আমি যখন নীচের বাগানে যাই, বলতে লাগলেন বিশাখা চৌধুরী, প্রথমটায় অশোককে কোথায়ও দেখতে পাইনি। তাই ইতস্তত তার সন্ধান করতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে শেষে সেই কামিনী ঝোপের পশ্চাতে গিয়ে উপস্থিত হতেই একটি চাপা সতর্ক নারীকণ্ঠস্বর আমার কানে এল।
নারীকণ্ঠ।
হ্যাঁ।
চিনতে পেরেছিলেন সে নারীকণ্ঠ?
না। কারণ ইতিপূর্বে সে কণ্ঠস্বর কখনও আমি শুনেছি বলে মনে হয় না।
হুঁ। তারপর বলে যান–
শুনতে পেলাম সতর্ক নারীকন্ঠে কে যেন বলছে, এক মুহূর্ত আর এখানে থেকো না। যত তাড়াতাড়ি পার এখান থেকে চলে যাও। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে এবং অন্যান্য মেম্বাররা সব এসে পড়লে তখন মুশকিলে পড়বে। সেই নারীকণ্ঠের প্রত্যুত্তরে শুনলাম কে যেন বললে, কিন্তু হাত-পা আমার পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। পারব না, আমি পালাতে পারব না। তার জবাবে সেই পূর্ব নারীকণ্ঠস্বর এবারে বললে, ছি, তুমি না পুরুষমানুষ! এত ভীতু তুমি! এইটুকু সাহস তোমার নেই? যাও শিগগির পালাও এখান থেকে। এরপর পালাবার আর পথ পাবে না। জবাবে এবার পুরুষ বললে, কিন্তু পালালে কি সকলের সন্দেহ আমার ওপরেই পড়বে না? পূর্ব নারী এবারে জবাব দিল, সে পরের কথা পরে। এখনও পালাও। তাছাড়া একটা কথা ভুলে যাচ্ছকেন, সকলেইতোমার সঙ্গে ওর ইদানীংকার ঘনিষ্ঠতার কথা জানে। এমনিতেও তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না, অমনিতেও না। এই পর্যন্ত বলে বিশাখা চৌধুরী থামলেন।
বলুন, তারপর?
তারপরই একটা দ্রুত পদশব্দ পেলাম, সেটা যেন দূরে চলে গেল ক্রমে ক্রমে।
বলতে বলতে বিশাখা চৌধুরী আবার থামলেন। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।
তারপরই আবার কিরীটী বললে, থামলেন কেন, বলুন যা বলছিলেন মিসেস চৌধুরী।
মিসেস চৌধুরী আবার বলতে শুরু করলেন, তারপর কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন স্তব্ধ অনড় হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
এবং কতকটা তারপর ধাতস্ত হবার পর, অতি সন্তর্পণে সেই কামিনী ঝোপের মধ্যে ঢুকে আরও একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম, পিছন ফিরে কে যেন বেঞ্চের ওপর বসে আছে। আর আশেপাশে দ্বিতীয় জনপ্রাণী নেই। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ভাল করে দেখে নিয়ে তারপর ঝোপ থেকে সন্তর্পণে বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়াতেই, মৃদু চাঁদের আলোয় বেঞ্চের ওপরে উপবিষ্টা মিত্রাকে দেখে যেন চমকে উঠলাম। প্রথমটায় অতটা খেয়াল হয়নি। তারপরই হঠাৎ মনে হল অমন নিঝুম হয়ে মিত্রা বেঞ্চের ওপর বসে আছে কেন? মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে! মনটার মধ্যে কেমন যেন ছাঁত করে উঠল। মৃদুকণ্ঠে ডাকলাম, মিত্রা! মিত্রা! কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। সন্দেহটা এবারে যেন আরও দৃঢ় হল। ভয়টা আরও চেপে বসল। আবার ডাকলাম, মিত্রা! মিত্রা! না, তবু কোন সাড়া-শব্দ এল না মিত্রার দিক থেকে। এবারে সত্যি সত্যিই ভয়ে ও আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা যেন কেমন আমার কেঁপে উঠল। এগিয়ে গিয়ে ওর মাথা স্পর্শ করতেই সভয়ে দুপা পিছেয়ে এলাম। সেই মুহূর্তেই আশঙ্কা আমার দৃঢ় হল, মিত্রা মরে গিয়েছে। এবং মারা গেছে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে সঠিকভাবে আরও চার-পাঁচ মিনিট চলে গেল। হাত পা সবঙ্গ তখন আমার কাঁপছে। হঠাৎ এমন সময় ফিরে আসবার জন্য পা বাড়াতেই আমার পায়ে যেন কী ঠেকল। তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে জিনিসটা হাতে তুলে নিতেই দেখি একটা রেকর্ড সিরিঞ্জ, যা ডাক্তাররা সাধারণত ইনজেকশনের জন্য ব্যবহার করে।
ইনজেকশনের সিরিঞ্জ!
হ্যাঁ, এই যে দেখুন। বলতে বলতে বিশাখা তাঁর হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি কাঁচের রেকর্ড টু সি-সি সিরিঞ্জ বের করে কিরীটীর হাতের উপর তুলে দিলেন।
কিরীটী সিরিঞ্জটা হাতের উপর নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল, আমিও তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। টু সি-সি কাঁচের রেকর্ড সিরিঞ্জ একটা এবং ছোট অত্যন্ত সরু একটা হাইপোডারমিক নীডল তখনও তাতে পরানো আছে। তবে নীডলটা একটু বেঁকে গিয়েছে।
ধীরে ধীরে সিরিঞ্জটা দেখা হয়ে গেলে সামনের টেবিলে রেখে কিরীটী পুনরায় বিশাখা চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল। বললে, তারপর বলুন?
সিরিঞ্জটা ব্যাগের মধ্যে পুরে সোজা আর মুহূর্তকাল দেরি না করে উপরে বার-রুমে চলে এলাম। মাথার মধ্যে তখনও আমার যেন কেমন করছে। মীরজুমলার কাছ থেকে একটা স্টিফ পেগ হুইস্কি গলায় ঢেলে হলঘরে ঢুকে সোফার ওপরে বসে পড়লাম। তারই দু-তিন মিনিট বাদে রঞ্জিত রক্ষিত এসে হলঘরে ঢুকল। সেখান থেকে দু-এক মিনিট বাদেই আমরা আবার এসে এই ঘরে ঢুকি।
তাহলে রঞ্জনবাবুর সঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে আবার আপনি বাইরে গিয়েছিলেন কেন?
প্রেসিডেন্টকে সংবাদটা দিতে।
দিয়েছিলেন তাঁকে সংবাদটা?
না। কারণ তখনও তিনি তাঁর ঘরে এসে পৌঁছাননি। তাই এ ঘরেই আবার আমি ফিরে আসি। এবং তারই দু-এক মিনিট বাদে মহারানী এসে এই ঘরে ঢোকেন।
একটা কথা বিশাখা দেবী, কিরীটী প্রশ্ন করে, বাগানের সেই পুরুষকণ্ঠটি চিনতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ।
কার কণ্ঠস্বর সেটা?
অশোকের।
আর নারীকণ্ঠস্বরটি?
বললাম তো, চিনতে পারিনি।
এখানকার মেম্বারদের কারও গলার সঙ্গেই মেলে না?
না।
আর একবার ভাল করে ভেবে বলুন।
না। কারণ এখানকার কারও কণ্ঠস্বরই আমার অপরিচিত নয় মিঃ রায়।
হুঁ। আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন।
বিশাখা চৌধুরী অতঃপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
এরপর বাকি সকলকে একের পর এক ডেকে দু-চারটি প্রশ্ন করে কিরীটী তাঁদের ছেড়ে দিতে লাগল।
জবানবন্দি নেবার পালা যখন শেষ হল রাত তখন আড়াইটে বেজে গিয়েছে।
একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে কিরীটী বললে, এবারে চল, ওঠা যাক লাহিড়ী। আপাতত উপরের তলার সমস্ত ঘরগুলোতে তালা দিয়ে দুজন কনস্টেবলকে প্রহরায় রেখে দাও। কাল সকালে তোমার থানায় আমি আসছি। পরবর্তী কাজের প্ল্যান সেখানেই আমরা চক-আউট করব।
সেইমতই ব্যবস্থা করে মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে, আমরা বৈকালী সঙ্ঘ থেকে বের হয়ে এলাম এবং রজত লাহিড়ীকে থানায় নামিয়ে দিয়ে কিরীটীর সঙ্গে তার গাড়িতে তারই বাসায় এসে উঠলাম।