১৮৩তম অধ্যায়
পার্থপ্রতি শক্তিপ্রয়োগে কর্ণের ঔদাসীন্যকারণ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সূতপুত্ৰ কৰ্ণ কি নিমিত্ত সকলকে পরিত্যাগ করিয়া একমাত্র অর্জ্জুনের প্রতি সেই একপুরুষঘাতিনী শক্তি নিক্ষেপ করিল না? ধনঞ্জয় নিহত হইলে সৃঞ্জয় ও পাণ্ডবগণ বিনষ্ট ও জয়শ্রী আমাদেরই হস্তগত হইত। পূর্ব্বে অর্জ্জুন প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, আমি যুদ্ধে আহূত হইয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইব না। অতএব তাহাকে সমরে আহ্বান করা কর্ণের অতি কর্ত্তব্য ছিল। মহাবীর কর্ণ কি নিমিত্ত ধনঞ্জয়কে আহ্বানপূর্ব্বক দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবর্ত্তিত করিয়া বাসবদত্ত শক্তিদ্বারা সংহার করিল না? আমার আত্মজ দুৰ্য্যোধন নিতান্ত নির্বোধ ও সহায়শূন্য এবং বিপক্ষেরা তাহাকে একান্ত নিরুপায় করিয়াছে; সুতরাং সেই নরাধম কিরূপে শত্ৰুসংহার করিবে? সে যে শক্তির উপর নির্ভর করিয়া বিজয়লাভে অভিলাষ করিত, বাসুদেব কৌশলক্রমে সেই দিব্যশক্তি রাক্ষস ঘটোৎকচের প্রতি নিক্ষেপ করাইয়া উহা একান্ত নিষ্ফল করিয়াছেন; যেমন পরস্পর যুদ্ধে প্রবৃত্ত বরাহ ও কুক্কুরের অন্যতরের মৃত্যু হইলে চণ্ডালেরই লাভ হইয়া থাকে, তদ্রুপ কর্ণ ও ঘটোৎকচ এই দুইজনের মধ্যে অন্যতম বীর বিনষ্ট হইলে বাসুদেবেরই পরমলাভ সন্দেহ নাই। যদি ঘটোৎকচ কর্ণকে বিনাশ করিতে পারে, তাহা হইলে পাণ্ডবগণের অতিশয় উপকার হয়, অথবা যদি মহাবীর কর্ণ ঘটোৎকচকে সংহার করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলেও তাহার একপুরুষঘাতিনী শক্তির বিনাশে পাণ্ডবগণের হিতকর কাৰ্য্য সাধন করা হয়, বাসুদেব বুদ্ধিবলে এইরূপ অবধারণ করিয়া পাণ্ডবগণের হিতসাধনের নিমিত্তই সূতপুত্রদ্বারা ঘটোৎকচের বিনাশসাধন করিয়াছেন, সন্দেহ নাই।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর কর্ণ শক্তিদ্বারা অর্জ্জুনকেই সংহার করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়াছিলেন। মহাবুদ্ধিসম্পন্ন জনার্দ্দন কর্ণের এই অভিলাষ অবগত হইয়া সেই অমোঘশক্তি প্রতিহত করিবার নিমিত্ত মহাবলপরাক্রান্ত ঘটোৎকচকে তাঁহার সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে নিয়োজিত করিয়াছিলেন। যদি তিনি তৎকালে কর্ণের হস্ত হইতে মহারথ অর্জ্জুনকে রক্ষা না করিতেন, তাহা হইলে আমরা নিঃসন্দেহে কৃতকাৰ্য্য হইতাম। হে কুরুরাজ! সেই যোগিগণের ঈশ্বর বাসুদেব ঐরূপ কৌশল না করিলে ধনঞ্জয় অশ্ব, ধ্বজ ও রথের সহিত কর্ণের হস্তে কলেবর পরিত্যাগ করিতেন, সন্দেহ নাই। অর্জ্জুন কৃষ্ণের উপায়বলেই রক্ষিত হইয়া সম্মুখীন শত্রুগণকে পরাজিত করিয়া থাকেন। অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন বাসুদেবই সেই অব্যর্থ শক্তি হইতে অর্জ্জুনকে রক্ষা করিয়াছিলেন, নচেৎ উহা বজ্রাহত বৃক্ষের ন্যায় তাঁহাকে নিপতিত করিত।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমার আত্মজ দুর্য্যোধন নিতান্ত বিরোধী [বিবাদপ্রিয়], কুমন্ত্রণাপরতন্ত্র ও প্রজ্ঞাভিমানী [স্বয়ং বুদ্ধিমান বলিয়া অহঙ্কারী], তাহার নিমিত্তই এই অর্জ্জুনের বধোপায় নিষ্ফল হইয়াছে। যাহা হউক, মহাবীর কর্ণ সকল শস্ত্রধারিগণের অগ্রগণ্য ও মহাবুদ্ধিসম্পন্ন, সে কি নিমিত্ত অর্জ্জুনের প্রতি সেই অমোঘশক্তি প্রয়োগ করিল না? হে সঞ্জয়! তুমিও কি এই বিষয় বিস্মৃত হইয়াছিলে? তুমি কেন ইহা তৎকালে কর্ণকে স্মরণ করাইয়া দিলে না?”
তখন সঞ্জয় রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন, শকুনি, দুঃশাসন ও আমি, আমরা প্রতি রাত্রিতেই সূতপুত্রকে কহিতাম, হে কর্ণ! তুমি সমস্ত সৈন্য পরিত্যাগপূর্ব্বক ধনঞ্জয়কে সংহার কর; তাহা হইলে আমরা পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে কিঙ্করের ন্যায় নির্দেশানুবর্তী করিতে পারিব। অথবা অর্জ্জুন বিনষ্ট হইলেও কৃষ্ণ পাণ্ডবগণের অন্যতমকে সমরে দীক্ষিত করিবেন; অতএব তুমি অর্জ্জুনকে বিনষ্ট করিয়া কৃষ্ণকেই বিনাশ কর। কৃষ্ণ পাণ্ডবগণের মূলস্বরূপ এবং পাঞ্চালেরা পত্রস্বরূপ। পাণ্ডবদিগের কৃষ্ণই আশ্রয়, কৃষ্ণই বল, কৃষ্ণই নাথ এবং কৃষ্ণই পরমগতি। অতএব হে কর্ণ! তুমি পর্ণ, শাখা ও স্কন্ধ পরিত্যাগ করিয়া মূলস্বরূপ কৃষ্ণকে বিনাশ কর। যদি বাসুদেব নিহত হইয়া সমরশয্যায় শয়ন করেন, তাহা হইলে শৈল, সাগর ও অরণ্যপরিশোভিত সমুদয় বসুন্ধরা তোমার বশবর্তী হইবে, সন্দেহ নাই।’ হে মহারাজ! আমরা প্রতি রজনীতেই হৃষীকেশকে সংহার করিবার নিমিত্ত এইরূপ অবধারণ করিতাম, কিন্তু যুদ্ধকালে উহার সম্যক পরিবর্ত্তন হইয়া যাইত। মহাত্মা বাসুদেব সতত ধনঞ্জয়কে রক্ষা করিয়া থাকেন; তিনি সূতপুত্রের সমক্ষে তাঁহাকে অবস্থাপিত করিতেন না। তিনি সেই অমোঘশক্তি নিষ্ফল করিবার নিমিত্ত অন্যান্য রথীদিগকে কর্ণের সহিত সমরে প্রবর্ত্তিত করিতেন। হে মহারাজ! যখন বাসুদেব এইরূপে কর্ণের হস্ত হইতে অর্জ্জুনকে রক্ষা করেন, তখন যে তিনি আত্মরক্ষায় উপেক্ষা প্রদর্শন করিবেন, কদাচ ইহা সম্ভবপর নহে। ফলতঃ আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম যে, জনার্দ্দনকে পরাজিত করিতে সমর্থ, এমন কেহই এই ত্রিলোকমধ্যে জন্মগ্রহণ করেন নাই।
“হে কুরুরাজ! ঘটোৎকচ বধের পর সত্যবিক্রম সাত্যকি কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘হে বাসুদেব! কর্ণ ধনঞ্জয়ের প্রতি সেই অমিতপরাক্রম শক্তি প্রয়োগ করিবে বলিয়া স্থিরনিশ্চয় করিয়াছিল, কিন্তু কি নিমিত্ত তাহার অন্যথাচরণ করিল?’ বাসুদেব সাত্যকির এই কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে শিনিপ্রবীর! দুঃশাসন, শকুনি ও জয়দ্রথ দুর্য্যোধনের সহিত পরামর্শ করিয়া সতত কর্ণকে কহিত, “হে সূতপুত্র! তুমি কুন্তীনন্দন ধনঞ্জয় ভিন্ন অন্য কাহারও প্রতি এই শক্তি কদাচ প্রয়োগ করিও না। ধনঞ্জয় দেবগণমধ্যে সুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় পাণ্ডবগণমধ্যে সাতিশয় যশস্বী; তাহাকে সংহার করিতে পারিলে সৃঞ্জয় ও পাণ্ডবগণ হুতাশনবিহীন সুরগণের ন্যায় বিনষ্টপ্রায় হইবে সন্দেহ নাই।” হে সাত্যকে! দুঃশাসনপ্রমুখ কৌরবপক্ষীয় বীরগণ বারংবার এইরূপ কহিলে কর্ণও তাহাদের বাক্যে অঙ্গীকার করিয়াছিল এবং এই শক্তিদ্বারা ধনঞ্জয়েরই বধসাধন করিতে মহা হইবে ইহা সততই তাহার অন্তঃকরণে জাগরূক থাকিত; কিন্তু আমি তাহাকে বিমোহিত করিলাম বলিয়াই সে অর্জ্জুনের প্রতি সেই শক্তি প্রয়োগ করে নাই। হে শৈনেয়! আমি যে পর্য্যন্ত না অর্জ্জুনের এই মৃত্যুর প্রতিকার করিয়াছিলাম, ততদিন আমার নিদ্রা ও হর্ষ এককালে তিরোহিত হইয়াছিল। এক্ষণে সেই অমোঘশক্তি রাক্ষসরাজ ঘটোৎকচের প্রতি প্রযুক্ত হইয়াছে দেখিয়া ধনঞ্জয়কে কৃতান্তের করাল-আস্যদেশ হইতে আচ্ছিন্ন বলিয়া বোধ হইতেছে। ধনঞ্জয়কে রক্ষা করা আমার যেমন কর্ত্তব্য, আপনার জীবন এবং পিতা, মাতা, ভ্রাতা ও তোমাদিগকে রক্ষা করা তদ্রূপ নহে। অধিক কি, বিশ্বরাজ্য অপেক্ষাও যদি কোন বস্তু দুর্লভ থাকে, আমি অর্জ্জুনবিহীন হইয়া তাহাও প্রার্থনা করি না। হে যুযুধান! ধনঞ্জয়কে পুনর্জীবিতের ন্যায় নিরীক্ষণ করিয়া আমার এইরূপ গুরুতর হর্ষ উপস্থিত হইয়াছে। রাত্রিকালে কর্ণকে নিবারণ করিতে পারে, ঘটোৎকচ ভিন্ন এমন আর কেহই নাই; এই নিমিত্তই আমি ভীমতনয়কে যুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলাম।
“হে মহারাজ! ধনঞ্জয়ের হিতানুষ্ঠানপরতন্ত্র মহাত্মা বাসুদেব সাত্যকিকে তৎকালে এইরূপ কহিয়াছিলেন।”