১৮৭তম অধ্যায়
শিবসমীপে অম্বার বরলাভ-অগ্নিপ্ৰবেশ
“অনন্তর তপঃপরায়ণ মহর্ষিগণ সেই কন্যাকে সন্দর্শন করিয়া কহিলেন, “হে ভদ্রে! আমরা তোমার কি কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিব?”
“অম্বা কহিলেন, “হে তপোধন! ভীষ্ম আমাকে প্রত্যাখ্যান করিয়া পতিরূপ ধর্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট করিয়াছেন। এক্ষণে আমি তাঁহার বধসাধনাৰ্থ তপস্যায় দীক্ষিত হইয়াছি। অন্যের অনিষ্ট চেষ্টা করা আমার উদ্দেশ্য নহে। আমি একমাত্র ভীস্মকে সংহার করিয়া নিশ্চয়ই শান্তিলাভ করিব। আমি তাঁহা হইতেই পতিলোকবিহীন [ইহকালে পতিরূপ আশ্রয়াশূন্য—পরকালে পতিলোকহীন] হইয়া এইরূপ অবিচ্ছিন্ন দুঃখসমূহ প্রাপ্ত হইতেছি এবং না স্ত্রী না পুরুষ হইয়া ইহলোকে অবস্থান করিতেছি। এক্ষণে আমি ভীষ্মকে বিনাশ না করিয়া কদাচ নিবৃত্ত হইব না, ইহাই আমার অভিলাষ। আমি পুরুষাৰ্থ [ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ] সাধনে উদ্যত হইয়া কেবল স্ত্রীভাব প্রযুক্ত খিন্ন হইতেছি। তথাপি আমি ভীষ্মকে ইহার প্রতিফল প্রদর্শন করাইব, তাহাতে সন্দেহ নাই; আপনারা আমাকে নিবারণ করবেন না।”
“তখন ভগবান শূলপাণি [মহাদেব] স্বীয় আকার পরিগ্রহপূর্ব্বক সেই সমস্ত ব্ৰাহ্মণগণমধ্যে আবির্ভূত হইয়া কন্যার নেত্রপথে দণ্ডায়মান হইলেন এবং কহিলেন, “হে ভদ্রে! তুমি এক্ষণে বর গ্রহণ কর।” অম্বা কহিল, ‘ভগবন! আমি ভীষ্মকে পরাজয় করিতে অভিলাষ করি।” শূলপাণি কহিলেন, “বৎসে! তুমি ভীষ্মকে বিনাশ করিতে সমর্থ হইবে।” অম্বা পুনর্ব্বার কহিল, “হে দেব! আমি স্ত্রীলোক হইয়া কিরূপে জয়লাভে সমর্থ হইব? স্ত্রীভাবসুলভ শান্তরস আমার অন্তঃকরণে নিরন্তর সঞ্চারিত হইতেছে। কিন্তু আপনি ভীষ্মের বধসাধনাৰ্থ বরপ্ৰদান করিলেন; অতএব এক্ষণে যেরূপে ইহা সত্য হয়, তাহার অনুষ্ঠান করুন। আমি যেন সময়ে তাঁহাকে বধ করিতে পারি।” রুদ্র কহিলেন, “হে ভদ্রে! আমার বাক্য মিথ্যা হইবার নহে, অবশ্যই সত্য হইবে। তুমি সংগ্রামে ভীষ্মকে বিনাশ ও পুরুষত্বলাভ করিবে এবং দেহান্তরলাভ হইলেও তোমার পূর্ব্ববৃত্তান্তসমুদয় স্মৃতিপথে আরূঢ় থাকিবে। তুমি দ্রুপদবংশে জন্মপরিগ্রহ করিয়া কালক্রমে ক্ষিপ্রাস্ত্র [দ্রুত অস্ত্রনিক্ষেপে সমর্থ] ও ক্ষিপ্ৰযোধী পুরুষ হইবে। আমি যাহা কহিলাম, তাহার কিছুই অন্যথা হইবে না।” দেবাদিদেব মহাদেব এই কথা বলিয়া বিপ্ৰগণের সমক্ষে সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।
“অনন্তর অম্বা অরণ্য হইতে কাষ্ঠভার আহরণ করিয়া যমুনাদ্বীপে এক উন্নত চিতা প্রস্তুত করিল এবং ঐ চিতায় অগ্নি প্ৰদান করিয়া রোষাবিষ্টমানসে [ক্ৰোধদ্বারা অভিনিবিষ্টচিত্তে] ব্ৰাহ্মণগণসমক্ষে ‘আমি ভীষ্মের বধের নিমিত্ত অগ্নিপ্রবেশ করিতেছি,’ বলিয়া তাহতে প্রবিষ্ট হইল।”