সন্তু সারা রাত না ঘুমিয়ে ছটফট করল। কাকাবাবু কী করে অদৃশ্য হয়ে গেছেন, তা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মানুষ কখনও অদৃশ্য হতে পারে না। কাকাবাবু নিশ্চয়ই কোনও খাদের মধ্যে পড়ে গেছেন। অথচ, সেখানে কাছাকাছি কোনও খাদের চিহ্নও নেই।
মাঝে মাঝে তন্দ্রার মধ্যে সন্তু একটা স্বপ্নই দেখতে লাগল বারবার। সে নিজে যেন বরফের মধ্যে গেথে যাচ্ছে, তারপর এক সময় তার পা ঠেকে যাচ্ছে লোহার পাতের মতন কোনও শক্ত জিনিসে।
তারপর তন্দ্ৰা ভেঙে গেলেই সন্তুর মনে হয়, এটা তো স্বপ্ন নয়, সত্যি। সে সত্যিই তো একবার বরফের মধ্যে ড়ুবে যাচ্ছিল এই রকমভাবে।
ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে সে মিংমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলল।
মিংমা ঘুমোয় একেবারে পাথরের মতন, আবার একটু ডাকলেই সে তড়াক করে উঠে বসে। দুহাতে চোখ রাগড়াতে রাগড়াতে সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, সন্তু সাব, তুমি নিদ যাওনি?
সন্তু বলল, মিংমা, কাকাবাবু যেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, সে জায়গাটা তুমি তো খুঁড়ে দেখলে। সেখানে পাথর ছিল, লোহার মতন কিছু দেখতে পাওনি?
মিংমা বলল, না, সন্তু সাব, শুধু পাত্থরই ছিল।
আমার যে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না! আচ্ছা মিংমা, আমি একদিন যেখানে বরফের মধ্যে ড়ুবে যাচ্ছিলাম, সেই জায়গাটা তোমার মনে আছে?
সেখানে তো একটা রুমালের নিশানা রেখে এসেছিলাম, কী জানি সেটা বরফে চাপা পড়ে গেছে কি না। বাতাসেভি উড়ে যেতে পারে।
চলো, এক্ষুনি সেই জায়গাটা খুঁজে বার করতে হবে।
কিন্তু আংকলসোব যেখান থেকে গায়েব হয়ে গেলেন, সেখান থেকে তো ও জায়গাটা বহুত দূরে
তা হোক! তবু সে জায়গাটা পেলেই আমার চলবে।
সন্তু সাব, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। বরফক নীচে পে পাখির থাক কি লোহা থাক, তাতে কী ফারাক আছে?
বরফের নীচে পাথরই থাকে, লোহা থাকে না। যদি লোহার পাত থাকে, সেটা অস্বাভাবিক। সেটা ভাল করে দেখা দরকার। চলো, শাবল-গাঁইতি নিয়ে আমরা এখুনি বেরিয়ে পড়ি।
এখুনি? আগে হেলিকপটার আসুক। রানা সাব আর ভার্মা সাব ওয়াপস আসবেন বলেছেন।
ওদের আসতে যদি দেরি লাগে? তার আগে চলো, আমরা জায়গাটা খুঁজে দেখি
তার আগে একটু চা খেয়ে নিই কম। সে কম? এতনা ঠাণ্ডার মধ্যে একটু চা না খেলে যে হাত-পা চলবে না।
তাহলে তাড়াতাড়ি চা বানাও!
গম্বুজের মধ্যে জিনিসপত্র সবই আছে। স্পিরিট স্টেভ জেলে মিংমা গরম জল চাপিয়ে দিল।
সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়ে লাফাতে লাগল জোরে জোরে। এতে শরীরের আড়ষ্টতা কাটে, খানিকটা গা গরম হয়।
একবার সে ভাবল, মিংমার চা তৈরি হতে হতে সে বাইরে গিয়ে একটু ছুটে আসবে গম্বুজটার চারদিকে।
সে গিয়ে গম্বুজটার দরজা খুলতে যেতেই মিংমা বলল, দাঁড়াও সন্তু সাব, একেলা যেও না, আমরা দুজনে সাথ সোথ বাইরে যাব।
সন্তু বলল, আমি বেশিদূর যাচ্ছি না, এই বাইরে একটুখানি!
সন্তু লোহার দরজাটা খুলল। তারপর খুব সাবধানে মুখ বাড়াল বাইরে। এখনও ভাল করে রোদ ওঠেনি, বাইরে নরম, ঠাণ্ডা আলো। দূরে কালাপাথর পাহাড়টার রং এখন লালচে হয়ে গেছে।
দরজাটা ভাল করে খুলে সন্তু এক পা বাইরে এসে দাঁড়াল। কেন যেন অকারণেই তার গা ছমছম করছে। চারদিক এমন নিস্তব্ধ বলেই বুঝি ভয় হয়। রাত্তির বেলাও কোনও শব্দ শোনা যায়নি।
ডান দিকে তাকিয়েই সন্তু চমকে উঠল। গম্বুজের পাশের চাতালে একগাদা মুর্গির পালক ছড়ানো। শুধু পালক নয়, চোখ আর চামড়া সমেত মুর্গির মুণ্ডুও দু-তিনটে।
সন্তু চাপা গলায় ডাকল, মিংমা—
তারপর আর উত্তরের অপেক্ষা না করে সে দৌড়ে চলে এল ভেতরে। মিংমা তখন চা ছাঁকতে শুরু করেছে। সন্তুকে দৌড়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কেয়া হুয়া?
সন্তু বলল, পালক, অনেক পালক…
মিংমা কিছুই বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বললে সন্তু সাব? পালক? কিসক পালক? পালক দেখে তোমার ডর লাগল?
সন্তু বলল, মুর্গির পালক। এখানে এল কী করে? কারা যেন মুর্গির গলা মুচড়ে মেরেছে?
মিংমা প্ৰথমে মাথা নিচু করে একটু ভাবার চেষ্টা করল। তবু ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকাল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, চা ঠাণ্ডা হো জায়গা। আগে চা পিয়ে লাও
সন্তু চায়ের গেলাসটা ধরে রাখতে পারছে না, এমনই হাত কাঁপছে তার! সব ব্যাপারটাই তার কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছে। সে হলফ করে বলতে পারে, কাল বিকেল পর্যন্ত ওখানে কোনও মুর্গির পালক ছিল না। তাছাড়া এই বরফের দেশে মুর্গির পালক আসবেই বা কী করে?
চায়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দশেক বিস্কুট খেয়ে ফেলল মিংমা। তারপর প্রায় বিড়ির সমান একটা চুরুট বার করে ধরিয়ে আরামে দুবার টান দিয়ে বলল, এবার চলো তো সন্তু সাব, দেখি কোথায় তোমার মুর্গির পালক।
সন্তু আর মিংমা বেরিয়ে এল বাইরে। হাওয়ায় মুর্গির পালকগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। আস্ত মুণ্ডু থেকে চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মনে হয়। কেউ যেন ওদের গলা টিপে মেরেছে।
মিংমা একটা ছোট্ট শিস দিয়ে বলল, বড়ি তাজব কী বাত! ইধার মুগা কেউন লায়ে গা? জিন্দা মুগা
তারপর তারা দুজনেই একসঙ্গে পরের জিনিসটি দেখতে পেল। বরফ মেশা বালিতে টাটকা পাঁচ-ছটা খুব বড় পায়ের ছাপ! দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকাল, একটাও কথা না বলে দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে দৌড়ে ফিরে এল গম্বুজটার মধ্যে। মিংমা দাড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজাটা। নিজের বুকের ওপর এক হাত চেপে ধরে বলল, ইয়েটি! ইয়েটি! ইয়েটি!
সন্তু বলল, আমাদের কাছে রিভলভার নেই, কোনও অস্ত্র নেই!
মিংমা আবার বলল, ইয়েটি! ইয়েটি!
সন্তু বলল, ইয়েতি মুগা খায়! কিন্তু এখানে মুর্গি পেল কী করে?
মিংমা খানিকটা দম নিয়ে বলল, হেলিকপটার নেহি আনে সে-আমরা বাহার যেতে পারব না।
সন্তু বলল, ইয়েতিটা কি এখনও এখানে আছে? কোনও সাড়া-শব্দ শুনতে পাইনি। আচ্ছা মিংমা, ইয়েতি কি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে? মানে, ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে?
মিংমা একটা হাত ঘুরিয়ে বলল, কেয়া মালুম!
তারপর আরও ঘণ্টা-দেড়েক ওরা রইল গম্বুজের মধ্যে বন্দী হয়ে। দুজনেই বসে থাকলে ওপরে জানলাটার কাছে ঠেসাঠেসি করে, কিন্তু হেলিকপটারের কোনও পাত্তা নেই। ইয়েতিরও কোনও চিহ্ন নেই। সেটা কি লুকিয়ে আছে। ওদের ধরবার জন্য?
সন্তুর আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেল। একসময় তার মনে হল, এরকমভাবে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে বাইরে গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করাও অনেক ভাল। এর আগে সে যত ইয়েতির গল্প পড়েছে, তাতে কোনও ইয়েতিই কিন্তু মানুষকে মারেনি। ইয়েতি মানুষের কাছে দেখা দিতে চায় না। এখানকার ইয়েতি রাত্তিরবেলা গম্বুজের ধারে বসে মুর্গি খেয়ে গেছে, কিন্তু ওদের কোনওরকম বিরক্ত করেনি।
সন্তু বলল, মিংমা চলো, বাইরে যাই!
মিংমা বলল, আভি? দাঁড়াও, হেলিকপটার জরুর আসবে।
সন্তু তাকে কিছু না বলে নেমে গিয়ে খুলে ফেলল। গম্বুজের দরজাটা। মিংমাও নেমে এসে জিজ্ঞেস করল, কী করছ, সন্তু সাব?
সন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। সে লক্ষ করল, ভয়ে তার বুক কাঁপছে না। আর। সে দৌড়ে গোল করে ঘুরে এল গম্বুজটা। সেখানে কেউ নেই।
সন্তু এবার বলল, মিংমা, সেই জায়গাটা খুঁজতে যাবে?
মিংমা বলল, কোন জায়গা?
যেখানে তুমি রুমালের নিশানা রেখেছিলো।
আর একটু ঠারো। হেলিকপটার এসে যাক।
না, আর আমার দেরি করতে ভাল লাগছে না। তুমি যাবে তো চলো।
সন্তু গম্বুজের মধ্যে ঢুকে একটা স্নো-অ্যাক্স নিয়ে বেরিয়ে এল। সে যাবেই দেখে মিংমাও অগত্যা জিনিসপত্র নিয়ে আসতে লাগল তার পিছু পিছু। সন্তু সোজা হাঁটছে। দেখে মিংমা এক সময় বলল, ডাহিনা, ডাহিনা চলো, সন্তু সাব।
অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করল ওরা দুজনে। কোথাও সেই লাল রুমালের চিহ্ন নেই। ইয়েতির ভয়ে ওরা বারবার পেছন ফিরে চেয়ে সব দিক দেখে নিচ্ছে। আকাশে আজ বেশ চড়া রোদ, সব দিক পরিষ্কার, এর মধ্যে কারুর কোথাও লুকিয়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সন্তুর বারবার মনে হচ্ছিল, হয়তো এই বিশাল প্ৰান্তরের মধ্যে সে কোথাও কাকাবাবুকে শুয়ে থাকতে দেখবে। কাকাবাবু তো আর সত্যিই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন না।
এক জায়গায় এসে মিংমা। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। সে যেন ঠিক বিপদের গন্ধ পায়। সন্তুর হাত চেপে ধরে সে বলল, আউর যাও মত! খাতরা হ্যায়।
সেখানে বরফের ওপর শুয়ে পড়ল সে। তারপর হাতটা লম্বা করে জোরে একটা গাইতির ঘা দিল। অনেকখানি বসে গেল। গাঁইতিটা। বুঝতে কোনও ভুল হয় না যে ঐ জায়গাটা ফাঁপা। Spe
সন্তু দারুণ উত্তেজনা বোধ করল। পেয়েছে, এবার তারা ঠিক জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে। এই জায়গাটাতেই সন্তু বরফের মধ্যে ড়ুবে যাচ্ছিল সেদিন।
মিংমা। এদিক-ওদিক গাইতি চালিয়ে বুঝে নিল, ঠিক কতখানি জায়গা ফাঁপা সেখানে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বরফ কোপাতে লাগল, সন্তুও যোগ দিল তার সঙ্গে।
এখানে একটু পরিশ্রম করলেই নিশ্বাসের কষ্ট হয়। এমনিতেই এখানকার বাতাস বেশ ভারী। খানিকক্ষণ কুপিয়েই সন্তু বেশ হাঁপিয়ে গেল। কিন্তু মিংমার কী অসাধারণ শক্তি, সে কিছুতেই ক্লান্ত হয় না। এর মধ্যে সে বেশ একটা বড় চৌবাচ্চার মাপে গর্ত খুঁড়ে ফেলেছে। তারপর সে গর্তের এক পাশ থেকে বুকে নীচে গাহতি চালাতে লাগল। একসময় সে নিজেই লাফিয়ে নেমে পড়ল গর্তটার মধ্যে।
আরও কয়েকবার বেশ জোরে গাইতি চালাবার পর মিংমা মুখ তুলে সন্তুকে বলল, তুম ঠিক বোলা, সন্তু সাব নীচে লোহা হ্যায়।
সন্তুও তখন লাফিয়ে নেমে পড়ল গর্তটার মধ্যে। দুজনে মিলে আরও খানিকটা বালি-মেশানো বরফ সরিয়ে ফেলার পর দেখা গেল, সেখানে পাতা রয়েছে একটা লোহার পাত। কিন্তু তাতে কবজ কিংবা গুপ্ত দরজা কিছুই নেই।
সন্তু বলল, এখন দেখা দরকার, এই লোহার পাতটা কত বড়! এখানে বরফের তলায় কে এরকম লোহার পাত রাখবে? কোনও অভিযাত্রীদল নিশ্চয়ই এতবড় লোহার পাত বয়ে নিয়ে আসে না!
মিংমা কপালের ঘাম মুছল বাঁ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে। আবার খোঁড়াখুড়ি করতে হবে। লোহার পাতটা কত বড় কে জানে! লোহার পাতটা দেখে অবশ্য মিংমাও খুব অবাক হয়েছে। একটা কোনও দারুণ রহস্যের সন্ধান পেয়ে খাড়া হয়ে উঠেছে তার মাথার চুল।
আবার নতুন উৎসাহে সে বরফ পরিষ্কার করতে লাগল। লোহার পাতটা বেড়েই চলেছে। কতখানি জায়গা জুড়ে যে একটা পাতা আছে, তা বোঝার কোনও উপায় নেই।
মিংমা এক সময় জিজ্ঞেস করল, আউর কেয়া করিনা, বোলো সন্তু সাব!
সন্তুও ঠিক বুঝতে পারছে না। এরকমভাবে আর কতক্ষণ খোঁড়াখুড়ি চলবে? এ তো একজন দুজন মানুষের কাজ নয়। তবে একটা দারুণ জিনিসের সন্ধান পাওয়া গেছে, এটাকে আর হারালে চলবে না কিছুতেই।
এই সময় খ্যার খ্যার শব্দ শোনা গেল হিলিকপটারটার। দুরের আকাশে দেখা গেল একটা কালো বিন্দু। মিংমা আনন্দে চেঁচিয়ে বলল, আ গয়া! আ গয়্যা!
কিন্তু আর কিছু বলতে পারল না মিংমা। ওরা আগে লক্ষই করেনি যে, লোহার পাতটার এক জায়গায় চুলের মতন সরু দাগের জোড়া আছে। সেই জায়গাটা ফাঁক হয়ে একটা দিক ঢালু হয়ে যেতেই সন্তু গড়িয়ে পড়ে গেল নীচের অন্ধকারে। মিংমাও পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তারই মধ্যে সে দু হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল খাদের ওপরটা।
দুটো লোহার পাতের মাঝখানে আটকে গেল মিংমার পায়ের তলা থেকে কোমর পর্যন্ত। সে যন্ত্রণায় অ-আ করে আর্তনাদ করতে লাগল।