অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – জলে স্থলে
জলে লাফাইয়া পড়িয়া বজ্র ডুবিয়া গেল। তারপর অনেক দূর পর্যন্ত ডুব সাঁতার কাটিয়া সে মাথা ঝাড়া দিয়া ভাসিয়া উঠিল। চারিদিক অন্ধকার, তীর দেখা যায় না; কেবল গঙ্গার খরস্রোত দুর্বার বেগে তাহাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।
বজ্রের দেহে সামান্য দুই চারিটা আঁচড় লাগিয়াছিল, মাথার আঘাতও গুরুতর নয়। কিন্তু তাহার মনের মধ্যে একটা বাক্যাতীত বিস্ময় জাগিয়া ছিল। কী হইল? উহারা কি তাহাকে মারিয়া ফেলিতে চাহিয়াছিল? কিন্তু কেন? অঙ্গদের জন্য?
বজ্র হাত দিয়া অনুভব করিয়া দেখিল— অঙ্গদ যথাস্থানে আছে, উহারা কাড়িয়া লইতে পারে নাই।
গঙ্গার বুকে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। পশ্চাতে তাহাকে ধরিবার জন্য ডিঙা আসিতেছে না, আসিলে দাঁড়ের শব্দ শুনা যাইত। বজ্র ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, পিছন দিকে নগরের দুই চারিটা মিটিমিটি আলো দূর হইতে ক্রমশ আরও দূরে সরিয়া যাইতেছে।
বজ্র আর সাঁতার কাটিতেছিল না, কেবল জলের উপর গা ভাসাইয়া ছিল। তাহার মনে হইল স্রোতের টান আরও বাড়িতেছে; অজ্ঞাতসারে স্রোতের আকর্ষণ তাহাকে নদীর মাঝখানে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। এভাবে ভাসিয়া চলিলে সে কোথায় ভাসিয়া যাইবে তাহার স্থিরতা নাই। হয়তো সুন্দরবনে গিয়া পৌঁছিবে, হয়তো সমুদ্রে গিয়া পড়িবে— সমুদ্র কতদূরে তাহা সে জনিত না।
বজ্র আবার সাঁতার কাটিতে আরম্ভ করিল, ডান দিকের তীর লক্ষ্য করিয়া সাঁতার দিয়া চলিল। তীর কিন্তু অদৃশ্য, এমন কি তীরাহত জলের কলধ্বনি পর্যন্ত শুনা যায় না।
এইভাবে অন্ধের মত অনেকক্ষণ সাঁতার কাটিবার পর স্রোতের বেগ ঈষৎ মন্দীভূত হইল।
বজ্র বুঝিল— সে স্রোত কাটাইয়া তির্যকভাবে তীরের দিকে আসিতেছে। তারপরই অকস্মাৎ সে এক নূতন কল্লোলধ্বনি শুনিতে পাইল; তাহার চারিদিকে উতরোল তরঙ্গ সংঘাত যেন তাহাকে গ্রাস করিতে উদ্যত হইল।
কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। বজ্র ভাল সাঁতার জানে, দেহে শক্তিও অসীম; সে তরঙ্গের সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে মাথা জাগাইয়া রহিল। তারপর হঠাৎ আবার স্রোতের মত্ততা শান্ত হইয়া গেল। বজ্রের চিন্তা করিবার সামর্থ্য ছিল না, থাকিলে বুঝিতে পারিত সে গঙ্গা ও ময়ূরাক্ষীর সঙ্গমস্থল পার হইয়া আসিয়াছে।
আরও কিছুক্ষণ বজ্র নিস্তরঙ্গ জলে ভাসিয়া চলিল। তারপর সহসা একটি আলোকের বিন্দু তাহার চোখে পড়িল। ডান দিকে, কিছু সম্মুখে আলোকবিন্দুটি যেন ঊর্ধ্ব হইতে ধীরে ধীরে নামিয়া আসিতেছে। বজ্র আর চিন্তা করিল না, শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিয়া ঐ রক্তাভ বিন্দুটির দিকে সাঁতার কাটিয়া চলিল।
ক্রমে সেই ক্ষীণ দীপালোকে তীরের একটি অংশ তাহার চোখে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। প্রশস্ত ঘাট নয়, শীর্ণ একশ্রেণী সোপান উচ্চ পাড় হইতে জল পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে। একটি কিশোরী মেয়ে প্রদীপ হস্তে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া নামিতেছে।
মেয়েটির বয়স দশ-এগারো বছর; গায়ের রঙ কোমল কালো। মুখে কৌতুক আগ্রহ ভীরুতা মেশা একটি ভাব। সে একাকিনী ঘাটে আসিয়াছে, জলে প্রদীপ ভাসাইয়া নিজের সৌভাগ্য গণনা করিবে।
মেয়েটি নিম্নতম পৈঠায় আসিয়া বসিল, প্রদীপ পাশে রাখিল, আঙ্গুল জলে ডুবাইয়া মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা দিল। তারপর সহসা জলে আলোড়নের শব্দ শুনিয়া ভয়-বিস্ফারিত চক্ষে চাহিল। যাহা দেখিল তাহাতে তাহার বাক্নিঃসরণের ক্ষমতা রহিল না, হস্তপদ সঞ্চালনের শক্তিও রহিত হইল।
প্রথমে একটা সাদা মানুষের মুখ, তারপর একটা প্রকাণ্ড শরীর আসিয়া ঘাটে ঠেকিল। বজ্র জলে নিমজ্জিত পৈঠার উপর উঠিয়া বসিল। মেয়েটি অনড় অভিভূত হইয়া চাহিয়া রহিল।
বজ্র তাহার অবস্থা বুঝিয়াছিল, সে দ্রুত নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বলিল— ‘ভয় পেও না।’
মানুষের কণ্ঠস্বর শুনিয়া কিশোরীর মনের অসাড় ভাব বোধহয় একটু কাটিল। তাহার ঠোঁট দুটি হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিল।
বজ্র বলিল— ‘হাতিঘাটে জলে পড়ে গিয়েছিলাম, ভাসতে ভাসতে এসেছি।’
এবার কিশোরীর সাহস আর একটু বাড়িল, সে অধরের স্ফুরণ সংযত করিয়া কৌতূহলী চক্ষে বজ্রকে দেখিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বজ্রের প্রগণ্ডে অঙ্গদটি তাহার চোখে পড়িল। অঙ্গদের বস্ত্রাবরণ সাঁতার কাটিবার সময় খুলিয়া পড়িয়া গিয়াছিল। কিশোরী মন্ত্রমুগ্ধের মত চাহিয়া রহিল।
বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘এখান থেকে কানসোনায় ফিরে যাবার পথ আছে?’
কিশোরী মাথা নাড়িল— ‘না।’
‘পথ নেই!’
কিশোরী বলিল— ‘ময়ূরাক্ষী পার হয়ে কানসোনায় যেতে হয়। এখন খেয়া বন্ধ হয়ে গেছে।’
বজ্র চিন্তা করিল। কানসোনায় ফিরিয়া গিয়াই বা লাভ কি?— কুহু আসিবে, আসিয়া ফিরিয়া যাইবে। তা যাক।
‘এখানে কাছাকাছি বসতি আছে? তুমি এখানে থাকো?’
‘হাঁ।’
‘তোমার ঘরে কে কে আছে?’
‘শুধু আমি আর আয়ি বুড়ি। আর কেউ না।’
‘পুরুষ নেই?’
‘না।’
‘তোমাদের চলে কি করে?’
‘কানসোনায় শাক-পাতা কলা-মূলো বিক্রি করি।’
‘আমাকে আজ রাত্রে তোমাদের ঘরে থাকতে দেবে? কাল সকালেই আমি চলে যাব।’
‘আমি জানি না, আয়ি বুড়ি জানে।’
‘বেশ, আমাকে আয়ি বুড়ির কাছে নিয়ে চল।’
‘আচ্ছা।’
কিশোরী এতক্ষণ কথা কহিতে কহিতে অঙ্গদটি ফিরিয়া ফিরিয়া দেখিতেছিল, এখন আর কৌতূহল সম্বরণ করিতে পারিল না; জিজ্ঞাসা করিল— ‘তোমার তাগা কি সোনার?’
বজ্র ঈষৎ হাসিয়া বলিল— ‘হাঁ।’
কিশোরীর মুখে বিস্ময়ের সঙ্গে একটা ভক্তিভাব ফুটিয়া উঠিল। সে সসম্ভ্রমে বজ্রের মুখের পানে চাহিল; তারপর প্রদীপ তুলিয়া লইয়া বলিল— ‘এস।’
তাহার মনের সমস্ত ভয় শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমে পরিণত হইয়াছে।
সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া কিশোরী একদিকে চলিল; বজ্র সিক্ত বস্ত্রে তাহার পশ্চাতে চলিল। যাইতে যাইতে সে ভাবিতে লাগিল, আজ রাত্রিটা কোনও ক্রমে কাটাইয়া কালই সে গ্রামে ফিরিয়া যাইবে। কর্ণসুবর্ণে আর নয় যথেষ্ট হইয়াছে। নাগরিক জীবন তাহার জন্য নয়, সে বেতসগ্রামে ফিরিয়া যাইবে। মা‘র কাছে, গুঞ্জার কাছে ফিরিয়া যাইবে।
আশ্চর্য এই যে বিম্বাধর বা বটেশ্বরের প্রতি সে বিশেষ ক্রোধ অনুভব করিল না। প্রথমে নাবিকগণ কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া তাহার মনে যেরূপ প্রতিক্রিয়া হইয়াছিল তখন বিম্বাধর বা বটেশ্বরকে হাতের কাছে পাইলে বোধকরি দুই হাতে ছিঁড়িয়া ফেলিত। কিন্তু এখন তাহার মনে সামান্য তিক্ততা ভিন্ন আর কিছু নাই। সর্প দংশন করে, বাঘ-ভালুক উদরের দায়ে জীবহিংসা করে; ইহা তাহাদের স্বভাব। ক্রোধ করিয়া লাভ কি? তাহাদের সংসর্গ হইতে দূরে থাকিলেই হইল।
অল্প কিছুদূর চলিবার পর কিশোরী বজ্রকে লইয়া একটি কুটিরের সম্মুখে উপস্থিত হইল। মাটির কুটির, খড়ের চাল। আশেপাশে আরও কয়েকটি কুটির রহিয়াছে তাহা আবছায়াভাবে অনুমান করা যায়।
দ্বারের পাশে প্রদীপ রাখিয়া কিশোরী বলিল— ‘তুমি বোসো, আমি আয়িকে ডাক্ছি।’
বজ্র ভিজা কাপড়ে দাওয়ার নীচে দাঁড়াইয়া রহিল, কিশোরী ভিতরে গেল। পরীক্ষণেই এক বৃদ্ধার স্বর শুনা গেল— ‘ওলো গঙ্গা, তুই এলি। কোথায় গিছ্লি বল্ দেখি!’
তারপর কিছুক্ষণ নিম্নস্বরে কথা হইল। বুড়ি বাহিরে আসিল। বজ্রকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল— ‘ওমা, এ যে সোনার কার্তিক! এস বাছা, এস। হাতিঘাটে জলে পড়ে গিছলে! খুব বেঁচে গেছ বাছা, ভগবান রক্ষে করেছেন। তা আজ রাত্তিরটা আমার দাওয়ায় থাকো, কাঙ্গালের শাক-ভাত খাও। — ওরে গঙ্গা, শুকনো কাপড় এনে দে, পাটি পেতে দে।’
গঙ্গা শুষ্ক বস্ত্র আনিয়া দিল, দাওয়ায় পাটি পাতিয়া দিল। বজ্র বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া পাটিতে লম্বা হইল; ক্লান্তির সহিত একটি পরম নিশ্চিন্ততা তাহার দেহমনকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। অল্পকাল মধ্যে সে ঘুমাইয়া পড়িল।
দণ্ড দুই তিন পরে যখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিল তখন গঙ্গা তাহার পায়ের অঙ্গুষ্ঠ ধরিয়া নাড়া দিতে দিতে বলিতেছে— ‘ওঠো, ভাত হয়েছে, খাবে চল।’
বজ্র ঘুমভরা চোখে উঠিয়া গিয়া খাইতে বসিল। কুটিরের একটিমাত্র ঘরে পিঁড়ি পাতিয়া আসন করা হইয়াছে; সম্মুখে কলাপাতায় স্তূপীকৃত ভাত। গরম ভাতে ঘিয়ের ছিটা; ব্যঞ্জনের মধ্যে ও-বেলার শাকচচ্চড়ি, কচু-ডাঁটার ঘণ্ট, সরিষা-বাটা দিয়া ইল্লিশ মাছের ঝাল ও কাসুন্দী। খাইতে খাইতে বজ্রের বেতসগ্রাম ও মায়ের রান্না মনে পড়িয়া গেল।
আয়ি বুড়ি একটু বেশি কথা বলে, সে নানা অসংলগ্ন কথা বলিয়া চলিল। তারপর বজ্রের আহার শেষ হইয়া আসিয়াছে তখন সে বলিল— ‘ঘরে অতিথ্ আসা তো গেরস্তর ভাগ্যি। তা বাছা, আমার এমন পোড়া কপাল, ঘরে কি ভাল বিছানা আছে! তুমি বড় ঘরের ছেলে, খাট-পালঙ্কে শোয়া অভ্যেস, তুমি কি আমার কাঁথা-কানিতে শুয়ে ঘুমতে পারবে?’
বজ্র বলিল— ‘খুব পারব আয়ি। আমি তোমাদেরই মত গাঁয়ের মানুষ। আমার কোন কষ্ট হবে না।’
বুড়ি বলিল— ‘তা বললে শুন্ব কেন বাছা! তোমার যে সোনার অঙ্গ। আহা, গায়ের রঙ যেন মল্মলে বাঁধা খাঁড়ি মসূর! তাই ভাবছিলাম কি, কোদণ্ড ঠাকুরকে গিয়ে বলি, তিনিই না হয় আজ রাত্তিরটা তোমায় ঘরে ঠাঁই দিন।’
বজ্র চমকিয়া মুখ তুলিল— ‘কোদণ্ড ঠাকুর! তিনি কে?’
বুড়ি বলিল— ‘বামুন গো। আগে মস্ত লোক ছিলেন, এখন অবস্থা পড়ে গেছে তাই আমাদের মত চাষী-মালীদের মধ্যে আছেন। তাঁকেই বলি গিয়ে, তিনি একলা মানুষ, তোমাকে ঘরে থাকতে দিতে পারবেন। আমার এখানে তো দাওয়ায় পড়ে থাকতে হবে।’
বজ্র ভাবিতে লাগিল, ইনি কি সেই কোদণ্ড মিশ্র যাঁহার কথা শীলভদ্র বলিয়াছিলেন? তাহার পিতামহ শশাঙ্কদেবের সচিব…কাল প্রাতে বজ্র গ্রামে ফিরিয়া যাইবে, তৎপূর্বে পিতামহের সচিবকে একবার দেখিয়া যাইবে না?
আহার সমাধা করিয়া বলিল— ‘বেশ, তিনি যদি আমাকে থাকতে দেন, তাঁর ঘরেই থাকিব।’