১৭. পত্রাবলী ৫৩৫-৫৪৪

৫৩৫*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৫ জুলাই, ১৯০১

প্রিয় মেরী,
তোমার সুদীর্ঘ সুন্দর চিঠিখানির জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ; বিশেষতঃ আমার মনের প্রফুল্লতার জন্য এখনই এ-রকম একটি চিঠির প্রয়োজন ছিল। আমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ যাচ্ছে। কিছুদিনের জন্য আরোগ্যলাভ করি, তারপরেই আসে অবশ্যম্ভাবী ভাঙন। যাই হোক এই হল রোগটার প্রকৃতি।

সম্প্রতি আমি পূর্ববাঙলা ও আসাম পরিভ্রমণ করছিলাম। কাশ্মীরের পরেই আসাম ভারতের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা, কিন্তু খুবই অস্বাস্থ্যকর। দ্বীপময় বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাহাড়-পর্বতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে, এ দৃশ্য দেখবার মত।

তুমি জান, আমার এই দেশকে বলা হয় জলের দেশ। কিন্তু তার তাৎপর্য পূর্বে কখনও এমন ভাবে উপলব্ধি করিনি। পূর্ববাঙলার নদীগুলি যেন তরঙ্গসঙ্কুল স্বচ্ছ জলের সমুদ্র, নদী মোটেই নয়, এবং সেগুলি এত দীর্ঘ যে ষ্টীমার—সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাদের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে।

মিস ম্যাকলাউড এখন জাপানে। দেশটি দেখে সে একান্ত মুগ্ধ। আমাকে যেতে লিখেছে, কিন্তু এরূপ দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা আমার শরীর সইতে পারবে না বলে বিরত হয়েছি। জাপান আমার পূর্বেই দেখা আছে।

তাহলে তুমি ভিনিসে আনন্দ উপভোগ করছ। বৃদ্ধটি নিশ্চয়ই খুব আমোদপ্রিয়; তবে বৃদ্ধ শাইলকের বাড়ীও ছিল ভিনিসে, তাই নয় কি?

স্যাম এ বছর তোমার সঙ্গে আছে—তাতে আমি খুবই আনন্দিত। উত্তরাঞ্চলের নিরানন্দ অভিজ্ঞতার পর সে নিশ্চয়ই ইওরোপের ভাল জিনিষগুলি উপভোগ করবে। বর্তমানে কোন নূতন চিত্তাকর্ষক বন্ধু আমার জোটেনি, পুরানো যাদের কথা তুমি জান, তাঁরা প্রায় সকলেই ইহজগৎ থেকে বিদায় নিয়েছেন, এমন কি খেতড়ির রাজা পর্যন্ত। সেকেন্দ্রায় সম্রাট্‌ আকবরের সমাধির একটি উঁচু চূড়া থেকে পড়ে গিয়ে তিনি মারা গিয়েছেন। আগ্রার এই পুরাতন রমণীয় স্থাপত্যকীর্তিটি তিনি নিজব্যয়ে সংস্কার করছিলেন, কাজটা পরিদর্শন করতে গিয়ে একদিন পা পিছলে গিয়ে একেবারে কয়েক-শ ফুট নীচে পড়ে যান। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের প্রতি অত্যধিক আগ্রহের ফলে এভাবে মাঝে মাঝে আমাদের দুঃখ পেতে হয়। সাবধান মেরী, তুমি ভারতীয় ধ্বংসাবশেষটির সম্বন্ধে খুব বেশী আগ্রহান্বিত হয়ো না।

মিশনের সীলমোহরে সাপটি হল রহস্যবিদ্যার (mysticism) প্রতীক; সূর্য জ্ঞানের; তরঙ্গায়িত জল কর্মের; পদ্ম প্রেমের; সকলের মাঝখানে হংসটি হল আত্মার প্রতীক।

স্যাম এবং মাকে ভালবাসা।

সদা প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমার চিঠি সংক্ষিপ্ত করতে হল; আমি সর্বদাই অসুস্থ; এই হল শরীর!

৫৩৬*

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৬ জুলাই, ১৯০১

প্রিয় ক্রিষ্টিন,
এক-একবার এক-একটি কাজের ঝোঁক যেন আমায় পেয়ে বসে। আজ লেখার নেশায় আছি। তাই সর্বাগ্রে তোমাকেই কয়েক পঙ‍্‍ক্তি লিখছি। দুর্নাম আছে, আমার ধাত স্নায়ু-প্রধান—আমি অল্পেতেই ব্যাকুল হয়ে পড়ি। কিন্তু প্রিয় ক্রিষ্টিন, এ বিষয়ে তুমিও তো আমার চেয়ে নেহাৎ কম বলে মনে হয় না। আমাদের জনৈক কবি লিখেছেন, ‘হয়তো পর্বত নিশ্চিহ্ন হবে, অগ্নিও শীতল হবে, কিন্তু মহতের হৃদয় কখনও মহত্ত্ব হারাবে না।’ আমি ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র; কিন্তু আমি জানি যে তুমি মহৎ, আর তোমার মহত্ত্বে আমার সর্বদা আস্থা আছে। অন্য সকলের বিষয়ে ভাবনা হলেও তোমার সম্পর্কে আমার একটুও দুশ্চিন্তা নেই।

জগজ্জননীর কাছে তোমাকে সমর্পণ করেছি। তিনিই তোমাকে সর্বদা রক্ষা করবেন ও পথ দেখাবেন। এ কথা নিশ্চয় জানি যে, কোন অনিষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না—কোন বাধাবিঘ্ন মুহূর্তের জন্যও তোমাকে নিরুৎসাহ করতে পারবে না। ইতি

ভগবদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

৫৩৭*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৭ অগষ্ট, ১৯০১

প্রিয় মেরী,
তুমি যেমন চেয়েছিলে, আমার শরীরের অবস্থা যদি তেমন থাকত—অন্ততঃ তোমাকে একটি বড় চিঠি লেখার মত! বস্তুতঃ, দিন দিন শরীর আরও খারাপের দিকে চলেছে এবং সে ছাড়াও কত সব জটিল ও বিরক্তিকর উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। সে সব লক্ষ্য করা আমি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি।

সুইজারল্যাণ্ডের রমণীয় কাঠের কুটীরে তোমাদের সর্ববিধ আনন্দলাভ হোক, এই আমার শুভাকাঙ্ক্ষা—চমৎকার স্বাস্থ্য, উত্তম ক্ষুধা, এবং চাঙ্গা হবার জন্য সুইজারল্যাণ্ডের বা অন্যান্য প্রাচীন কীর্তির একটু আধটু চর্চা। তুমি পর্বতের মুক্ত বায়ু সেবন করছ জেনে খুব আনন্দিত, কিন্তু স্যামের শরীর সুস্থ নেই জেনে দুঃখিত। তবে তার জন্য কোন উদ্বেগের কারণ নেই, তার শরীরের গঠন এতই সুন্দর!

‘নারীর মনোভাব ও পুরুষের ভাগ্য—দেবতারাও জানেন না, মানুষ কোন্‌ ছার?’৪১ আমার সহজাত প্রকৃতি অনেকটা নারীসুলভ হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যা নিয়ে চিন্তিত, তা হল—তোমার মধ্যে কিছুটা পৌরুষ সঞ্চারিত হোক। অহো মেরী, তোমার মেধা স্বাস্থ্য সৌন্দর্য সবই শুধু একটি প্রয়োজনীয় জিনিষের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—তা হল ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। তোমার ঔদ্ধত্য, উৎসাহ ইত্যাদি সব কিছুই অর্থহীন ও কৃত্রিম, তুমি বড়জোর একটি বোর্ডিঙ-স্কুলের মেয়ে—মেরুদণ্ডহীন, মেরুদণ্ডবিহীন!

হায়! জীবনভোর এই শিশু-হাঁটানোর প্রচেষ্টা! কথাটা খুবই রূঢ়, খুবই নির্দয়, কিন্তু উপায় নেই। মেরী, তোমাকে আন্তরিক ও অকপট স্নেহ করি; ভাবপ্রবণ বাক্যের মিছরি দিয়ে তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারি না। সে সব আমার কখনও আসে না।

তারপর আবার, আমি এখন মৃত্যুপথযাত্রী। ভাঁড়ামি করবার সময় আমার নেই। জাগো, বালিকা। তোমার কাছ থেকে এখন আমি কঠোর সমালোচনাপূর্ণ চিঠি আশা করছি; সোজাসুজি আঘাত কর, বেশ খানিকটা জাগানো চাই আমাকে।

ম্যাকভী-রা (Mac Veaghs) যখন এখানে ছিলেন, তখন আমি তাদের কোন খবর পাইনি। নিবেদিতা বা মিসেস বুলের কাছ থেকে সোজাসুজি কোন সংবাদ পাইনি, কিন্তু মিসেস সেভিয়ারের পত্র নিয়মিত পাই। তাঁরা সকলে এখন নরওয়েতে মিসেস বুলের অতিথি।

নিবেদিতা কবে ভারতে আসবে, কিম্বা আদৌ আসবে কিনা, জানি না।

এক অর্থে আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি; ‘আন্দোলন’ কি রকম চলছে, তার অনেক কিছুরই আমি বিশেষ লক্ষ্য রাখি না; তবে ‘আন্দোলন’ জোরাল হচ্ছে—একজন লোকের পক্ষে সবকিছু খুঁটিনাটি জানা সম্ভব নয়।

আহার ও নিদ্রার চেষ্টা ছাড়া এখন আর কিছুই করছি না, বাকী সময়টা শরীরের শুশ্রূষা করে কাটাই। প্রিয় মেরী, বিদায়; আশা করি এ জীবনে আমরা আবার কোথাও মিলিত হব; তবে দেখা হোক বা নাই হোক, আমি সতত তোমার স্নেহের ভ্রাতা।

 

সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

৫৩৮*

[শ্রীমহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৯ অগষ্ট, ১৯০১

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
আমার শরীর ক্রমেই সুস্থ হচ্ছে, যদিও এখনও আমি খুবই দুর্বল। … সুগার বা এলবুমেন নেই দেখে সকলেই অবাক। বর্তমান অস্বস্তি শুধু স্নায়বিক। যাই হোক, আমি ক্রমে সেরে উঠছি।

মা-ঠাকরুণ দয়া করে যে প্রস্তাব করেছেন, তাতে আমি বিশেষ কৃতার্থ হয়েছি। কিন্তু মঠের সবাই বলছে যে, নীলাম্বরবাবুর বাড়ী, এমন কি গোটা বেলুড় গ্রামই এ মাসে ও পরের মাসে ম্যালেরিয়ায় ছেয়ে যায়। তারপর ভাড়াও অত্যধিক। সুতরাং মা-ঠাকরুণ যদি আসতে চান, তবে আমি তাঁকে এই পরামর্শ দিই যে, তিনি কলিকাতায় একটি ছোট বাড়ী ঠিক করুন। আমিও সম্ভবতঃ কলিকাতায় গিয়েই থাকব; কারণ বর্তমান শারীরিক দুর্বলতার উপর আবার ম্যালেরিয়া হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। আমি এখন সারদানন্দ বা ব্রহ্মানন্দের মত লই নাই। তারা দুজনেই কলিকাতায় আছে। এ দু-মাস কলিকাতায় স্বাস্থ্য অনেকটা ভাল এবং খরচও অনেক কম।

ফল কথা, প্রভু তাঁকে যেরূপ চালান, তিনি সেরূপই চলবেন। আমরা শুধু প্রস্তাব করতে পারি; আমরা যা বলব, তা একেবারে ভুলও হতে পারে। তিনি যদি থাকার জন্য নীলাম্বরবাবুর বাড়ীই পছন্দ করেন, তবে ভাড়া ইত্যাদি আগে থেকেই ঠিক করে রেখ। মায়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক—আমি তো এইটুকুই বুঝি।

আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জেনো। ইতি

 

সতত প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

৫৩৯*

[শ্রীমহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০১

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
ব্রহ্মানন্দ ও অপর সকলের মতামত জানা আবশ্যক হওয়ায়, এবং তারা সকলেই কলিকাতায় থাকায় তোমার শেষ পত্রের উত্তর দিতে দেরী হয়ে গেল।

সারা বছরের জন্য বাড়ী নেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভেবে-চিন্তে করতে হবে। একদিকে যেমন এ মাসে বেলুড়ে ম্যালেরিয়া হবার ভয় আছে, অন্যদিকে তেমনি কলিকাতায় প্লেগের ভয়। তা ছাড়া কেউ যদি গাঁয়ের ভিতরে যাওয়া সম্বন্ধে সাবধান থাকে, তবে ম্যালেরিয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে; কারণ নদীর ধারে ম্যালেরিয়া মোটেই নেই। প্লেগ এখনও নদীর ধারে আসেনি; আর প্লেগের এই প্রকোপ-কালে এ গাঁয়ে যে-কটা বাড়ী ছিল, সবই মাড়োয়ারীদের দ্বারা ভর্তি।

তা ছাড়া, সবচেয়ে বেশী তুমি কত ভাড়া দিতে পার তা জানাও, আমরা তদনুযায়ী বাড়ী দেখব। আর একটা প্রস্তাব হচ্ছে, বাড়ীটি কলিকাতায় নেওয়া। আমি নিজে এখন কলিকাতায় বিদেশী বললেই হয়, তোমার পছন্দমত অন্যেরা দেখে দেবে। যত শীঘ্র সম্ভব এ দুটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত করতে পার ততই ভালঃ (১) মা বেলুড়ে থাকবেন, না কলিকাতায়? (২) যদি কলিকাতায় থাকেন, তবে ভাড়া কত এবং কোন্‌ পাড়ায় থাকা তাঁর পক্ষে ভাল? তোমাদের উত্তর পেলে এ কাজটা ঝট করে হয়ে যাবে।

আমার আন্তরিক ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবে। ইতি

 

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—এখানে আমরা সবাই ভাল আছি। এক সপ্তাহ কলিকাতায় থেকে মতি ফিরে এসেছে। গত তিন দিন এখানে দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দুটি গরুর বাচ্চা হয়েছে।

—বি

৫৪০*

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০১

কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
আমরা সকলেই সাময়িক আবেগে চলি—অন্ততঃ এ-কাজটার বেলায় তাই। আমি স্প্রিংটি (কাজের ঝোঁকটি) চেপে রাখতে চাই; কিন্তু এমন একটা কিছু ঘটে যায়, যার ফলে স্প্রিং অবিরত শব্দ করতে থাকে; আর তা তো দেখতেই পাচ্ছ—এই চিন্তা চলছে, স্মরণ হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, আঁচড় কাটা হচ্ছে—আরও কত কিছু!

বর্ষার কথা বলতে গেলে বলতে হয় পূর্ণবেগে তা এসে গেছে, আর দিনরাত চলেছে মুষলধারে বর্ষণ, কেবল বৃষ্টি—বৃষ্টি—আর বৃষ্টি। নদী সব ফুলে উঠে দু-কূল ভাসিয়ে চলেছে, দীঘি-পুকুর সব ভরপুর।

মঠের জমিতে যে বর্ষার জল দাঁড়ায়, তার নিষ্কাশনের জন্য একটি গভীর নর্দমা কাটা হচ্ছে। সেই কাজে খানিকটা খেটে আমি এইমাত্র ফিরলাম। কোন কোন জায়গায় বৃষ্টির জল কয়েক ফুট দাঁড়িয়ে যায়। আমার সেই বিশালাকার সারসটি এবং হংস-হংসীগুলি খুব স্ফূর্তিতে আছে। আমার পোষা কৃষ্ণসার (হরিণ)-টি মঠ থেকে পালিয়েছিল এবং তাকে খুঁজে বের করতে আমাদের দিন-কয়েক বেশ উদ্বেগে কাটাতে হয়েছে। আমার একটি হংসী দুর্ভাগ্যক্রমে কাল মারা গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমাদের একজন হাস্যরসিক বৃদ্ধ সাধু তাই বলছিলেন, ‘মশায় এই কলিযুগে যখন জল-বৃষ্টিতে হাঁসেরও সর্দি লাগে, আর ব্যাঙও হাঁচতে শুরু করে, তখন আর বেঁচে থেকে লাভ নেই।’

একটি রাজহংসীর পালক খসে যাচ্ছিল। আর কোন প্রতিকার জানা না থাকায় একটি টবে খানিকটা জলের সঙ্গে একটু কার্বলিক অ্যাসিড মিশিয়ে তাতেই কয়েক মিনিটের জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল—উদ্দেশ্য ছিল যে, হয় সেরে উঠবে, না হয় মরে যাবে; তা হংসীটা এখন ভাল আছে। ইতি

 

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৫৪১*

প্রিয় নিবেদিতা,
… জীবনের স্রোতে উঠছি, পড়ছি। আজ যেন কতটা অবতরণের পথে …।

 

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৫৪২*

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
৮ সেপ্টেম্বর, ১৯০১

প্রিয় জো,
Abatement—কথাটার ব্যাখ্যাসমেত যে চিঠিখানা গেছে, তা তুমি ইতোমধ্যেই পেয়েছ নিশ্চয়। আমি নিজে সে চিঠি লিখিনি, আর টেলিগ্রামও পাঠাইনি। আমি তখন এত অসুস্থ ছিলাম যে, দুটোর একটাও করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পূর্ববঙ্গ-ভ্রমণের পর থেকে শয্যাগত আছি বললেই হয়। দৃষ্টিশক্তির হ্রাস—এই আর একটি উপসর্গ জোটায় এখন আমি আগের চেয়েও খারাপ। এ-সব বিষয়ে আমি লিখতুম না’ কিন্তু কেউ কেউ দেখছি সব খুঁটিনাটি চায়।

যা হোক, তুমি তোমার জাপানী বন্ধুদের নিয়ে আসছ জেনে বেশ আনন্দিত হলাম। আমার ক্ষমতায় যতটা কুলায়, আমি তাঁদের খাতির-যত্ন করব। খুব সম্ভব আমি তখন মান্দ্রাজে থাকব। আমি ভাবছি যে, আগামী সপ্তাহে কলিকাতা ছাড়ব এবং ক্রমশঃ দক্ষিণদিকে এগিয়ে যাব।

তোমার জাপানী বন্ধুদের সঙ্গে উড়িষ্যার মন্দিরগুলি দেখা সম্ভব হবে কিনা, জানি না। আমি ম্লেচ্ছদের খাবার খেয়েছি বলে আমাকেই ঢুকতে দেবে কিনা, জানি না। লর্ড কার্জনকে ভেতরে যেতে দেয়নি।

যা হোক, আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব, তা আমি তোমার বন্ধুদের জন্য করতে সর্বদা প্রস্তুত। মিস মূলার কলিকাতায় আছেন, অবশ্য তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি।

 

সতত স্নেহশীল
তোমাদের বিবেকানন্দ

৫৪৩*

গোপাললাল ভিলা
বেনারস ক্যাণ্টনমেণ্ট
৯ ফেব্রুআরী, ১৯০২

প্রিয় স্বরূপ,
মিসেস বুলের কণ্ঠাস্থি (Collar-bone)-র অবস্থা জেনে বড় কষ্ট হল। আশা করি চলে-ফিরে বেড়াবার মত শক্তি তিনি পাবেন। তাঁকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে। চারুর চিঠি সম্বন্ধে উত্তর এই, তাকে বলবে সে যেন ‘ব্রহ্মসূত্র’ নিজে নিজে পড়ে। ‘ব্রহ্মসূত্রে বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ আছে’—চারুর এ-কথার অর্থ কি? অবশ্য সে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যগুলিকে লক্ষ্য করেই এ কথা বলেছে, আর সেগুলিকে লক্ষ্য করেই বলা উচিত; ভাষ্যকারদের মধ্যে শঙ্কর তো শুধু শেষ ভাষ্যকার। বৌদ্ধসাহিত্যে অবশ্য বেদান্তের উল্লেখ আছে, আর বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখা তো অদ্বৈতপন্থী। বৌদ্ধ অমরসিংহ বুদ্ধদেবের একটি নাম ‘অদ্বয়বাদী’ বলে উল্লেখ করলেন কেন? চারু লিখেছে, উপনিষদে ‘ব্রহ্ম শব্দের উল্লেখ নাই!! কি আহাম্মকি!

আমার মতে বৌদ্ধধর্মের শাখাদ্বয়ের মধ্যে মহাযান প্রাচীনতর। মায়াবাদ ঋক‍্সংহিতার মতই প্রাচীন। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যে ‘মায়া’ শব্দ আছে, সেটি ‘প্রকৃতি’র ভাব থেকে ক্রমশঃ বিকশিত হয়েছে। আমার মতে ঐ উপনিষদ্ অন্ততঃ বৌদ্ধধর্ম থেকে প্রাচীনতর।

সম্প্রতি আমি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে অনেক নূতন আলো পেয়েছি। আর আমি প্রমাণ করতে প্রস্তুত আছিঃ

(১) নানা আকারের শিবপূজা বৌদ্ধদের আগেই প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধগণ শৈবদের স্থানগুলি দখল করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাতে অকৃতকার্য হয়ে সেই আবেষ্টনীরই মধ্যে নিজেদের নূতন নূতন স্থান করে নিয়েছিল—যেমন বুদ্ধগয়ায় ও সারনাথে।

(২) অগ্নিপুরাণে গয়াসুর সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে, তাতে (যেমন ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মত) বুদ্ধদেবকে মোটেই লক্ষ্য করা হয়নি, ওটা কেবল পূর্বপ্রচলিত একটি উপাখ্যান মাত্র।

(৩) বুদ্ধ যে গয়শীর্ষ পর্বতে বাস করতে গিয়েছিলেন, তাতেই ঐ স্থানের পূর্বাস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।

(৪) আগে থেকেই গয়াতে পিতৃপুরুষের উপাসনা প্রচলিত ছিল, আর বৌদ্ধেরা হিন্দুদের কাছ থেকে পদচিহ্ন-উপাসনার অনুকরণ করেছিল।

(৫) বারাণসী সম্বন্ধে বক্তব্য এইঃ এটি শিবোপাসনার একটি প্রধান স্থান ছিল, ইত্যাদি কথা প্রাচীনতম লিপি প্রভৃতি থেকে প্রমাণিত হয়।

আমি বুদ্ধগয়া ও সাহিত্য থেকে অনেক নূতন তথ্য সংগ্রহ করেছি। চারুকে বল, সে নিজে নিজে পড়ুক, মূর্খদের মত দ্বারা যেন প্রভাবিত না হয়।

আমি এখন বারাণসীতে বেশ ভালই আছি। যদি ধীরে ধীরে এ ভাবেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে থাকে। তবে বেশ লাভই হবে।

বৌদ্ধধর্ম ও আধুনিক হিন্দুধর্মের সম্বন্ধ-বিষয়ে আমার মতের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। আমি এ বিষয়ে একটু-আধটু আলো দেখতে পেয়েছি, তা বিশেষ ভাবে বুঝবার আগেই আমার শরীর যেতে পারে; কিন্তু কি ভাবে এ বিষয়ে অগ্রসর হতে হবে, তা আমি দেখিয়ে দিয়ে যাব; তোমাকে ও তোমাদের গুরুভাইদের তা কার্য পরিণত করতে হবে। তুমি আমার বিশেষ ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

 

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৫৪৪*

[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

গোপাললাল ভিলা, বেনারস ক্যাণ্টনমেণ্ট
১০ ফেব্রুআরী ১৯০২
মাতা ও কন্যাকে ভারতে আবার স্বাগত জানাচ্ছি। জো-র সৌজন্যে মান্দ্রাজের একখানি সংবাদপত্র পেয়ে আমি বিশেষ আনন্দিত হয়েছি; নিবেদিতা মান্দ্রাজে যে অভ্যর্থনা পেয়েছে, তা নিবেদিতা ও মান্দ্রাজ উভয়ের পক্ষেই কল্যাণকর। তার ভাষণ যথার্থই সুন্দর হয়েছিল।

সুদীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করে—আশা করি, আপনি এখন ভালভাবে বিশ্রাম নিচ্ছেন, এবং নিবেদিতা বিশ্রাম নিচ্ছে। আমার একান্ত ইচ্ছা যে, আপনারা কয়েক ঘণ্টার জন্য কলিকাতার পশ্চিমের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে কাঠ, বাঁশ, বেত, অভ্র ও খড়ের তৈরী পুরাতন বাঙলার চালাঘর দেখে আসুন। এই বাংলোগুলি অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্যের নিদর্শন। হায়! আজকাল শুয়োরের খোঁয়ারের মত ঘরগুলোরও ‘বাংলো’ নাম দেওয়া হয়।

প্রাচীনকালে কোন ব্যক্তি যখন প্রাসাদ নির্মাণ করতেন, তার সঙ্গে অতিথি-আপ্যায়নের জন্য একটি বাংলোও তৈরী করতেন। সেই শিল্প লুপ্ত হতে চলেছে। নিবেদিতার সমগ্র বিদ্যালয়টি যদি সেই ছাঁচে তৈরী করে দিতে পারতাম! তবে এখনও যে ক-টি অবশিষ্ট আছে, তাই দেখে রাখা ভাল, অন্ততঃ একটিও। ব্রহ্মানন্দ তার ব্যবস্থাদি করবেন; আপনাদের কাজ শুধু কয়েক ঘণ্টার ভ্রমণ।

ছোটখাট একটু ভ্রমণে মিঃ ওকাকুরা বেরিয়ে পড়েছেন—আগ্রা, গোয়ালিয়র, অজন্তা, ইলোরা, চিতোর, উদয়পুর, জয়পুর এবং দিল্লী দেখবার অভিপ্রায় নিয়ে। বারাণসীর এক সুশিক্ষিত ধনী যুবা—যার পিতার সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের বন্ধুত্ব ছিল—গতকাল এই শহরে এসেছে। শিল্প সম্বন্ধে তার বিশেষ আগ্রহ; লুপ্তপ্রায় ভারতীয় শিল্প পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় সে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রচুর অর্থব্যয় করেছে। মিঃ ওকাকুরার চলে যাবার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাকে শিল্পময় ভারত (অর্থাৎ যতটুকু অবশিষ্ট আছে) দেখাবার সে-ই উপযুক্ত লোক এবং শিল্প সম্বন্ধে ওকাকুরার নির্দেশে সে নিশ্চয়ই বিশেষ উপকৃত হবে। ওকাকুরা এখানে ভৃত্যদের ব্যবহারের একটি সাধারণ টেরাকোটার জলের পাত্র দেখতে পেয়েছিলেন। সেটির আকৃতি ও খোদিত কারুকার্য দেখে তিনি একেবারে মুগ্ধ। কিন্তু এটি একটি সাধারণ মৃৎপাত্র এবং পথের ধাক্কা সহ্য করার অনুপযোগী, তাই তিনি আমাকে অনুরোধ করে গিয়েছেন, পিতল দিয়ে অবিকল সেরূপ আর একটি তৈরী করাতে। কি করা যায় ভেবে ভেবে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টা পরে আমার যুবক বন্ধুটি আসে, সে সেটা করে দিতে রাজী তো হয়েছেই, আবার বলেছে, ওকাকুরার পছন্দ ওই জিনিষটির চেয়ে বহুগুণ ভাল খোদিত কারুকার্যবিশিষ্ট কয়েক-শ টেরাকোটার পাত্র সে দেখাতে পারে।

সেই অপূর্ব পুরাতন শৈলীতে প্রাচীন চিত্রাবলীতে ও সে দেখাবে বলেছে। প্রাচীন রীতিতে আঁকতে পারে, এরূপ একটি মাত্র পরিবার বারাণসীতে টিকে আছে। তাদের মধ্যে একজন একটি মটর-দানার উপর শিকারের একটি সম্পূর্ণ চিত্র এঁকেছেন—খুঁটিনাটি বর্ণনাসহ একেবারে নিখুঁত কাজ। পর্যটন শেষ করে ওকাকুরা আবার আশা করি এই শহরে ফিরে আসবেন, তখন এই ভদ্রলোকের অতিথি হয়ে অবশিষ্ট দ্রষ্টব্য জিনিষগুলি কিছু কিছু দেখে যাবেন।

মিঃ ওকাকুরার সঙ্গে নিরঞ্জন গিয়েছে। তিনি জাপানী বলে কোন মন্দিরে তাঁর প্রবেশ করা নিয়ে কেউ আপত্তি করে না। মনে হয়, তিব্বতী ও অন্যান্য উত্তরদেশীয় বৌদ্ধগণ বরাবরই শিবপূজার উদ্দেশ্যে এখানে আসছেন।

তারা তাঁকে শিবের প্রতীক স্পর্শ করতে ও পূজা করতে দিয়েছে। মিসেস এনি বেস্যাণ্ট একবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বেচারী যদিও খালি পায়ে শাড়ী পরে পুরোহিতদের সামনে দীনহীনভাবে ধূলোয় লুটিয়ে পড়েছিলেন, তথাপি তাঁকে মন্দিরপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আমাদের বড় বড় মন্দিরগুলিরকোনটাতেই বৌদ্ধদের অহিন্দু বলে মনে করা হয় না।

আমার এখনও কিছু স্থির হয়নি; শীঘ্রই এ স্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারি। শিবানন্দ ও ছেলেরা (শিষ্যরা) আপনাকে তাদের স্বাগত, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাচ্ছে।

আপনার চিরদিনের
অশেষ স্নেহের সন্তান
বিবেকানন্দ