১৭. পিচ্ছিল আঠালো চটচটে এক ধরনের তরল

পিচ্ছিল আঠালো চটচটে এক ধরনের তরলের ভেতর দিয়ে দুজনে গড়িয়ে গড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় হাজির হলো। জায়গাটি বিচিত্র। এটি আশ্চর্য রকম সমতল এবং চারপাশের দেয়ালগুলো দেখলে প্রাগৈতিহাসিক কারুকাজের কথা মনে পড়ে। য়ুহা এবং রায়ীনা উঠে দাঁড়াল, চটচটে আঠালো তরলে তারা মাখামাখি হয়ে আছে। য়হা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমরা কোথায়?

রায়ীনা বলল, তুমি শুনে বিশ্বাস করবে কী না জানি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমরা কোনো একটা প্রাণীর পেটের ভেতরে হাজির হয়েছি!

পেটের ভেতরে?

হ্যাঁ।

য়ুহা ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকালো, চারপাশের অংশটুকুর তার পরিচিত কোনে কিছুর সাথে কোনো মিল নেই। সে তার জীবনে এ রকম বিচিত্র কিছু দেখেনি। রায়ীনা নিচু গলায় বলল, তুমি দেয়ালগুলো দেখো–কিছুক্ষণ থেকেই হেডফোনে একটা খসখসে চাপা শব্দ আসছিল য়ুহা তাই ভালো করে কথা শুনতে পেল না, সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ?

তুমি দেয়ালগুলো দেখ–সেগুলো নড়ছে।

য়ুহা চারপাশের দেয়ালগুলোর দিকে তাকালো, সেগুলো শুধু নড়ছে না ধীরে ধীরে সেগুলোর আকার পাল্টে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেখানে ছোট ছোট অসংখ্য বিন্দু বড় হতে শুরু করছে। য়ুহা তার অস্ত্রটি হাতে নিয়ে বলল, এটা জীবন্ত?

রায়ীনার হেডফোনেও একটা কর্কশ শব্দ, সে তার মাঝে চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ, মনে হয় এটা জীবন্ত।

রায়ীনার কথা শেষ হবার সাথে সাথে য়ুহা তার হেডফোনে একটা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেল, য়ুহা কথাটা পরিষ্কার বুঝতে পারল না, রায়ীনাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ?

আবার প্রতিধ্বনির মতো একটা শব্দ হলো, তার ভেতরে রায়ীনা বলল, আমি কিছু বলিনি।

তাহলে কে বলেছে?

আবার ভোঁতা একটা শব্দ হলো। রায়ীনা চারদিক ঘুরে তাকালো, বলল, অন্য কেউ বলছে।

অন্য কেউ?

হ্যাঁ।

কী বলছে?

বুঝতে পারছি না।

রায়ীনার কথা শেষ হবার আগেই খসখসে একটা শব্দ শোনা গেল, বুঝি বুঝি বুঝি…

য়ুহা চমকে ওঠে, কে কথা বলে?

প্রতিধ্বনির মতো একটা গমগমে আওয়াজ আসে, কে? কে? কে?

রায়ীনা নিচু গলায় বলল, কেউ একজন আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছে।

য়ুহা বলল, কী বলছে?

দুর্বোধ্য কিছু শব্দ শুনতে পেল তারা, সেই অর্থহীন শব্দগুলোর মাঝে শুধু মানুষ শব্দটা তারা বুঝতে পারে। য়ুহা বলল, হ্যাঁ। আমরা মানুষ। তোমরা কারা?

মানুষ প্রতিধ্বনির মতো আবার শব্দ হয় মানুষ! সত্যি মানুষ! জীবন্ত মানুষ! মানুষ!

হ্যাঁ। আমরা জীবন্ত মানুষ। তোমরা কারা?

আমরা? আমরা? মানুষ না। মানুষ না। তোমরা মানুষ। আমরা মানুষ।

আবার দুর্বোধ্য কিছু শব্দ শুনল, দ্রুত বিজাতীয় এক ধরনের ভাষার কথা বলতে থাকে তার মাঝে বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি এ রকম কয়েকটা শব্দ তারা বুঝতে পারল। রায়ীনা চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, আমরা তোমাকে দেখতে চাই।

দেখতে চাও? দেখতে চাও?

হ্যাঁ।

এই তো আমি। আমি।

তুমি কি একা?

একা। আমি একা। আমি এক এবং একা।

এই গ্রহে তুমি একা?

আমি একা। আমি সব। আমি সব।

তুমি কি এই মহাকাশযানগুলো ধ্বংস করেছ?

ধ্বংস? ধ্বংস?

হ্যাঁ। এই বিধ্বস্ত মহাকাশযানটা কি তুমি ধ্বংস করেছ?

না। আমি করি নাই।

য়ুহা লক্ষ করল দুর্বোধ্য একটা দুটো শব্দ দিয়ে কথা শুরু করলেও খুব দ্রুত এই প্রাণীটি অর্থবহ কথা বলতে শুরু করেছে। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তুমি কী চাও?

আমি মানুষ বুঝতে চাই। গমগমে এক ধরনের কণ্ঠস্বরে মহাকাশের প্রাণীটি বলে, বিধ্বস্ত মহাকাশযানে কোনো জীবন্ত মানুষ নাই। আমি জীবন্ত মানুষ বুঝতে চাই।

য়ুহা বলল, আমরা জীবন্ত মানুষ।

আমি বুঝতে চাই।

রায়ীনা বলল, আমরাও তোমাকে বুঝতে চাই। তুমি কেমন করে দেখ কেমন কথা বল আমরা বুঝতে চাই। তোমরা কেমন করে চিন্তা কর বুঝতে চাই।

তোমরা আলাদা। তোমাদের কথা আলাদা। চিন্তা আলাদা। আমি এক। আমি একা।

তুমি কেমন করে কথা বল? দেখ? শোন? স্পর্শ কর?

আমি কথা বলি না। দেখি না। শুনি না। স্পর্শ করি না। আমি এক। আমি একক।

রায়ীনা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি চিন্তা কর?

আমি চিন্তা করি।

তুমি কীভাবে চিন্তা কর?

তোমরা যেভাবে চিন্তা কর আমি সেভাবে চিন্তা করি। তোমাদের সবার আলাদা আলাদা মস্তিষ্ক। আমার একটা মস্তিষ্ক।

কোথায় তোমার মস্তিষ্ক? দেখতে চাই।

এই গ্রহের ভেতরে বিশাল মস্তিষ্ক।

গ্রহের ভেতরে?

হ্যাঁ, এই গ্রহের ভেতরে বিশাল জায়গা জুড়ে আমার মস্তিষ্ক। আমার সেই মস্তিষ্ক আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।

আমরা যে রকম হাঁটতে পারি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারি তুমি সেটা পার না?

না। আমার তার প্রয়োজন হয় না। আমার যেটা দরকার আমি সেটা আমার নিজের কাছে নিয়ে আসি।

রায়ীনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমাদেরকে যেভাবে এনেছ?

হ্যাঁ। তোমাদেরকে যেভাবে এনেছি।

কেন এনেছ আমাদের।

আমি আগে শুধু মৃত মানুষ দেখেছি। শুধু মৃত মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। আমি জীবন্ত মানুষ দেখতে চাই, তারা কেমন করে কাজ করে বুঝতে চাই।

তুমি কী বুঝতে পেরেছ?

আমি তাদের আরো গভীরভাবে দেখতে চাই। আরো গভীরভাবে বুঝতে চাই। আরো নিবিড়ভাবে দেখতে চাই, শরীরের প্রত্যেকটা কোষ দেখতে চাই, মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা নিউরন দেখতে চাই

য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কীভাবে দেখবে তুমি?

খুলে খুলে।

না য়ুহা চিৎকার করে বলল, আমি দেব না। কিছুতেই দেব না।

দেব না?

না। আমাদের ছেড়ে দাও। যেতে দাও।

য়ুহা অবাক হয়ে দেখে তাদের চারপাশের দেয়ালগুলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু আগে সেগুলো প্রায় মসৃণ ছিল, এখন সেগুলো অসমান, কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। গোলাকার অংশ ফুলে ফুলে বের হয় আসছে। তার চারপাশে শুড়ের মতো অংশ কিলবিল করতে করতে নড়ছে। য়ুহা চারদিকে তাকিয়ে খপ করে অস্ত্রটা তুলে নেয়, সাথে সাথে শুড়ের মতো একটা অংশ তাকে জড়িয়ে ধরে ফেলে। য়ুহা ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, পারে না। সে রায়ীনার দিকে তাকালো, বেশ কয়েকটা শুড়ের মতো জিনিস তাকেও জাপটে ধরেছে, রায়ীনা প্রাণপণ চেষ্টা করছে মুক্ত হবার জন্যে কিন্তু মুক্ত হতে পারছে না। গোলাকার জিনিসগুলো তাদের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে, য়ুহা তখন সেগুলোকে চিনতে পারে। গোলাকার জিনিসগুলো এক ধরনের চোখ, একটি দুটি নয় অসংখ্য চোখ তাদের দেখছে। গভীরভাবে দেখছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

পেঁচিয়ে থাকা শুড়গুলো য়ুহাকে জাপটে ধরে ওলট পালট করে, কানের ভেতর ভেঁতা একটা যান্ত্রিক শব্দ, চোখের সামনে একটা লাল পর্দা ঝুলছে। মাথার ভেতরে একটা দপদপে যন্ত্রণা, মনে হচ্ছে পুরো মস্তিষ্কটা বুঝি ফেটে বের হয়ে যাবে। সে মাথা ঘুরিয়ে রায়ীনাকে দেখার চেষ্টা করল। কিলবিলে শুড় আর ছোট-বড় অসংখ্য চোখের আড়ালে সে ঢাকা পড়ে গেছে। সামনে কিছু একটা খুলে যায়, বিশাল এলাকা জুড়ে কিছু একটা থলথল করছে, নড়ছে, মাঝে মাঝে বুদবুদের মতো কিছু একটা বের হয়ে আসছে। শুড়ের মতো কিছু বের হয়ে আসছে, আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। অহা টের পেল তাকে সেখানে ফেলে দেয়া হলো, থলথলে আঠালো একটা ঘন তরলের মাঝে সে ড়ুবে যাচ্ছে, অসংখ্য নল তাকে পেচিয়ে ধরেছে, তাকে দেখছে, নাড়ছে। য়ুহা পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছিল না। ভয়ঙ্কর আতঙ্কে সে চিৎকার করে ওঠে, রায়ীনা–রায়ীনা-

কেউ তার কথার উত্তর দিল না।