মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সিভিল সার্জনের কাছে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, অতএব সে কাজ শেষ হওয়ার পূর্বে সৎকারের কোন ব্যবস্থাই হতে পারে না। তথাপি আজ হোক বা কাল হোক সৎকার তো করতেই হবে। দুঃশাসন ও বৃহন্নলা সেক্রেটারি প্রাণতোষবাবু ও তহশীলদার কুণ্ডলেশ্বর শর্মার সঙ্গে নিচের মহালে বাইরের ঘরে তারই ব্যবস্থার জন্য নিম্নস্বরে আলাপ-আলোচনা করছিলেন পরস্পরের মধ্যে। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সাধারণতঃ গৃহস্থঘরে যে স্বাভাবিক কান্নাকাটি ও শোকপ্রকাশ কয়েকটা দিন ধরে চলে অব্যাহত গতিতে তার কিছুই যেন নেই এক্ষেত্রে।
কে জানে, স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়ে হত্যা বলেই হয়ত এই স্তব্ধতা। গত রাত্রে ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর হতে কেউ হয়ত একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি, কান্না তো দুরের কথা। অথচ স্বাভাবিক ভাবে সকলেরই হয়ত শোক করা কর্তব্য ছিল।
শোক নেই তবু যেন বাড়ির মধ্যে সর্বত্র একটা শ্বাসরোধকারী বিষণ্ণতা থমথম করে। সবাই। যেন কেমন ভীতসন্ত্রস্ত।
সকলেই যেন কান পেতে আছে একটা কিছু শোনবার জন্যে, অবশ্যম্ভাবী একটি পরিণতির আশঙ্কায় প্রত্যেকেই যেন শঙ্কিত, ব্যাকুল হয়ে প্রহর গুনছে।
নিহত হবার আগে রোগশয্যায় শুয়ে অসুস্থ রায়বাহাদুর গত কয়েকদিন ধরে বলতে গেলে দিবারাত্র যে দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন জাগ্রত ও নিদ্রিত সকল অবস্থাতেই, সেই দুঃস্বপ্নেরই অশরীরী প্ৰেতটা যেন এখন এ বাড়ির প্রত্যেকের মনের উপর চেপে বসেছে। যেন সকলকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
.
শ্রীনিলয়ের পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বেলা দুটো ঘোষণা করে।
কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে ডাঃ সানিয়ালের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলছিল। একটু আগে সে দালাল সাহেবের প্রেরিত অনুচরের মুখে সংবাদ পেয়েছে পলাতক শকুনি ঘোষ শেষ পর্যন্ত পুলিসের চোখ এড়িয়ে বেশীদূর পালাবার আগেই ধরা পড়েছে ও তাকে থানায় নিয়ে গিয়েছে।
ধরেছেন তাকে অবশ্য দালাল সাহেব নিজেই। কিছুদূরে একটা কোলিয়ারীতে জরুরী একটা তদন্তে নিজের গাড়িতে করে দালাল সাহেব যাচ্ছিলেন, এমন সময় পথের মধ্যে একেবারে দুখানা গাড়ি দুইদিক হতে মুখোমুখি হওয়ায় শকুনি ঘোষের অবস্থাটা সঙ্গীন হয়ে ওঠে এবং একপ্রকার বাধ্য হয়েই দালাল সাহেবের পূর্ব নির্দেশকে অমান্য করে স্থানত্যাগ করবার অপরাধে ধৃত হয়ে সরাসরি একেবারে সশস্ত্র প্রহরীর হেপাজতে হাজতে প্রেরিত হয়েছে। সংবাদটা অবশ্য একমাত্র কিরীটী ও ডাঃ সানিয়াল ব্যতীত এ বাড়ির একটি প্রাণীও জানে না বা কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি।
কিছুক্ষণ পূর্বে কিরীটী ও ডাঃ সানিয়ালের মধ্যে শকুনি ঘোষ সম্পর্কেই কথা হচ্ছিল। তবে কি শকুনিবাবুই অপরাধী মিঃ রায়? প্রশ্ন করেন ডাঃ সানিয়াল।
মনে মনেও অন্ততঃ তিনি কিছুটা অপরাধী বৈকি। নচেৎ ওভাবে হঠাৎ তিনি পালাবার চেষ্টাই বা করবেন কেন? কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়।
আপনার কি সত্যিই মনে হয় স্পষ্ট করে বলুন মিঃ রায়। আপনার ধারণা কি তাহলে শকুনি ঘোষই কাল রাত্রে—কথাটা বলে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকালেন ডাঃ সানিয়াল কিরীটীর মুখের দিকে।
প্রশ্নটা আপনার বড় direct ডাক্তার, এক্ষেত্রে অবিশ্যি সত্যিকারের সংবাদটা গোপন করে যাওয়াটাও একটা মস্তবড় অপরাধ। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে, নিজের হাতে হত্যা
করলেও উনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হত্যাকারীকে সাহায্য করেছেন। বিচারের দৃষ্টিতে ও আইনে murder ও abetment of murder—দুটো charge কি একই পর্যায়ে পড়ে না?
তবে কি–
ক্ষমা করবেন, অত স্পষ্ট করে কিছুই আমি বলতে চাই না ডাক্তার, তবে শকুনি ঘোষ যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন একথাও আমি বলব, তাছাড়া এটা হয়ত তাঁর জানা ছিল না, বাঘে একবার কামড়ালে আঠারো জায়গায় ঘা হয়। ও বড় মারাত্মক ছোঁয়া। বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে উপস্থিত হয়ে কিরীটী ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে বলে, কিন্তু আপনাকেও যে আমার কয়েকটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল ডাক্তার!
আমাকে?
হ্যাঁ।
কি বলুন তো?
অবশ্য কথাটা সম্পূর্ণই আমার ও আপনার মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে, কোন তৃতীয় ব্যক্তি জানতে পারবে না।
বলুন না কি জানতে চান মিঃ রায়।
কথাটা সুলতা কর সম্পর্কে।
সুলতা!
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ডাঃ সানিয়ালের মুখখানা যেন রক্তিম হয়ে ওঠে। আপনা হতেই দুচোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসে ডাক্তারের।
কিরীটী মনে মনে না হেসে পারে না। এবং কৌতুকের লোভটাও সম্বরণ করতে পারে না।
স্মিত কণ্ঠে বলে, ডাক্তার, মনের খোঁজ নিয়ে মন দিয়েছিলেন তো?
লাজরক্তিম মুখটা তুলে ডাক্তার বলেন, যাঃ, কি যে বলেন মিঃ রায়! Simply I liked that girl, বেশ মেয়েটি!
সে বিষয়ে আমিও নিঃসন্দেহ, তবু বলব মনটা দেবার আগে বোধহয় একটু যাচাই করে নিলে পারতেন।
ডাঃ সানিয়াল যেন চমকে ওঠেন কিরীটীর শেষের কথায়।
তাই-ই ডাক্তার, কারণ মহাভারতের উপাখ্যানের সঙ্গে এখানে সামান্য একটু উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে। মাতুল না হয়ে এখানে হয়েছেন ভাগিনেয়। দুর্যোধন মাতুল, ভাগিনেয় শকুনি।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ডাক্তার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
শকুনি!
হ্যাঁ। সংবাদটা কিন্তু আপনার রাখা উচিত ছিল।
শকুনি?
তাই। আশ্চর্য, এই সহজ ব্যাপারটা আপনার চোখে পড়েনি! সুলতা দেবীর প্রতি শকুনির চাউনিটাই তো ইতিপূর্বে আমার কাছে সংবাদটা ব্যক্ত করেছিল ডাক্তার!
কিন্তু সুলতা–
তা অবশ্য আমার চাইতে আপনারই বেশী জানবার কথা। কিন্তু রাত্রে কফি দিতে গিয়ে যে এদিকে আপনি একটা প্রচণ্ড জটিলতার সৃষ্টি করে ফেলেছেন!
জটিলতা!
হ্যাঁ। প্রতি রাত্রেই তাকে আপনি কফি দিয়ে আসতেন ইদানীং, তাই তো?
ডাক্তার সানিয়াল লজ্জায় আবার দৃষ্টি নত করলেন।
সুলতা দেবী বলেছেন, গতরাত্রেও নাকি আপনিই তাকে কফি দিয়ে এসেছেন অথচ তার জানা নেই যে আমরা আপনার ঘরে ঠিক গতরাত্রে ঐ সময়টায় উপস্থিত থাকায় লজ্জা। এসে আপনাকে আপনার চরণ ধরে বাধা দিয়েছিল।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! আমি তো কাল–
জানি। আপনি তাকে কফি দেননি—অন্ততঃ গতকাল রাত্রে। অথচ মজা কি জানেন, আপনি দিলেও লোকে জেনেছে আপনিই দিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যাকে দিয়েছেন তারও। সুনিশ্চিত ধারণা তাই।
সে কি!
হ্যাঁ। একেই বলে শয়তানীর চাতুরী…..
কিন্তু কিরীটীর বক্তব্য শেষ হল না, বাইরে থেকে বন্ধ দরজার কপাটের গায়ে অত্যন্ত মৃদু একটা করাঘাত শোনা গেল।
নিশ্চয়ই রুচিরা দেবী! আপনি একটু অনুগ্রহ করে বাইরে যান ডাক্তার ওপাশের ঐ দরজাটা দিয়ে, ওঁর সঙ্গে আমার কয়েকটি কথা আছে।
নিশ্চয়ই। ডাঃ সানিয়াল আর কোনরূপ মন্তব্য না করেই কিরীটীর নির্দেশমত ঘরের দ্বিতীয় দ্বারপথে বের হয়ে গেলেন।
এবং পরক্ষণেই দরজার গায়ে আবার মৃদু করাঘাত শোনা গেল।
আসুন রুচিরা দেবী! কিরীটী মৃদু কণ্ঠে আহ্বান জানায়।
রুচিরাই।
রুচিরা দ্বার ঠেলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী মৃদু শান্ত কণ্ঠে বলে রুচিরাকে, আসুন। বসুন ঐ চেয়ারটায় রুচিরা দেবী।
রুচিরা নিঃশব্দে কিরীটী-নির্দিষ্ট চেয়ারটা টেনে নিয়ে বারেকের জন্য কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে একেবারে কিরীটীর মুখোমুখি বসল।
খোলা জানালাপথে শীতের পড়ন্ত রৌদ্রালোক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে। দিনশেষের শেষ লিপি যেন।
কিরীটী রুচিরার দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।
রুচিরার পরিধানে একটা গেরুয়া রঙের দামী মিলের শাড়ি। গায়ে একটা ফিকে আকাশ-নীল রঙের দামী কাশ্মীরী শাল জড়ানো। মাথায় তৈলহীন রুক্ষ চুল এলো খোঁপা করে বাঁধা অবস্থায় কাঁধের একপাশে পাকার হয়ে আছে। সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী রুচিরা।
কিরীটী তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে রুচিরাকে দেখছিল। গতরাত্রে প্রথম দৃষ্টিতে যাকে ষোল-সতের বছরের যুবতী বলে মনে হয়েছিল, সুস্পষ্ট দিনের আলোয় তাকে পুনবার ভাল করে দেখতেই যেন তার সে ভুল ভেঙে যায়। মুখখানি অতীব কমনীয় ও ঢলঢলে হলেও রুচিরার বয়স তেইশ-চব্বিশের কম নয়, বরং দু-এক বছর বেশীও হতে পারে।
অতঃপর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে অতিবাহিত হবার পর কিরীটী প্রশ্ন করে সর্বপ্রথমে, আপনি তো কলকাতায় বেথুনে পড়েন রুচিরা দেবী?
হ্যাঁ, আমার ফোর্থ ইয়ার।
যদি কিছু মনে না করেন, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি, আপনার বর্তমান বয়স কত হল?
বোধ হয় চব্বিশ। মৃদু অনাসক্ত কণ্ঠে রুচিরা জবাব দেয়।
আপনার পদবী?
মিত্র।
আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। কিরীটী মনে মনে নিজেকে বোধ করি গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে—কি ভাবে তার আসল বক্তব্যটা এবারে সে শুরু করবে। কিন্তু তার আগে সুযোগ রুচিরাই করে দেয়। সে-ই এবারে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আমাকে আপনি ডেকেছিলেন কেন মিঃ রায়?
ও হ্যাঁ, বিশেষ তেমন কিছুই নয় রুচিরা দেবী। গত রাত্রের সম্পর্কে কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, কিন্তু তার আগে আপনার—
ভ্রুকুটিপূর্ণ দৃষ্টিতে রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, আপনার মাকে বুঝি জানাননি যে ডাঃ সেনের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
কেন বলুন তো!
কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম এইজন্য যে, মিথ্যে তাহলে আর হয়ত আপনাকে অন্যত্র উনি বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করতেন না।
আমার মাকে আপনি জানেন না মিঃ রায়, কোন একটা ব্যাপারে মা একপ্রকার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁকে সে সিদ্ধান্ত থেকে টলানো দুঃসাধ্য।
কিন্তু তাতে করে জটিলতা কি আরও বাড়ে না? যাক সে কথা, কিন্তু সমীরবাবুকে অন্ততঃ সে কথাটা জানিয়ে দিলেও হয়ত–
সেরকম বুঝলে জানাতেই হবে।
আমি বলব?
প্রয়োজন নেই। যা করবার আমিই করব।
বেশ। এবার তাহলে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসা যাক।
কিন্তু যা আমি জানতাম সবই তো দালাল সাহেবকে কাল রাত্রেই বলেছি!
বলেছেন সত্যি, তবে আরও আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে।
দেখুন মিস মিত্র, যে প্রশ্নগুলো আপনাকে আমি করব, জানবেন তার জবাবের ওপর আপনার বড়মামা রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারটা অনেকখানি নির্ভর করছে।
কি প্রশ্ন?
প্রশ্নগুলো অবশ্য কিছুটা গত রাত্রেরই পুনরুক্তি বলতে পারেন। তবু বলছি এজন্য যে কিছু কিছু ব্যাপার আরও স্পষ্ট করে আমি জানতে চাই।
কি জানতে চান বলুন?
গত রাত্রে আপনার মামার নিহত হবার কথাটা জানবার আগে আপনি কোথায় ছিলেন ও কি অবস্থায় ছিলেন? অর্থাৎ ঠিক ঐ সময়টাতে-সোয়া তিনটে থেকে পৌনে চারটে পর্যন্ত আপনি জেগে ছিলেন, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
মুহূর্তকাল কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে রুচিরা জবাব দেয়, আমি আমার ঘরে তখনও জেগেই ছিলাম। ঘুম আসছিল না বলে শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিলাম।
কিরীটীর মনে হয় রুচিরা যেন শেষের দিকে একটু ইতস্ততঃ করে কথাটা শেষ করল।
হুঁ, কাল তাহলে মিথ্যে কথা বলেছিলেন যে আপনি ঐ সময় ঘুমোচ্ছিলেন! যাক গে, কাল রাত্রের মতই এমনি রাত জেগে উপন্যাস পড়াটাই কি আপনার অভ্যাস?
না। তবে ঘুম না আসা পর্যন্ত পড়ি।
পাশের ঘরে আপনার মা ঘুমিয়ে ছিলেন?
হ্যাঁ।
কিরীটী ক্ষণকাল আবার চুপ করে থাকে। অতঃপর বলে, কেউ আপনার ঘরে ঐ সময় আর ছিল না?
রুচিরা মুহূর্তকাল যেন আবার একটু ইতস্ততঃ করে, তারপর বললে, না।
জবাবটা মৃদু। হঠাৎ কিরীটী বলে ওঠে, শুনুন রুচিরা দেবী, সকালবেলা তখন নটা-দশটার সময়ই হবে, আপনি যখন আপনার ঘরে ছিলেন না, সেই সময় আপনার ঘরের মধ্যে আপনার বিনানুমতিতেই আমাকে একবার বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল—
আপনি আমার ঘরে গিয়েছিলেন! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, শুধু আপনার ঘরেই নয়—আপনাদের প্রত্যেককেই না জানিয়ে প্রত্যেকের ঘরেই আমাকে যেতে হয়েছিল। অবশ্য ক্ষমা চাইছি সেজন্য। এবং জানেন না আপনারা কেউ যে, প্রত্যেকের ঘরেই আমি কিছু-না-কিছু সূত্রের সন্ধান পেয়েছি।
সূত্রের সন্ধান!
হ্যাঁ।
আমার ঘরে? রুচিরা হঠাৎ যেন প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ, আপনার ঘরেও। বলতে বলতে কিরীটী পকেটের মধ্যে সহসা হাত ঢুকিয়ে কয়েকটি দগ্ধাবশেষ সিগারেটের অংশ বের করে প্রসারিত হাতের পাতার উপর রেখে হাতটা রুচিরা দেবীর চোখের সামনে এগিয়ে ধরল এবং মৃদুকণ্ঠে বললে, এই বিশেষ সিগারেটের দগ্ধাবশেষগুলো আপনার ঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পেয়েছি মিস মিত্র। Special Turkish brand সিগারেট! নিশ্চয়ই আপনার ধূমপানের অভ্যাস নেই?
স্তম্ভিত নির্বাক, অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রুচিরা কিরীটীর প্রসারিত হাতের উপর রক্ষিত সিগারেটের অংশগুলির দিকে চেয়ে থাকে।
সামান্য শব্দও তার কণ্ঠ থেকে নির্গত হয় না।
আরও বলছি শুনুন, খোঁজ নিয়ে জেনেছি গতরাত্রে এ বাড়িতে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র সমীরবাবুই এই brand-এর সিগারেটে অভ্যস্ত এবং একটু বেশী মাত্রাতেই ধূমপান করে থাকেন তিনি।
নিষ্করুণ ও কঠোর কিরীটীর অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠস্বর।
অব্যর্থ তীক্ষ্ণ শর সে যেন নিক্ষেপ করেছে।
শরাহত পক্ষিণীর দৃষ্টি রুচিরার দুই চোখের তারায় ঘনিয়ে ওঠে। একটা বোবা যন্ত্রণা যেন তার চোখমুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রুচিরা দেবী! আবার কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এবারে বলবেন কি, অত রাত্রে সমীরবাবু কেন আপনার ঘরে গিয়েছিলেন? এবং কখনই বা গিয়েছিলেন, আর কতক্ষণই বা সেখানে মানে আপনার ঘরে ছিলেন?
তথাপি নির্বাক রুচিরা।
জবাব দিন রুচিরা দেবী! রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারে একবার যদি আপনি তালিকার মধ্যে এসে যান, আপনারও অবস্থা ঠিক আপনার মাসতুতো ভাই শকুনির মতই হবে—হাজত
একটা অস্ফুট আর্ত শব্দ কেবল রুচিরার কণ্ঠ হতে নির্গত হল। কিন্তু কোন কথাই সে বলতে পারল না।
কিরীটী আবার বলে, শুনুন, মিথ্যে আপনি নিজেকে গোলমালের মধ্যে জড়িয়ে ফেলছেন। হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ—এ ঠিক মাকড়সার বিষাক্ত রস-গরল। গরল গায়ে লাগলেই ঘা দেখা দেবে। Come out with it! বলুন–
বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, সত্যিই আমি মামার হত্যার ব্যাপারের কিছুই জানি না।
অত্যন্ত দ্রুত কথাগুলি বলে রুচিরা যেন হাঁপাতে থাকে।
সে কথা তো আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি। আমি জিজ্ঞাসা করছি কাল রাত্রে কখন সমীরবাবু আপনার ঘরে গিয়েছিলেন এবং কতক্ষণই বা ছিলেন? কেনই বা গিয়েছিলেন এবং তিনি স্ব-ইচ্ছায়ই গিয়েছিলেন, না আপনিই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন? বলুন জবাব দিন!
আ—আমি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
আপনি?
হ্যাঁ।
কখন গিয়েছিলেন তিনি?
রাত তিনটে বাজার বোধ হয় কয়েক মিনিট পরেই। বই বন্ধ করে আমি শুতে যাব, ঠিক এমনি সময় তিনি আমার ঘরে এসে ঢোকেন।
অত রাতে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
না, সন্ধ্যার সময় ডেকেছিলাম—এসেছিলেন ঐ সময়।
হুঁ, তাহলে রায়বাহাদুরের ঘর থেকে বের হয়ে সোজা তিনি আপনার ঘরেই এসে ঢুকেছিলেন! কতক্ষণ ছিলেন?
বোধ করি আধঘণ্টাটাক হবে।
আধ ঘণ্টা, না ঘণ্টাখানেক?
তা ঘণ্টাখানেকও হতে পারে।
হুঁ। ঘণ্টাখানেক যদি হয় তাহলে রাত তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত আপনারা দুজনে আপনার ঘরেই ছিলেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
সমরের কথাটা বলতেই।
বলেছেন তাঁকে?
না।
কেন?
সুযোগ পাইনি।
কেন?
কেবলই তিনি অন্য কথা বলতে লাগলেন!
এবারে কিরীটীর দ্বিতীয় শর নিক্ষিপ্ত হল রুচিরার প্রতি, দ্বিতীয় প্রশ্ন।
এবারে বলুন রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা আপনাদের কে দিয়েছিল?
সে তো কালই বলেছি, ছোটমামা!
দুঃশাসনবাবু?
হ্যাঁ।
দুঃশাসনবাবু যখন আপনাকে খবরটা দেন, সে সময় সমীরবাবুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন কি?
কিরীটীর প্রশ্নে রুচিরা কেমন যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।
বলুন?
না, মামার পায়ের শব্দ শুনে ঘরে কেউ আসছে টের পেয়ে চট করে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল সমীর।
হুঁ। দুঃশাসনবাবু আপনাকে কি বলেছিলেন?
বলেছিলেন, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে—দাদাকে ছোরা দিয়ে কে যেন হত্যা করেছে, শীগগিরি আয়-বলেই তিনি ঘর থেকে চলে যান।
তারপর?
কিন্তু সংবাদটা এত আকস্মিক যে কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর মাকে গিয়ে সংবাদ দিই।
আপনার মা ঐ সময় জেগে ছিলেন, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
ঘুমিয়েই ছিলেন বিছানায়।
আচ্ছা একটা কথা বলতে পারেন, আপনার মা কি গরম জামা গায়ে দিয়েই রাত্রে বিছানায় ঘুমোন?
না, কেন বলুন তো?
না, তাই বলছিলাম। আপনি হয়ত জানেন না বা লক্ষ্য করবারও সময় পাননি রুচিরা দেবী, গতরাত্রে আপনি যখন আপনার মাকে দুঃসংবাদটা দিতে যান তিনি তখন জেগেই ছিলেন। অর্থাৎ ঘুমের ভান করে শয্যায় শুয়েছিলেন মাত্র। তবে এখন বুঝছি আপনার কথাই সত্যি!
রুচিরা কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। গতরাত্রে সে যখন তার মাকে ডাকতে যায়, মা তাহলে জেগেই ছিলেন? বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে থেকেও ঘুমের ভান করে ছিলেন? কিন্তু কেন? তবে কি-রুচিরার চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল কিরীটীর প্রশ্নে!
এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, গতরাত্রে আপনার ও সমীরবাবুর মধ্যে যে আলোচনাই হয়ে থাক—সমস্ত কিছুই তিনি পাশের ঘরে জেগে থাকার দরুন শুনতে পেয়েছেন!
কিন্তু কেন—মা তা করতেই বা যাবেন কেন?
কিরীটী এবারে হেসে ফেলে, তারপর স্মিতকণ্ঠে বলে, তা কেমন করে বলি বলুন! আপনাদের সাংসারিক ব্যাপার তো আমার জানা সম্ভব নয়!
But I hate simply hate this sort of spying! এ ধরনের কারও কথা আড়ি পেতে শোনা আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি। অত্যন্ত বিরক্তিমিশ্রিত রুক্ষকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল রুচিরা।
কিরীটী তার অনুমানকে যাচাই করবার এমন সুবর্ণ সুযোগটি হেলায় যেতে দিল না। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে, হয়ত তাঁর ইচ্ছা আপনি সমীরবাবুকেই বিবাহ করেন, তাই!
রুচিরার গোপন ব্যথার স্থানে অতর্কিতেই আঘাত করে কিরীটী। মুহূর্তে রুচিরার সমগ্র চোখমুখ রাগে ও উত্তেজনায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।
তিক্ত কঠোর কণ্ঠে রুচিরা আর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বলে ওঠে, তাঁর ইচ্ছা। নিজের ভালমন্দ বিবেচনা করবার মত যথেষ্ট বয়েস হয়েছে আমার। কারোর ইচ্ছাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নেবতা সে যিনিই হোন না কেন, অন্তত রুচিরার দ্বারা তা হবে না।
শান্ত হোন রুচিরা দেবী, এসব ব্যাপারে বৃথা উত্তেজিত হয়ে তো কোন লাভ নেই। আপনি সমীরবাবুকে বিবাহ করতে চান না সে কথা সুস্পষ্টভাবে আর কাউকে না পারেন সমীরবাবুকেও তো অন্ততঃ জানিয়ে দিতে পারতেন এতদিন। আর সেই কথাই আমি একটু আগে বলছিলাম।
সেই কথাই কাল রাত্রে তাকে বলব বলে ডেকে এনেছিলাম গোপনে, কিন্তু লোভী সে —কিছুতেই আমার কথা শুনতে চাইছিল না। যাক গে, না শোনে না শুনুকতাছাড়া আজ আর বড়মামাও বেঁচে নেই, দায় থেকে আমিও মুক্ত। মার এবং বিশেষ করে তাঁরই ইচ্ছায় এ ব্যাপারটা এতদূর অগ্রসর হয়েছিল। এইখানেই এর শেষ।
আপনার বড়মামা রায়বাহাদুরই বুঝি ঐ বিবাহে ইচ্ছুক ছিলেন?
হ্যাঁ। সমীরের সঙ্গে আমার বিবাহ দিয়ে বড়মামা ঐ সমীরের গ্রাস থেকে একটা কোলিয়ারী বাঁচাতে চেয়েছিলেন। মাত্র দিন-দুই হল দাদুর মুখে আমি কথাটা জানতে পেরেছি। আগে তো জানতেই পারিনি।
কে? অবিনাশবাবু আপনাকে বলেছিলেন ও-কথা?
হ্যাঁ। আমি অবিশ্যি প্রথম থেকেই কথাটায় আমল দিইনি। কিন্তু বিশেষ করে ঐ কথাটা কয়েকদিন আগে জানবার পর কাল রাত্রে খোলাখুলি ভাবেই আমার অমত জানিয়ে দেব ভেবেছিলাম সমীরকে ডেকে এনে।
রুচিরার গতরাত্রের সত্নরচিত গোপনতার আড়ালটুকু কিরীটী সুকৌশলে আঘাতের পর আঘাত দিয়ে ভেঙে একেবারে চুরমার করে দিল। রুচিরা সব কিছু অতঃপর প্রকাশ করে দিল।
আর একটা কথার জবাব চাই আমি আপনার কাছ থেকে মিস মিত্র।
কি?
গতকাল আপনার ছোটমামা যখন আপনাকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদটা দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেন তখন আপনি তাঁকে বলেছিলেন—তাঁর কীর্তির কথা নাকি কারও জানতে বাকি নেই! কেন তাঁকে সে কথা আপনি বলেছিলেন বলবেন কি?
কি আর—এই বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ওঁর এইখানে আসা অবধিই তো বড়মামার সঙ্গে নিত্য প্রায় খিটিমিটি চেঁচামেচি হত, বড়মামা যে অসুস্থ এই সামান্য কথাটাও যেন উনি ভুলে যেতেন—
তাই কি?
শুধু কি তাই! বলতে লজ্জা হয় মিঃ রায়, মার মুখে শুনেছি—একদিন নাকি উইলের ব্যাপারে ছোটমামা threaten পর্যন্ত করেছেন!