১৮৭. কৃষ্ণাদর্শনে নৃপমণ্ডলীর মোহ
সপ্তাশীত্যধিকশতম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, সেই সমস্ত বলবীৰ্যসম্পন্ন অস্ত্রশিক্ষানিপুণ তরুণবয়স্ক নরেন্দ্ৰবৰ্গ বিচিত্র বেশভূষা সমাধান করিয়া অস্ত্র শস্ত্র ধারণপূর্বক আগমন করিলেন। তাঁহার রূপ, যৌবন, কুল, শীল ও ঐশ্বর্যমদে মত্ত হইয়া মদস্রাবী হৈমবত মাতঙ্গযুথের ন্যায় ঈর্ষাকষাষিতলোচনে পরস্পর বদন নিরীক্ষণ করিয়া স্পর্ধা করিতে লাগিলেন এবং ত্রিভুবনলোমভূতা কৃষ্ণসন্দর্শনে কামমোহিত হইয়া দ্রৌপদী আমারই হইবে বলিয়া, রাজাসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। যেমন দেবগণ পৰ্বতরাজপুত্রী উমাকে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, সমাগত সভাস্থ ভূপালগণ সেইরূপে দ্রৌপদীকে জিগীষা করিতে লাগিলেন। রঙ্গ সমস্ত লোক কৃষ্ণার অনুপম রূপলাবণ্য সন্দর্শনে সিম কন্দর্পণে নিপীড়িত হইয়া তগ তদয়ে নিরন্তর কেবল তাঁহাকেই চিন্তা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা পরাজকুমারীর নিমিত্ত আপন বন্ধুবান্ধবের প্রতি ও ঈর্ষা প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর রুদ্র,আদিত্য, বসুগণ, অশ্বিনীকুমারযুগল, সাধ্য, যম ও কুবের প্রভৃতি দেবগণ বিমানারোহণ পূর্বক রাজসভায় আগমন করিলেন। অসংখ্য দৈত্য, সুপ, মহোরগ, দেবর্ষি, গুহক, চারণ ও বিশ্বাবসু, নারদ, পৰ্বত প্রভৃতি ঋষি, গন্ধর্ব ও অঙ্গরোগণ সমাগত হইয়াছিলেন। বলভদ্র, জনার্দন, বৃষ্ণিবংশীয় যদুশ্রেষ্ঠগণ কৃষ্ণের মতাবলম্বী হইয়া পাণ্ডবগণকে পৰ্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। যদুপ্রবীর কৃষ্ণ ভস্মাবৃত হুতাশনের ন্যায় সেই গজেন্দ্রাকার, পঞ্চপাণ্ডবকে নিরীক্ষণ করিয়া কিয়ৎকাল চিন্তা করিলেন। পরে তিনি যুধিষ্ঠির, ভীম ও নকুল সহদেবের কথা বলদেবকে জানাইলেন। বলদেব তাহাদিগকে দেখিয়া প্রীতমনে কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। কিন্তু অন্যান্য রাজকুমারেরা দুরাশাগ্রস্ত হইয়া কৃষ্ণাতে মন প্রাণ সমুদায় সমর্পণ করিয়াছিলেন, সুতরাং পাণ্ডবদিগকে দর্শন করা দুরে থাকুক তাঁহারা ঈর্ষাকষায়িত ও রোষপরবশ হইয়া অধর দংশনপূর্বক অরক্ত নয়নযুগল ইতস্ততঃ সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবেরও দ্রৌপদীকে নয়নগোচর করিয়া সকলেই কন্দর্পণে অভিভূত হইলেন।
অনন্তর দেবর্ষি ও গন্ধর্বগণে সমাকুল সুপর্ণ, নাগ, অসুর ও সিদ্ধগণ কর্তৃক পরিসেবিত সেই সভাভবন রমণীয় গন্ধে সুবাসিত এবং বিকৗৰ্য্যমনি দিব্য কুসুম সমূহের সুগন্ধে আমোদিত হইল। মহান দুন্দুভিধ্বনিতে গগনমণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইল। চতুর্দিকৃ বিমানসম্বাধ এবং বেণু, বীণা ও পণবনিনাদে পরিপূরিত হইল। কর্ণ, দুৰ্য্যোধন, শা, শল্য, দ্রৌণায়নি, ক্রাধ, সুনীথ, বক্র, কলিঙ্গ, বঙ্গাধিপ, পাণ্ড্য, পৌণ্ড্র বিদেহরাজ ও যবনাধিপ প্রভৃতি অনেকানেক রাজতনয়েরা কিরীট, হার, অঙ্গদ ও চক্ৰবাল প্রভৃতি বিচিত্র অলঙ্কারে অলঙ্কত হইয়া স্ব স্ব বলবীৰ্য্য প্রদর্শন ও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই ভীষণ শরাসনে জ্যা সংযুক্ত করা দূরে থাকুক, কাক সজ্য করিব, এরূপ মনে করিতেও তাঁহারা সমর্থ হইলেন না। সুবিক্রান্ত নরেন্দ্রগণ ধস্পর্শমাত্র আহত ও ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিলেন, তাহাদিগের অঙ্গের আভরণ সকল বিভ্রন্ত হইয়া পড়িল। তাঁহারা নিস্তেজঃ ও হতাশ্বাস হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক ক্রমে ক্রমে শান্তিভাব অবলম্বন করিলেন; কিরীট, হার, বলয়ঙ্গ প্রভৃতি আভরণ সকল অঙ্গ হইতে বিস্রস্ত হইয়া পড়িল এবং দ্রৌপদীলিল। এককালে নিরস্ত হইয়া গেল।
সকল ধনুর্দ্ধরপ্রবর কর্ণ রাজগণের এইরূপ বুখােদ্যম নিরীক্ষণ করিয়া সরে ধঃ উত্তোলনপূর্বক তাহাতে জ্যা সংযুক্ত করিয়া শরাসনে শরসন্ধান করিলেন। পায়ের কর্ণকে নয়নগোচর করিয়া মনে করিলেন, ইনিই লক্ষ্যভেদ করিয়া কন্যারত্ব লাভ করিবেন, সন্দেহ নাই। দ্রৌপদী কর্ণের ব্যবসায় দর্শনে মুক্তকণ্ঠে কহিলেন, আমি সূতপুত্রকে বরণ করিব না; এই কথা শ্রবণমাত্র ক সামর্ষহাস্যে সূৰ্যসন্দর্শনপূর্বক শরাসন পরিত্যাগ করিলেন।
এইরূপে সমুদায় ক্ষত্রিয়বর্গ বিফল প্রযত্ন হইয়া প্রস্থান করিলে পর, চেদিদেশাধিপতি শিশুপাল শরাসনে শরসন্ধান করিতে উদ্যত হইলেন, কিন্তু অবশেষে ভগ্নজা হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন। মহাবীৰ্য্য জরাসন্ধও ঐ প্রকারে ধনুরাঘাতে ভূতলে পতিত হইলেন, পরে গাত্রোত্থানপূর্বক আপন রাজ্যে প্রস্থান করিলেন। মাধিপতি শল্যও সেই ধনুকে জ্যা রোপণ করিতে গিয়া জানু পাতিয়া ভূতলে পতিত হইলেন। এইরূপে সভাস্থ সমস্ত নাধিপগণ ক্রমে ক্রমে পরাঙ্মুখ হইলে কুন্তীনন্দন অর্জুন সেই শরাসনে জ্যা-রোপণ ও শরসন্ধানের মানস করিলেন।