মুনি বলে শুন শুন রাজা জন্মেজয়।
করেন দারুণ যুদ্ধ বীর ধনঞ্জয়।।
হেথায় ধর্ম্মের পুত্র না দেখি অর্জ্জুনে।
কৃষ্ণেরে না দেখি দুঃখ ভাবিলেন মনে।।
বহুদূর গেল, রথধ্বজ নাহি দেখি।
চিন্তাকুল হয়ে রাজা ডাকেন সাত্যকি।।
ডাক শুনি সাত্যকি আসিল সেইক্ষণ।
সাত্যকিরে বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
একেশ্বর গেল পার্থ কৌরব ভিতর।
না জানি কিরূপ তথা করয়ে সমর।।
রথধ্বজ নাহি দেখি কিসের কারণ।
এ সকল ভাবি মোর স্থির নহে মন।।
শীঘ্রগতি রথে চড়ি করহ গমন।
ডাকিলাম তোমারে যে, এই সে কারণ।।
সাত্যকি বলিল, রাজা করি নিবেদন।
তোমার রক্ষার্থে আমি নিযুক্ত এখন।।
তোমারে ছাড়িয়া আমি যাইব কিমতে।
এই নিবেদন মম তোমার অগ্রেতে।।
শুনি যুধিষ্ঠির বলিলেন আরবার।
মম লাগি চিন্তা কিছু নাহিক তোমার।।
অর্জ্জুনের তত্ত্ব জানি আইস সত্বর।
তবে সে সুস্থির হবে আমার অন্তর।।
এত শুনি সাত্যকি কহিল ভীমসেনে।
সাবধান হয়ে তুমি থাকিবে আপনে।।
অর্জ্জুনের তত্ত্ব নিতে কহেন রাজন।
অতএব তথা আমি করিব গমন।।
যুধিষ্ঠিরে তব স্থানে করি সমর্পণ।
রাজার নিকটে রহ যত যোদ্ধাগণ।।
সাবধান হয়ে তুমি থাকিবে হেথাই।
পুনরপি আসি যেন যুধিষ্ঠিরে পাই।।
ভীম বলে, তুমি যাহ অর্জ্জুনের তথা।
যুধিষ্ঠির হেতু তব নাহি কোন ব্যথা।।
সহদেব নকুলাদি যত যোদ্ধাগণে।
রাজারে রাখিবে সবে অতি সাবধানে।।
সাত্যকি তোমার মত নাহি কোন জন।
কি দিয়া শুধিব ঋণ তোমার এখন।।
ইহা শুনি সাত্যকি উঠিল রথোপরে।
একা রথে যায় বীর নির্ভয় অন্তরে।।
নিমেষেতে প্রবেশিল ব্যূহের ভিতর।
অর্জ্জুনের শিষ্য বীর মহাধনুর্দ্ধর।।
সাত্যকিরে দেখি যত কৌরবের গণ।
ঝটিতি আসিল সবে করিবারে রণ।।
নানা অস্ত্রে রথিগণ ছাইল গগন।
আষাঢ় শ্রাবণে যেন মেঘ বরিষণ।।
পরিঘ মুষল শেল শূল জাঠা জাঠি।
ভূষণ্ডী পরশু নানা অস্ত্র কোটি কোটি।।
দেখিয়া সাত্যকি বীর সন্ধান পূরিল।
সবাকার অস্ত্র কাটি নিরস্ত্র করিল।।
তবে ক্রোধে দুঃশাসন পূরিল সন্ধান।
আকর্ণ পূরিয়া এড়ে দশগোটা বাণ।।
সাত্যকি কাটিল সেই বাণ সেইক্ষণ।
মহাধনুর্দ্ধর বীর সত্যক নন্দন।।
দশগোটা বাণ তবে পূরিল সন্ধান।
দুঃশাসন-ধনু কাটি করে খান খান।।
আর ধনু ধরি বীর ধৃতরাষ্ট্র সুত।
সাত্যকি উপরে বাণ মারেন অযুত।।
কাটিল সকল বাণ সত্যক-তনয়।
সন্ধান পূরিয়া বীর করে অস্ত্রময়।।
দশ বাণ মারে বীর ধৃতরাষ্ট্র-সুতে।
মূর্চ্ছিত হইয়া দুঃশাসন পড়ে রথে।।
মূর্চ্ছিত দেখিয়া বীরে সারথি সত্বর।
আপনি পলায় রথ লয়ে অতঃপর।।
সাত্যকি দেখিল, পলাইল দুঃশাসন।
সৈন্যের উপরে করে বাণ বরিষণ।।
ধ্বজ ছত্র পতাকায় পৃথিবী ছাইল।
সাত্যকির বাণে সব উচ্ছিন্ন হইল।।
সাত্যকি মন্থিল কুরুবল একেশ্বর।
বিস্ময় মানিয়া চাহে যতেক অমর।।
আকাশে অমরবৃন্দ পুষ্পবৃষ্টি করে।
ধন্য ধন্য করি তবে বলে সাত্যকিরে।।
এতেক দেখিয়া তব সুবল-নন্দন।
হাতে ধনু করি আসে করিবারে রণ।।
শকুনিরে দেখিয়া সাত্যকি ধনুর্দ্ধর।
সন্ধান পূরিয়া মারে চোখ চোখ শর।।
এড়িল বিংশতি অস্ত্র শকুনি উপর।
বাণে কাটি পাড়ে তাহা সুবল-কোঙর।।
বাণ ব্যর্থ দেখি বীর কোপে কাঁপে তনু।
পুনরপি বাণ এড়ে টঙ্কারিয়া ধনু।।
দশ বাণ এড়ে বীর পূরিয়া সন্ধান।
দুই বাণে ধ্বজ কাটি করে খান খান।।
চারি বাণে চারি অশ্ব কাটে বীরবর।
দুই বাণে সারথিরে দিল যমঘর।।
আর দুই বাণে কাটে শকুনির ধনু।
দশ বাণ এড়ি বীর বিন্ধিলেক তনু।।
শকুনি-সঙ্কট দেখি যত যোদ্ধাগণ।
হাহাকার করি তবে ধায় সেইক্ষণ।।
দুঃশাসন রথে চড়ি সুবল-নন্দন।
রণ এড়ি পলাইয়া করিল গমন।।
অবহেলে সাত্যকি করয়ে শরবৃষ্টি।
বিপক্ষ জানিল, আজি মজিবেক সৃষ্টি।।
সাত্যকির যুদ্ধ দেখি যত সৈন্যগণ।
ভয়ে পলাইয়া গেল লইয়া জীবন।।
সাত্যকির সারথি সে অতি বিচক্ষণ।
চালাইয়া দিল রথ পবন-গমন।।
পঞ্চ ক্রোশ মহাবীর গেল মুহূর্ত্তেকে।
অর্জ্জুনের রথধ্বজ তথা হতে দেখে।।
রথধ্বজ দেখি বীর আনন্দিত মন।
সৈন্যের উপরে করে বাণ বরিষণ।।
সাত্যকিরে দেখি কৃষ্ণ বলেন অর্জ্জুনে।
আসিল সাত্যকি বীর অই দেখ রণে।।
সাত্যকি দেখিয়া তবে বীর ধনঞ্জয়।
তার যুদ্ধ দেখি হন সানন্দ হৃদয়।।
সাত্যকিরে দেখি ভূরিশ্রবা নরপতি।
রথে চড়ি ধনু ধরি আসিল ঝটিতি।।
সাত্যকিরে দেখি বলে সোমদত্ত-সুত।
আমি আসিলাম তোর হয়ে যমদূত।।
বহুদিনে পাইলাম তোর দরশন।
অবশ্য পাঠাব তোরে যমের সদন।।
এত বড় গর্ব্ব তোর হইল এখন।
একা রথে আসিয়াছ করিবারে রণ।।
শুনিয়া সাত্যকি তবে করিল উত্তর।
কি কারণে এত গর্ব্ব করিস্ ববর্বর।।
মরণ নিকট প্রায়, বুঝিনু লক্ষণে।
এমন বচন তোর তাহার কারণে।।
অবশ্য তোমারে আমি করিব সংহার।
এক বাণে দেখাইব যমের দুয়ার।।
এতেক শুনিয়া ভূরিশ্রবা নরপতি।
সন্ধান পূরিয়া বাণ এড়ে শীঘ্রগতি।।
মহাক্রোধে ভূরিশ্রবা এড়ে দশ বাণ।
বাণে কাটি সাত্যকি করিল খান খান।।
হেনমতে বাণবৃষ্টি করিল বিস্তর।
দোঁহাকার বাণে দোঁহে হইল জর্জ্জর।।
ভূরিশ্রবা সাত্যকিতে হৈল ঘোর রণ।
বিস্ময় মানিয়া চাহে যত যোদ্ধাগণ।।
তবে ভূরিশ্রবা সাত্যকির প্রতি বলে।
এস তুমি আমি যুদ্ধ করি ভূমিতলে।।
এত বলি ভূরিশ্রবা অসি চর্ম্ম লয়ে।
রথ হৈতে ভূমে পড়ে এক লাফ দিয়ে।।
হেরিয়া সাত্যকি তবে ত্যাজে ধনুঃশর।
অসি চর্ম্ম লয়ে বীর নামিল সত্বর।।
মণ্ডলী করিয়া দোঁহে ফিরে চারিভিতে।
সাত্যকির চর্ম্ম বীর কাটে আচম্বিতে।।
শুধু খড়্গ লয়ে বীর করয়ে সংগ্রাম।
ন্যায় যুদ্ধ করে বীর অতি অনুপাম।।
সাত্যকি হইল তবে ক্রোধে কম্পমান।
ভূরিশ্রবা-চর্ম্ম কাটি করে খান খান।।
খড়্গহস্তে দুই বীর করয়ে সমর।
খড়্গের প্রহার দোঁহে হইল জর্জ্জর।।
জড়াজড়ি করি দোঁহে পড়ে ভূমিতলে।
সাত্যকিরে ধরে ভূরিশ্রবা মহাবলে।।
বুকের উপরে উঠে ধরিয়া চিকুরে।
দেখিয়া সাত্যকি বীর বায়ুবেগে ঘুরে।।
হাতে খড়্গ করি তবে সোমদত্ত-সুত।
সাত্যকিরে কাটিবারে হইল উদ্যত।।
কুমারের চাক যেন ঘুরয়ে সাত্যকি।
অদ্ভুত ঘটনা সবে দেখে দূরে থাকি।।
এতেক দেখিয়া তবে কৃষ্ণ মহাশয়।
ডাকিয়া বলেন, হেন ওহে ধনঞ্জয়।।
ভূরিশ্রবা ধরিয়াছে সাত্যকির চুলে।
সাত্যকি ঘুরিছে মহাবেগে ভূমিতলে।।
কৃষ্ণবাক্যে ধনঞ্জয় হইলেন ব্যস্ত।
বাণে কাটি পাড়িলেন ভূরিশ্রবা-হস্ত।।
ইহা শুনি রাজা জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল।
কহ মুনি কিবা হেতু এমত হইল।।
অশ্বত্থামা আদি করি যত যোদ্ধাগণ।
একাকী সাত্যকি বীর জিনে সর্ব্বজনে।।
সাত্যকিরে ভূরিশ্রবা করে পরাজয়।
আশ্চর্য্য শুনিয়া মম হইল বিস্ময়।।
দ্রোণপর্ব্বে সুধারস জয়দ্রথ-বধে।
কাশীরাম দাস কহে গোবিন্দের পদে।।