রাত বাড়ছিল। হঠাৎ বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে আর একটা আওয়াজ কানে এল অর্জুনের। মেজর চেয়ারে বসে চুলছেন। কিন্তু গোরানসাহেব তাকালেন অর্জুনের দিকে। শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। গাড়ির আওয়াজ। গোরানসাহেব বললেন, কেউ আসছে।
ততক্ষণে অর্জুন বুঝতে পেরেছে আওয়াজটা একটা নয়, দুটো গাড়ির এঞ্জিনের। দুটো আওয়াজের ধরন আলাদা। তার মানে দুরকমের গাড়ি আসছে। এই রাত্রে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এমন মারাত্মক বৃষ্টিতে দুটো গাড়ি এদিকে আসছে কেন, বুঝতে পারছিল না অর্জুন। যে ভদ্রলোক এই বাংলোটি কিনেছেন তিনি নিশ্চয়ই এমন সময়ে আসবেন না, তাঁর আসার কথা অনেক পরে।
অর্জুন বলল, যারা আসছে তারা ভাল লোক নাও হতে পারে।
তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু ওরা থাকলে যে জনে এসেছি সেই কাজটায় বাধা হবেই। গোরানসাহেবের কথা শেষ হতেই গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। আলোগুলো ঘুরে বাংলোর সামনে চলে এল। মেজর হকচকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, কে, কে?
অর্জুন দ্রুত উঠে ঘরের বাইরে চলে এল। মাঝখানের প্যাসেজ দিয়ে ও সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। রান্নাঘরের জানলা বন্ধ। কিন্তু সেখানে কোনও গ্রিল বা তারের জানলা নেই এটা সে দুপুরে দেখেছিল। জানলাটাকে খুলল সে। বাড়ির এপাশে কিছু গাছগাছড়া আছে। বৃষ্টি পড়ছে এখনও। বাইরে বেরুলেই ভিতে হবে। হোক। অর্জুন জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র ভিজতে শুরু করল। সে ধীরে ধীরে কার্নিসের নীচ দিয়ে সামনের দিকে এগোল।
বর্ষাতি-পরা চারটে লোক একটা মারুতি থেকে নেমে এল। বটার সুমোটাকে দেখে ওরা যে অবাক হয়ে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছিল। টর্চ ফেলে ভেতরটা দেখল ওরা। তারপর ইশারা করল টর্চ জ্বেলে। সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জিপ থেকে দুটো লোক নেমে এল। ওদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে তা বিদ্যুতের আলোয় বোঝা গেল।
দলবদ্ধভাবে ওরা বারান্দায় উঠে যেতেই অর্জুন আর তাদের দেখতে পেল না। যারা অস্ত্র হাতে এত রাত্রে এখানে এসেছে তাদের মতলব ভাল হতে পারে না।
হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই, ভেতরে কে? বেরিয়ে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে মেজরের গলা শুলল, তুই কে? এতবড় আস্পর্ধা যে, আমাকে তুই বলছিস? মেরে দাঁত ভেঙে দেব শজারুর বাচ্চা!
তারপর ধুপধাপ শব্দ হল। লোকটা চেঁচিয়ে বলল, সবকটাকে বেঁধে ফ্যাল। আমার আস্তানায় এসে জুটেছে আবার আমাকে গালাগাল? কটা আছে এখানে খুঁজে দ্যাখ সবাই।
একটু বাদে উত্তর শোনা গেল অন্য গলায়, চারজন। এদের একজন সাহেব। -কজন সাদা চামড়া।
অর্জুন নিঃসন্দেহ হল। এরা কেউ এই বাংলোর মালিক লোকনাথ দত্তের লোক নয়। লোকনাথ দত্ত তাদের এই বাংলোয় নিয়ে আসার সময় তো স্পষ্ট বলেছিলেন যে, তিনি সাতদিনের মাথায় আসবেন। নিশ্চয়ই এই লোকগুলো এখানে যাওয়াআসা করে, যা লোকনাথ দত্ত জানেন না।
হঠাৎ বটার গলা শুনতে পেল অর্জুন, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি কিছু জানি না। আমি গাড়ি চালাই, এঁরা আমার গাড়ি ভাড়া করে এখানে এনেছেন।
কোত্থেকে এসেছিস?
জলপাইগুড়ি। ওখানকার স্ট্যান্ডে গিয়ে বটা বললে সবাই চিনবে।
এই যে মিস্টার হোঁৎকা! এই সাহেব কে?
কোনও জবাব শুনতে পেল না অর্জুন। সম্বোধনটা নিশ্চয়ই মেজরের উদ্দেশ্যে।
কী হল? কানে যাচ্ছে না কথা?
ভদ্রভাবে কথা বলো ভাই। আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়।
শাবাশ। কেন এসেছ এখানে? এই বিদেশি কে?
আমরা এসেছি ড্রাকুলার সন্ধানে।
ড্রাকুলা? লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল।
হ্যাঁ, যারা রক্ত চুষে মানুষকে মেরে ফেলে।
আচ্ছা! এই ব্যাপার। আমাদের খবরটা তোমরা পেলে কোথায়? তোমরা কি পুলিশের লোক? উত্তর দাও।
না। আমি আর ও আমেরিকা থেকে এসেছি। পাসপোর্ট দেখাতে পারি।
ওসব পকেটে রাখে। ব্যাপারটা যখন জেনেই গেছ তখন আর তোমাদের জ্যান্ত ছেড়ে দিতে পারি না।
এই সময় আর একটি গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। লোকটা বলল, এদের হাত-পা বেঁধে ফ্যাল। বস আসছে মনে হচ্ছে।
কার্নিসের নীচে দাঁড়িয়েও বৃষ্টির ছাঁট এড়াতে পারছিল না অর্জুন। হাওয়া নেই বলে শীত করছে না তেমন। অবশ্য বৃষ্টির তেজ এখন অনেক কমে গেছে। এদের হাত থেকে মেজরদের উদ্ধার করা কীভাবে সম্ভব, ভাবছিল অর্জুন। এই সময় গাড়ির হেডলাইট বাংলোর ওপর পড়ল। অর্জুন দেখল গাড়িতে একজনই মানুষ, তিনিই ড্রাইভার।
দরজা খুলে চটপট বারান্দায় উঠে গেলেন তিনি। অর্জুন শুনতে পেল, সব ঠিক আছে?
না, সার। এখানে এসে দেখি চারটে লোক বাংলো দখল করে আছে। ওদের ওই ঘরে হাত-পা বেঁধে রেখে দিয়েছি। বলল, আমেরিকা থেকে এসেছে।
কেন? কেন এসেছে?
মুখে বলল ড্রাকুলার সন্ধানে। মনে হচ্ছে আমাদের ব্যাপারটা জেনে গিয়েছে।
গোয়েন্দা না পুলিশ?
বুঝতে পারছি না, তবে যা চেহারা আর বয়স, তাতে পুলিশে চাকরি হবে না।
জিপে কজন আছে?
ছজনকে এনেছি।
বাঃ, ছয় প্লাস চার। একে-একে নিয়ে এসো। আমি টেবিল রেডি করছি। কেউ একজন আমাকে সাহায্য করুক। গাড়িতে সব যন্ত্রপাতি আছে।
স্টক আছে সার।
আচ্ছা, ওদের সঙ্গে আর কেউ ছিল না তো?
চারজনকেই তো পেয়েছি।
যদি কেউ পালিয়ে গিয়ে থাকে পেছনের দরজা দিয়ে, নিশ্চয়ই বৃষ্টির মধ্যে বেশিদূর যেতে পারবে না। সাবধানের মার নেই। দেখে এসো।
ওকে সার। বলে লোকটা বারান্দায় বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে বলল, একটা একটা করে ওদের ভেতরে নিয়ে এসো। বাঃ, বৃষ্টি ধরে গেছে, আমি একটু পাক দিয়ে আসছি।
অর্জুন ফাঁপরে পড়ল। এপাশে এলে লোকটা কি তাকে দেখতে পাবে? সে দ্রুত লন পেরিয়ে জঙ্গলের কাছে চলে যেতেই লোকটাকে দেখা গেল। টর্চ নিয়ে বেরিয়ে চারপাশে আলো ফেলছে। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার জন্যই বোধ হয় রাতের জঙ্গলে পোকামাকড় কম। পাতা থেকে জল পড়ছে ফোঁটা-ফোঁটা। অর্জুন দেখল লম্বা লোকটা আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলোর পেছনদিকে যাচ্ছে। খোলা জানলাটায় তার টর্চের আলো পড়ল। আরও এগোল লোকটা। কবরের কাছে পৌঁছনোমাত্র লোকটা এমন আর্ত চিৎকার করে উঠল যে, অর্জুন কেঁপে উঠল আতঙ্কে।
লোকটা যে মাটিতে পড়ে গেল, এটুকু বুঝতে পারল অর্জুন। জ্বলন্ত টর্চ ওর হাত থেকে ছিটকে কিছুটা দূরে ঘাসের ওপর পড়েছে। তিনবার চেঁচিয়েছিল লোকটা, তারপর একদম চুপ করে গেল। চিৎকারটা বাংলোর ভেতরে পৌঁছেছিল। অর্জুন দেখল তিনজন লোক টর্চ নিয়ে দৌড়ে বাইরে এসে চারপাশে আলো ফেলছে। অর্জুন জঙ্গলের আরও ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই ঝুপ ঝুপ করে ওর শরীরের ওপর ভেজা কিছু পড়তে লাগল। ডান হাতে সেগুলোকে ঘাড় এবং মাথার ওপর থেকে সরাতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু ওগুলো এমন আঁকড়ে আছে যে, সক্ষম হল না। জোঁক। জঙ্গুলে জোঁক। এখন চুপচাপ ব্যথা না দিয়ে তার রক্ত খেয়ে যাবে। এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে বাংলোয় ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। আবার সেটা করতে গেলে ওদের হাতে ধরা দিতে হবে। কিছুক্ষণ জোঁকগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়াই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
লোকগুলো এখন ডাকাডাকি করছে। রাজুভাই, ও রাজুভাই, রাজুভাই। কিন্তু কোনও সাড়া পাচ্ছে না। ওরা এবার বাংলোর পেছনদিকে যাচ্ছিল। আর তখনই ওদের টর্চের আলো মাটিতে পড়ে থাকা রাজুভাইকে আবিষ্কার করল। দৌড়ে কাছে গিয়ে ওরা কী দৃশ্য দেখল অর্জুন বুঝতে পারল না, কিন্তু ওখান থেকেই ওরা এমন হল্লা শুরু করল যে, বাংলোর ভেতর থেকে তিনজন মানুষ বেরিয়ে এল। এদের একজন বেশ প্রবীণ, সাদা দাড়ি আছে। মেঘ সরে যাওয়ায় আকাশ পরিষ্কার। লোকটাকে আবছা আবছা যেটুকু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তাতে বয়স্ক বলেই মনে হল অর্জুনের।
কী হয়েছে?
রাজু মরে গিয়েছে। ওর শরীরটাকে কেউ দুমড়ে দিয়েছে।
কে করল?
জানি না সার। কোনও মানুষের পক্ষে এই কাজ এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব নয়। ওর মাথাটাও ঘুরে গেছে ভেঙে যাওয়ার পর।
তিনটে নোক এগিয়ে যাচ্ছিল রাজুভাই-এর মৃতদেহ দেখতে। অর্জুন দেখল এই তার সুযোগ। বাংলোর সামনে এখন কেউ নেই। প্রথম গাড়িতে চারজন, জিপে দুজন আর পরে একজন মানুষ এখানে এসেছে। মোট সাতজন। তার মধ্যে একজন মারা গেল। বাকি দুজন এখন বাংলোর পেছনে মৃতদেহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৌড়ল।
বারান্দায় উঠেই সে দেখতে পেল বসার ঘরে টেবিলের ওপর একটি লোককে শুইয়ে রাখা হয়েছে। এই লোকটি কোত্থেকে এল? লোকটি যেন ঘুমোচ্ছে। পাশের দরজা বন্ধ। সেটা খুলতেই ও অন্ধকারে কিছুই দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি এই ঘরে আছেন?
মেজরের গলা পাওয়া গেল, হুঁ। চটপট দড়ি খুলে দাও।
কেউ কথা বলবেন না প্লিজ। অর্জুন প্রথমে গোরক্ষনাথকে পেল। তার বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, আমার মাথা ঘাড় বুকে জোঁক পড়েছে। ছাড়িয়ে দিতে পারবে? জলদি!।
বাবু অন্ধকারে কী করে দেখব? জোঁক? আপনি আমার শকুনের কাছে চলে যান। ল্যাংড়া শকুন জোঁক খেতে ভালবাসে।
শকুন? অর্জুনের মাথায় কিছু ঢুকল না। সে দৌড়ল। গোরক্ষনাথদের ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। শকুনের খাঁচাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সেটা একবার অবাক চোখে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল। খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে মাথাটা এগিয়ে নিয়ে গেল অর্জুন চোখ বন্ধ করে। আর তখনই অভাবনীয় ব্যাপারটা ঘটল। চটপট ঠোকর এসে পড়ছে মাথায়, ঘাড়ে, বুকে। শব্দ হচ্ছে কপাৎ কপাৎ করে। কিন্তু জোঁকগুলো সহজে চামড়া ছাড়তে চাইছিল না, রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে তারা। শকুনটাও যেন পাগল হয়ে গেল। শেষ জোঁকটাকে গেলার পর অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠল পাখিটা। অর্জুনের হঠাৎ মনে হল পাখিটার ঋণ শোধ করা উচিত। সে হাত বাড়িয়ে ওর পায়ের দড়ি খোলার চেষ্টা করল। ভয় হচ্ছিল যদি শকুনটা তাকে ঠুকরে দেয় তা হলে এখানে ইনজেকশন নেওয়ারও উপায় নেই। কিন্তু শকুনটা চুপচাপ দেখে যেতে লাগল। ও বাঁধনমুক্ত হওয়ামাত্র ওড়ার চেষ্টা করল। খানিকটা দূরে গিয়ে বসে পড়ল অবশ্য। সম্ভবত খাঁচায় থাকার ফলে ওর ডানার জোর কমে গিয়েছে। শকুনটাকে উড়তে দেখে কাকটা চিৎকার শুরু করল। এই মধ্যরাতে কা কা ডাকটা আরও কর্কশ শোনাচ্ছিল।
বারান্দায় আবার মানুষের গলা পাওয়া গেল। অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে এল। জানলাটা এখনও খোলা। সে শুনল প্রৌঢ় বলছে, রাজু মারা গিয়েছে, ওর বউকে নিশ্চয়ই ক্ষতিপূরণ করে দেওয়া হবে।
কিন্তু ওকে যে মারল তাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
কে মেরেছে? প্রৌঢ়র গলা, বুঝতে পারছ কোনও মানুষ ওকে মারেনি। ওর শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গেছে যে, সে কখনওই মানুষ নয়।
যে কাজটা করেছে সে নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছে। আমরা ওকে খুঁজে বের করব। ওকে শেষ না করে এখান থেকে যাব না। লোকটা মরিয়া।
ঠিক আছে। দুজন বাইরে গিয়ে পাহারা দাও। বাকিরা আমাকে সাহায্য করো। বড় জারটা কোথায়? নিয়ে এসো কেউ।