১৮শ অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনাদির দোষানুস্মরণে গান্ধারীর বিলাপ
“হে মাধব! এই যে আমার শতসংখ্যক পুত্রকে নিহত দেখিতেছ, ভীমসেন প্রায়ই গদাঘাতে উহাদিগকে নিপাতিত করিয়াছে। এক্ষণে যে আমার হতপুত্ৰা পুত্রবধূগণ আলুলায়িতকেশে রণস্থলে ধাবমান হইতেছে, ইহাই সর্বাপেক্ষা সমধিক ক্লেশকর। পূর্বে যাহারা অলঙ্কৃতপদে প্রাসাদোপরি বিচরণ করিত, অদ্য তাহারা বিষম বিপদগ্রস্ত ও শোকার্ত্ত হইয়া রুধিরার্দ্রভূমিতে [শোণিতসিক্ত—রক্তে কৰ্দমিত] মত্তের ন্যায় পরিভ্রমণ করিয়া গৃধ্র, গোমায়ু ও বায়সগণকে উৎসারিত করিতেছে। এই সর্বাঙ্গসুন্দরী কৃশোদরী দুৰ্য্যোধন মহিষী ঘোরতর জনক্ষয়সন্দর্শনে দুঃখাৰ্ত্ত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতেছে। ঐ রাজপুত্রীকে অবলোকন করিয়া আমার মন স্থির হইতেছে না। ঐ দেখ, কামিনীগণ কেহ কেহ পতি ও কেহ কেহ তনয়গণকে সমরনিহত নিরীক্ষণ করিয়া উহাদের হস্তধারণপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইতেছে। প্রৌঢ় ও স্থবির কামিনীগণ অতিভীষণরবে ক্রন্দন করিতেছে। ঐ দেখ, শ্রান্ত ও মোহাবিষ্ট অবলাগণের মধ্যে কেহ কেহ রথনীড় ও কেহ কেহ নিহত গজবাজিগণের দেহ ধারণ এবং কেহ বা স্বীয় স্বামীর কুণ্ডলযুক্ত ছিন্ন-মস্তক গ্রহণ করিয়া অবস্থান করিতেছে। বোধ হয়, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী কামিনীগণের সহিত আমি পূর্ব্বজন্মে বহুবিধ গুরুতর দুষ্কর্ম্ম করিয়াছিলাম, সেই নিমিত্তই ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির হইতে এইরূপ বিপ উপস্থিত হই। ফলভোগ ব্যতীত পাপপুণ্যের কখনই ক্ষয় নাই। হে জনার্দ্দন! ঐ দেখ, নবযৌবনসম্পন্না লজ্জাশীলা অবলাগণ দুঃখশোকে নিতান্ত অভিভূত ও ভূতুলে নিপতিত হইয়া সারসী[হংসী]গণের ন্যায় শব্দ করিতেছে। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে উহাদের মুখপদ্ম শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। হায়! আজ আমার মত্তমাতঙ্গপরাক্রম পুত্রগণের মহিষীরা সামান্য লোকদিগের দৃষ্টিপথে পতিত হইল। ঐ দেখ, আমার পুত্রগণের শতচন্দ্রযুক্ত চর্ম্ম, সূৰ্য্যসন্নিভ ধ্বজ এবং সুবর্ণনির্মিত বর্ম্ম, নিষ্ক ও শিরস্ত্রাণসকল ভূতলে নিপতিত হইয়া হুতহুতাশনের ন্যায় শোভা পাইতেছে। ঐ দেখ, মহাবীর দুঃশাসন সমরস্থলে শয়ান রহিয়াছে। মহাবীর ভীমসেন উহাকে নিপাতিত করিয়া উহার সর্বাঙ্গের রুধির পান এবং দূতক্লেশ ও দ্রৌপদীর বাক্য স্মরণ করিয়া গদাঘাতে দুৰ্য্যোধনকে সংহার করিয়াছে। দুর্বুদ্ধি দুৰ্য্যোধন ভ্রাতা দুঃশাসন ও প্রিয়চিকীর্ষ সূতপুত্র কর্ণের প্ররোচনায় সভামধ্যে দ্রৌপদীকে কহিয়াছিল, ‘পাঞ্চালি! তুমি আজ দাসভাৰ্য্যা হইয়াছ, অতএব অবিলম্বে নকুল, সহদেব ও অর্জুনের সহিত আমাদিগের গৃহে প্রবেশ কর। আমি ঐ সময় দুৰ্য্যোধনকে আসন্নমৃত্যু অবগত হইয়া কহিয়াছিলাম, ‘বৎস! তুমি অবিলম্বে কলহপ্রিয় দুর্বুদ্ধি মাতুল শকুনিকে পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডবদিগের সহিত সন্ধি সংস্থাপন কর। ভীমসেন তোমার বাকশল্যে বিদ্ধ হইয়া যে উল্কাভিহত[উল্কাদ্বারা পীড়িত] কুঞ্জরের ন্যায় রোষাবিষ্ট হইতেছে, তাহা তুমি অনুধাবন করিতেছ না।’ হে মাধব! তৎকালে দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবদিগকে ক্রুদ্ধ জানিয়াও সর্প যেমন বৃষভের প্রতি বিষ পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ তাহাদিগের প্রতি বাক্যবাণ প্রয়োগ করিয়াছিল; সেই অপরাধেই এক্ষণে কুরুকুল নির্মূল হইল। ঐ দেখ, দুঃশাসন সুদীর্ঘ ভুজযুগল প্রসারিত করিয়া ভূতলে শয়ান রহিয়াছে। সিংহ যেমন মাতঙ্গকে বিনাশ করে, তদ্রূপ মহাবীর বৃকোদর রোষাবিষ্ট হইয়া উহাকে সংহারপূর্ব্বক উহার শোণিত পান করিয়া অতি ভয়ানক কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে।”