তলা দিয়েই চলে যাবে।
তলা দিয়ে?
নিশ্চয়ই। এটা তো জানেন যে বরফের একভাগ জলের উপর সে, আর তিনভাগ থাকে জলের তলায়। সামনের ওই বরফের পাহাড়গুলো যদি তিনশো ফুট উচু হয়, তাহলে জলের তলায় রয়েছে নশো ফুট—তার তলা দিয়ে গেলেই তত হলো। আপনি তো এতদিনে এটা জেনেছেন যে নটিলাস-এর পক্ষে সমুদ্রের আরো-তলা দিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
তা ঠিক।
অবশ্যি কোনো অসুবিধে যে নেই, তা বলি না। কতদিন জলের তলায় থাকতে হবে, তা জানি না। সঞ্চিত বাতাস ফুরিয়ে যাবার পরেও যদি কুমেরুবিন্দুতে ওঠবার পথ না-পাই, তাহলে শ্বাস রোধ হয়ে মরবো আমরা সবাই।
তক্ষুনি নশো ফুট নিচে নামার আয়োজন শুরু হয়ে গেলো। নাবিকেরা কুডুল নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে, চারপাশে বরফ কাটতে লাগলো তারা, আর চাড় দিয়ে দিয়ে একটু একটু পথ করে নিচে নামতে লাগলো নটিলাস। নশো ফুট নামবার পর জল পাওয়া গেলো, কিন্তু নটিলাস নামতে লাগলো আরো নিচেকারণ এর পরে কত ফুট উঁচু বরফের পাহাড় আছে, কে জানে। প্রায় আড়াই হাজার ফুট নিচে নেমে আসার পর আবার শুরু হলো এগিয়ে যাওয়া।
পরের দিন উনিশে মার্চ নটিলাস-এর গতি কমে আসছে দেখে বোঝা গেলো জাহাজ এবার ধীরে ধীরে উপরে ওঠবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কিসের সঙ্গে যেন ভীষণ ধাক্কা লাগলো নটিলাস-এর অত বড়ো জাহাজটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। বুঝলুম উপরে উঠতে গিয়ে বরফের গায়ে ঘা খেলো নটিলাস। সর্বনাশ! দু-হাজার ফুট বরফ ভেদ করে উপরে ওঠার ক্ষমতা তত নটিলাস-এর নেই-তা–হলে এই তুহিন জলেই তার সমাধি হবে। জাহাজ কিন্তু তবু নির্বিকারভাবে দক্ষিণ মুখে চললল, তারপর আবার আরেক ধাক্কা লাগলো বরফের সঙ্গে। এমনি করে বারেবারে ধাক্কা মারতে মারতে এগোতে লাগলো নটিলাস, পরীক্ষা করে দেখতে চাইলো বরফের স্তর কোথায় পাৎলা হয়ে এসেছে, কোথায় সে ধোলা সমুদ্রে ভেসে উঠতে পারবে। সারা রাত দুশ্চিন্তায় কেটে গেল আমার; যদি বরফের স্তর পাৎলা না-হয়, তাহলে? কিন্তু সকালবেলাতেই ক্যাপ্টেন নেমে এসে সুখবরটা দিয়ে গেলেন আমাকে, খোলা সমুদ্রে এসে পড়েছি।
প্ল্যাটফর্মে ছুটে এলুম। সত্যি, খোলা সমুদ্রই! যদিও ইতস্তত বরফের চাঙড় ছড়িয়ে আছে আশপাশে, তবু শান্ত নীল জলের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে নটিলাস। আকাশে পাখির গান, জলে খেলা করছে মাছের ঝাঁক, নটিলাস-এর চাকার শব্দ উঠছে ছলে লো। কে বলবে যে ওই বরফের প্রাচীরের আড়ালে এমন একটি স্পন্দমান সপ্রাণ জগৎ লুকিয়েছিল!
আমার বুকের স্পন্দন বেড়ে গেলো। মেরুদেশে এসে পড়েছি তাহলে!
এখনো তা বলি না। ক্যাপ্টেন নেমো বললেন, সূর্য উঠলে দুপুরবেলা কম্পাস দেখে নটিলাস-এর অবস্থান স্থির করব।
ধুসর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললুম, এই কুয়াশার মধ্যে সূর্যের দেখা পাবেন বলে ভাবছেন?
যতটুকু পাই তাই যথেষ্ট।
মাইল দশেক দূরে ছোট্ট একটা দ্বীপ দেখতে পেলুম আমরা। নটিলাস এর নৌকোয় করে ক্যাপ্টেন নেমে আমাদের দ্বীপে নিয়ে গেলেন। নৌকো তীরে ভিড়তেই কোনসাইল লাফিয়ে নামতে যাচ্ছিলো, আমি বাধা দিয়ে বললুম, ক্যাপ্টেন নেমে, আপনি আগে নামুন। এখানে সর্বপ্রথম পদার্পণ করার গৌরব আপনারই প্রাপ্য।
ক্যাপ্টেনের পিছন পিছন আমরাও নামলুম, কিন্তু দুপুর বারোটার সময়ও কুয়াশা ও ঘন বাষ্প ছিঁড়ে সূর্য দেখা দিলো না। তাই দ্বীপটার সঠিক অবস্থান নাজেনেই আমাদের ফিরে আসতে হলো।
পরের দিন বেলা নটার সময় যন্ত্রপাতি নিয়ে আবার আমরা ওই ছোট্ট দ্বীপে হাজির হলুম। বেলা বারোটার সময় কুয়াশার মধ্য দিয়ে আবছা দেখা গেলো সূর্যকে ক্রনোমিটার এগিয়ে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ঘোষণা করলুম, দুপুর বারোটা।
হ্যাঁ, দক্ষিণ মেরুই বলে দূরবিনটা আমার হাতে তুলে দিলেন ক্যাপ্টেন নেমে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে দেখি সূর্য ঠিক আধখানা ফালি হয়ে আছে।
একটা কালো নিশেন উড়িয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন নেমো। কালোর মধ্যে সোনালি হরফে তাঁর নামের আদ্যক্ষর লেখা; সূর্যের শেষ শিখা পড়ে সেই সোনার অক্ষরটি জ্বলজ্বল করতে লাগলো।
তারপর সূর্যের দিকে ফিরে তাকিয়ে শেষ রশ্মিটুকু লক্ষ্য করে বললেন, বিদায় সবিতা, বিদায়! এবার তুমি বিশ্রাম নাও এই স্বাধীন সমুদ্রের তলায়, মিলিয়ে যাক তোমার নক্ষত্র দুতি। তারপর আমার নতুন দেশে নেমে আসুক ষান্মাষিক তমি।।