পুলিশদুটো হেলতেদুলতে খানিকটা তফাতে এসে দাঁড়াল। এত বড় শরীরের পুলিশ অর্জুন কখনও দ্যাখেনি। প্রথমজন বলল, রেস্টুরেন্টের ভেতরটা একবার দেখে এসো।
দ্বিতীয়জন পা বাড়াতেই বিপ বিপ শব্দ বাজল। প্রথম পুলিশ কানে রিসিভার তুলল, মাইক স্পিকিং। নো, নো ট্রেস। বাট এভরিথিং ইজ ফাইন হিয়ার। ওকে।
দ্বিতীয় পুলিশটি ফিরে আসতেই প্রথমজন বলল, লেটস গো।
পুলিশের গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই মেজর কথা বললেন, আমি বুঝতে পারছি, মাফিয়াদের হয়ে পুলিশ আমাদের খোঁজ করছে নাকি?
গেট ভেঙে বেরিয়েছি, সাইরেন বেজেছে, পুলিশ তো চারপাশে খোঁজ করবেই। চলুন ভেতরে যাওয়া যাক।
রেস্টুরেন্টের যে দিকটায় বসলে রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায় সেদিকের টেবিল নিল ওরা। দুপুরে যা খাওয়া হয়েছিল, এতক্ষণের উত্তেজনায় তা কখন হজম হয়ে গিয়েছে। মেজর নিজের জন্যে একটা বিগম্যাক, অনেকটা লম্বা আলুভাজা আর বেশ বড় গ্লাসের চকোলেট মিল্ক কেক নিলেন ওই মিল্ক কেক খেতে খুব ভাল। চকোলেটের গন্ধমাখা ঘন ক্ষীরের মতো। কিন্তু খেলেই পেট ভারী হয়ে যায়। ওজন বাড়বেই। কথাটা মনে করিয়ে দিলে মেজর বললেন, সমুদ্রে দুবালতি জল ঢাললে কী এমন ক্ষতি হবে? অর্জুন চিকেন ফ্রাই আর কফি নিল।
খাওয়ার সময় মেজর কথা বলা পছন্দ করেন না। শেষপর্যন্ত তৃপ্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী বুঝলে?
কোনটা?
আরে টেলিফোনে কথা বলে কী মনে হল?
বুঝতে পারলাম না। তবে ওরা নাড়া খাবে।
হুঁঃ। মুশকিল। গাড়িটাকে ছেড়ে দেওয়া হল, এখন এখান থেকে বের হবে কী করে? এই শহর থেকে ওদের চোখ এড়িয়ে বের হওয়া প্রায়।
অসম্ভব।
এখান থেকে বাস বাইরে যায় না?
যায়। মেজর বললেন, বাসে ওঠার জন্যে টার্মিনালে যেতেই তো ওদের নজরে পড়ে যাবে।
রাস্তায় হাত দেখালে বাস থামবে না?
নো, নো, নন। মাথা নাড়লেন মেজর।
অর্জুন হতাশ ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রোগা শীর্ণ চেহারার একটি লোক তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই লোকটি হাসবার চেষ্টা করল। অর্জুন গম্ভীর হয়ে আছে দেখে এবার বাঁ হাত সামান্য উচুতে তুলে নাড়ল। অর্জুন ইশারায় লোকটাকে কাছে ডাকতেই সে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এল।
আপনারা খুব বিপদে পড়েছেন, তাই না? ফিসফিসিয়ে বলল লোকটা। বলছে ইংরেজিতে কিন্তু আমেরিকানদের মতে ইংরেজি নয়। কিন্তু এর গায়ের রং সাদা, চোখ কটা, চুল বাদামি।
তোমাকে কে বলল? মেজর সন্দিগ্ধ হলেন।
হুঁ হুঁ বাবা। আমি টের পাই। কেউ বিপদে পড়তেই বুঝতে পারি।
তুমি মেক্সিকান?
হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে একটা মিল্ক কেক খাওয়াবে?
মেজর কিছু বলার আগেই অর্জুন ডলার বের করে লোকটাকে দিল। লোকটা সুড়ত করে কাউন্টারের দিকে চলে যেতে মেজর বলল, না, না, এদের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। ভিখিরি দলের একজন। পয়সা নষ্ট।
অর্জুন হাসল, মিল্ক কেকটা তো আপনার মতো আমিও খেতে পারতাম।
ইতিমধ্যে গ্লাস নিয়ে লোকটা ফিরে এল টেবিলে। চেয়ার টেনে বসে স্ত্র ঢুকিয়ে বিরাট একটা টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গিলল। তারপর বলল, প্রব্লেমটা কী? পুলিশ দেখে থামের আড়ালে লুকোলে কেন?
অর্জুন মেজরকে এক পলক দেখে নিয়ে বলল, আমরা চোর-ডাকাত নই।
সেটা তো চেহারা দেখেই বুঝে নিয়েছি। আবার ঐ ঠোঁটে নিয়ে টানল লোকটা, পুলিশের হাত থেকে বাঁচা খুব মুশকিল ব্যাপার। এক, কোনওক্রমে যদি আমেরিকা ছেড়ে যেতে পারো। এখান থেকে সেটা সম্ভব নয়। অবশ্য যদি রাতারাতি কানাভা বর্ডার পার হতে পারো।
আমেরিকা ছাড়ার দরকার নেই। এই আটলান্টিক সিটি থেকে কী করে চুপচাপ বেরিয়ে যাওয়া যায় বলতে পারো? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
লোকটা তাকাল। ওর মুখ আঁ হয়ে গেল। তারপর নিচু গলায় সে বলল, তার মানে পুলিশ নয়। তোমরা ভয় পাচ্ছ ওদের?
ওদের মানে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
যারা এই শহরটাকে চালায়। মাই গড। আগে জানলে এটা খেতাম না। আমি ঠিক বলছি, তাই না?
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করো?
কিছু না। আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই। ওরা সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে।
কারা?
না। আমি মুখ খুলব না। তোমরা কারা?
অর্জুন বলল, আমরা ভারতবর্ষের লোক। ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ার নাম শুনেছ?
তোমরা তোমাদের প্রাইম মিনিস্টারকে গুলি করে মেরেছিলে। তাই না?
আমরা মারিনি। কয়েকজন নির্বোধ মেরেছিল।
হ্যাঁ, শুনেছি। এখানে কী করতে এসেছ তোমরা?
বেড়াতে।
কী করে বিশ্বাস করব?
অর্জুন পাশপোর্ট বের করে দেখাল। আমেরিকার ইমিগ্রেশনের স্ট্যাম্প দেখে লোকটা যেন চিন্তায় পড়ল। মেজরের কাগজপত্র দেখতে চাইল না সে। তারপর চারপাশ তাকিয়ে নিয়ে বলল, এখানে কথা বলা ভুল হবে।
তা হলে?
আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। তোমরা কিছুটা দূরত্বে থেকে আমাকে ফলো করো। যদি বিপদে পড়ো তা হলে চেঁচিয়ে দয়া করে ডেকো না। লোকটা উঠে দাড়াতেই মেজর বলল, ওহে, তোমার নামটা এখনও বলনি।
আমার নাম মারিও। গ্লাস শেষ করে লোকটা ওটাকে গারবেজ বাক্সে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল। মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কী করবে? ওরকম বাউন্ডুলে লোকের কথায় বিশ্বাস করবে?
বিশ্বাস না করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
কিন্তু ও যদি ওদের লোক হয়?
কিছু করার নেই। অর্জুন উঠে পড়ল।
মারিও হেলতে-দুলতে আগে-আগে যাচ্ছে। অর্জুন মেজরের পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে লক্ষ করল মারিও গলি বা নির্জন রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। এসব রাস্তায় গাড়ি তেমন নেই, মানুষজনও কম। মিনিট সাতেক হাঁটার পর পেছনদিকে না তাকিয়ে মারিও হাত নাড়ল এগিয়ে যেতে। ওরা কাছে পৌঁছতে মারিও বলল, বাঁ দিকের বাড়িটা জনসনের। ব্যাটা এখন নেশা করে আউট হয়ে আছে। দরজা খোলা। তোমরা ওর বসার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করো।
আমি দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি। পাখির মতো উড়ে গেল লোকটা।
অর্জুন দেখল পাশের বাড়ির দরজা আধা-ভেজানেনা। সেখানে কোনও লোক আছে বলে মনে হচ্ছে না। মেজর বললেন, নো অর্জুন। আমার মনে হচ্ছে এটা একটা ট্র্যাপ। ওই বাড়িতে আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে ও মাফিয়াদের খবর দিতে গিয়েছে।
অর্জুন বলল, আমার তা মনে হয় না।
অত ভালমানুষি এখন কাজ দেবে না অর্জুন!
দেখুন, ও যদি মাফিয়াদের খবর দিতে চাইত তা হলে আমাদের রেস্টুরেন্টে বসিয়েই সেটা করতে পারত। চলুন, দেখা যাক।
দরজা ঠেলে ভেতরে পা বাড়াতেই নাক ডাকার আওয়াজ কানে এল। কোনও মানুষ এমন বীভৎস শব্দে নাক ডাকতে পারে তা না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঘরটি সাধারণ। জরাজীর্ণ একটি সোফা আর টিভি রয়েছে দেখল। অর্জুন ভেতরের ঘরে উঁকি মারল। সেই ঘরে খাটে চিত হয়ে শুয়ে একটি প্রৌঢ় অঘোরে ঘুমোচ্ছে। পাশের টেবিলে হুইস্কির বোতল, গ্লাস।
ভেতরের দরজা বন্ধ করে সোফায় বসতেই অর্জুনের পাশে এসে বসে মেজর বললেন, সর্বনাশ, আমাকেও দেখছি হারিয়ে দিচ্ছে।
অর্জুন হেসে ফেলল। মেজরও সশব্দে নাক ডাকেন। কিন্তু সে কথা বলতে ইচ্ছে হল না।
তুমি বলছ মারিওকে বিশ্বাস করা যেতে পারে?
না করে উপায় কী?
আমি নিউ ইয়র্কে ফিরে গিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে চিঠি লিখব। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের জানা উচিত মাফিয়ারা কীরকম বেড়ে উঠেছে। ডেঞ্জারাস। বলতে বলতে টিভির দিকে তাকালেন মেজর। তারপর উঠে গিয়ে সেটাকে চালু করলেন। নব ঘোরাতেই খবর চালু হল। পাকিস্তানে উগ্রপন্থী আততায়ীদের হাতে মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছেন। পাক প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, যত শিগগির সুম্ভব খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। আজ বিকেলে এক সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন মহিলা নিহত হয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে তাঁরা আটলান্টিক সিটিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার সময় তাঁদের গাড়িকে একটি ভারী ট্রাক পেছন থেকে ধাক্কা মারে। গাড়িটি ঘটনাস্থলেই চুরমার হয়ে যায়। মহিলা দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার ডাক্তাররা মৃত বলে ঘোষণা করেন। ট্রাকের ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গেলেও ট্রাকটিকে পরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। ড্রাইভারের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ঘোষকের কথার পাশাপাশি ছবি দেখানো হল।
মেজর চিৎকার করে উঠলেন, মাই গড!
অর্জুন ঠোঁট কামড়াল। তার চোখের সামনে সিম্বা এবং গ্যাব্রিয়েলার মুখ ভেসে উঠল। সে ফোন করে অনুরোধ করা সত্ত্বেও ওরা ওদের খুন করল। সিম্বা আজই ফিরতে চেয়েছিল নিউ ইয়র্কে। ওদের অনুরোধে বেচারা এসেছিল আটলান্টিক সিটিতে। গ্যাব্রিয়েলার কোনও প্রয়োজন ছিল না, শুধু জিমের কথা ভেবে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন, এখানে এসেছিলেন, অর্জুন দেখল ঘরের এক কোণে টেলিফোন রয়েছে।
সে উঠে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে কেউ বলল, হেলো।
আমি বস-এর সঙ্গে কথা বলতে চাই?
তোমার কোড নাম্বার?
লকেটের সাপ।
বলমাত্র সব চুপচাপ হয়ে গেল। তারপর ভারী গলা শুনতে পেল অর্জুন, হেলো!
আমি তোমাকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও মেয়েদের খুন করলে কেন?
আমি খুন করিনি।
কিন্তু এর পরিণাম খুব খারাপ হবে।
আমি যার জন্যে দায়ী নই তা কেন আমার খারাপ করবে।
আমি এখনও লকেটটার মালিক। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। তারপর লোকটা বলল, হে ম্যান, তোমার মতো আমিও জানি ওইসব সাপের গল্প অর্থহীন। কবে কখন যে গল্প তৈরি হয়েছিল তা আফ্রিকার নিবোধ মানুষ বিশ্বাস করে চলেছে এখনও এবং তা থেকে তুমি ফায়দা লুঠতে চাইছ। আমারও একই ধান্দা। তোমরা বোর্ডের একজন রেসপেক্টেড মেম্বারের বাড়ি ভেঙে পালিয়ে গেছ। ওই গাড়িতে তোমরা আছ মনে করে অ্যাকসিডেন্ট করানো হয়েছে। এর পেছনে আমার কোনও ভূমিকা নেই। আমার ওই লকেটটা চাই। তার বদলে কী চাও তুমি?
ওয়েল। এ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু তুমি আটলান্টিক সিটি থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারবে না। ওখানে তোমার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমার শত্রু বেড়ে যাবে। দ্যাখে, যদি বেরিয়ে আসতে পারে তা হলে আগামীকাল সকাল দশটায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে অপেক্ষা কোরো। হঠাৎ রিসিভার হাতছাড়া হয়ে গেল। অর্জুন ঘুরে দেখল মারিও লাইনটা কেটে দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখছে।
কী হল? অর্জুন রেগে গেল। তুমি কি ওদের সঙ্গে কথা বলছিলে?
হ্যাঁ।
তোমরা যে এত নিবোধ তা ভাবিনি। কথা বলে সময় নিয়ে ওরা এতক্ষণে ট্রেস করে ফেলেছে কোন টেলিফোন থেকে কলটা গিয়েছিল। পালাতে চাও তো ফলো মি, কুইক। মারিও দরজার দিকে এগোল।
সরু গলি দিয়ে খানিকটা হাঁটতেই ওরা সমুদ্র দেখতে পেল। তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা ছোট বজরা ভাসছে। দূরে প্রচুর লোক নৌকো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নৌকোগুলো শৌখিন। মারিও জিজ্ঞেস করল, সাঁতার কাটতে পারো?
মেজর বললেন, সাঁতার? হ্যাঃ। একবার প্রশান্ত সাগরের নীচে–।
মারিও তাকে থামিয়ে বলল, এখানে জল কম। সাঁতরে ওই বজরায় উঠতে হবে। কুইক। বলে লোকটা জামা-জুতে সুষ্ঠু জলে নেমে পড়ল। জলপাইগুড়ির করলা নদীতে একসময় সাঁতার শিখেছিল অর্জুন। কিন্তু জুতো-প্যান্ট পরে সে কখনও সাঁতার কাটেনি। কিন্তু বিপদ যখন পেছনে তাড়া করে আসছে তখন আর দ্বিধা করে লাভ নেই। সে প্রায় স্থির জলে সাঁতার কাটতে কাটতে শুনল জলে বিকট শব্দ হল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মেজর জল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলছেন, হেঁটেই যাওয়া যায়। জল বেশি নেই। ভদ্রলোক শেষপর্যন্ত বেশ নাকানিচুবুনি খেয়ে বজরায় উঠলেন। ভিজে জামা-প্যান্টে শীত করছে। এই সময় ভেতর থেকে একটি নারীকণ্ঠ ভেসে এল, মারিও ওদের ভেতরে আসতে বলে। আমি চাই না কেউ বাইরে থেকে ওদের দেখতে পাক।