১৮১তম অধ্যায়
সৰ্প যুধিষ্ঠির-ধর্ম্মসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সৰ্প আপনি নিখিল বেদবেদাঙ্গের পারদর্শী, অতএব কি কর্ম্ম করিলে সদগতিলাভ হয়, অনুগ্রহ করিয়া বলুন।”
সৰ্প কহিল, “হে যুধিষ্ঠির! আমার মতে অহিংসাপর হইয়া সত্য ও প্ৰিয়বাক্যের সহিত সৎপাত্রে দান করিলে স্বর্গলাভ হয়।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দান ও সত্য, ইহার মধ্যে কোনটি প্রধান এবং অহিংসা ও প্রিয়, ইহার মধ্যেই বা কোনটির গৌরব অধিক?”
সৰ্প কহিল, “হে রাজেন্দ্র! দান, সত্য, তত্ত্ব, অহিংসা ও প্রিয় ইহাদের পরস্পর ফলের সহিত তুলনা করিয়া গৌরব ও লাঘব বিবেচনা করিতে হয়। কোনপ্রকার দান অপেক্ষা সত্যই উৎকৃষ্ট, কখন সত্য অপেক্ষা কোনপ্রকার দানও গুরুতর; এইরূপ কোন স্থলে প্রিয়বাক্য অপেক্ষা অহিংসার গৌরব অধিক, কোন স্থলে বা অহিংসার অপেক্ষা সত্যের মাহাত্ম্য অধিক। হে যুধিষ্ঠির! এক্ষণে তোমার আর কি অভিপ্ৰায় আছে, বল।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সৰ্পবর! আত্মা শরীরশূন্য হইয়া কি প্রকারে স্বর্গে গমন ও স্থিরতর কর্ম্মফলভোগ করে, এবং তাহার তৎকালোপভোগ্য বিষয় সকলই বা কি প্রকার?”
সৰ্প কহিল, “হে রাজন! মানব-জাতির স্বকর্ম্মনির্দ্দিষ্ট গতি তিন প্রকার;—মানবজন্মপ্রাপ্তি, স্বৰ্গলাভ ও তিৰ্য্যগ্যোনিপ্রাপ্তি। নিরালস্য হইয়া অহিংসা ও দানাদিকর্ম্ম করিলে নরলোক হইতে মুক্ত ও স্বৰ্গলাভ হয়; ইহার বিপরীতকর্ম্ম মনুষ্যজন্মের কারণ; আর তিৰ্য্যগ্যোনিপ্রাপ্তির পক্ষে যে-সকল বিশেষ কারণ নিৰ্দ্ধারিত আছে, শ্রবণ কর। কাম, ক্ৰোধ, হিংসা ও লোভাপরায়ণ ব্যক্তি মনুষ্যত্ব হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া তিৰ্য্যগযোনিতে জন্ম পরিগ্রহ করে। তিৰ্য্যগযোনি হইতে মুক্ত হইলে মনুষ্যজন্মলাভ হয়; কিন্তু কখন কখন গো, অশ্ব প্রভৃতি জন্তুগণকে একেবারে দেবত্বলাভ করিতে দেখা গিয়াছে; অতএব জীবসকল কর্ম্মবশতঃই এতাদৃশ গতিপ্ৰাপ্ত হইয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে থাকে। দেহাভিমানী আত্মা সুখকামনায় পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করিয়া দেহযোগ-জনিত ফলভোগ করে; কিন্তু নিষ্কাম ব্যক্তি অন্তঃকরণে শুদ্ধতাতিশয় নিবন্ধন সংসারের যথার্থ তত্ত্ব অনুভব করিয়া কর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক সনাতন পুরুষে জীবাত্মাকে সমাহিত করেন।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে মহামতো! আত্মা কিরূপে শব্দ, রূপ, রস ও গন্ধ গ্রহণ করেন, আর এই সকল বিষয় যুগপৎ গ্রহণ করা যায় কি না, বিশেষ করিয়া বলুন।”
সৰ্প কহিল, “হে নরবীর! আত্মা যখন দেহ ও করণবিশিষ্ট হয়েন, তখন তিনি বিষয়-সকল যথাবিধি উপভোগ করেন। তাঁহার ভোগাধিকরণ দেহে, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মন এই তিনটি করণ। জীবাত্মা শরীরাধিষ্ঠিত হইয়া ইন্দ্ৰিয়সংসত্তা মনদ্বারা ক্ৰমে ক্ৰমে শব্দাদি বিষয়-সকল পরিগ্রহ করেন; এই জন্য মন বিষয়গ্ৰহণে বুদ্ধিকর্ত্তৃক ব্যাপৃত হয়; এই জন্য মন কালভেদবশতঃ যুগপৎ সকল বিষয় গ্রহণ করিতে পারে না; বুদ্ধিও স্বতন্ত্র নহে। আত্মা ভূদ্বয়ের মধ্যবর্ত্তী হইয়া বিষয়াধিকরণ-দ্রব্যে উত্তমাধ্যম বুদ্ধি প্রেরণ করেন। পণ্ডিতেরা যুক্তি ও অনুভবদ্বারা বুদ্ধির পরীক্ষণেও যে জ্ঞানের উপলব্ধি করিয়া থাকেন, উহাই বুদ্ধি হইতে পৃথক জীবাত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সৰ্প মন ও বুদ্ধির লক্ষণ নিরূপণ করাই অধ্যাত্মবিৎ ব্যক্তিদিগের প্রধান কাৰ্য্য, আপনি উহা বিশেষ অবগত আছেন; অতএব মন ও বুদ্ধির লক্ষণ কি বলুন?”
সৰ্প কহিল, “হে যুধিষ্ঠির! বুদ্ধি আত্মার নিতান্ত অনুগত ও আশ্রিত, ব্যতিক্রমের বিধেয় এবং ইচ্ছার প্রয়োজক। মন একেবারে উৎপন্ন হইয়াছে; কিন্তু বুদ্ধি কাৰ্য্য হইতে উৎপন্ন হইতেছে; মন গুণসম্পন্ন, বুদ্ধি নির্গুণ; অতএব মন ও বুদ্ধির যে প্রভেদ, অতএব এ-বিষয়ে আর কি বোধ করিতেছ?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “কি আশ্চৰ্য্য! আপনি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও বেদিতব্য বিষয়ে অদ্বিতীয় অভিজ্ঞ হইয়াও কি নিমিত্ত প্রশ্ন করিতেছেন? আপনি স্বৰ্গবাসী ও সর্ব্বজ্ঞ, তথাপি মোহ কি প্রকারে আপনাকে অভিভূত করিল? আপনি ব্রাহ্মণের অবমাননারূপ অদ্ভুত কর্ম্ম করিয়াছেন, ইহা কোনমতেই বিশ্বাস হয় না।”
সৰ্প কহিল, “আমি নিশ্চয় জানি, সম্পদ প্রজ্ঞাসম্পন্ন শৌৰ্য্যশালী মনুষ্যকেও মোহিত করিয়া রাখে, মনুষ্যেরা সুখে আসক্ত হইলেই মুগ্ধ হইয়া থাকে। এই জন্য আমিও সেইরূপ ঐশ্বৰ্য্যমদে মত্ত হইয়াছিলাম, এক্ষণে পতিত হইয়া চৈতন্য হওয়াতে তোমাকেও সচেতন করিয়া দিতেছি। হে মহারাজ! তুমি আমার সহিত সাধু সম্ভাষণপূর্ব্বক আমাকে এই দুৰ্ম্মোচ্য ঘোরতর শাপ হইতে মুক্ত করিয়া অসাধারণ কাৰ্য্যসাধন করিলে।
অজগরের অগস্ত্য-শাপবৃত্তান্ত
“পূর্ব্বে আমি দেবলোকে দিব্য বিমানারোহণে বিচরণ করিতাম, অভিমানে মত্ত হইয়া কাহাকেও লক্ষ্য করিতাম না। দেব, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষস, পান্নগ, ব্রহ্মর্ষি ও ত্ৰিলোকনিবাসী সমুদয় লোক আমাকে কর প্রদান করিত। আমার ঈদৃশ দৃষ্টিশক্তি জন্মিয়াছিল যে, মানবগণকে অবলোকন করিবামাত্র তাহার তেজ হরণ করিতাম। সহস্ৰ সহস্ৰ ব্ৰহ্মর্ষি আমার শিবিকা-বহন করিত। এই প্রকার অবিনয়ই আমাকে শ্ৰীভ্রষ্ট করিয়াছে।
“একদিন অগস্ত্য মুনি আমার শিবিকা-বহন করিতেছিলেন, আমি সেই সময়ে তাঁহাকে পাদদ্বারা স্পর্শ করিয়াছিলাম, তিনি সেই পাদস্পর্শে রোষাভিভূতচিত্তে আমাকে ‘সর্প হইয়া পতিত হও’ বলিয়া শাপ প্ৰদান করিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ হীনতেজা ও ভুজঙ্গ হইয়া বিমান হইতে অধোমুখে নিপতিত হইলাম তখন আমি আপন দুরবস্থা বুঝিতে পারিয়া তাঁহার নিকটে পাপবিমোচন প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। “হে ভগবান! আমি অনবধানতাদোষে বিমূঢ় হইয়া এই অপরাধ করিয়াছি, আপনি ক্ষমা করুন।” তখন তিনি আমাকে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া কারুণ্যরসবশংবদ হইয়া কহিলেন, ‘ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমাকে শাপমুক্ত করিবেন। তোমার এই অহঙ্কারজনিত ঘোর পাপের ফলভোগ, পৰ্য্যবসিত হইলে পুনরায় পুণ্যফল ভোগ করিবে।”
“আমি তাদৃশ তপোবল, ব্ৰহ্মপরায়ণতা ও ব্রাহ্মণত্ব দর্শন করিয়া বিস্ময়রসে প্লবমান হইলাম, এবং এই নিমিত্তই তোমাকে প্রশ্ন করিয়াছিলাম। সত্য, দম, তপ, দান, অহিংসা ও ধর্ম্মনিত্যতাই পুরুষাৰ্থসাধক, জাতি ও কুল কোন কাৰ্য্যকারক নহে। হে যুধিষ্ঠির! তোমার এই মহাবল ভ্রাতার ও তোমার কল্যাণ হউক, আমি এক্ষণে সুরলোকে গমন করি।”
নহুষরাজ আত্মবৃত্তান্ত বর্ণনপূর্ব্বক অজগরকলেবর পরিত্যাগ ও দিব্য-বিগ্ৰহ পরিগ্রহ করিয়া দিব্যধামে গমন করিলেন। পরে রাজা যুধিষ্ঠির, ভীমসেন ও ধৌম্য-সমভিব্যাহারে আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তত্ৰস্থ সমস্ত দ্বিজগণকে অজগর বিবরণ বিবৃত করিয়া কহিলেন। দ্বিজগণ, অর্জ্জুনাদি ভ্রাতৃত্ৰয় ও দ্রুপদনন্দিনী সেই বৃত্তান্ত-শ্রবণে অত্যন্ত লজ্জিত হইলেন। দ্বিজাতিগণ ভীমসেনের অসমসাহসিক কর্ম্মের নিমিত্ত তাঁহাকে নিন্দা করিয়া কহিলেন, ভমিসেন! ঈদৃশ কর্ম্ম আর কদাচ করিও না। পাণ্ডবগণ বিপদবিনির্মুক্ত ভীমসেনকে অবলোকন করিয়া প্রীতিপ্ৰফুল্লচিত্তে তাঁহার চিত্তবিনোদনের নিমিত্ত তথায় ক্রীড়া করিতে লাগিলেন।
অজগরপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত