১৮তম অধ্যায়
ভীমসমীপে দ্ৰৌপদীর সাপমান দুঃখ-নিবেদন
দ্রৌপদী কহিলেন, “হে ভীম! রাজা যুধিষ্ঠির যাহার ভর্ত্তা, তাহার সুখস্বচ্ছন্দতা কোথায়? তুমি আমার সমুদয় দুঃখ সবিশেষ জ্ঞাত হইয়াও এক্ষণে কেন এইরূপ জিজ্ঞাসা করিতেছ? তৎকালে [হস্তিনায় বস্ত্রহরণসময়ে]। প্ৰতিকামী আমাকে দাসী বলিয়া যে সভামধ্যে আনয়ন করিয়াছিল, তাহা অদ্যাপি নিরন্তর আমার হাদয় দগ্ধ করিতেছে। দেখ, দ্রৌপদী ব্যতিরেকে অন্য কোন রাজদুহিতা ঈদৃশ দুঃখ সহ্য করিয়া জীবিত থাকে? বনবাসকালে দুরাত্মা জয়দ্ৰথ বলপর্বূক আমার অবমাননা করিয়াছিল, আমা ব্যতিরেকে তাহাই বা আর কে সহ্য করিতে পারে? সম্প্রতি কীচক ধূর্ত্ত মৎস্যরাজসমক্ষে আমাকে পদাঘাত করিয়াছে। হে ভীম! আমি বারংবার এইরূপ ক্লেশ পাইতেছি, তথাপি তুমি আমার দুঃখে কিছুই মনোযোগ করিতেছ না, অতএব আর আমার জীবনধারণের প্রয়োজন কি?
“দুমর্ত্তি কীচক বিরাটরাজের শ্যালক ও সেনাপতি; সে আমাকে সৈরিন্ধ্রী দেখিয়া প্রতিদিনই আমাকে “আমার প্ৰেয়সী হও, আমার প্রেয়সী হও” এই কথা কহিয়া থাকে। সেই দুরাত্মার অবমাননায় আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। এক্ষণে যাহার কর্ম্মফলে আমি এই অনন্ত দুঃখ প্রাপ্ত হইয়াছি, তুমিই তোমার সেই দূতাসক্ত ভর্ত্তাকে তিরস্কার করা। ঐ দ্যূতাসক্ত ব্যতিরেকে আর কোন ব্যক্তি রাজ্য, সর্ব্বস্ব ও আপনাকে দুরোদমুখে [পাশক্রীড়া] বিসর্জন করিয়াও পুনরায় প্ৰব্ৰজ্যা অবলম্বনার্থে দ্যূতক্রীড়া করিয়া থাকে? যদি ধর্ম্মরাজ নিষ্কসহস্র ও মহামূল্য রত্নজাত দ্বারা অনেক বৎসর সায়ং-প্ৰাতঃকালে ক্রীড়া করিতেন, তাহা হইলেও রজত, সুবর্ণ, বস্ত্র, যান, অশ্ব ও অশ্বতর-সকল কদাচ ক্ষয় হইত না। কিন্তু তিনি দ্যূতবিবাদের নিমিত্ত শ্ৰীভ্রষ্ট হইয়া এক্ষণে কেবল অতীত কর্ম্মের অনুশোচনা করিয়া নিতান্ত মূঢ়ের ন্যায় তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়াছেন।
“পূর্ব্বে দশ সহস্ৰ হন্তী ও অশ্ব-সমুদয় যাহার অনুগমন করিত, এক্ষণে তিনি দ্যূতক্ৰীড়া অবলম্বনপূর্ব্বক জীবিকানির্ব্বাহ করিতেছেন। ইন্দ্ৰপ্ৰস্থে শত সহস্র ভূপালগণ যে যুধিষ্ঠিরকে উপাসনা করিতেন, যাঁহার মহানসে [পাকশালায়] শত সহস্ৰ দাসী পাত্ৰ হস্তে লইয়া দিবারাত্ৰ অতিথিভোজন করাইত, যিনি সহস্ৰ সহস্ৰ নিষ্ক [সুবর্ণমুদ্রা] দান করিতেন, তিনিই এখন দ্যূতক্ৰীড়া অবলম্বনপূর্ব্বক কালব্যাপন করিতেছেন। পূর্ব্বে মধুরস্বরসংযুক্ত মণিময়কুণ্ডলধারী সূত ও বৈতালিকগণ যাঁহাকে সায়ং ও প্ৰাতঃকালে উপাসনা করিত, তপস্যা ও শ্রুতসম্পন্ন সহস্ৰসংখ্যক ঋষি যাঁহার সভাসদ ছিলেন, যিনি অষ্টশীতি সহস্র গৃহমেধী স্নাতক ও তাঁহাদের দাসীগণ এবং দশ সহস্ৰ অপ্ৰতিগ্রাহী [দানগ্রহণে বিরত] উৰ্দ্ধারেতা যতিগণকে ভরণ-পোষণ করিতেন, যাঁহাতে অনুশংসতা, অনুক্রোশ [দয়া] ও সংবিভাগ [প্রার্থী পাত্রে বিবেচনাপূর্ব্বক যথোচিত প্রয়োগ-পক্ষপাতরহিত দান] এই সকল সদগুণ বিদ্যমান আছে, তিনিই এক্ষণে দুর্দ্দশাপন্ন হইয়া কালব্যাপন করিতেছেন।
“যিনি রাষ্ট্রমধ্যে অন্ধ, অনাথ, বালক প্রভৃতি দুরবস্থাগ্রস্ত ব্যক্তিদিগকে সর্ব্বদা প্রতিপালন করিতেন, যিনি কোন বস্তু বিভাগ করিতে হইলে পক্ষপাতনিরপেক্ষ হইতেন, এক্ষণে তাঁহাকে সভামধ্যে সকলে বিরাট-পরিচারক দ্যূতক্রীড়ক কঙ্ক বলিয়া আহ্বান করিয়া থাকে। তাঁহার এই অবস্থা নরকপ্রাপ্তির তুল্যই বোধ হইতেছে। ইন্দ্রপ্রস্থে অবস্থানকালে ভূপালগণ যাঁহার নিকট উপহার লইয়া সমুচিত অবসরে সমুপস্থিত হইতেন, তিনিই এক্ষণে জীবিকানির্ব্বাহার্থে অন্যের নিকট বেতন গ্ৰহণ করিতেছেন। বহুসংখ্যক ভূপতিগণ সতত যাঁহার বশবর্তী ছিলেন, তিনি এক্ষণে স্বয়ং পরবশ হইয়াছেন। যিনি তেজঃ-প্রভাবে সূৰ্য্যের ন্যায় সমস্ত মেদিনীমণ্ডল পরিতাপিত করিতেন, তিনি এখন বিরাটরাজের সভাসদ হইয়াছেন। অনেকসংখ্যক ভূপতি ও ঋষিগণসমভিব্যাহারে সভামধ্যে যাঁহার উপাসনা করিতেন, তিনিই এক্ষণে অন্যের সভায় অধ্যাসীন হইয়া তাহার প্ৰিয়বাদী হইয়াছেন। উহাকে দর্শন করিয়া আমার ক্ৰোধানল পরিবর্দ্ধিত হইতেছে! এই ধর্ম্মাত্মা ধর্ম্মরাজকে জীবিকানির্ব্বাহার্থে পরাধীন দেখিয়া কাহার না দুঃখের উদ্রেক হয়? হে ভীম! আমি অনাথার ন্যায় এবংবিধ বহুবিধ দুঃখভারে নিতান্ত কাতর হইতেছি, তুমি কেন আমার দুঃখমোচনে যত্ন করিতেছি না?”