১৮শ অধ্যায়
রুদ্রপ্রভাব প্রদর্শনে যুধিষ্ঠিরাদির সান্ত্বনা
ভগবান কৃষ্ণ কহিলেন, “অনন্তর দেবযুগ অতীত হইলে দেবগণ বেদবিধানানুসারে যজ্ঞ করিবার মানসে হবিঃ প্রভৃতি উপকরণসামগ্রী সমুদয় আহরণ করিলেন। তাঁহারা যজ্ঞভাগ কল্পনাসময়ে ভগবান্ ভুতভাবনকে বিশেষ রূপ বিদিত ছিলেন না বলিয়া তাঁহার ভাগনির্দেশ করেন নাই, কেবল আপনাদিগেরই ভাগ কল্পিত করিয়াছিলেন। তখন কৃত্তিবাসাঃ [ব্র্যাঘ্রচর্ম্মপরিধায়ী] ভূতপতি স্বীয় ভাগকল্পনা না হওয়াতে প্রথমেই যজ্ঞনাশক শরাসনের সৃষ্টি করিতে অভিলায় করিলেন। হে মহারাজ! লোকযজ্ঞ [লোকোণা—অখিললোকের উপকারসাধন যজ্ঞ], ক্রিয়াযজ্ঞ [বাসনাপূরক কার্য্যযজ্ঞ], গৃহযজ্ঞ [গর্ভাধনাদি সংস্কার—সাধুচরিত্র সন্তানপ্রদ যজ্ঞ ও পঞ্চভূতযজ্ঞ [নিখিল প্রাণীর অন্নাদি ভোজ্যদ্রব্যসাধন যজ্ঞ] এই চারি যজ্ঞ দ্বারা সমুদয় জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। মহাত্মা মহেশ্বর ঐ সমুদয় যজ্ঞের মধ্যে লোক্যজ্ঞ ও নৃযজ্ঞ দ্বারা পাঁচ কিষ্কু [তিন পোয়া হাতে ১ কিষ্কু = ৫ কিষ্কুতে ৩দ পৌনে চারি হাত] পরিমাণ এক শরাসন নির্ম্মাণ করিলেন। বার ঐ শরাসনের জ্যা হইল এবং চারি যজ্ঞাঙ্গ উহার দৃঢ়তা সম্পাদন করিল। তখন ভগবান্ মহাদেব ক্রোধভরে সেই কার্মুক গ্রহণ করিয়া ব্রহ্মচারিবেশে দেবগণের যজ্ঞস্থলে আগমন করিলেন। তাঁহাকে ধনুষ্পণি [ধনুর্বাণধারী] অবলোকন করিয়া বসুন্ধরা নিতান্ত ব্যথিত হইলেন, পৰ্বতসকল কম্পিত হইতে লাগিল, সমীরণ স্থির হইলেন, হুতাশনও আর পূৰ্ব্বর্ব্বৎ প্রজ্বলিত হইলেন না। অন্তরীক্ষমধ্যে নক্ষত্রমণ্ডল ভীত হইয়া পরিভ্রমণ করিতে লাগিল; দিবাকরের আর সেরূপ জ্যোতিঃ রহিল না; চন্দ্রমণ্ডল একেবারে শোভাবিহীন হইল এবং ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল নিবিড় অন্ধকারে। আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। তখন দেবগণ নিতান্ত ভয়াভিভূত হইয়া বিষয়জ্ঞানশূন্য হইলেন এবং তাঁহাদের যজ্ঞেরও শোভা তিরোহিত হইয়া গেল। অনন্তর মহাদেব অতি ভীষণ শর দ্বারা সেই যজ্ঞকে বিদ্ধ করিলেন। যজ্ঞ বাণবিদ্ধ হইয়া মৃগরূপ ধারণপূর্ব্বক পাবকের সহিত তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া স্বর্গে গমন করিতে লাগিল; মহেশ্বরও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন।
এইরূপে যজ্ঞ তথা হইতে প্রস্থান করিলে দেবতাদিগের আর কিছুমাত্র জ্ঞান রহিল না। তখন ভগবান্ বিরূপাক্ষ চাপকোটি [ধনুকের ছিলা] দ্বারা সূর্য্যের ভুজযুগল, ভগের নয়নদ্বয় এবং পুষার দন্তপংক্তি বিনষ্ট করিলেন। তখন দেবগণ ও যজ্ঞাঙ্গ-সমুদয় ভীত চিত্তে তথা হইতে পলায়ন করিতে লাগিলেন এবং কেহ কেহ ঘূর্ণায়মান হইয়া তথায় মৃতবৎ নিপতিত রহিলেন। মহাত্মা মহাদেব এইরূপে সকলকে বিদ্রাবিত করিয়া হাস্যবদনে শরাসন দ্বারা দেবগণের গতিরোধ করিতেন। ঐ সময় দেবগণের বাক্যে সহসা সেই শরাসনের জ্যা ছিন্ন হইয়া গেল। তখন দেবগণ দেবশ্রেষ্ঠ মহাদেবকে শরাসনবিহীন দেখিয়া যজ্ঞের সহিত তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া শরণাগত হইলেন। তদ্দর্শনে ভগবান্ ভূতপতি প্রসন্ন হইয়া জলাশয়ে স্বীয় ক্রোধ সংস্থাপন করিলেন। সেই ক্রোধ অগ্নিরূপ ধারণ করিয়া সলিল শোষণ করিতে লাগিল। অনন্তর মহাদেব সূৰ্য্যকে ভুজযুগল ও পুষাকে তাহার দন্তপংক্তি প্রদান করিয়া যজ্ঞ করিতে আদেশ করিলেন। তখন সমুদয় জগৎ সুস্থ হইল। দেবগণ সমস্ত হবনীয়দ্রব্যে [আহুতিরূপে প্রদত্ত ঘৃতাদি বস্তুতে] মহেশ্বরের ভাগ কল্পনা করিলেন।
হে ধর্ম্মনন্দন! এইরূপে দেবাদিদেব মহাদেব ক্রুদ্ধ হওয়াতে সকলেই অসুস্থ হইয়াছিল এবং তিনি প্রসন্ন হওয়াতে সমুদয় সুস্থ হইল। এক্ষণে সেই মহাবীৰ্য্যশালী ভগবান ভূতনাথ অশ্বত্থামার প্রতি প্রসন্ন হওয়াতেই সে আপনার মহারথ পুত্রগণ এবং অনুচরসমেত মহাবলশালী পাঞ্চালগণকে নিহত করিয়াছে। অশ্বত্থামার প্রভাবে কখনই এরূপ ঘটে নাই, কেবল মহাদেব প্রসাদে এইরূপ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছে। অতএব এক্ষণে কার্য্যান্তরসাধনের চেষ্টা করুন।”
শৌপ্তিকপর্ব্ব সমাপ্ত