১৮. রুক্মিণীর যৌবন

কিরীটী বলছিল।

রুক্মিণীর যৌবন তিনজনকে আকর্ষণ করেছিল। প্রৌঢ় গগনবিহারী আর যুবক সুবিনয় ও সুবীর। তবে সুবীর ভীতু প্রকৃতির। কিন্তু রুক্মিণী গভীর জলের মাছ। সে কারও কথা কারও কাছে না বলে দুজনকেই নিয়ে খেলিয়েছে। রামদেও মিলিটারি ফেরতা রগচটা লোক ব্যাপারটা কোনক্রমে জানতে পারলে ছোরা বসিয়ে দেবে বুকে। তাই সুবিনয় কৌশলে রামদেকে পেথিডিনে অ্যাডিক্ট করে ক্রমশঃ তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসে। সুবীর ভীতু প্রকৃতির আগেই বলেছি–সে বেশীদূর অগ্রসর হবার সাহস পায়নি–কাজেই সুবিনয়ের আরও সুবিধা হয়ে যায়।

তারপর? অরূপ জিজ্ঞাসা করে।

কিন্তু গোপন প্রেমের যা শেষ পরিণতি–শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। গগনবিহারী ব্যাপারটা জানতে পেরে গিয়েছিলেন। এবং সে জানাটা আদৌ তাঁর পক্ষে আনন্দের হয়নি। আর কেউ না–তাঁরই আশ্রিত এবং তাঁরই ভাগ্নে তাঁর লালসার ভোগে ভাগ বসাচ্ছে জানতে পেরে নিশ্চয়ই ক্ষেপে উঠেছিলেন তিনি। ফলে তিনি সুবিনয়কে ডেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন।

কবে? অরূপ প্রশ্ন করে।

কিরীটী বললে, যে রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে সেইদিন সকালে।

জানলেন কি করে?

ঠাকুর প্রিয়লালের কাছে। ঐদিন সকালে অফিস যাবার আগে খেতে বসে সুবিনয় বলেছিল প্রিয়লালকে, পরের দিনই সকালে সে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

তারপর?

কিন্তু সুবিনয় মুখে যাই বলুক রুক্মিণীর উগ্র রূপ ও যৌবন যার স্বাদ সে পেয়েছিল সেটা ভুলে যাওয়া বা সে লোভ দমন করা সুবিনয়ের পক্ষে তখন আর সম্ভবপর ছিল না। তাছাড়া জগতে বিশেষ একশ্রেণীর নারী আছে যারা পুরুষকে একেবারে কুক্ষিগত করে ফেলে তাদের যৌন আবেগ দিয়ে, একবার কোন পুরুষ তার বাহুবন্ধনে ধরা দিলে। সুবিনয়েরও হয়েছিল তাই–ঐ রুক্মিণীও হচ্ছে সেই শ্রেণীর স্ত্রীলোক। তাই শেষ পর্যন্ত রুক্মিণীকে হারাবার ভয়ে সুবিনয় ডেসপারেট হয়ে ওঠে।

ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল।

অরূপ বলে, আশ্চর্য! মানুষটাকে দেখে একবারও মনে হয় না ঐ প্রকৃতির–

ওরা হচ্ছে বর্ণচোরা আম। তাই তো প্রথমটায় আমার ধোঁকা লেগেছিল। কিন্তু তিনটে ব্যাপার আমার মনকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। এক নম্বর, জ্যাকিকে ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করে ফেলা। আর দু নম্বর, সে–রাত্রে সুবিনয়ের গৃহে উপস্থিতি। এবং শেষ তিন নম্বর, যেভাবে গগনবিহারীকে আমূল ছোরা বিঁধিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সেটা কোন শক্তিশালী লোক ছাড়া সম্ভব ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে আমি মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটার অ্যানালিসিস শুরু করি। প্রথমত কার কার পক্ষে গগনবিহারীকে হত্যা করা সম্ভব ছিল ভাবতে গিয়ে এবং সমস্ত ব্যাপারটা ও গগনবিহারীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছিল চারজনের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল–রুক্মিণী, শমিতা, রামদেও ও সুবিনয়। রুক্মিণীকে বাদ দিয়েছিলাম হিসাব থেকে এই কারণে যে তার কাছে গগনবিহারী ছিল স্বর্ণডিম্বপ্রসবকারী হংস। কাজেই সে গগনবিহারীকে হত্যা করতে পারে না। শুধু তাই নয়, ঐভাবে আমূল ছোরা বিঁধিয়ে তার মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে হত্যা করাও সম্ভব ছিল না। তারপর শমিতা। গগনবিহারীর হাতের মুঠোয় ভাঙা চুড়ি ও শমিতার হাতের ক্ষত যদিও উভয়ের মধ্যে একটা স্ট্রাগলের সম্ভাবনা আমার মনে উঁকি দিয়েছিল কিন্তু সেও নারী। একই কারণে রুক্মিণীর মত তাকেও আমি হিসাব থেকে বাদ দিয়েছিলাম।

তারপর?

তারপর রামদেও। গগনবিহারীকে এত বোকা ভাবতে পারি না যে তিনি রামদেওর চোখের উপরেই তার বৌকে সম্ভোগ করবেন। তাছাড়া সে গগনবিহারীকে হত্যা করলে তার বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকেও বাদ দিত না। তাকেও ঐ একই সঙ্গে শেষ করে দিত। তাহলে বাকি থাকে সুবিনয়। সন্দেহটা সুবিনয়ের উপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারা, তার উপস্থিতি সে রাত্রে ও সে একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ–সব মিলিয়ে আমার মনকে সজাগ করে তোলে। তারপর জ্যাকিকে ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করা–রামদেও ধরা পড়বার পর সেও অ্যাডিক্টেড জানতে পেরে আমার কোন সন্দেহের আর অবকাশ রইল না। অবিশ্যি তার আগেই শমিতা দেবীর কিছুটা সত্য বিবৃতিও সেদিন থানায় আমার সন্দেহকে ওর ওপরে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। যাক, এবারে আসল ঘটনায় আসি।

কিন্তু একটু থেমে আবার শুরু করল, সুবিনয় সম্ভবত রুক্মিণীর মুখেই গগনবিহারী ও শমিতার সব ব্যাপারটা ও ঝগড়ার ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল আর সেইটাই সে শেষ মুহূর্তে কাজে লাগায়।

কি ভাবে? অরূপ শুধায়।  

সুবিনয় ফোন করেছিল শমিতাকে ক্লাবে। গগনবিহারী নয়। আমার ধারণা–কারণ সে শমিতার উপরে দোষটা চাপাবার জন্য তাকে অকুস্থলে টেনে নিয়ে আসে। শমিতা আসতেই তারপর যা যা ঘটেছিল সেও শমিতার মুখেই তোমরা শুনেছ। যখন দুজনে ঝটাপটি চলেছে তখন পশ্চাৎ দিক থেকে সুবিনয় গগনবিহারীকে ছোরা মেরেই ঘর ছেড়ে যাবার আগে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেয়। কাজেই শমিতা সুবিনয়কে দেখতে পায়নি। সব ব্যাপারটা রুক্মিণী জানতে পেরেছিল অবিশ্যি, কিন্তু সেও ভয়ে মুখ খোলেনি। গগনবিহারীর কোট ও জুতোটা আগে থাকতেই সরিয়ে রেখেছিল সুবিনয়। একটা গায়ে ও একটা পায়ে দিয়ে হত্যা করেছিল যাতে পুলিসের কুকুর ও জ্যাকিকেও ধোঁকা দিতে পারে। সর্বশেষে পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড, সম্পূর্ণ তার হাতের কজীতে, রামদেকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ আটঘাট বেঁধেই প্ল্যান করে সব কিছু করেছিল সুবিনয়, কিন্তু এত করেও সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না, সে নিজের ভুলের ফাঁদেই নিজে আটকে পড়ল। 

হ্যাঁ। এমনিই হয়। সবার চোখের আড়ালে একজন যিনি সর্বক্ষণ চোখ মেলে বসে আছেন তাঁকে ফাঁকি দেওয়া শেষ পর্যন্ত যায় না। সুবিনয়ও পারল না। ভুলের কথা বলছিলাম না! প্রথম ভুল সে করেছিল জ্যাকিকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে। যদিও তা পুরোপুরি। সম্ভবপর হয়নি। দ্বিতীয় ভুল রামদেওকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিয়ে। পাছে নিজে ধরা পড়ে যায় এবং সে যে আগে রামদেকে পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড করেছে সেটা কোনক্রমে প্রকাশ। হয়ে পড়ে।

রামদেওকে খুন করে ফেললেই তো একেবারে ল্যাঠা চুকে যেত! অরূপ বলে।

তা যেত—কিরীটী বলে, কিন্তু তখন আর সেটা হয়ত সম্ভবপর ছিল না। অবিশ্যি সে যদি আগে রামদেকে শেষ করত, তবে চট করে হয়ত রামদেওর প্রবলেম তার সামনে এসে দাঁড়াত না। কিন্তু সেরকম পরিকল্পনা হয়ত ওর মাথায় আসেনি। রামদেও পুরোপুরি তার হাতের মুঠোর মধ্যে ছিল বলে রামদেওর ব্যাপারটা পরে কোন একসময় মেটাবে মনে করে রামদেকে তখনও হয়ত শেষ করেনি। এবং তৃতীয় ও মারাত্মক ভুল যেটা করেছিল সুবিনয় সেটা হচ্ছে গগনবিহারীর জামা ও জুতো চুরি করে হত্যার সময় সেটা ব্যবহার করে। ঐ দুটো বস্তুই আমাকে। স্থিরনিশ্চিত করেছিল হত্যাকারী ঐ বাড়িরই কেউ, যার পক্ষে ঐ দুটি বস্তু হাতানো সম্ভবপর ছিল। সর্বশেষে ঐ দুটি বস্তুর ব্যবহার থেকেও আমার যে কথাটি মনে হয়েছিল সেটা হচ্ছে হত্যাকারী রামদেও নয়—হয় সুবিনয়, না হয় সুবীর—দুজনের একজন।

তাহলে যত নষ্টের মূল রুক্মিণীই দেখতে পাচ্ছি! অরূপ বলে।

হ্যাঁ। রুক্মিণী নয়, বল বনমরালী। গগনবিহারীর সাধের বনমরালীই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারণ হল।

কিরীটী থামল।

.

পরের দিন প্রত্যুষে লেকে দেখা হল যোগজীবনবাবুর সঙ্গে কিরীটীর। এই কদিন ভদ্রলোক লজ্জায় বেড়াতেও আসেননি লেকে সকালে বোধ হয়।

রায় সাহেব।

যোগজীবনের ডাকে কিরীটী ফিরে তাকায়।

শমিতা দেবীর খবর কি সান্যাল মশাই?

সে অমলেন্দুর ওখানেই আছে।

মিটে গিয়েছে তাহলে?

তাই তো মনে হচ্ছে।

যাক। পাশ থেকে যোগেশবাবু বলে উঠলেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েৎ!

ফণীবাবু বললেন, আজকালকার পোলাপান কি যে ভাবে আর কি যে করে—

কিরীটী শেষ করে কথাটা, বোঝাই যায় না!

সকলে হেসে ওঠে।