১৮. পর্বতশিখরে বিপর্যয়
শল্যের বর্ণনায় একটু ভুল ছিল। পাহাড়টি নরমুণ্ডের মতো নয়। তবে তার বৈশিষ্ট্য রয়েছে সানুদেশে। গিরিচূড়ায় অবিস্থত প্রশস্ত প্রাঙ্গণের ন্যায় বিস্তৃত পাষাণ-চত্বরের উপর থেকে উঠে গেছে প্রস্তর ও মৃত্তিকায় জড়িত নরমুণ্ডসদৃশ একটি স্তূপ। ভাস্করের ছেনি ও বাটালির আঘাতে গঠিত হয়নি ওই নরমুণ্ড- প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়ালে যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির ধারা, সূর্যতাপ, বজ্রপাত ও নানাবিধ দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত ওই ভূপটি ধীরে ধীরে মাংসহীন ব্যাদিতবদন নরমুণ্ডের আকার ধারণ করেছে। দূর থেকে মনে হয় বিকট হাস্য মুখব্যাদন করে আছে সুবিশাল এক কঙ্কালমুণ্ড!
ওই মুখবিবরই হচ্ছে গুহার প্রবেশপথ। ওইখানেই রয়েছে শল্যের লুণ্ঠিত সম্পদ; যে সম্পদের লোভে মরণ তুচ্ছ করে ছুটে এসেছে চারটি দুঃসাহসী মানুষ, এবং পরবর্তীকালে রহস্যময়ী নিয়তির চক্রান্তে ওই চার সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি সংখ্যা পাঁচ!
সন্ধ্যার প্রাক্কালে পূর্বোক্ত পাঁচটি জীবন্ত সংখ্যা এসে দাঁড়াল ব্যাদিতহাস্য কঙ্কালমুণ্ডের সম্মুখে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, সন্ধ্যা আগত। এখনই সব অন্ধকার হয়ে যাবে।
শায়ন বলল, তবে চলো, ভিতরে প্রবেশ করি। অন্ধকার হওয়ার আগেই একবার ভিতরে ঢুকে দেখতে পারি ওখানে কি আছে।
তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার রেশ গোপন রইল না।
কর্ণদেব বলল, হ্যাঁ, আমিও একবার ভিতরে প্রবেশ করতে চাই। একটু পরেই অন্ধকার এসে আমাদের দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবে।
বল্লভ বলল, এত অধৈর্য হওয়ার কি প্রয়োজন? অগ্নির সাহায্যে অন্ধকারের বুকে অনায়াসেই আলোকপাত করা যায়।
কর্ণদেব বলল, তোমার যেন বিশেষ আগ্রহ নেই মনে হচ্ছে?
বল্লভ বলল, আগ্রহ না থাকলে এতদুর প্রাণবিপন্ন করে ছুটে আসব কেন? তবে আমার বয়সে অল্পবয়স্ক কিশোরের ন্যায় চাঞ্চল্য প্রকাশ করা অশোভন।
শায়ন বলল, আমি অল্পবয়স্ক কিশোর নই– কিন্তু গুহায় প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছি একথা বলতে লজ্জাবোধ করছি না।
পরন্তপ বলল, দিনের আলো নিবে গেছে। এখানে মুক্ত আকাশের নীচে আমরা এখনও আলোর দেখা পাচ্ছি বটে, কিন্তু গুহার মধ্যে যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আগুন না জ্বাললে ওখানে অন্ধকারের মধ্যে কিছুই খুঁজে পাব না।
শায়ন চট করে এগিয়ে গিয়ে গুহার ভিতর দৃষ্টিপাত করেই পিছিয়ে এসে বলল, পরন্তপ। তুমি ঠিকই বলেছ; আগুন না জ্বাললে ওখানে কিছুই আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে না…! বল্লভ! আগুনের ব্যবস্থা করো।
কঠিন শুষ্ক মৃত্তিকা ও প্রস্তরের বুক থেকে কোনোক্রমে রস আহরণ করে এখানে-ওখানে কয়েকটি গুল্ম ও তৃণগুচ্ছ আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদেরই মধ্যে কিছু উদ্ভিদকে সমূলে উৎপাটিত করে শুষ্ক বৃক্ষশাখা দিয়ে মশাল প্রস্তুত হল– তারপর সেই জ্বলন্ত মশাল দিয়ে সকলে প্রবেশ করল গুহার মধ্যে।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গুহার চারদিক বারংবার নিরীক্ষণ করে পরন্তপ বলল, শল্য দেখছি মৃত্যুকালে আমার সঙ্গে পরিহাস করেছে।
কর্ণদেব বলল, তাই বটে। তোমার মুখে শুনেছি গুহার একস্থানে তার নামের আদ্য-অক্ষর খোদিত আছে। কিন্তু এখানে দেখছি চারদিকেই শ অক্ষরের ছড়াছড়ি।
শায়ন বলল, চিহ্নিত স্থানগুলিতে আঘাত করে দেখ। তাতে বিলম্ব হলেও গুপ্তকক্ষ ও গুপ্তধনের সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
তিক্তস্বরে পরন্তপ বলল, হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু মরণকালে পরিষ্কার নির্দেশ না দিয়ে সে আমাদের সমস্যায় ফেলল কেন? চারদিকে রাশি রাশি খোদিত শ অক্ষরের মধ্যে কোথায় কতক্ষণে আমরা গুপ্তধনের সন্ধান পাব?…হাতে অফুরন্ত সময় আছে একথা ভাবলে তোমরা ভুল করবে। অনার্য প্রহরীদের সাক্ষাৎ আমরা পাইনি বটে, কিন্তু যে কোনো সময়ে তারা আমাদের ঘিরে ফেলতে পারে।
এই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা শুনে সকলেই চঞ্চল হয়ে উঠল।
শশক বলল, পরন্তপ! অনার্য প্রহরীরা সাধারণত রাত্রে বনপথে চলাচল করে না, একথা তোমার জানা উচিত। আর গুহার মধ্যে রাশি রাশি শ অক্ষর নিয়ে মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত না করলেও চলবে। আমার বিশ্বাস, গুহার পশ্চিম দেয়ালে সন্ধান করলে ধনভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যাবে।
পরন্তপ বলল, পশ্চিম দেয়ালে অবশ্য শ অক্ষরের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু সবদিক ছেড়ে হঠাৎ পশ্চিম দেয়ালে খুঁজলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে এমন কথা তোমার মনে হল কেন?
শশক কোনো কথা না বলে বল্লভের হাত থেকে মশাল নিয়ে গুহার পশ্চিম দেয়ালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পদচালনা করল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে একস্থানে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে উঠল, বোধহয় এইখানেই অভীষ্ট বস্তু অবস্থান করছে। বল্লভ! তুমি হাত চার্লিয়ে দেখতে পারো।
বল্লভ এগিয়ে এসে নির্দিষ্ট স্থানে কয়েকবার হস্তচালনা করে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, পাথরের জোড়ে আমার আঙুল পড়েছে। এইখানেই আছে গুপ্তধন।
সকলে তাকিয়ে দেখল গুহাগাত্রে দুই হাত দিয়ে বল্লভ কিছু যেন আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে, .. একটু পরেই গুহার দেয়ালে ফাঁক দেখা দিল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রবল শব্দে গুহার ভিতর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে একটা মস্ত পাথর সরে গিয়ে দেয়ালের গায়ে একটা গহুর আত্মপ্রকাশ করল!
তৎক্ষণাৎ মহা উল্লাসে চিৎকার করে ছুটে গেল শায়ন, কর্ণদেব ও বল্লভ তাদের লুব্ধ দৃষ্টির সম্মুখে দেখা দিয়েছে তিনটি বিশাল সিন্দুক!
কর্ণদেব এক লাফে ছুটে গিয়ে একটি সিন্দুকের ডালা টেনে খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ঝকমক করে উঠল রাশি রাশি মণি-মুক্তা, অজস্র স্বর্ণমুদ্রা ও অলঙ্কার।
অন্য সিন্দুক দুটির ডালা খুলে দেখা গেল সেই দুটির মধ্যেও রয়েছে প্রভূত ধনসম্পদ!…
অকস্মাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে হো হো শব্দে হেসে উঠল কর্ণদেব। পরক্ষণেই সেই হাসি যেন রোগজীবাণুর মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রচণ্ড অট্টরোলে গুহার ভিতর প্রতিধ্বনি তুলে হেসে উঠল শায়ন, তারপরই সেই হাসির শব্দকে ডুবিয়ে জাগল বল্লভের প্রচণ্ড অট্টহাস্য।
হোহোহো! হা-হা-হা!অট্টহাস্যের তরঙ্গ ফেটে পড়তে লাগল গুহা-গহ্বরের মধ্যে। ধীরস্থির গম্ভীর বল্লভও সঙ্গীদের সঙ্গে অট্টহাসির পাল্লা দিতে লাগল মহা-উৎসাহে!…
পরন্তপ গম্ভীর মুখে তাকাল শশকের দিকে। শশকের মুখেও হাসি নেই। একবার পরন্তপের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় করেই সে মুখ ঘুরিয়ে গুহার বাইরে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করল।
অট্টহাসির বেগ যখন কমে এসেছে, স্নায়ুর প্রবল উত্তেজনা শান্ত হওয়ায় সকলেই যখন অল্প-বিস্তর প্রকৃতিস্থ, সেই সময় হঠাৎ ধ্বনিত হল পরন্তপের গভীর কণ্ঠস্বর, শশক! গুহার পশ্চিম দেয়ালে কোন জায়গায় গুপ্তধন আছে সেকথা তুমি জানলে কি করে?
খুব সহজেই, শশক বলল, তোমার হয়তো মনে নেই মৃত্যুর আগে গুপ্তধনের সন্ধান বলতে বলতেই হঠাৎ শল্যের বাক্রোধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকবার প-প-পশ বলেই সে জলের জন্য আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন ব্যাপারটাকে গুরত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম তোমাকে নাম ধরে সম্বোধন করার চেষ্টা করছিল সে। পরে বুঝলাম তা নয়।
-তা নয়! তবে? তবে কি বলতে চেয়েছিল শল্য?
-পশ্চিম দিকে গুপ্তধন লুকানো আছে এইকথাই সে বলতে চেয়েছিল। এখন বুঝলাম, পরন্তপ নয় পশ্চিম কথাটাই উচ্চারণ করতে গিয়ে মৃত্যুর স্পর্শে তার বাকরোধ হওয়ার উপক্রম করেছিল। তাই কথার খেই হারিয়ে সে জলের জন্য আর্তনাদ করে উঠেছিল।
কিন্তু গুহার পশ্চিম দিকের দেওয়ালেও অন্তত চার পাঁচটি শ অক্ষর আছে। পাথরের জোড় এমন কৌশলে দেয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল যে, ফাটলের চিহ্ন চোখে পড়ে নি। তুমি কোনো চেষ্টা না করে দেয়ালে হাত না দিয়ে একবারেই গুপ্তস্থান আবিষ্কার করেছ। এটা কি করে সম্ভব হল?
–পরন্তপ! মস্তিষ্ককে চালনা করতে জানি বলেই এটা সম্ভব হল। শল্য চারদিকের দেয়াল শ অক্ষরের চিহ্নত করেছিল, তার কারণ আছে। দৈবক্রমে কোনো পথিক যদি এখানে এসে এক জায়গায় একটি মাত্র অক্ষর খোদিত দেখতে পায় এবং কৌতূহল বশে সেইস্থানে নাড়াচাড়া করতে থাকে– তাহলেই সর্বনাশ! গুপ্তধন আবিষ্কৃত হবে তৎক্ষণাৎ! সেইজন্যই চারদিকে শ অক্ষরের ছড়াছড়ি। পশ্চিম দেয়ালে অক্ষরের সংখ্যা কম। তার মধ্যেও যে অক্ষরটি সবচেয়ে অস্পষ্ট, সেইটির দিকে সহজে দর্শকের চোখ পড়বে না। ওই কথা বুঝেই উক্ত অক্ষরকে সবচেয়ে অস্পষ্ট করে খোদাই করেছিল শল্য। আশা করি এখন বুঝতে পারছ কেমন করে আমি গুপ্তধন অতি সহজেই আবিষ্কার করেছি।
সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শশকের বক্তৃতা শুনছিল। এবার বল্লভ মুগ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, তুমি অসাধারণ মানুষ। শশক! তোমার দেহ এবং মস্তিষ্ক সমান শক্তিশালী।
কর্ণদেব বলল, বল্লভের কথা সত্য। পেশীর শক্তি ও মস্তিষ্কের শক্তির এমন আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায় না। শশক! মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচরবিভাগে কাজ করলে তুমি মন্ত্রী মহাসত্ত্বের প্রিয়পাত্র হয়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করতে পারবে।
শশক চমকে উঠল, তারপর মৃদুহেসে বলল, কর্ণদেব! তোমার উপদেশ আমি মনে রাখার চেষ্টা করব।
শায়ন বলল, এই বিপুল সম্পদ বহন করে শ্রাবস্তীর রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব নয়। অবশ্য কিছু রত্ন ও কয়েক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আমরা পরিধেয় বস্ত্রে বন্ধন করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই বিপুল সম্পদের তুলনায় সে আর কতটুকু? আমরা কি তবে একই সঙ্গে নগরীতে গিয়ে অশ্ব সংগ্রহ করে আবার দলবদ্ধ হয়ে ফিরে আসব অবশিষ্ট সম্পদের জন্য? এ ছাড়া আর কি ব্যবস্থা হতে পারে? আমরা প্রত্যেকেই এখন স্থানটি জেনে ফেলেছি। আমাদের পক্ষে যে-কোনো ব্যক্তি গোপনে এসে সমুদয় ধনরত্ন নিয়ে পলায়ন করতে পারে। এতএব, সম্পদ যথাযথ ভাবে বণ্টন না হওয়ার আগে আমাদের পরস্পরের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অনুচিত। অবশ্য আমি কারও সততায় সন্দেহ প্রকাশ করছি না, কিন্তু তবু সতর্ক থাকা উচিত। কি বলো পরন্তপ?
পরন্তপ বলল, এই সম্পদের অর্ধাংশ শশকের প্রাপ্য। শস্যের অনুরোধে তার প্রাপ্য অংশ শশককে দিতে আমি প্রতিশ্রুত। সমস্ত ধনসম্পদের হিসাব নিয়ে চুল চেরা ভাগ করার সময় নেই। তাই মোটামুটিভাবে বণ্টনের যে ব্যবস্থা ভেবেছি, তা তোমাদের বলছি। তিনটি সিন্দুকের ভিতর একটি সিন্দুক শশক পাবে। অপর দুটি সিন্ধুকের ধনরত্ন আমাদের চারজনের মধ্যে ভাগ হবে। আমার এবং কর্ণদেবের অংশ তোমদের সম্মতিক্রমে এখনই গ্রহণ করছি।
শায়ন বলল, এখনই!… এত তাড়া কিসের?
উত্তর না দিয়ে কয়েকটি মণি-মাণিক্য ও হীরক তুলে নিল পরন্তপ, তারপর বলল, তোমরা দেখে নাও। কর্ণদেব আর আমি আমাদের অংশ গ্রহণ করছি। আশা করি তোমাদের আপত্তি নেই?
শায়ন সবিস্ময়ে বলল, কয়েকটি রত্ন নিয়েই তোমরা সন্তুষ্ট? তোমাদের নায্য অংশের সিকি পরিমাণও তোমরা গ্রহণ করা নি!
কর্ণদেবও বিস্মিতচক্ষে পরন্তপের দিকে চাইল। সেদিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, কর্ণদেব! কয়েকটি মাত্র রত্ন নিয়ে তুমি তোমার প্রাপ্য অংশের দাবি ছেড়ে দেবে?
কর্ণদেব বলল, পরন্তপের সিদ্ধান্তের উপর আমি কথা বলব না।
পরন্তপ বলল, আমরা অল্পেই সন্তুষ্ট। যা নিয়েছি এর বেশি আর কিছু চাই না।
শায়ন বলল, তিনটি সিন্ধুকের মধ্যে একটি শশককে দিতে তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অপর দুটি সিন্ধুকের যাবতীয় বস্তু বল্লভ আর আমার মধ্যে ভাগ হবে?
পরন্তপ বলল, হ্যাঁ। আমাদের অংশ আমরা বুঝে নিয়েছি। অবশিষ্ট অংশ তোমার ভাগ করে নাও।
বল্লভ ও শায়ন পরস্পরের মুখের দিকে চাইল। অর্থের প্রতি দস্যু পরন্তপের এমন তাচ্ছিল্য ও বীতরাগ দেখে তারা আশ্চর্য হয়ে গেল।
শায়নকে উদ্দেশ করে বল্লভ বলল, ওরা যদি স্বেচ্ছায় ওইটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট হয়, তাহলে আমাদের কি বলার আছে? আমরা তো ওদের বঞ্চিত করছি না। কি বলো, শায়ন?
শায়ন বলল, যথার্থ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশাল এই গুরুভার সিন্দুক দুটিকে আমরা কখন এবং কি উপায়ে স্থানান্তরিত করব?
বল্লভ বলল, সেবিষয়ে চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে। আপাতত আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে চাই। প্রায় সপ্তাহকাল ধরে যে পরিশ্রম করেছি, তার তুলনা নেই। এখন কার্যসিদ্ধি হয়েছে। মনও দুশ্চিন্তামুক্ত- অতএব নিশ্চিন্তে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারব। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে যে, অনার্য প্রহরীদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি! সেরকম কিছু ঘটলে হয়তো আমরা নরহত্য করতে বাধ্য হতাম। নররক্তে হস্ত রঞ্জিত না করেও অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে বলেই বিশেষ করে আনন্দলাভ করছি।
শায়ন বলল, যুদ্ধ করলেই একসময়ে নরহত্যা করতে হবে। তুমিও যোদ্ধা। অসি বা ধনুর্বাণ নিয়ে তুমি যুদ্ধ না করলেও তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই তোমার অস্ত্রস্বরূপ ব্যবহৃত হয় কারণ, তুমি মল্লযোদ্ধা। মল্লযুদ্ধও যুদ্ধ। বল্লভ! তুমি কি কখনও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেনি?
অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে বল্লভ বলল, জীবনে একবারই আমার হাতে প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু আমি তাকে হত্যা করতে চাইনি।
শায়ন সোৎসাহে বলল, আমি যুদ্ধ করতে ভালোবাসি, যুদ্ধ দেখতে ভালোবাসি, যুদ্ধের গল্প শুনতেও ভালোবাসি। যে যুদ্ধে দৈবক্রমে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু হয়েছে, সেই যুদ্ধের কাহিনি আমি শুনতে চাই।
কর্ণদেব বলল, আমিও বল্লভের কাহিনি শুনতে উৎসুক।
পরন্তপ ও শশক কোনো অভিমত প্রকাশ না করলেও তাদের চোখমুখের ভাবভঙ্গিতে স্পষ্টই বোঝা গেল গল্প শোনার আগ্রহ তাদেরও কিছু কম নয়।
তবে শোন, বল্লভ শুরু করল, বেশ কয়েক বৎসর আগে আমি যখন কর্ণদেবের মতো অল্প ব্যস্ক কিশোর, সেই সময় আমায় এক বন্ধু এসে জানাল মহারাজ প্রসেনজিতের রাজ্য মিথিলায় যোদ্ধাদের জন্য এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে– তরবারি, ভল্ল, ধনুর্বাণ প্রভৃতি অস্ত্রধারী যোদ্ধাদের মতো মল্লবীরগণও ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। আমি বরাবরই একটু অলস প্রকৃতির, তাই সহসা দেশভ্রমণে ইচ্ছুক হলাম না। অনিচ্ছার আরও একটা কারণ ছিল নিজের প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি সম্পর্কে আমি অত্যন্ত সচেতন ছিলাম, উত্তেজনার বশে প্রতিদ্বন্দ্বী মল্লকে যদি মর্মান্তিক ভাবে আহত করে ফেলি, সেই ভয়ে ওই প্রতিযোগিতায় আমি কখনো অংশগ্রহণ করতাম না। কিন্তু বন্ধুর সনির্বন্ধ অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে মিথিলায় গমন করলাম। তবে শর্ত ছিল- ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হব না। বন্ধু বলল আমাকে প্রতিযোগিতায় নামতে সে অনুরোধ করবে না, আমার সাহচর্য পেলেই সে খুশি। আমার শর্তে রাজি হওয়ায় তার সঙ্গী হতে আমি আপত্তি করলাম না এবং নির্দিষ্ট দিনে মিথিলার মল্লভূমিতে উপস্থিত হলাম…।
যথাসময়ে অন্যান্য প্রতিযোগিতার সঙ্গে মল্লযুদ্ধও শুরু হল।প্রতিদিনই বিভিন্ন রাজ্যের মল্লগণ ওই স্থানে মল্লযুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে বিভিন্ন ও বিচিত্র রণকৌশল প্রদর্শন করত। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী মল্লকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থাও ছিল। কয়েকদিন মল্লযুদ্ধ দেখার পর একদিন হঠাৎ আমার বন্ধু দর্শকের ভূমিকা ত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করল।
বন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী মিথিলার স্থানীয় অধিবাসী। তার বয়স অল্প, কিন্তু অভিজ্ঞতা অল্প ছিল না। উক্ত মল্পের দেহটি ছিল সত্যই দর্শনীয় কবাটবক্ষ, সিংহকটি, আজানুলম্বিত বিশাল বাহুর সমানুপাতে গঠিত কদলীবৃক্ষের ন্যায় স্কুল পেশীবদ্ধ দুই উরু অসাধারণ শক্তির পরিচায়ক। মল্লটি যে শুধু শক্তির অধিকারী ছিল তা নয়– তার রণকৌশলও অপূর্ব। বন্ধুর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ শুরু হতে না হতেই উক্ত যোদ্ধা বন্ধুবরকে পরাস্ত করল। চারদিক থেকে ধিক্কার-ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। আবার বন্ধু দ্বিতীয়বার মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হল। কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই অদ্ভুত কৌশলে তাকে পুনরায় পরাজিত করল মিথিলার মল্লযোদ্ধা। দর্শকরা সোল্লাসে বিদ্রূপ বর্ষণ করতে লাগল। প্রতিযোগিতায় নামলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কে কোন্ দেশের অধিবাসী সেকথা ঘোষণা করা হয়– দর্শকবৃন্দ ব্যঙ্গ করে বলতে লাগল শ্রাবস্তী রাজ্যের মল্লগণ যে অতিশয় দুর্বল এই ব্যক্তিকে দেখেই তা বোঝা যায়– মিথিলার মল্লভূমিতে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত তারা নয়।
ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে বন্ধু আবার মিথিলার মল্লবীরকে দ্বৈরথ রণে আহ্বান জানাল। সেবারেও ওই মল্লযোদ্ধা অতি সহজেই আমার বন্ধুকে পরাস্ত করল। বার বার তিনবার পরাজিত হয়ে বিরস বদনে বন্ধুবর মল্লভূমির বাইরে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী মল্ল- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার নামটিও এখন মনে পড়েছে হৈহয়! হ্যাঁ, হৈহয় নামে ওই বিজয়ী মল্ল আমার বন্ধুকে মিথিলার মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হওয়ার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাতৃদুগ্ধ পান করে আসার পরামর্শ দিল। পূর্বেই আমার মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়েছিল বন্ধুর প্রতি বিদ্রুপের উক্তি সেই ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দিল;- দর্শকের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালাম আমিও শ্রাবস্তীর নাগরিক এবং প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে চাই। মধ্যস্থ অনুমতি দিতেই মল্লভূমিতে বাহ্বাস্ফোট করে সদম্ভে অবতীর্ণ হলাম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমাকে আলিঙ্গনবদ্ধ করতেই দর্শকদের মধ্যে কয়েকজন বিদ্রূপ করে বলল, শ্রাবস্তীর মল্পের জন্য এইবার চিকিৎসককে আহ্বান জানাতে হবে। তুমুল অট্টহাস্য আর বিদ্রুপাত্মক ধ্বনিতে আমার মাথায় আগুন জ্বলতে লাগল, তার উপর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যখন আমার গ্রীবা আকর্ষণ করে সবলে পেষণ করতে শুরু করল, তখনই আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। দারুণ ক্রোধে দক্ষিণ কবপুট দিয়ে তরবারি চালানোর ভঙ্গিতে তার ঘাড়ে আঘাত করলাম। সেই আঘাতেই ঘাড় ভেঙে তার মৃত্যু হল।
কর্ণদেব সাগ্রহে প্রশ্ন করল, তারপর?
বল্লভ বলল, তারপর আর কি? ওইভাবে আঘাত করা মল্লযুদ্ধের নিয়ম-অনুসারে অন্যায় নয়। আমাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়েছিল বিধিসম্মতভাবে। মৃত্যুকে দৈব-দুর্ঘটনা বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।
পরন্তপ বলল, এটা তো দুর্ঘটনাই বটে। তুমি তো ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করনি।
শায়ন আর কর্ণদেবের সঙ্গে কখন যে পরন্তপ আর শশকও গল্পের আসরে শ্রোতার ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তা লক্ষ করেনি বল্লভ; পরন্তপের কথা শুনে সে বুঝল অনেকক্ষণ ধরেই তার কাহিনি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে পরন্তপ শশক মৌন থাকলেও তার চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে শ্রোতার কৌতূহল ও উত্তেজনা অতিশয় স্পষ্ট।
ইচ্ছা করে হত্যা করিনি বটে, বল্লভ বলল, কিন্তু নিজের দৈহিক শক্তি সম্পর্কে সচেতন থাকায় জানতাম, ওইভাবে আঘাত করলে প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। তা সত্ত্বেও মুহূর্তের উত্তেজনায় দুর্ঘটনা ঘটল। আমি মল্লযুদ্ধের সূক্ষ্ম কলাকৌশল ভালোবাসি, হত্যার পক্ষপাতী নই। পেশাদার মল্লযোদ্ধা অবশ্য অনেক সময় প্রতিযোগীকে হত্যা করতে ইতস্তত করে না।
শায়ন বলল, পেশাদার মল্ল না হলেও তুমি এক নির্দোষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেছ। হ্যাঁ, এটাকে হত্যাই বলব- তুমি নিজমুখেই স্বীকার করেছে ওইভাবে আঘাত করলে মৃত্যু ঘটতে পারে সে কথা তোমার জানা ছিল।
বল্লভ বলল, এটাকে সঠিকভাবে হত্যা বলা যায় না, তবে আমি তো নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলছি না।
-তাহলে দোষ স্বীকার করছ?
–অস্বীকার তো করিনি।
–অপরাধ করেছ। তার জন্য দণ্ডগ্রহণ করাও তো উচিত। তাই না বল্লভ?
বল্লভ সবিস্ময়ে বলল, তুমি কি বলছ শায়ন? বহুদিন আগের অনিচ্ছাকৃত এক অপরাধের জন্য আজ দণ্ডগ্রহণ করব?
বহুদিন ধরে কোনো অপরাধী যদি আইনকে ফাঁকি দেয়, তবে তার অপরাধের মাত্রা লঘু হয় না, শায়নের অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর সকলকে চমকিত করল, তার দুই চোখে জ্বলে উঠল অবরুদ্ধ রোষের হিংস্র দীপ্তি, বল্লভ! হৈহয়ের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে আমি শিশুর মতো ক্রন্দন করেছিলাম। ভেবেছিলাম, মল্লক্রীড়া করতে গিয়ে দৈবাৎ আঘাত পেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাকে যে হত্যা করা হয়েছে তা জানা ছিল না।
বল্লভ বিল স্বরে বলল, তুমি হৈহয়কে জানো? সে তোমার পরিচিত?
উত্তর এল, হৈহয় আমার ভাই। সহোদর নয়, মাতুলপুত্র।
গুহার মধ্যে নেমে এল অসনীয় স্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জাগল শায়নের ভয়াবহ কণ্ঠস্বর, আমার শৈশব অতিবাহিত হয়েছে মাতুলালয়ে। বাল্যকালে হৈহয় ছিল আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সঙ্গী। বল্লভ! তাকে তুমি হত্যা করেছ! আমি তোমাকে নিষ্কৃতি দেব না।
বল্লভ বলল, তুমি অনর্থক উত্তেজিত হচ্ছ। শায়ন! এটা দৈব দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়।
একটি দুর্ঘটনা আর একটি দুর্ঘটনার কারণ হবে, উপবিষ্ট অবস্থা থেকে দণ্ডায়মান হয়ে ভয়ঙ্কর স্বরে শায়ন বলল, বল্লভ! মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।
শায়ন তরবারিকে কোষমুক্ত করল।
একবার শায়নের দিকে তাকিয়ে বল্লভ অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার দুই হাত আগের মতোই স্থির হয়ে রইল জানুর উপর।
অধীর স্বরে শায়ন বলল, অস্ত্র নাও, বল্লভ!
মৃদুগম্ভীর স্বরে বল্লভ বলল, শায়ন! আমি যুদ্ধ করব না। ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে হত্যা করতে পার।
ক্রুদ্ধস্বরে শায়ন বলল, নিরস্ত্র মানুষকে বধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
বল্লভ বলল, আমার পক্ষেও তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।–
-বল্লভ! কুঠার গ্রহণ করো।
–শায়ন! আমার বক্তব্য তুমি শুনেছ।
-তুমি যদি যুদ্ধ করতে না রাজি হও, তাহলে অবশ্য আমি তোমায় হত্যা করতে পারব না, শায়ন এগিয়ে এল, কিন্তু এই অসি দ্বারা তোমাকে এমনভাবে চিহ্নিত করে দেব, যা চিরকাল তোমার মনে থাকবে।
ঘটনার অভাবনীয় পরিস্থিতি তিনজন দর্শককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। হঠাৎ কৰ্ণদেব বলে উঠল, শায়ন! তুমি কি উন্মাদ হয়েছ? বহু বৎসর আগে মল্লভূমিতে তোমার মাতুলপুত্র ন্যায়সঙ্গত দ্বৈরথ-রণে নিহত হয়েছে- সেইজন্য তুমি বিশ্বস্ত এক সহচরের অঙ্গে অস্ত্রাঘাত করতে চাও? না, না, এমন কাজ আমি তোমায় করতে দেব না।
কর্ণদেব সামনে এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই একলাফে পিছিয়ে গিয়ে শায়ন হিংস্রকণ্ঠে গর্জে উঠল, কর্ণদেব! আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার হাত দিও না। সাবধান!
কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, শায়ন! তুমি কাকে সাবধান করছ? বল্লভ তোমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করতে পারে, কিন্তু আমি করব না।
জ্বলন্ত চক্ষে তার দিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, কর্ণদেব! তোমার স্পর্ধা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মনে রেখো আমার ধৈর্য অসীম নয়।
তরবারির মুষ্টিতে হাত রেখে কর্ণদেব তপ্তস্বরে বলল, আমিও ধৈর্যের শেষ সীমায় উপস্থিত হয়েছি।
অকস্মাৎ কর্ণদেবের দক্ষিণ বাহু দৃঢ়মুষ্টিতে চেপে ধরে পরন্তপ বলে উঠল, কর্ণদেব! এটা শায়নের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমার হস্তক্ষেপ এখানে অবাঞ্ছনীয়।
গম্ভীর স্বরে শশক বলল, আমারও তাই মনে হয়। হয়তো বলপূর্বক শায়নকে নিরস্ত্র করা সম্ভব, কিন্তু
সিংহের মতো গর্জন করে শায়ন বলল, তোমরা সমবেতভাবে চেষ্টা করলে আমায় বধ করতে পারবে, কিন্তু বলপূর্বক আমাকে নিরস্ত্র করতে পারবে না।
শায়নের কথায় কান না দিয়ে শশক বলল, শায়নকে নিরস্ত্র করা সম্ভব, কিন্তু অন্ধ আক্রোশের নিবৃত্তি ঘটবে না– অদূর ভবিষ্যতে আবার এই ঘটনার পুরনাবৃত্তি অনিবার্য। সুতরাং দ্বন্দ্বযুদ্ধেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
বিমর্ষভাবে মস্তক সঞ্চালিত করে বল্লভ বলল, আমি অস্ত্রগ্রহণ করব না। শায়ন ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেছে, এখন সে উন্মাদ-তুল্য। সাময়িক উত্তেজনা প্রশমিত হলে সে তার ভুল বুঝতে পারবে।
আর্যযোদ্ধা যুদ্ধে ভীত। কাপুরুষকে হত্যা করে না, কঠোর স্বরে শায়ন বলল, কিন্তু বল্লভ! তোমাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
চকিতে বিদ্যুৎশিখার মতো শায়নের তরবারি বল্লভের মুখের কাছ থেকে ফিরে এল। সকলে সচমকে দেখল বল্লভের দক্ষিণ কর্ণ মুখের উপর থেকে বিলুপ্ত ক্ষতমুখ থেকে ছুটছে তপ্ত রক্তস্রোত।
কয়েকমুহূর্ত নিশ্চল হয়ে বসে রইল বল্লভ, একবার ক্ষতস্থানে হাত দিল, তারপর চোখের সামনে রক্তাক্ত হাতটি ধরে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নির্বোধের মতো শায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করল ঘটনাটা যেন এখনো তার বোধগম্য হয়নি, নিজের চোখকেও যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না…।
ধীরে অতি ধীরে, তার মুখের উপর ফুটল যন্ত্রণার চিহ্ন, তারপরই ক্রোধের আবির্ভাবে মুছে গেল যন্ত্রণার চিহ্ন মুখের উপর থেকে, দারুণ আক্রোশে জ্বলে উঠল দুই চক্ষু, দণ্ডায়মান শায়নের মুখের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভীষণবণ্ঠে চিৎকার করে উঠল আহত মল্ল…
সেই ভয়ংকর অমানুষিক ধ্বনি অসিযোদ্ধাকে বিহ্বল করে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে উপবিষ্ট অবস্থা থেকেই বল্লভের বিশাল দেহ জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ছিটকে গেল শায়নের দিকে! অসিযোদ্ধায় অভ্যস্ত স্নায়ু যন্ত্রচার্লিতের মতো কাজ করল, তীক্ষ্ণ তরবারি দংশন করল বল্লভের মস্তকে পরক্ষণেই পেশীস্ফীত দুই বিশাল বাহুর মরণবাঁধনে বন্দি হল শায়নের মস্তক, স্কন্ধ ও গ্রীবাদেশ!
মট করে একটা শব্দ; শায়নের মাথা হেলে পড়ল, বল্লভের বাহুর বাঁধন সরে গেল, সশব্দে গুহাতলে লুটিয়ে পড়ল শায়নের দেহ!
মাথার উপর বিদ্ধ তরবারিকে টেনে আনার চেষ্টা করল বল্লভ। পারল না; শাণিত অস্ত্র ব্রহ্মতালু ভেদ করে বসে গেছে। বল্লভের দুই হাত শিথিল হয়ে ঝুলে পড়ল। ধীরে ধীরে সে বসে পড়ল, তারপর মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল। গুহাতলে মাটি ও পাথরের উপর ছুটল রক্তের স্রোত।
স্তম্ভিত দর্শকদের মধ্যে প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল শশক। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে মৃতদেহ দুটিকে পরীক্ষা করে সে মন্তব্য করল, সব শেষ। বল্লভের মস্তক অসির আঘাতে বিদীর্ণ, শায়নের ঘাড় ভেঙে গেছে মল্লযোদ্ধার আলিঙ্গনে। ইহজীবনে ওরা আর কলহ করবে না।
বিস্ফারিত নেত্রে মৃতদেহ দুটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল কর্ণদেব। অভাবিত এই ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি তার রসনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
দুই হাত কোমরে রেখে কঠোর হাস্য করে পরন্তপ বলল, চারটি জীবন্ত সংখ্যার মধ্যে দুটি সংখ্যা অবলুপ্ত হল মৃত্যুর করাল গ্রাসে। অপর দুটি সংখ্যার মধ্যে একটির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন এবং অপরটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
পরন্তপের দিকে তাকিয়ে কর্ণদেব স্খলিতস্বরে বলল, পরন্তপ! আমাদের দুটি বন্ধু শোচনীয়ভবে মৃত্যুবরণ করেছে। এখন কি তোমার পরিহাসের সময়?
পরন্তপ গম্ভীর স্বরে বলল, আমি আদৌ পরিহাস করছি না।
প্রথম দুটি সংখ্যা সম্পর্কে তোমার বক্তব্য বুঝলাম, কর্ণদেব বলল, কিন্তু কে বিপন্ন আর কার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত সে কথা বুঝতে পারছি না।
আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি, পরন্তপর বলল, যদি কোথাও বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে আমাদের সুযোগ্য বন্ধু শশকের সাহায্য চাইলেই সে তোমায় সহজভাবে সব কিছু বুঝিয়ে দেবে।
পরন্তপ! শশকের কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তোমার কথা আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু এসব হেঁয়ালি ছেড়ে মৃত বন্ধু দুটির সৎকার কার্যে মনোনিবেশ করা উচিত অবিলম্বে।
পরন্তপ হেসে বলল, তা তো করতেই হবে। তবে তার আগে আমার কয়েকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে ক্ষতি কি?
জিজ্ঞাসু চক্ষে পরন্তপের দিকে তাকাল কর্ণদেব। গুহার দ্বারপথে আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল শশক।