২৮৫*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
লণ্ডন
৭ জুলাই, ১৮৯৬
স্নেহের খুকীরা,
এখানকার কাজ আশ্চর্যভাবে এগিয়ে চলেছে। এখানে ভারত থেকে একজন সন্ন্যাসী এসেছিলেন। তাঁকে আমেরিকায় পাঠিয়েছি এবং ভারত থেকে আর একজনকে পাঠাতে বলেছি। এখানকার মরসুম শেষ হয়েছে; সুতরাং ক্লাস ও রবিবারের বক্তৃতাগুলি আগামী ১৬ থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। আর সুইজরলণ্ডের পাহাড়ে শান্তি ও বিশ্রামের জন্য ১৯ তারিখে আমি যাচ্ছি—মাসখানেকের জন্য। আবার শরৎকালে লণ্ডনে ফিরে কাজ আরম্ভ করা যাবে। এখানে কাজ খুবই আশাজনক হয়েছে। এখানে আগ্রহ জাগিয়ে—আমি প্রকৃতপক্ষে ভারতে থেকে যা করতে পারতাম, তার চেয়ে বেশী ভারতের জন্যই করছি। মা (মিসেস হেল) আমাকে লিখেছেন যে, তোমরা যদি ফ্ল্যাট-বাড়ীটা ভাড়া দিতে পার, তাহলে তিনি সানন্দে তোমাদের মিশর দর্শনে নিয়ে যেতে পারেন। আমি তিনজন ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে সুইজরলণ্ডের পাহাড়ে যাচ্ছি। পরে শীতের শেষে কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে নিয়ে ভারতে যাবার আশা করি। তাঁরাও আমার মঠে থাকতে যাচ্ছেন, মঠ হবার পরিকল্পনা চলছে মাত্র। হিমালয়ের কোথাও সেটা বাস্তবে রূপ নেবার চেষ্টা করছে।
তোমরা কোথায় আছ? এখন তো পুরাদস্তুর গরমিকাল—এমন কি লণ্ডনও খুবই তেতে উঠেছে। দয়া করে মিসেস এডামস্, মিসেস কংগার এবং চিকাগোতে অন্য বন্ধুদের আমার গভীর ভালবাসা জানিও।
তোমাদের স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৮৬*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৮ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয়—,
ইংরেজ জাতটা খুব উদার। সেদিন মিনিট তিনেকের মধ্যেই আমার ক্লাস থেকে আগামী শরৎকালের কাজের নূতন বাড়ীর জন্য ১৫০ পাউণ্ড (প্রায় ২২৫০ টাকা) চাঁদা উঠেছে। এমন কি, চাইলে তারা সেই মুহূর্তেই ৫০০ পাউণ্ড দিত। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে কাজ করতে চাই—হঠাৎ কতকগুলো খরচপত্র করতে চাই না। এখানে এই কাজটা চালাতে অনেক লোক পাওয়া যাবে, যারা ত্যাগের ভাব কতকটা বোঝে—ইংরেজ-চরিত্রের গভীরতা এখানেই (যে ভাবটা তাদের মাথার ভেতর ঢোকে, সেটা কিছুতেই ছাড়তে চায় না)। ইতি
বিবেকানন্দ
২৮৭*
ইংলণ্ড
১৪ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয় নাঞ্জুণ্ড রাও,
‘প্রবুদ্ধ ভারত’গুলি পৌঁছেছে এবং ক্লাসে বিলি করাও হয়েছে। পত্রিকা খুব সন্তোষজনক হয়েছে; ভারতে এর যথেষ্ট প্রচলন হবে নিশ্চয়। আমেরিকাতেও এর কিছু গ্রাহক হতে পারে। ইতোমধ্যেই আমি আমেরিকায় এই কাগজটার বিজ্ঞাপন দেবার ব্যবস্থা করেছি এবং গুডইয়ার ইতোমধ্যেই তা করে ফেলেছে। কিন্তু এখানে (ইংলণ্ডে) কাজ অপেক্ষাকৃত ধীরে অগ্রসর হবে। এখানে মুশকিল এই যে, এরা সকলেই নিজেদের কাগজ বের করতে চায়। আর এমনই হওয়া উচিত; কারণ সত্যি বলতে গেলে কোন বিদেশীই খাঁটি ইংরেজের মত তেমন ভাল ইংরেজী লিখতে পারে না, এবং খাঁটি ইংরেজীতে লিখলে ভাবের যা বিস্তার হবে, হিন্দু-ইংরেজীতে তা হতে পারে না। তারপর বিদেশী ভাষায় প্রবন্ধ লেখার চেয়ে গল্প লেখা আরও শক্ত।
আমি এখানে গ্রাহক-সংগ্রহের চেষ্টায় আছি; কিন্তু বিদেশী সাহায্যের উপর একদমই একেবারেই নির্ভর করবেন না। ব্যক্তির মত জাতিকেও নিজেকে নিজে সাহায্য করতে হবে। এই হচ্ছে ঠিক ঠিক স্বদেশপ্রেম। যদি কোন জাতি তা করতে না পারে, তবে বলতে হবে—তার এখনও সময় হয়নি, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। মান্দ্রাজ থেকেই এই নূতন আলোক ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া চাই—এই উদ্দেশ্য নিয়েই আপনাকে কাজ করতে হবে। একটি বিষয়ে কিন্তু আমার একটু মন্তব্য করতে হল—মলাটটা একেবারে রুচিহীন—অতি বিশ্রী ও কদর্য। সম্ভব হলে এটাকে বদলে ফেলুন। এটাকে ভাবব্যঞ্জক অথচ সরল করুন—আর এতে মানুষের মূর্তি মোটেই রাখবেন না। বটবৃক্ষ মোটেই প্রবুদ্ধ হওয়ার চিহ্ন নয়, পাহাড়ও তা নয়, ঋষিরাও নন, ইওরোপীয় দম্পতিও নন। পদ্মফুলই হচ্ছে পুনরভ্যুত্থানের প্রতীক। চারুশিল্পে আমরা বড়ই পেছিয়ে আছি—বিশেষতঃ চিত্রশিল্পে। বনে বসন্ত জেগেছে, বৃক্ষলতায় নবকিশলয় আর মুকুল দেখা দিয়েছে—এই ভাবের একটি বনের ছবি আঁকুন দেখি। কত ভাবই তো রয়েছে—ধীরে ধীরে তা চিত্রশিল্পে ফুটিয়ে তুলুন। লণ্ডনের গ্রীনম্যান কোম্পানী যে ‘রাজযোগ’ ছেপেছে, তাতে আমার তৈরী প্রতীকটি দেখুন—আপনি বোম্বেতে তা পাবেন। আমি নিউ ইয়র্কে রাজযোগ সম্বন্ধে যে-সব বক্তৃতা দিয়েছিলাম, সেগুলি এই পুস্তকে আছে।
আমি আগামী রবিবার সুইজরলণ্ডে যাচ্ছি, এবং শরৎকালে ইংলণ্ডে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করব। সম্ভব হলে আমি সুইজরলণ্ড থেকে আপনাকে ধারাবাহিকভাবে কতকগুলি প্রবন্ধ পাঠাব। আপনি জানেন, আমার পক্ষে বিশ্রাম খুব দরকার হয়ে পড়েছে।
একান্ত আশীর্বাদক ও শুভানুধ্যায়ী
বিবেকানন্দ
২৮৮*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
স্যান্স গ্রাণ্ড, সুইজরলণ্ড
২৫ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয়—,
আমি জগৎটাকে একেবারে ভুলে যেতে চাই, অন্ততঃ আসছে দু-মাসের জন্য; একটু কঠোর সাধনা করতে চাই। ওই আমার বিশ্রাম। … পাহাড় এবং বরফ দেখলে আমার মনে এক অপূর্ব শান্তির ভাব আসে। এখন আমার যেমন সুনিদ্রা হচ্ছে, এমন অনেক দিন হয়নি।
বন্ধুদের আমার ভালবাসা জানাবেন।
আপনাদের
বিবেকানন্দ
২৮৯*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
গ্র্যাণ্ড হোটেল, ভ্যালে
সুইজরলণ্ড
আমি অল্পস্বল্প পড়াশুনা করছি—উপোস করছি অনেক এবং সাধনা করছি তার চেয়েও বেশী। বনে বনে বেরিয়ে বেড়ানটা অতি আরামপ্রদ। আমাদের বাসস্থানটি তিনটি বিরাট তুষার-প্রবাহের নীচে এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম।
ভাল কথা, সুইজরলণ্ডের হ্রদে আর্যদের আদি বাসভূমি সম্বন্ধে আমার মনে যা-ও একটু সন্দেহের ভাব ছিল, তা একেবারে চলে গেছে; তাতারদের মাথা থেকে লম্বা টিকিটা সরিয়ে দিলে যা দাঁড়ায়, সুইজরলণ্ডের অধিবাসীরা হচ্ছে তাই।
স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২৯০*
[লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
রিডিং, লণ্ডন৯৯
৫অগষ্ট, ১৮৯৬
আপনার সহৃদয় অভিনন্দনের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার কাছে একটি বিষয় জানবার আছে। দয়া করে সংবাদটি জানালে বিশেষ বাধিত হব। আমি একটা মঠ স্থাপন করতে চাই—আলমোড়ায় বা আলমোড়ার কাছে হলেই ভাল। আমি শুনেছি, মিঃ র্যামজে নামে জনৈক ভদ্রলোক আলমোড়ার কাছে একটি বাংলোতে বাস করতেন, ঐ বাংলোর চারিদিকে একটি বাগান আছে। ঐ বাংলোটি কেনা সম্ভব হবে কি? দাম কত? যদি কেনা সম্ভব না হয়, তবে ভাড়া পাওয়া যাবে কি?
আলমোড়ার কাছে কোন সুবিধামত জায়গা আপনার জানা আছে কি, যেখানে বাগবাগিচা সহ আমাদের মঠ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? সঙ্গে বাগান প্রভৃতি অবশ্যই থাকা চাই। একটা গোটা ছোট পাহাড় হলেই ঠিক আমার মনোমত হয়।
আশা করি, শীঘ্র আপনার উত্তর পাব। আপনি এবং আলমোড়ার অন্যান্য সব বন্ধুরা আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানবেন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
২৯১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
৫ অগষ্ট, ১৮৯৬
আজ সকালে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের একখানি পত্র এসেছে; তাতে খবর পেলাম যে, শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’ পত্রিকার অগষ্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।তুমি কি তা পড়েছ? তিনি ঐ বিষয়ে আমার মত চেয়েছেন। এখনও তা দেখিনি বলে তাঁকে কিছু লিখতে পারছি না। তুমি যদি তা পেয়ে থাক তো দয়া করে আমায় পাঠিয়ে দিও। ‘ব্রহ্মবাদিনে’র কোন সংখ্যা এসে থাকলে তাও পাঠিও। ম্যাক্সমূলার আমাদের কার্যধারা জানতে চান, … এবং মাসিক পত্রিকা সম্বন্ধেও খবর চান। তিনি যথেষ্ট সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ লিখতে প্রস্তুত আছেন।
আমার মনে হয়, পত্রিকাদি সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে তোমার সরাসরি পত্রালাপ করাই উচিত। ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’ পড়ার পরে তাঁর পত্রের উত্তর দিতে যখন আমি তোমাকে তাঁর চিঠিখানি পাঠিয়ে দেব, তখন তুমি দেখতে পাবে যে, আমাদের প্রচেষ্টায় তিনি কত খুশী হয়েছেন এবং যথাসাধ্য সাহায্য করতে রাজী আছেন।
পুনশ্চ—আশা করি, বড় পত্রিকাখানি সম্বন্ধে ভাল করে ভেবে দেখবে। আমেরিকায় কিছু টাকা তুলতে পারা যাবে এবং কাগজখানি নিজেদের হাতেই রাখা যাবে। তুমি ও ম্যাক্সমূলার কি প্রকার কার্যধারা ঠিক কর, তা জেনে আমি আমেরিকায় পত্র লিখব ভেবেছি।
যে গাছের ফল ও ছায়া আছে, তারই আশ্রয় নিতে হয়; ফল যদি নাই বা পাওয়া যায়, ছায়া থেকে তো কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না?১০০ সুতরাং শিক্ষণীয় এই যে, বড় বড় কাজ এভাবেই করা উচিত।
২৯২*
সুইজরলণ্ড
৬ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব্রহ্মবাদিন্’ কতটা আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছে, তা তোমার পত্রে জানলাম। লণ্ডনে যখন ফিরে যাব, তখন তোমায় সাহায্য করতে চেষ্টা করব। তুমি সুর নামিও না যেন—কাগজখানি চালিয়ে যাও; অতি শীঘ্রই তোমায় এমন সাহায্য করতে পারব যে, বাজে শিক্ষকতার কাজ থেকে তুমি অব্যাহতি পাবে। ভয় পেও না; বড় বড় সব কাজ হবে, বৎস! সাহস অবলম্বন কর। ‘ব্রহ্মবাদিন্’ একটি রত্নবিশেষ, একে নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। অবশ্য এ-জাতীয় পত্রিকাকে সর্বদাই ব্যক্তিগত বদান্যতার দ্বারা বাঁচিয়ে রাখতে হয়, আর আমরা তাই করব। আরও মাস-কয়েক আঁকড়ে পড়ে থাক।
ম্যাক্সমূলারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরীতে’ বেরিয়েছে। সেটি পেলেই আমি তোমায় পাঠিয়ে দেব। তিনি আমাকে চমৎকার সব চিঠি লেখেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের একখানি বড় জীবনী লেখবার উপাদান চান।
কলিকাতায় লিখে দাও, যেন তারা যতটা সম্ভব উপাদান যোগাড় করে তাঁকে পাঠায়।
আমেরিকার কাগজে প্রেরিত সংবাদটি আমি আগেই পেয়েছি। ওটি ভারতবর্ষে প্রকাশ করবে না। সংবাদপত্রে এই সব হইচই ঢের হয়ে গেছে; আমার অন্ততঃ এ সবে বিরক্তি এসে গেছে। মূর্খেরা যাই বলুক না কেন, আমরা আমাদের কাজ করে যাব। সত্যকে কেউ চেপে রাখতে পারবে না।
Organization is power and the secret of that is obedience দেখতেই পাচ্ছ, আমি এখন সুইজরলণ্ডে রয়েছি, আর ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি। পড়া বা কোন লেখার কাজ আমি করতে পারছি না—করাও উচিত নয়। লণ্ডনে আমার এক মস্ত কাজ পড়ে আছে, আগামী মাস থেকে তা শুরু করতে হবে। আগামী শীতে আমি ভারতে ফিরব এবং সেখানকার কাজটাকে দাঁড় করাব।
সকলে আমার ভালবাসা জানবে। সাহসে বুক বেঁধে কাজ করে যাও, পিছু হটো না—‘না’ বলো না। কাজ কর—প্রভু পেছনে আছেন। মহাশক্তি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—ভয় পেও না; টাকা ও আর সব শীঘ্রই আসবে।
২৯৩*
[পাশ্চাত্য শিষ্য স্বামী কৃপানন্দকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
অগষ্ট, ১৮৯৬
পবিত্র হও ও সর্বোপরি অকপট হও; মুহূর্তের জন্যও ভগবানে বিশ্বাস হারিও না—তাহলেই আলো দেখতে পাবে। যা কিছু সত্য, তাই চিরস্থায়ী; কিন্তু যা সত্য নয়, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বর্তমান ক্ষিপ্র অনুসন্ধিৎসার যুগে জন্মগ্রহণ করে আমরা অনেকটা সুবিধা পেয়েছি। অন্যে যাই ভাবুক আর করুক, তুমি কখনও তোমার পবিত্রতা, নীতি ও ভগবৎপ্রেমের উচ্চ আদর্শ খর্ব করো না। সর্বোপরি সব রকম গুপ্ত সমিতির বিষয়ে সতর্ক থেক। ভগবৎ-প্রেমিকের পক্ষে চালাকিতে ভীত হবার কিছুই নেই। স্বর্গে ও মর্ত্যে পবিত্রতাই সবচেয়ে মহৎ ও দিব্য শক্তি। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’—সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার নয়; সত্যের মধ্য দিয়েই দেবযান মার্গ চলেছে। কে তোমার সহগামী হল বা না হল, তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামিও না; শুধু প্রভুর হাত ধরে থাকতে যেন কখনও ভুল না হয়; তাহলেই যথেষ্ট।
গতকাল আমি ‘মণ্টি রোজা’র তুষারপ্রবাহের ধারে গিয়েছিলাম এবং সেই চিরতুষারের প্রায় মাঝখানে জাত কয়েকটি শক্ত পাপড়িবিশিষ্ট ফুল তুলে এনেছিলাম। তারই একটি চিঠির মধ্যে তোমাকে পাঠাচ্ছি—আশা করি, জাগতিক জীবনের সর্বপ্রকার বাধা-বিপর্যয়রূপ হিমরাশি ও তুষারপাতের মধ্যে তুমিও ঐ রকম আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা লাভ করবে।
তোমার স্বপ্নটি খুবই সুন্দর। স্বপ্নে আমরা আমাদের মনের এমন একটা স্তরের পরিচয় পাই, যা জাগ্রত অবস্থায় কখনও পাই না, এবং কল্পনা যতই অবাস্তব হোক না কেন, অজ্ঞাত আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ তার পশ্চাতেই অবস্থান করে। সাহস অবলম্বন কর। মানবজাতির কল্যাণের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব—বাকী সব প্রভুই জানেন।
অধীর হয়ো না, তাড়াহুড়ো করো না। ধীর, একনিষ্ঠ এবং নীরব কর্মই সফল হয়। প্রভু অতি মহান্। বৎস, আমরা সফল হবই—সফল হতেই হবে। তাঁর নাম ধন্য হোক।
এখানে … কোন আশ্রম নেই। একটি থাকলে কী সুন্দরই না হত! আমি তাতে কতই না আনন্দিত হতাম এবং তাতে এদেশের কতই না কল্যাণ হত!
২৯৪*
সুইজরলণ্ড
৮ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কয়েকদিন পূর্বে তোমায় একখানি পত্র লিখেছি। সম্প্রতি আমার পক্ষে তোমায় জানান সম্ভবপর হয়েছে, ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য আমি এইটুকু করতে পারবঃ তোমায় দু-এক বছরের জন্য মাসিক ১০০ টাকা হিসাবে অর্থাৎ বছরে ৬০ বা ৭০ পাউণ্ড হিসাবে, যাতে মাসে ১০০ পুরা হয়; এমন সাহায্য করতে পারব, তাতে তুমি নিজে স্বাধীন হয়ে ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর কাজ করতে পারবে ও সেটিকে ভাল করে দাঁড় করাতে পারবে। মণি আয়ার এবং অন্য কয়েকটি বন্ধু কিছু টাকা তুলে পত্রিকার মুদ্রণ প্রভৃতির ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। গ্রাহকদের চাঁদা থেকে কত আয় হয়? তা খরচ করে ভাল ভাল লেখকদের কাছ থেকে ভাল ভাল প্রবন্ধ সংগ্রহ করা চলে না কি? ‘ব্রহ্মবাদিনে’ যা কিছু বেরুবে, তার সবটাই যে সকলকে বুঝতে হবে, তার কোন মানে নাই; কিন্তু দেশপ্রেম-প্রণোদিত হয়ে ও পুণ্যসঞ্চয়ের জন্য সকলের এ-পত্রিকার গ্রাহক হওয়া উচিত—অবশ্য আমি হিন্দুদের লক্ষ্য করেই এ কথা বলছি।
[তোমাদের] কয়েকটি গুণ থাকা প্রয়োজনঃ
প্রথমতঃ হিসাবপত্র সম্বন্ধে বিশেষ সততা অবলম্বনীয়। এই কথা বলতে গিয়ে আমি এমন কোন আভাস দিচ্ছি না যে, তোমাদের মধ্যে কারও পদস্খলন হবে, পরন্তু কাজকর্মে হিন্দুদের একটা অদ্ভুত অগোছালো ভাব আছে—হিসাবপত্র রাখার বিষয়ে তাদের তেমন সুশৃঙ্খলা বা আঁট নাই; হয়তো কোন বিশেষ ফণ্ডের টাকা নিজের কাজে লাগিয়ে ফেলে এবং ভাবে শীঘ্রই তা ফিরিয়ে দেব—ইত্যাদি।
দ্বিতীয়তঃ ‘ব্রহ্মবাদিন্’টিকে ভালভাবে পরিচালনা করার উপর তোমার মুক্তি নির্ভর করে, এই ভাব নিয়ে উদ্দেশ্য-সিদ্ধি বিষয়ে পূর্ণ নিষ্ঠা প্রয়োজন। এই পত্রিকাই তোমার ইষ্টদেবতাস্বরূপ হোক; তাহলেই দেখবে সাফল্য কেমন করে আসে। এর আগেই অভেদানন্দকে ভারতবর্ষ থেকে ডেকে পাঠিয়েছি। আশা করি, পূর্বের ‘স্বামী’ (সন্ন্যাসী)-কে পাঠাবার সময় যেমন দেরী হয়েছিল, এবারে তেমন হবে না। এই চিঠি পেয়ে তুমি আমায় ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর সমস্ত আয়ব্যয়ের একটা পরিষ্কার হিসাব পাঠিও—যাতে আমি বুঝতে পারি, কি করা উচিত। মনে রেখো—অখণ্ড পবিত্রতা ও গুরুর প্রতি স্বার্থশূন্য একান্ত আজ্ঞাবহতাই সকল সিদ্ধির মূল।
দু-বৎসরের মধ্যে আমরা ‘ব্রহ্মবাদিন্’কে এরূপ দাঁড় করাব যে, পত্রিকার আয় থেকে শুধু যে খরচ চলে যাবে তা নয়, স্বতন্ত্র একটু আয়ও হবে। বিদেশে ধর্ম-পত্রিকার বেশী কাটতি হওয়া অসম্ভব; সুতরাং হিন্দুদের মধ্যে যদি এখনও কিছুমাত্র ধর্মজ্ঞান বা কৃতজ্ঞতা অবশিষ্ট থাকে, তবে এ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা তাদেরই করতে হবে।
ভাল কথা, এনি বেসাণ্ট (Annie Besant) একদিন আমাকে তাঁদের সমিতিতে ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি এক সন্ধায় বক্তৃতা দিই—কর্ণেল অল্কট্ (Col. Olcott)-ও উপস্থিত ছিলেন। সকল সম্প্রদায়ের প্রতিই আমার সহানুভূতি আছে, এটি দেখাবার জন্যই আমি এরূপ করেছিলাম; কিন্তু আমি কোন আজগুবিতে যোগ দেব না। আমাদের দেশের আহাম্মকদের বলো, আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমরাই জগতে শিক্ষক—বিদেশীরা নয়। ইহলোকের বিষয়ে অবশ্য তাদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে ম্যাক্সমূলারের প্রবন্ধ পড়েছি। ছয় মাস আগে যখন তিনি ওটি লেখেন, তখন তাঁর কাছে প্রতাপ মজুমদারের ক্ষুদ্র পুস্তিকা ছাড়া লেখবার আর কোন উপাদান ছিল না; সুতরাং সে হিসাবে তাঁর প্রবন্ধটি ভালই হয়েছে, বলতে হবে। সম্প্রতি তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একখানি বড় বই লেখবার সঙ্কল্প প্রকাশ করে আমাকে একখানি সুন্দর সুদীর্ঘ পত্র লিখেছেন। আমি এর মধ্যেই তাঁকে অনেক উপাদান দিয়েছি; ভারত থেকে আরও উপাদান পাঠাতে হবে। কাজ করে যাও। লেগে থাক, সাহসী হও, ভরসা করে সব বিষয়ে লাগ। ব্রহ্মচর্যের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখবে; তোমার তো ছেলেপুলে যথেষ্ট হয়েছে—আর কেন? এই সংসারটা কেবল দুঃখময়। কি বল? আমার স্নেহাশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ