ক্ষতবিক্ষত শরীরে ববি অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে শারীরিক ও মানসিক লড়াই চালিয়েছেন। প্রতিপক্ষদের মধ্যে বিবেকহীন দৈত্য ও পেশাদার খুনির সংখ্যাই প্রবল। এতক্ষণ যে বেঁচে আছেন ববি, তা কেবল দৈবের বশে। কিন্তু আস্তে আস্তে ববির ক্ষতমুখগুলি বিষিয়ে উঠছে। কেটে যাচ্ছে ওষুধের ক্রিয়া। ববির রিফ্লেক্স ভাল কাজ করছে না। চোখে মাঝে মাঝে ঝাপসা দেখছেন।
প্রতিপক্ষ শুধু প্রবলই নয়, এ পর্যন্ত সর্বোত্তম। লড়াইটা জেতা ববির পক্ষে সাংঘাতিক প্রয়োজন। সুস্থ থাকলে কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু এখন ববির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন বাড়তি জল ঢুকে পড়েছে। হাত তুলতে, পা তুলতে দেড়গুণ-দ্বিগুণ সময় লাগছে। পিঠ থেকে একটা ব্যথা উরু অবধি অবশ করে দিচ্ছে। মাথার ভিতরে প্রবল যন্ত্রণা। আর এ লড়াই লড়তে হচ্ছে শূন্যে লাফিয়ে, জমিতে পড়ে, শরীরে চুড়ান্ত ভারসাম্যের ওপর। এক চুল, এক পলের এদিক ওদিক হলেই একটি হাই পাওয়ার কিক বা কারাটে চপ খেয়ে চোখ ওলটাতে হবে।
প্রায় পনেরো মিনিট কেউ কাউকে ছুঁতে পারল না। লড়াই রইল সমান-সমান। কিন্তু আসলে সমান-সমান নয়। ববি যে আস্তে আস্তে নিজের শরীরের কাছে হার মানছেন তা তিনিও বুঝতে পারছিলেন। আর সেটা বুঝতে পারছিল তার বুদ্ধিমান প্রতিপক্ষও। ট্রাংক কল-এ সে জানতে পেবেছে ববি ওয়্যারহাউসে কী পরিমাণ পিটুনি গ্রহণ করেছেন তার শরীরে। সারা রাত ঘুম বলতে গেলে হয়নি। প্রতিপক্ষ এয়ারপোর্টের ঘটনাও জানে। সে জানে, ববিকে এই বাড়ির ভূগর্ভের ঘরে আসতে তিন-তিনটে সাব-মেশিনগানধারী গুন্ডার মোকাবিলা করতে হয়েছে। তার মধ্যে একজন হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা। সুতরাং লোকটা ববিকে যতখানি পারে পরিশ্রান্ত করে তুলছিল। লোকটার নিজের রিফ্লেক্স চমৎকার। নড়াচড়া বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন। তাই আহত পরিশ্রান্ত ববিকে সে আক্রমণের পর আক্রমণ রচনা করতে দিয়ে নিজেকে বারবার চকিতে সরিয়ে নিচ্ছিল।
ববি বুঝলেন, এভাবে পারা যাবে না। লড়াই তাড়াতাড়ি শেষ করা দরকার। চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ববি হঠাৎ বৃত্তটা ভেঙে এবং এ লড়াইয়ের নিয়মের তোয়াক্কা না করে আচমকাই সোজা সরল পথে লোকটার কোমর লক্ষ করে জোড়া পায়ে লাফিয়ে পড়লেন।
চমৎকার হালকা ও চকিত লাফ। স্বাভাবিক অবস্থায় এই আকস্মিক দিক পরিবর্তনের ফলে লোকটা দিশাহারা হয়ে যেত। নিশ্চিত পরাজয় লেখা ছিল তার কপালে।
কিন্তু ভাগ্য মন্দ ববির। লোকটা ববির ওই বিভীষণ আক্রমণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল চিতাবাঘের তৎপরতায়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুরন্ত এক খোলা হাতের কোপ বসিয়ে দিল ববির মাথায়। হাতের কানার সেই দুর্দান্ত মার ববির মাথার খুলিতে ফেটে পড়ল। ববির চোখের সামনে সহসা ফুলঝুরির মতো আলোর বিন্দু নাচতে লাগল। অসাড় অবসন্ন দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেল।
লোকটা হাঁটু গেড়ে বসে ববিকে অনেকক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে দেখল। তারপর মুখ তুলে লীনার দিকে চাইল। ফিসফিস করে বলল, এ লোকটা মানুষ না অতিমানুষ তা কি তুমি জানো মিস লীনা?
লীনা অরুদ্ধ স্বরে বলল, মানুষ। একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ।
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, তুমি জানো না। তুমি জানো না এ লোকটা বম্বেতে আমার গ্যাং-এর হাতে ধরা পড়ার পর যে মার খেয়েছে তা দশটা লোককে ভাগ করে দিলেও তারা বোধহয় সাতদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারত না। এ লোকটা আহত অবস্থায় আমার দু’জন অত্যন্ত শক্ত সমর্থ লোককে ঘায়েল করে পালায়। মাত্র কয়েক মিনিট আগে এ লোকটা আমার তিনজন সশস্ত্র সঙ্গীকে হারিয়ে এবং সম্ভবত অজ্ঞান বা হত্যা করে আমার পিছু নিয়েছে। তিনজনের মধ্যে একজন যে হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা তা তার চেহারা দেখে তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছ। এর পরেও যেভাবে আমার সঙ্গে লড়ছিল তাতে যে-কোনও সময়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারত। এ লোকটা মানুষ নয়, মিস লীনা।
লীনা কোনও জবাব দিল না। টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে থরথর করে কাঁপছিল। এই ভীষণ পুরুষালি জীবন-মরণ লড়াই সে তো জন্মেও দেখেনি। এত হিংস্র, বর্বর, নিষ্ঠুর কিছু তার অভিজ্ঞতায় নেই। তার অস্তিত্ব আজ নাড়া খেয়ে গেছে ভীষণ।
লোকটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর দেয়ালের চারদিকে কী যেন একটু খুঁজল আপনমনে। লীনার দিকে দৃকপাতও করল না। কিন্তু লীনা তাকে লক্ষ করছিল। লোকটা দেয়ালে একটু উঁচুতে ডিং মেরে পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে কী যেন একটা অনুভব করল। লীনা লক্ষ করল, দেয়ালের গায়ে একটা লাল বোতাম।
লোকটা নিচু হয়ে মেঝের ওপর কিছু খুঁজল। তারপর একটা হাতলের মতো জিনিস ধরে টানতেই ম্যানহোলের ঢাকনার মতো একটা চৌকো ঢাকনা খুলে এল। লোকটা একটা টর্চ বের করে ভিতরটা দেখে নিল। নামল না। ঢাকনাটা আবার যথাস্থানে বসিয়ে দিয়ে ভিডিয়োেগুলো সব অফ করে দিল।
লীনা ধীরে ধীরে ববির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। নাড়ি চলছে। একটু ক্ষীণ। শ্বসটা যেন অনিয়মিত।
লোকটা লীনার দিকে ফিরে বলল, মিস লীনা, কোনও মহিলার সামনে তার ভালবাসার লোককে আমি খুন করতে চাই না।
লীনা জলভরা চোখ তুলল। চারদিকটা যেন ভাঙাচোরা। লোকটা যেন আবছা এক সিল্যুট।
লোকটা বলল, কিন্তু এই কাজটা করার জন্যই আমাকে কয়েক হাজার মাইল আসতে হয়েছে। আর এ কাজটায় ইনভলভড় লক্ষ লক্ষ টাকা। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, ববির মতো বিশাল মানুষের মৃত্যুও হবে মহান। ওই যে দেয়ালে লাল বোতামটা দেখছ ওটা হল এই বাড়ির সুইসাইড কোড। বোধহয় দুমিনিটের ফিউজ আছে। আমার মনে হয়, তুমি ওকে ছেড়ে পালাবে না। যেমন তোমার ইচ্ছে। কিন্তু আমাকে যেতে হবে মিস লীনা। ওই লাল বোতামটা টিপে দিলেই আমার মিশন শেষ।
লীনার লাল বোতামের কথা মনে পড়ল। তেমন বিপদ বুঝলে লীনাকেই বোতামটা টিপতে বলেছিলেন ববি রায় তাঁর চিঠিতে।
লীনা আতঙ্কিত গলায় বলে উঠল, প্লিজ প্লিজ! আমাদের চলে যেতে দিন।
মিস লীনা, তুমি চলে যেতে পারো। কেউ বাধা দেওয়ার নেই। ববিকে একা তার মহান মৃত্যু বরণ করতে দাও। সে তার নিজের সৃষ্টির সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এর চেয়ে সুন্দর আর কীই বা হতে পারে! আর তুমিও যদি ওর সঙ্গে সঙ্গে মহৎ হতে চাও তা হলে তো আমার কিছু করার। নেই।
মনুষ্যত্ব বলে কি কিছু নেই?
আছে মিস লীনা, আমি জানি আছে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষ, যাদের বেঁচে থাকা মানেই প্রতি পদে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষা, তাদের কাছে ও ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। আমরা মনুষ্যত্ব মানে বুঝি, হয় বাঁচো, না হয় মরো। তুমি বেশ ভাল মেয়ে লীনা, দেখতেও চমৎকার। এমন একটা সুন্দর মেয়ের এরকম পরিণতি আমি চাই না। কিন্তু কিছু করার নেই। গুড বাই…
লীনা কিছু বলার আগেই লোকটা চকিতে লাল বোতামটা টিপে দিয়ে এক লাফে দরজায় পৌঁছেই চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়াল লীনা। এভাবে মরবে ববি? এরকমভাবে কি ওকে মরতে দেওয়া যায়? ওর কত ভুল যে শুধরে দেওয়ার আছে লীনার
ক’মিনিটের ফিউজ? লোকটা বলল, দু’মিনিট, ববিও সেরকমই যেন কিছু জানিয়েছিল তাকে। মাত্র দুমিনিট। লাল বোতামটা টেপার সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভে চলে গেছে সংকেত। যেখানে অপেক্ষারত এক শক্তিশালী বিস্ফোরক হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙে উক্তণ হয়েছে। তার কানে সংকেতটা পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে ব্লু-উ-উ-ম-ম-ম্-ম্…
লীনা মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হাতলটা খুঁজল। ওই ঢাকনার তলাতেই রয়েছে সেই উৎকর্ণ বিস্ফোরক। লীনাকে তা অকেজো করতেই হবে। হাতলটা মেঝের সঙ্গে মিশে আছে। লীনা তার লম্বা নখ ঢুকিয়ে দিল খাঁজে। তারপর খুঁটে তুলবার চেষ্টা করল। নখটা উলটে গিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। লীনা গ্রাহ্যও করল না।
হাতলটা উঠে এল ঠিকই। কোলাপসিবল হাতল, মেঝেয় মিশে থাকে, বোঝাও যায় না। হাতলটা ধরে টানতেই ঢাকনাটা সরে এল। হালকা ফাইবারের তৈরি জিনিস, ভারী নয়। আলগা ঢাকনাটা তুলে দূরে ছুড়ে ফেলল লীনা। তারপর গর্তটার মধ্যে নেমে পড়ল।
ঠিক এ সময়ে একজোড়া পা দৌড়ে এল ঘরে।
মিস ভট্টাচারিয়া, আপনি কী করছেন?
লীনা লোকটার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, আপনি ববির বন্ধু না শত্রু?
বন্ধু, ভীষণ বন্ধু! আমি ইন্দ্রজিৎ সেন, প্রাইভেট আই।
তা হলে ছুরি কঁচি যা আছে দিন। ভীষণ দরকার।
এই যে নিন। ছুরি আমার সবসময়ে থাকে। শুধু রিভলভার…
লীনা যে গর্তে নামল তা মোটেই গভীর নয়। তার কাঁধ অবধি বড় জোর। নীচে একটা জটিল যন্ত্র। অনেক তার। অনেক স্কু এবং বন্টু। কী করবে লীনা? সে পাগলের মতো একটার পর একটা তার কেটে ফেলতে লাগল ছুরি দিয়ে।
ঠিক পনেরো সেকেন্ডে ওপরে উঠে এল জন। দরজার বাইরে পা দিয়েই সে দেখল, বিশাল দানবটার সংজ্ঞা ফিরেছে। উঠে বসবার চেষ্টা করছে ঘাসের ওপর।
জন গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। সময় নেই। একদম সময় নেই।
দানবটা উঠে বসল। মাথায় হাত দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল, সে কোথায় এবং তার কী হয়েছে। আর তখনই সে জনকে দেখতে পেল গাড়ির জানালায়।
জন! এই জন!
জন একটু ইতস্তত করল। তারপর কী ভেবে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দিল।
জন! তুমি কোথায় যাচ্ছ?
জনের সময় নেই। অ্যাকসেলেটরে পা দাবিয়ে দিল সে।
দানবটা আচমকাই কুড়িয়ে নিল তার কারবাইন। তারপর নলটা ঘুরিয়ে আধ সেকেন্ডের একটা বা চালু করল। কানে তালা দেওয়ার মতো বাতাসে তরঙ্গ তুলে এক ঝাক গুলি গিয়ে উড়িয়ে দিল পিছনের দুটো টায়ার।
জন নেমে এল গাড়ি থেকে, বোকা! গাধা! হোঁতকা!
জনের ডান হাতটা একবার মাত্র একবারই অতি দ্রুত আন্দোলিত হল। বাতাসে শিস আর রোদে ঝলক তুলে গ্লোয়িং নাইফটা ছুটে এল। দানবটা কিছু বুঝে উঠবার আগেই সেটা আমূল, বাঁট পর্যন্ত গেঁথে গেল বাঁ দিকের বুকে। ঠিক যেখানে হৃৎপিণ্ডের অবস্থান।
লোকটা অবিশ্বাসের চোখে একবার নিজের বুকের দিকে তাকাল।
জন হরিণের পায়ে দৌড়োচ্ছে। পালাবে? দানবটা তার কারবাইন বিবশ হাতে তুলল। লক্ষ্য স্থির নেই, এমনকী চোখেও সে ভাল দেখছে না। তবু ট্রিগার চেপে ধরল সে।
ট্যাট ট্যাট ট্যাট… রা রা রা রা রা করে উজাড় হয়ে যেতে লাগল সাব-মেশিনগান।
সেই ঝাঁকবাঁধা গুলির তোড়ে জন প্রায় দু’-আধখানা হয়ে গেল। উড়ে গেল তার হাতের একটা আঙুল, শরীরের নানা অংশ ছিটকে পড়ল নানাদিকে। দাঁড়ানো অবস্থাতেই সে বিভক্ত হয়ে গেল শতধা। যখন মাটিতে পড়ল তার অনেক আগেই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে।
দানবটা কয়েকবার হেঁচকি তুলল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আট্টা গুড বয়। ইউ নেভার ডিচ এ ফ্রেন্ড… ওকে?
তারপর দানবটা চোখ বুজল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আর শ্বাস নিতে পারল না।
দৃশ্যটা দেখল একজন। যে ছাদে ছিল। দুটো সাহেবকে একে অন্যের হাতে খুন হয়ে যেতে দেখে সে আর অপেক্ষা করল না। নেমে এল।
মৃত দুই সাহেবের পকেটে হাত দিয়ে সে দুটো ওয়ালেট বের করে নিল। বেশ পুরুষ্টু ওয়ালেট। তারপর হাতের অস্ত্রটা একটা ঝোলায় পুরে নিয়ে সে দ্রুত ফটক পেরিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘স্যার, স্যার…’ বলে কে যেন প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল।
গভীর ঘোরের মধ্যেও সেই ডাকটা ববির কানে পৌঁছোল। খুব ক্ষীণভাবে।
স্যার, আমরা মরে যাচ্ছি… আমরা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি স্যার, যে আগ্নেয়গিরি এখুনি ইরাপ্ট করবে।
ববির ঘোরটা কাটল। মাথায় হাত দিয়ে তিনি ‘ওঃ’ বলে কাতর একটা আওয়াজ করলেন। মুখের ওপর একটা চেনা মুখ ঝুলে আছে। ইন্দ্রজিৎ। এত বড় বড় চোখ ইন্দ্রজিতের।
ববি দুর্বল গলায় বললেন, কী বলছ?
রেড বাটন প্রেস করে বদমাশটা পালিয়েছে এক মিনিট হয়ে গেল। কিছু করুন স্যার। দিদিমণি সব তার কেটে ফেলেছেন।
ববি এবার চমকে জেগে উঠলেন, ডেটোনেটর অ্যাক্টিভ! সর্বনাশ! কিন্তু আমি যে—
আপনি উঠবেন না। শুধু বলুন কী করতে হবে?
ববি দেখতে পেলেন, মেঝের চৌকো গর্তের মধ্যে নেমে পাগলের মতো তার কেটে কেটে ওপরে জড়ো করছে লীনা।
ববি চেঁচিয়ে বললেন, লীনা!
লীনা পাগলের মতো চোখে ফিরে তাকাল।
ববি শান্ত স্বরে বললেন, এক্সপ্লোসিভের মাথায় একটা নীল বোতাম আছে। সেটা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে প্যাঁচ খুলে টান দিলেই একটা সরু ডার্ট বেরিয়ে আসবে। তাড়াতাড়ি করুন।
ববির দিকে চেয়েই লীনা শান্ত হল। মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল।
ইন্দ্রজিৎ চিৎকার করছিল, আর পাঁচ সেকেন্ড… চার সেকেন্ড… তিন সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড…
লীনা নীল বোতামটা তার ওড়না দিয়ে চেপে ধরে বাঁ দিকে প্রাণপণে মোচড় দিচ্ছিল। একটু ধীরে ঘুরছিল পাঁচ। বড় শক্ত।
আর এক সেকেন্ড…
লীনা একটা টান দিয়ে ডার্টটা বের করে ফেলল।
ইন্দ্রজিৎ কানে আঙুল দিয়ে চোখ বুজে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু বলল, জিরো…
লীনা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গর্তটার মধ্যেই।
ইন্দ্রজিৎ কান থেকে হাত নামাল, ঘড়ি দেখল, তারপর দু’হাত তুলে চেঁচাতে লাগল, জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা, জয় বাবা মহাদেব… স্যার, আমি যদিও নাস্তিক, কিন্তু ফর দি টাইম বিয়িং… জয় মা দুর্গা, জয় মা কালী, হর হর মহাদেব…
ববি দু’বার উঠবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তার শরীরের গভীর ক্ষতগুলি টাটিয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে স্নায়ুতন্তুজাল। বুকের মধ্যে হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে।
তৃতীয়বার উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ববি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন।
বাঘিনীর মতো উঠে এসে লীনা উপুড় হয়ে পড়ল ববির ওপর। না, শ্বাস চলছে, নাড়ি চলছে। তবে বড় দ্রুত। ববির গায়ে হাত রেখে লীনা বুঝল, অন্তত একশো দুই তিন ডিগ্রি জ্বর।
অবস্থাগতিক দেখে ইন্দ্রজিৎও ববির কাছে হাঁটু গেড়ে বসল, কেমন বুঝছেন?
এখনই কোনও নার্সিং হোম-এ নেওয়া দরকার।
নো প্রবলেম। চলুন ধরাধরি করে ওপরে তুলি। আমাদের গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করা আছে। আমি চট করে নিয়ে আসব গিয়ে।
দু’জনে একরকম চ্যাংদোলা করে ববিকে ধীরে ধীরে ওপরে নিয়ে এল।
দরজার বাইরে পা দিয়েই যে দৃশ্যটা দেখল দু’জনে তাতে লীনা একটা আর্ত চিৎকার দিয়ে চোখ ঢাকল। আর ইন্দ্রজিৎ এমন হা হয়ে গেল যে বলার নয়।
লীনার চিৎকারেই বোধহয় ববির জ্ঞান দ্বিতীয়বার ফিরল। ওরা বারান্দায় শুইয়ে দিয়েছিল তাঁকে। তিনি এবার ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। দু’টি রক্তাক্ত দেহ অনেকটা তফাতে পড়ে আছে। এই দৃশ্যটাই সম্ভবত ববির ভিতরে কিছু উদ্দীপনা সঞ্চার করে দিল। তিনি দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালেন।
লীনা তখনও চোখ ঢেকে কাঁপছে, টলছে।
ববি অনুচ্চ স্বরে বললেন, লীনা, এরা দুজন বেঁচে থাকলে আমাদের কারও শান্তি থাকত না। এ দেশের সরকারেরও নয়। যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে।
লীনা চোখ থেকে হাত সরিয়ে ববির দিকে তাকাল। চোখ ভরা জল। হঠাৎ এই অবস্থাতেও সে একটু হাসল, আমার নামটা তা হলে মনে পড়েছে আপনার!
ববি চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, পড়েছে। আর ভুলব না।
ইন্দ্রজিৎ বিস্ময় কাটিয়ে গিয়ে গাড়িটা নিয়ে এল।
ববি মাথা নেড়ে বললেন, এখনই নয়। যাও ইন্দ্রজিৎ, ছাদটা দেখে এসো। ওখানে একজন স্নাইপার মজুত ছিল। যদিও আমার ধারণা সে পালিয়ে গেছে।
ইন্দ্রজিৎ দৌড়ে ওপরে গেল তারপর ফিরে এসে বলল, কেউ নেই স্যার।
পিছনের বাগানে যে দু’জন পড়ে আছে তাদের একটু খবর নাও। যদি জ্ঞান না-ফিরে থাকে তবে হাত আর পা বেঁধে সেলার-এ ঢুকিয়ে দরজায় তালা দাও।
এসব কাজে ইন্দ্রজিৎ খুবই পাকা এবং নির্ভরযোগ্য। দু’জন সংজ্ঞাহীন লোককে বেঁধে মাটির নীচে একটা অতিরিক্ত ঘরে বন্ধ করে আসতে তার সব মিলিয়ে পঁচিশ মিনিট লাগল।
ববি কলকাতায় এক্স-সার্ভিসমেনদের একটা সিকিউরিটি এজেন্সিকে ফোন করলেন। তারা এসে নীল মঞ্জিলের নিরাপত্তার ভার নেবে এবং দু’জন বন্দিকে তুলে দেবে পুলিশের হাতে। পুলিশকেও তারাই নিয়ে আসবে এখানে।
ববি আর-একটা ফোন করলেন। ট্রাংক কল। দিল্লির প্রতিরক্ষা দফতরে।
লীনা অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, আপনার এখনই মেডিক্যাল অ্যাটেনশন দরকার। কলকাতা অনেক দূর। কেন সময় নষ্ট করছেন? আপনার পিঠের জামা রক্তে ভিজে যাচ্ছে।
ববি লীনার দিকে ঘুম-ঘুম ক্লান্ত চোখে চেয়ে বললেন, ওরা নীল মঞ্জিলের সমস্ত ভার আমাকে দিতে চাইছে।
বিরক্ত লীনা বলল, ওসব পরে শুনব। এখন চলুন।
ববি ধীরে ধীরে হেঁটে গাড়িতে এসে উঠলেন। পিছনের সিটে লীনা তার পাশে বসল। ইন্দ্রজিৎ গাড়ি ছেড়ে দিল।
ববি কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ধীরে ধীরে টলতে লাগলেন।
ইন্দ্রজিৎ রিয়ারভিউ মিররে তাঁকে দেখতে পাচ্ছিল। বলল, শুয়ে পড়ুন স্যার। আপনাকে সাংঘাতিক সিক দেখাচ্ছে। দিদিমণির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ুন। আমি তাকাব না।
রিয়ারভিউ মিররটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল ইন্দ্রজিৎ।
ববির উপায় ছিল না। শরীরটা আপনা থেকেই গড়িয়ে পড়ে গেল লীনার কোলে।
লীনার শরীরে একটা বিদ্যুৎ বহুক্ষণ ধরে বয়ে যেতে লাগল। শিউরে শিউরে উঠল গা। তারপর ধীরে ধীরে এক প্রগাঢ় মায়ায় সে ববির মুখে হাত বুলিয়ে দিল।
ববি নিস্তেজ গলায় বললেন, কিন্তু ওই যে ভ্যাগাবন্ড— তার কী হবে?
লীনা ফিসফিস করে বলল, দোলন? উই ওয়ার নেভার ইন লাভ। আমরা শুধু গত এক বছর ধরে পরস্পরের প্রেমে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছি মাত্র। কিছু হয়নি। আমরা পারিনি।
আর এবার?
লীনা শিহরিত হল মাত্র। তারপর বলল, আমি কিন্তু আর মিসেস ভট্টাচারিয়া নই।
ববি হাসলেন। তারপর বললেন, হাউ অ্যাবাউট মিসেস রায়?