আঠারো – বিদ্রোহের মুহূর্ত
জুহা মৌলবি তিনপাহাড়ি থেকে ফিরে এসে অনেকগুলো খবর দিলেন। খবরের মতো খবর। সুধাময়বাবু চুলদাড়ি কেটে বিয়ে করেছেন এবং গোরাংবাবুর ব্যাপারে খুব উৎসাহী। মিশনারি হাসপাতালে দুবেলা খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনপাহাড়ির মতো স্বাস্থ্যকর স্টেশনে সুধাবাবুর চেহারা খুব খোলতাই হয়েছে। প্রথমে তো জুহাসায়েব চিনতেই পারেননি যে চিরোটি স্টেশনের সেই খ্যাংরাকাঠি লোকটি ইনি। তবে মৌলুবির মতে, সুধাবাবুটিও সেই উন্মাদাশ্রমে থাকার যোগ্য মানুষ। পাগল, পাগল, মাথাখারাপ!…বলে মৌলবি প্রচুর হাসলেন। কেন পাগল বলা হচ্ছে, তা অবশ্য বিশদ জানতে চায়নি স্বর্ণ।
এরপর ইয়াকুব সাধুর কথা।
হঠাৎ ওখানে ব্যাটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে জুহা মৌলবির। তাজ্জব কাণ্ড! মুসলমান বাউলফকিরদের একটা আখড়া আছে তিনপাহাড়িতে। আখড়া না বলে পাড়া বলাই ভালো। পাড়ার শেষদিকে একটা বিশাল দিঘি আছে। তার দক্ষিণ—পশ্চিম কোনায় আছে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ। তার তলায় ইয়াকুব সাধু এখন ইয়াকুব ফকির হয়ে বসে গিয়েছে। পয়সাকড়ি কামানোর ভালো ফন্দিফিকির এঁটেছে ব্যাটা বহুরূপী। হ্যাঁ, এখনও তার ভর ওঠে, মাথা দুলিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে সে। কিন্তু ‘কালী’ বলে না ভুলেও। তার বদলে ‘আলি—আলি’ বলে। সে চ্যাঁচানি শুনে দুর্বল লোকের মারা পড়ার কথা। গাঁজাখোর লোকের বুকে এত দম থাকে, ভাবা যায় না!
আর, সবচেয়ে তাজ্জব কাণ্ড—হেরুর ছেলে সেই ডেভিড কিংবা ইসমাইল এখন তার কাছে।
কীভাবে এই মিলন ঘটল, তাও শুনে এসেছেন মৌলবি। আগের বর্ষায় ইয়াকুব যখন এখানে—সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কাটোয়া স্টেশনে হেরুর ছেলেকে হঠাৎ দেখতে পায়। ইয়াকুব বলেছে—খুব বৃষ্টি পড়ছিল রাত্রিবেলা। স্টেশনের পিছনে রেলের মস্ত আটচালায় আরও সব ভবঘুরে ও ভিখিরিদের সঙ্গে সে রাত কাটাচ্ছিল। এমন সময় পাশেই আবিষ্কার করে ছোঁড়াটাকে। পাতলুন জামাপরা ক্ষুদে প্রাণীটা কুঁকড়ে শুয়ে ছিল। গাঁজা খাবার জন্যে দেশলাই জ্বালতেই তার মুখে আলো পড়ল। মুহূর্তে চিনেছিল ইয়াকুব। প্রথমবার সন্দেহ হলে আবার আলো ফেলেছিল। …
তবে আসল কথাটা হচ্ছে—ইয়াকুব বলেছে মৌলবিকে—সে ওই ছেলেটার জন্যেই চুপিচুপি চিরোটির দিকে এগোচ্ছিল। শেষরাতের রেল গাড়িতে চেপে সে ওখানে যেত—প্রথমে স্বর্ণমায়ের কাছে, তারপর মৌলবির কাছে। কারণ ছেলেটার জন্যে সে একটুও সুখ পাচ্ছিল না। ‘সাধনভজনে’ মন বসছিল না। তা—এই তো হচ্ছে চরম প্রমাণ যে ইয়াকুবের ঈশ্বর ইয়াকুবকে পরিত্যাগ করেননি।
ছেলেটা স্বল্পভাষী বরাবর। যেটুকু ইয়াকুব জেনেছে, তা হল : গোবরহাটির মতি বায়েনের বাড়ি থেকে সে সোজা মাঠবিলজঙ্গল পেরিয়ে চলতে থাকে। তার কিছু ভালো লাগছিল না। সে পাদরিবাবার কাছেই (কী নেমকহারাম ছেলে!) ফিরতে চেয়েছিল। পথ ভুলে সোজা গিয়ে ওঠে রেললাইনে, তারপর লাইন ধরে চলতে চলতে পৌঁছয় বাজারসাহু স্টেশানে। চিরোটির ডাউন একটা স্টেশনের পরেরটায়। তখন রাতদুপুর হয়ে গেছে। অতটুকু ছেলে বনবাদাড় ভেঙে হেঁটেছে! সাপে কাটেনি। ভয় পায়নি! তারপর সকালবেলা একটা গাড়ি আসতেই চেপে বসেছে। কথা বলতে চায় না তো! তাই কাকেও জিগ্যেস করেনি, গাড়িটা কোথায় যাবে।
গাড়িটা ভাগ্যিস ছিল লোকাল। ওখানেই শেষ। তাই ছেলেটা শেষ অব্দি কাটোয়ায় ঘুরেছে সারাটা দিন। সুন্দর টুকটুকে ছেলে দেখে অনেকে ভেবেছে ভদ্রলোকের ছেলে—পালিয়ে এসেছে কিংবা পথ হারিয়েছে। তাই কেউ কেউ খোঁজখবর করতে চেয়েছে। কিন্তু সে কারও কাছে ধরা দেয়নি।
শুধু এক ময়রার স্নেহকে সে প্রত্যাখ্যান করেনি, ময়রাটা তাকে পেটপুরে লুচিমিষ্টি খাইয়েছিল। ময়রাবউ বলেছিল, আমাদের ঘরে থাকো, বাবা। কিন্তু সে একফাঁকে ফুড়ুৎ করে উড়েছে। তারপর সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি এলে তখন আটচালায় গিয়ে জুটেছে।
ইয়াকুব বলেছে, ‘আমাকে চিনল সঙ্গে সঙ্গে। সাধুবাবা বলে কেঁদে উঠল। তবে কথা কী, মানুষের মধ্যে আত্মা আছে। সেই কেঁদেছিল। ও তো দুধের বাচ্চা। অত কিছু বোঝে না। ওর আত্মার কাছে সবই তো পরিষ্কার। যেমন এই দিঘির পানি—আপনি তার তলাঅব্দি দেখতে পাবেন মৌলবিসায়েব।
জুহা মৌলবি কীভাবে ইয়াকুবকে আবিষ্কার করলেন?
সেও কম চমকপ্রদ নয়। তিনপাহাড়িতে অধিকাংশ মানুষই বঙ্গভাষী—যদিও জায়গাটা বিহারপ্রদেশ। সেখানে মুসলমানরা আগের বছর জুহা মৌলবির কাছে ‘তৌবা, করে ফরাজিমতে দীক্ষা নিয়েছিল। পবিত্রভাবে জীবনযাপনের প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু করলে কী হবে? ফকির বাউল পাড়াটা কাছাকাছি থাকায় খুব শিগগির ঝাড়ফুঁক মন্তরতন্তর কিংবা অনৈসলামিক সংস্কার চলে যাওয়া সহজ নয়। এবার গোরাংবাবুকে নিয়ে যাবার পর মৌলবি সব টের পেলেন। মোড়ালরা জানাল, ‘জমাত’ (সমাজ) বশে আসছে না। লুকিয়ে বিবিসায়েবারা পিরের সিন্নি খায়। মানত করে। কামাল ফকিরের কাছে মাদুলি নেয়। মুশকিল আসানের চিরাগ থেকে পিদিম জ্বালে লুকিয়ে। তার ওপর ইদানীং উৎপাত কে এক প্রচণ্ড ফকির ইয়াকুব বাবাসাহেবের আবির্ভাব। আর ঠেকানো গেল না শরীয়ত। শুধু তিনপাহাড়িতে নয়, ঐ এলাকায় হিড়িক পড়ে গেছে। হিন্দু মুসলমান সবাই এসে ভিড় করছে তার আস্তানায়। একটা ঘরও করে দিয়েছে ফকিরবাবাকে।
সুতরাং, অন্যান্য ক্ষেত্রে যা করেন, এখানেও সেই কৌশল অবলম্বন করলেন জুহা মৌলবি। দলবল নিয়ে চড়াও হয়ে ভড়কে দেবার চেষ্টা করলেন। ইয়াকুবের সাগরেদও জুটেছিল দুচারজন। বাইরের ভিড়ও ছিল। সবে ভর ওঠার আয়োজন চলেছে। তিনপাহাড়ির আন্ডাবাচ্চা তাবৎ মুসলমান শিষ্যসহ জুহা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই চকিতে ব্যাপারটা টের পেয়ে ভিড় পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল। তারপর সাগরেদরা দিঘির জলে প্রায় ঝাঁপ দিল বলা যায়। (মৌলবি খুব হাসতে হাসতে এই বর্ণনাটা দিলেন) তখনও ব্যাটা ইয়াকুব চোখ বুজে ভান করছে। এদিকে হেরুর ছেলেটা ঘরের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। ওকে না দেখলে মৌলবি টেরই পেতেন না যে এ ব্যাটা সেই কালীসাধক ইয়াকুব!
জুহা তক্ষুনি চিনতে পারলেন ইয়াকুবকে। ব্যাটার চেহারায় জেল্লা খেলছিল। রোজগার ভালোই হচ্ছিল কি না। জুহা চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘অ্যাই ইয়াকুব!’
ইয়াকুব চোখ খুলল। তারপর হাত বাড়িয়ে দিল—’আসসালামু আলাইকুম মৌলনাসায়েব!’
ব্যাটা অসম্ভব ধূর্ত।
তাহলেও শরীয়তের পবিত্রতা রক্ষার জন্য জুহা কোনোরকম অজুহাত বরদাস্ত করতেন না। তিনি ভালোই জানেন, এসব ক্ষেত্রে ইয়াকুবের জন্যে থানার দারোগাবাবুরা কিছুতেই করবে না। কারণ, মোড়ালরা মৌলবির পক্ষে।
অথচ হঠাৎ কী ঘটে গেল মৌলবির মনে।
ঠিক কী ঘটল, তিনি এখনও স্পষ্ট বলতে পারবেন না। বড়জোর বলতে পারেন, বিকেলের লালচে রোদ পশ্চিমের খোলা মাঠ পেরিয়ে এসে দুটো মুখে পড়েছিল, আর পিছনে বটগাছের ছায়া দিঘির পাড় বেয়ে উঠে গিয়েছিল, একটা গভীর স্তব্ধতা নেমে এসেছিল হঠাৎ সেই পরিবেশে—কী জানি কেন, মৌলবির মনে হল—এখানে সবকিছু বড় নিষ্ফল আর অকারণ যেন। নাকি দুটো মুখেই কী ছিল—কোণঠাসা আক্রান্ত প্রাণীর ভয়, কিংবা উলটোটা—তীব্র পরিহাস, জুহাসায়েব ইয়াকুবের সঙ্গে অন্যরকম কথাবার্তাই বললেন। খুব ঠান্ডা মেজাজে ওকে কিছু সদুপদেশ দিলেন। ছেলেটার সঙ্গেও কিঞ্চিৎ রসিকতা করলেন। এতে কার মাহাত্ম্য বাড়ল, সেটা এখন বলা কঠিন—ইয়াকুবের কিংবা মৌলবির। তবে যে—কটা দিন ছিলেন, ইয়াকুব তাঁর কাছে গেছে—পায়ের কাছে বসে ধর্মোপদেশ শুনেছে আর ফাঁকে ফাঁকে চিরোটি এলাকার খবরাখবর জিগ্যেস করেছে। গোরাংবাবুর কথা শুনেছে, কেঁদে ফোঁস ফোঁস করে নাক ঝেড়েছে। বলেছে ‘আমি যখন কাছেই আছি—স্বর্ণমাকে বলবেন, কোনোরকম অসুবিধে হবে না ডাক্তারবাবুর।’
ছেলেটা—নেমকহারাম ছেলেটা মৌলবিকে একটি কথাও বলেনি!
এতসব বলার পর জুহা আচমকা বলে উঠলেন—’তবে আল্লার কসম, পাদরিকে আমি এলাকা থেকে তাড়াব। রাঙামাটির ঝিলে গরিবগুরবো লোকেরা এটাওটা কুড়িয়েবাড়িয়ে অ্যাদ্দিন খেয়ে বেঁচেছে। শুনলুম, চৌকিদার দফাদার আর লেঠেল বসিয়েছে সেখানে। মাছ বেচে মিশনের খরচ তুলবে।’
তারপর স্বভাবমতো তিনি ফের অন্যপ্রসঙ্গে গেলেন। বাঘের হাতে চৈতকের মৃত্যুতে খুব দুঃখপ্রকাশ করলেন। জর্জের ব্যাপারে বললেন—’লোকটা ভালো। তবে সেও এক পাগল। ওকেও না তিনপাহাড় নিয়ে যেতে হয়।’
শেষে বললেন, ‘বাঘটা আমিই মারব। লোকে মাঠে নামতে পারছে না। তার ওপর আমার বন্ধুর ঘোড়াটা খেল। শয়তানের শাস্তি না দিলে নয়।’
স্বর্ণ হাসতে পারত কথাটা শুনে। কিন্তু হাসির দিন তার নেই।
এরপরই জুহা মৌলবির বাঘমারার অভিযানটা ঘটে। সে বড় হাস্যকর ব্যাপার। স্বর্ণ স্বচক্ষে কিছু দেখেনি। বাঘটা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় বেশ কয়েকজনকে জখম করেছিল। এমনকি মৌলবিকে পুকুরের জলে ঝাঁপ দিতে হয়েছিল।
বাঘটার ব্যাপারে জুহা প্রচণ্ড খেপে গেলেন এবার। কালেকটার বাহাদুরের কাছে এলাকার লোকের সই সংগ্রহ করে দরখাস্ত গেল। সরকার আশ্বস্ত করলেন—সবুর, ব্রিটিশ প্রজাবর্গের অশান্তির কারণটিকে শীঘ্রই দূর করা হবে।
বাঘ মারতে একদল শিকারি এল। দুটো হাতি এল। স্টেশনের মাঠে তাঁবু পড়ল। সে এক হইচই ব্যাপার। শোনা গেল স্বয়ং কালেকটার বাহাদুরও আসবেন বন্দুক নিয়ে।
জর্জ হ্যারিসন ভেতরে—ভেতরে রেগে লাল। ইদানীং কেন কে জানে,—হয়তো নিজের ব্যর্থতার জন্যেই, স্বর্ণকে এড়িয়ে থাকে। স্বর্ণ কিন্তু মুখোমুখি হলেই খোঁচা দিতে ছাড়ে না—’কী জর্জ? তোমার খবর কী?’
‘—কী খোবোর?’
‘—বাঘ?’
জর্জের চোখ দুটো মুহূর্তে জ্বলে ওঠে। মনে হয়, জানোয়ারের মতো ঝাঁপ দিয়ে স্বর্ণকে ধরাশায়ী করতে পারলে তার পৃথিবী আর আকাশের মুক্তি ঘটে। আর স্বর্ণ ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে ধীরে ছন্দে চলে যায় গাঁওয়ালে। তার গলায় স্টেথিসকোপ, একহাতে ব্যাগ। সে এখন পায়ে হেঁটেই রোগী দেখতে যায়। ফিরতে রাত হবে বলে আগের মতো বিকেলে বেরোয় না—দুপুরেই রওনা হয়।
তিনপাহাড়ি যেতে মন টানছিল তার। যতটা না বাবার জন্যে, হেরুর ছেলেটার জন্যেই। ছোঁড়াটাকে এত যে দেখতে ইচ্ছে করে। কত বড় হয়েছে, কেমন হয়েছে এখন! পৃথিবীতে চোখ খোলার পর থেকে যাকে দেখেছে সামনে, সেই তো হবে তার প্রকৃত আত্মজ। তার নাম ইয়াকুব সাধু। তার কাছে গিয়ে তাই নিশ্চয় ছেলেটা শান্তি পেয়েছে। কিন্তু কী হবে ওর ভবিষ্যৎ? ওইরকম ভবঘুরে সাধুসন্নেসী হয়ে জীবন কাটাবে সে?
এটা সঙ্গত মনে হয় না। তার চেয়ে পাদরি সাইমনের কাছে থাকলে আর কিছু না হোক, সভ্যভদ্র একটা জীবনের আশা ছিল। লেখাপড়া শিখতে পারত। এখন মনে হয়, স্বর্ণ নিজেই বড্ড ভুল করেছে। কেন ছেলেটাকে লুকিয়ে রাখল সে? কেন ওকে ফিরিয়ে দিয়ে এল না পাদরির কাছে?
এখন আফশোস লাগে। বিক্ষোভটা মাঝে মাঝে এত তীব্র হয় যে মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে করে! কী ভুল, কী ভুল! হেরুর আত্মা কীসব দেখতে পাচ্ছে? সে নিশ্চয় এর জন্যে দায়ী করছে স্বর্ণ আর ডাক্তারবাবুকে। হেরু ছিল তাদেরই আশ্রিত মানুষ। তার ছেলের আখের এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া উচিত হয়নি।
এমনি চিত্তপ্রক্ষোভের মধ্যে দিনরাতে স্বর্ণ অবচেতনায় প্রস্তুত হচ্ছিল। এ ব্যাপারে একটা কিছু করা তার দরকার। কিছুতেই নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারছিল না সে। আগের মতো হঠকারী কোনো আবেগের ফলাফল নয়—একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছিল সে।
ইতিমধ্যে জুহা মৌলবির সঙ্গে পাদরি সাইমনের সংঘর্ষ আসন্ন হয়ে উঠল।
মোড়ল মাতব্বর লোকেরা অবশ্য এ ঝামেলা চায় না। পাদরির সঙ্গে তাদের কীসের বিরোধ? তারা কেউ ঝিলে নামে না শামুকগুগলি তুলতে। তারা পাদরির কাছে অসুখবিসুখে বিনাপয়সায় বা নামমাত্র দক্ষিণায় ওষুধ পায়। মুসলমান মোড়লরা মৌলবির ফতোয়া ফাঁকি দিয়ে গোপনে ওষুধ নিয়ে আসে। তারা অনেক ওজর—আপত্তি দেখাচ্ছিল।
তখন জুহা তাঁর ফতোয়ায় রণকৌশল বদলালেন। বললেন, সাদা চামড়ার খ্রিস্টানরা মুসলমানদের বাদশাহি কেড়েছে, অতএব তারা মুসলমানদের দুশমন। তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ বিশ্বাসী মুসলমানের অবশ্য পালনীয় কাজ।
মৌলবির এ কণ্ঠস্বর অবশ্য নতুন নয়। বারবার বলেছেন এমন কথা—কিন্তু জেহাদের ডাকটাই যা দেননি।
এখন জেহাদের ডাক দিতে গিয়ে টের পেলেন, কোনো সাড়া নেই। এই এলাকার মাটির মালিক আসলে জমিদাররা। সব প্রজাই জমিদারের অনুগত।
জমিদাররা ইংরেজ শাসনের একেকটি মজবুত স্তম্ভ।
প্রথম ধমক এল সেখান থেকে। দ্বিতীয় ধমক খোদ কালেকটরের। মৌলবির বাড়ির দরজায় চৌকিদার টাঙিয়ে দিয়ে গেল ইস্তাহার। ‘এতদ্দ্বারা মৌলবি মহম্মদ শামসুজ্জোহা পিতা মত মৌলবি মহম্মদ শাহাবুদ্দিন হালসাকিন ডাবকই ডাকঘর গোবিন্দপুর থানা সদর জেলা মুর্শিদাবাদ, তোমাকে আদেশ দেওয়া যাইতেছে যে তুমি সূর্যাস্ত হইতে সূর্যোদয় পর্যন্ত বাটির বাহির হইতে পারিবে না এবং সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাকিম ডাবকই বাদে কোথাও যাইতে হইলে পূর্বাহ্ণে নিকটবর্তী কোনো পুলিশ ফাঁড়িতে অনুমতি করাইয়া লইতে হইবে।’ ইত্যাদি।
জুহা মৌলবি হতভম্ব হয়ে পড়লেন। এ যে তাকে সপরিবারে ভাতে—মারার শামিল!
তিনি দেখলেন, খোদাতালার এই বিশাল দুনিয়ায় হঠাৎ এত একা হয়ে পড়েছিল। তার আশেপাশে কেউ নেই।
শিষ্যরা অবশ্য খুব আশ্বাস দিল—’আমরা আপনার পরিবারের সম্বৎসরের খরচ চালাব, আপনি ভাববেন না।’ কিন্তু এতদিনের মৌলবি টের পেয়ে গেছেন যে চাটরার পৈতৃক ভিটে থেকে এখানে আসার সময় যে উৎসাহ ছিল এদের, ক্রমে তা উবে গেছে। ভক্তিতেও ভাঁটা পড়ছে ক্রমশ।
তবু জুহার রক্তে কিছু ছিল। আগেই যাকে বর্ণনা করা হয়েছে মোগল কিংবা হূণ সর্দারদের তেজস্বী আবেগ বলে।
স্ত্রী গোবেচারা মানুষ। পৃথিবীর কোনো খবরই তাঁর জানা নেই। কিন্তু তিনিও টের পেয়েছিলেন, কী ঘটতে চলেছে। স্বামীকে অনেক বোঝালেন বেচারা। কিন্তু জুহা তখন সেই আবেগে ভাসছেন।
সেই সময় একদিন স্বর্ণ এল। মৌলবির নজরবন্দি হওয়ার কথা চারদিকে সঙ্গে সঙ্গে রটে গিয়েছিল। রাতে বারবার রাঙামাটির নতুন পুলিশচৌকি থেকে সেপাইরা আর চরণ চৌকিদার তাঁকে ঘুম থেকে ওঠায়। চরণ সবিনয়ে বলে, ‘অপরাধ নেবেন না মৌলুবিবাবা, রাজার হুকুম।’ এবং বিশেষ করে চরণের মুখে বিস্তারিত জেনেই স্বর্ণ এল।
জুহা ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডলে ঘৃণার ছাপ। স্বর্ণ সব শুনে শুধু বলল, আচ্ছা—’আসি মৌলবিচাচা।’
মৌলবি কি কিছু আশা করেছিলেন তার কাছে? স্বর্ণ যতক্ষণ না চলে গেল, তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বিদায় দিতে আসা তাঁর অভ্যাসে ছিল—এলেন না। বারান্দায় একটা মোড়ায় বসে দেখলেন স্বর্ণ উঁচু রেললাইনের ধারে—ধারে চলেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্ত্রীলোক মাত্র! কীই বা করতে পারে সে?
একদিন রাত বারোটায় চরণ চৌকিদার ও সেপাইরা এসে দেখল, জুহা মৌলবির জ্বর হয়েছে। রীতিমতো কম্পজ্বর। ঠকঠক করে কাঁপছেন। ওরা গ্রামের মাঝখানে বটতলার মাচায় বসে গাঁজা খেল। তারপর টলতে টলতে চৌকির দিকে এগোল। তখন রাত দেড়টার কিউল প্যাসেঞ্জার শিস দিতে দিতে হাউলির সাঁকো পেরোচ্ছে।
জুহা মৌলবি বেরিয়ে পড়লেন চুপিচুপি।
অন্ধকার রাত। হেমন্ত ঋতু। শীত সবে পড়তে শুরু করেছে। শিশির আর কুয়াসায় সব নিঃঝুম স্যাঁতসেতে। শেয়াল ডাকছিল হাউলির ধারে। জুহা গ্রামের পুবে বাঁজা ডাঙায় দাঁড়িয়ে দূরে স্টেশনের দিকে তাকালেন। শিকারিদের তাঁবুতে আলো জ্বলছে। বাঘটার কথা মনে পড়ল এতক্ষণে। একটু হাসলেন মৌলবি।
প্রথমে ঢুকলেন রাঙামাটির বাউরি পাড়ায়। সরা বাউরি জোয়ান ছেলে। তাকে কদিন আগে ঝিলে নামার অপরাধে পাদরির লোকেরা খুব মার দিয়েছিল। সরার নাম ধরে চাপা গলায় ডাকতে থাকলেন মৌলবি।
এই শেষ চেষ্টা। গরিব—গুরবো লোকগুলোকে নিয়ে যদি কিছু করা যায়!
সরা একা উঠল না। তার দুই ভাই মরা আর লখাও বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এল। তারপর হতভম্ব!
ততক্ষণে চকমকি ঠুকে পিদিম জ্বেলেছে সরা। জুহা বললেন, ‘খবরদার! আলো হটাও। বসো চুপচাপ। শোনো বলছি।…’
সরা হেসে বলে, ‘নতুন কী বলবেন মৌলবিসায়েব—আমরা কাল বিলে নামব। আমাদের সব ঠিক হয়ে আছে। যদুপুর মধুপুর আরোয়া গোবিন্দপুর আঙামাটি তাবৎ গাঁয়ের ছোটলোক টোটনোক সব তৈরি।’
উত্তেজিত মৌলবি রুদ্ধশ্বাসে বললেন, সে কী! কবে—কবে এসব ঠিক হল তোমাদের?’
সরা চাপা গলায় রহস্যময় হেসে বলল ‘হয়েছে বইকি। কাল সকালে দেখবেন, কে সবার আগু—আগু যাচ্ছে।’
‘বল কী! কে সে?’
সরা জবাব দেয়—’আবার কে? ডাক্তোরদিদি।’
‘অ্যাঁ! স্বর্ণ! স্বর্ণলতা! গোরাংবাবুর মেয়ে?’
‘হু গো। তিনিই তো কদিন থেকে মিটিং কল্লেন গাঁয়েগাঁয়ে। উদিকে রতনপুরের সেই ওমর শেখ—শেখদাদাও মেয়েকে দেখতে এসে সব শুনেছিল। ওমরদাদাকে তো জানেন—সবসময় তিরিক্ষি মেজাজ। সেও খুব খেপেছে। সৈদাবাদের জমিদারের কাছে গিয়ে খুব লম্ফঝম্প করে এসেছে। এ কাজটা উচিত হয়নি। ওনাদেরই তো সম্পত্তি ছিল ঝিলটা। তাব্বির করলে দখল পেতেন। তা না করেই তো সরকারি খাস তালুকে চলে গিয়েছিল। এখন সুযোগ পেয়ে পাদরি ডেকে নিয়েছে নিলাম। যাই হোক, ওমরদাদাও এর মধ্যে আছে।’
লখা বলে, ‘অবিচারটা দেখুন। ভগবানের জলা। আমরা সেখানটায় চরে খেয়ে চিরকাল বেঁচে থাকি। আজ এসে পাদরি বলে, খাজনা দিতে হবে। সেলামি দিতে হবে মাথাপিছু এক আনা পয়সা। একটা সিকির মুখ দেখিনি—তো একটা আনা! শালা যা আছে, কপালে! নয়তো জেলেই পচে মরব। হেরুর মতন! না কী রে দাদা?’
মরা জৈষ্ঠের গাম্ভীর্যে জবাব দেয়—’তা বইকি!’
জুহা যখন মাঠে নামলেন, তখন মনে হল তিনি এক দিগ্বিজয়ী ঘোড়া। শিশিরে পাজামা ভিজে ঢোল হল। ধানের শীষ আলোর ওপর উপচে এসে পড়েছে। সেই শীষ দলে হাঁটতে থাকলেন।
ফার্স্ট সিগনালের কাছে লাইন পেরিয়ে বটতলা ঘুরে স্বর্ণর বাড়ি পৌঁছলেন।
ফের চাপা গলায় ডাকতে থাকলেন—’স্বর্ণ, ও ও স্বর্ণ, মা স্বর্ণলতা!’…