৭৫*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
হাই ভিউ, রিডিং
২০ এপ্রিল, ১৮৯৬
স্নেহের ভগিনীগণ,
সমুদ্রের অপর পার থেকে তোমাদের অভিনন্দন জানাই। এবার সমুদ্রযাত্রা আনন্দদায়ক হয়েছে এবং কোন পীড়া হয়নি। সমুদ্রপীড়া এড়াবার জন্য আমি নিজেই কিছু চিকিৎসা করেছিলাম। আয়ার্লণ্ডের মধ্য দিয়ে এবং ইংলণ্ডের কয়েকটি পুরানো শহর দেখে এক দৌড়ে ঘুরে এলাম, এখন আবার রিডিং-এ ‘ব্রহ্ম, মায়া, জীব, জীবাত্মা ও পরমাত্মা’ প্রভৃতি নিয়ে আছি। অপর সন্ন্যাসীটি এখানে রয়েছে; আমি যত লোক দেখেছি, তাদের মধ্যে তিনি একজন চমৎকার লোক, বেশ পণ্ডিতও। আমরা এখনও গ্রন্থগুলি সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত। পথে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি—নিতান্তই নীরস, একটানা এবং গদ্যময়, আমার জীবনেরই মত। আমি যখন আমেরিকার বাইরে যাই, তখনই আমেরিকাকে বেশী ভালবাসি। যাই হোক, এ পর্যন্ত যা দেখছি, তার মধ্যে ওখানকার কয়েকটি বছরই সর্বোৎকৃষ্ট।
তোমরা কি ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য কিছু গ্রাহক সংগ্রহের চেষ্টা করছ? মিসেস এডামস্ (Mrs. Adams) ও মিসেস কংগারকে (Mrs. Conger) আমার ভালবাসা জানাবে। যত শীঘ্র পার তোমাদের সকলের কথা আমাকে লিখবে—আর তোমরা কি করছ, তোমাদের পান, ভোজন ও ঘুরে বেড়ানর একঘেয়েমি কি দিয়ে ভাঙছ? এখন একটু তাড়াতাড়ি, পরে এর চেয়ে বড় চিঠি লিখব; সুতরাং বিদায় এবং তোমরা সর্বদা সুখী হও।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমি সময় পেলেই মাদার চার্চের কাছে লিখব। স্যাম এবং ভগিনী লককে আমার ভালবাসা।
বি
২৭৬*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
মে, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনী,
আবার লণ্ডনে। এখন ইংলণ্ডের আবহাওয়া বেশ চমৎকার ও ঠাণ্ডা; ঘরে অগ্নিকুণ্ডে আগুন রাখতে হয়। তুমি জেন, আমাদের ব্যবহারের জন্য এবার একটা গোটা বাড়ী পাওয়া গেছে। বাড়ীটি ছোট হলেও বেশ সুবিধাজনক। লণ্ডনে বাড়ীভাড়া আমেরিকার মত তত বেশী নয়, তা বোধ হয় তুমি জান। এই তোমার মার কথাই ভাবছিলাম। এইমাত্র তাঁকে একখানা চিঠি লিখে C/o Monroe & Co., 7 Rue Scribe, Paris—এই ঠিকানায় পাঠিয়েছি। এখানে জনকয়েক পুরানো বন্ধুও আছেন। মিস ম্যাকলাউড সম্প্রতি ইওরোপ ভ্রমণ করে লণ্ডনে ফিরেছেন। তাঁর স্বভাবটি সোনার মত খাঁটি এবং তাঁর স্নেহপ্রবণ হৃদয়টির কোন পরির্বতন হয়নি। আমরা এই বাড়ীতে বেশ ছোটখাট একটি পরিবার হয়েছি; আর আমাদের সঙ্গে আছেন ভারতবর্ষ থেকে আগত একজন সন্ন্যাসী। ‘বেচারা হিন্দু’ বলতে যা বুঝায়, তা এঁকে দেখলেই বেশ বুঝতে পারবে। সর্বদাই যেন ধ্যানস্থ রয়েছেন, অতি নম্র ও মধুরস্বভাব। আমার যেমন একটা অদম্য সাহস এবং ঘোর কর্মতৎপরতা আছে, তাঁতে তার কিছুই নেই। ওতে চলবে না। আমি তাঁর ভেতর একটু কর্মশীলতা প্রবেশ করিয়ে দেবার চেষ্টা করব। এখনই আমার দুটি করে ক্লাসের অধিবেশন হচ্ছে। চার-পাঁচ মাস ঐরূপ চলবে—তারপর ভারতে যাচ্ছি; কিন্তু আমেরিকাতেই আমার হৃদয় পড়ে আছে—আমি ইয়াঙ্কি দেশ ভালবাসি। আমি সব নূতন দেখতে চাই। পুরাতন ধ্বংসাবশেষের চারদিকে অলসভাবে ঘুরে বেড়িয়ে সারাজীবন প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে হা-হুতাশ করে আর প্রাচীনকালের লোকদের কথা ভেবে ভেবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে রাজী নই। আমার রক্তের যা জোর আছে, তাতে ঐরূপ করা চলে না। সকল ভাব প্রকাশের উপযুক্ত স্থান, পাত্র ও সুযোগ কেবল আমেরিকাতেই আছে। আমি আমূল পরিবর্তনের ঘোরতর পক্ষপাতী হয়ে পড়েছি। শীঘ্রই ভারতবর্ষে ফিরব, পরিবর্তনবিরোধী থসথসে জেলি মাছের মত ঐ বিরাট পিণ্ডটার কিছু করতে পারি কিনা দেখতে। তারপর প্রাচীন সংস্কারগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নূতন করে আরম্ভ করব—একেবারে সম্পূর্ণ নূতন, সরল অথচ সবল—সদ্যোজাত শিশুর মত নবীন ও সতেজ। যিনি সনাতন, অসীম, সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ, তিনি কোন ব্যক্তিবিশেষ নন—তত্ত্বমাত্র। তুমি আমি সকলেই সেই তত্ত্বের বাহ্য প্রতিরূপ মাত্র। এই অনন্ত তত্ত্বের যত বেশী কোন ব্যক্তির ভিতর প্রকাশিত হয়েছে, তিনি তত মহৎ; শেষে সকলকেই তার পূর্ণ প্রতিমূর্তি হতে হবে; এরূপে এখনও যদিও সকলেই স্বরূপতঃ এক, তথাপি তখনই প্রকৃতপক্ষে সব এক হয়ে যাবে। ধর্ম এ ছাড়া আর কিছুই নয়; এই একত্ব অনুভব বা প্রেমই এর সাধন; সেকেলে নির্জীব অনুষ্ঠান এবং ঈশ্বরসম্বন্ধীয় ধারণাগুলি প্রাচীন কুসংস্কারমাত্র। বর্তমানেও সেগুলিকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করা কেন? পাশেই যখন জীবন ও সত্যের নদী বয়ে যাচ্ছে, তখন আর তৃষ্ণার্তদের নর্দমার জল খাওয়ান কেন? এটা মানুষের স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পুরাতন সংস্কারগুলোকে সমর্থন করে করে আমি বিরক্ত হয়ে পড়েছি। … জীবন ক্ষণস্থায়ী, সময়ও ক্ষিপ্রগতিতে চলে যাচ্ছে। যে স্থান ও পাত্রে ভাবরাশি সহজে কার্যে পরিণত হতে পারে, সেই স্থান ও পাত্রই প্রত্যেকের বেছে নেওয়া উচিত। হায়! যদি মাত্র বার জন সাহসী, উদার, মহৎ, সরলহৃদয় লোক পেতাম!
আমি নিজে বেশ আছি এবং জীবনটাকে খুব উপভোগ করছি। আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের বিবেকানন্দ
২৭৭*
লণ্ডন
৩০ মে, ১৮৯৬
প্রিয় মিসেস বুল,
… গত পরশু অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের সঙ্গে আমার বেশ দেখাশুনা হয়ে গেল। তিনি একজন ঋষিকল্প লোক; তাঁর বয়স ৭০ বৎসর হলেও তাঁকে যুবা দেখায়; এমন কি তাঁর মুখে একটি বার্ধক্যের রেখা নেই। হায়! ভারতবর্ষ ও বেদান্তের প্রতি তাঁর যেরূপ ভালবাসা তার অর্ধেক যদি আমার থাকত! তার উপর তিনি যোগশাস্ত্রের প্রতিও অনুকূল ভাব পোষণ করেন এবং তাতে বিশ্বাস করেন। তবে বুজরুকদের তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না।
সর্বোপরি রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপর তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি অগাধ এবং তিনি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’তে (Nineteenth Century) তাঁর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি তাঁকে জগতের সমক্ষে প্রচার করবার জন্য কি করছেন?’ রামকৃষ্ণ তাঁকে অনেক বৎসর যাবৎ মুগ্ধ করেছেন। এটা কি সুসংবাদ নয়?
এখানে কাজকর্ম ধীরে ধীরে—কিন্তু দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হচ্ছে। আগামী রবিবার থেকে জনসাধারণের জন্য আমার বক্তৃতা আরম্ভ হবে, ঠিক হয়েছে। ইতি—
আপনার চিরকৃতজ্ঞ ও স্নেহের
বিবেকানন্দ
২৭৮*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৩০ মে, ১৮৯৬
প্রিয় মেরী,
তোমার চিঠি এইমাত্র পেলাম। তুমি অবশ্যই ঈর্ষাপরায়ণ হওনি, কিন্তু দীন-দরিদ্র ভারতবর্ষের প্রতি সহসা যেন তোমার করুণা উথলে উঠেছিল। যা হোক, ভয় পাওয়ার কারণ নেই। … সপ্তাহ কয়েক আগে মাদার চার্চের (Mother Church) কাছে পত্র লিখেছিলাম; আজ পর্যন্ত একছত্র জবাব আদায় করতে পারিনি। ভয় হয়, তিনি দলবলসহ সন্ন্যাস গ্রহণ করে কোন ক্যাথলিক মঠে ঢুকে পড়েছেন; ঘরে চার-চারটি আইবুড়ো মেয়ে থাকলে বুড়ী মায়ের পক্ষে সন্ন্যাস না নিয়ে আর উপায় কি?
অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের সঙ্গে বেশ দেখাশুনা হয়ে গেল। তিনি ঋষিকল্প লোক—বেদান্তের ভাবে ভরপুর। তোমার কি মনে হয়? অনেক বছর যাবৎ তিনি আমার গুরুদেবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাসম্পন্ন। তিনি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’তে গুরুদেবের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন—তা শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। ভারতসংক্রান্ত নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হল। হায়! ভারতের প্রতি তাঁর প্রেমের অর্ধেকও যদি আমার থাকত!
এখানে আমরা আর একটি ক্ষুদ্র পত্রিকা বার করব। ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর খবর কি? তার প্রচার বাড়াচ্ছ তো? যদি চার জন উৎসাহী আইবুড়ী মিলে একখানা পত্রিকা ভাল রকম চালু করতে না পার তো আমার সকল আশায় জলাঞ্জলি! তুমি মাঝে মাঝে আমার চিঠি পাবে। আমি তো ছুঁচটি নই যে, যেখানে সেখানে হারিয়ে যাব! এখন এখানে ক্লাস খুলেছি। আগামী সপ্তাহ থেকে প্রতি রবিবার বক্তৃতা আরম্ভ করব। ক্লাসগুলি খুব বড় হয়; যে বাড়ীটি সারা মরশুমের জন্য ভাড়া করেছি, সেই বাড়ীতেই ক্লাস হয়। কাল রাত্রে আমি নিজেই রান্না করেছিলাম। জাফরান, লেভেণ্ডার, জয়ত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, মাখন, লেবুর রস, পেঁয়াজ, কিসমিস, বাদাম, গোলমরিচ এবং চাল—এগুলি মিলিয়ে এমনই সুস্বাদু খিচুড়ি বানিয়েছিলাম যে, নিজেই গলাধঃকরণ করতে পারিনি। ঘরে হিং ছিল না, নতুবা তার খানিকটা মিশালে গিলিবার পক্ষে সুবিধা হত।
কাল হালফ্যাশনের এক বিবাহে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু মিস মূলার নাম্নী জনৈকা ধনী মহিলা একটি হিন্দু ছেলেকে দত্তক গ্রহণ করেছেন এবং আমার কাজে সাহায্য করবার জন্য আমি যে বাড়ীতে আছি সেই বাড়ীতেই ঘর ভাড়া করেছেন। তিনিই বিয়ে দেখিবার জন্য আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠান যেন আর শেষ হয় না—কি আপদ! তুমি যে বিয়েতে নারাজ, এতে আমি খুশী। এখন বিদায়। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানিবে। আর লেখার সময় নাই; এখনি মিস ম্যাকলাউডের বাড়ীতে মধ্যাহ্ন-ভোজনে যাচ্ছি। ইতি
তোমাদের চির শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
২৭৯
ওঁ তৎ সৎ
England
মে (?) ১৮৯৬
প্রিয় শশী,
পূর্বপত্রে যদি ভুল হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই পত্রে লিখি যে, কালী যে দিবস start (যাত্রা) করিবে, সেদিন কিম্বা তাহার আগে যেন E. T. Sturdy (স্টার্ডি)-কে চিঠি লেখে, যাহাতে সে যাইয়া তাহাকে জাহাজ হইতে লইয়া আসে। এ লণ্ডন শহর মানুষের জঙ্গল—দশ পনরটা কলিকাতা একত্রে—অতএব ঐ প্রকার না করিলে গোলমাল হয়ে যাবে। আসতে দেরী যেন না হয়, পত্রপাঠ চলে আসতে বলবে। শরতের বেলার মত যেন না হয়। বাকী বুঝে-সুঝে ঠিক করে নেবে।
কালীকে যাই হোক সত্বর পাঠাবে। যদি শরতের বেলার মত দেরী হয় তো কাহাকেও আসতে হবে না; ও-রকম গড়িমসির কাজ নয়। মহা রজোগুণের কাজ, আমাদের দেশময় খালি তমস্, আমাদের দেশে রজস্ চাই—তারপর সত্ত্ব, সে ঢের দূরের কথা। ইতি
নরেন্দ্র
২৮০*
সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৫ জুন, ১৮৯৬
প্রিয়—,
‘রাজযোগ’ বইখানার খুব কাটতি হচ্ছে। সারদানন্দ শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রে যাবে।
আমার পিতা যদিও উকিল ছিলেন, তবু আমি ইচ্ছা করি না, আমাদের বংশের কেউ উকিল হয়। আমার গুরুদেব এর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং আমার বিশ্বাস, যে পরিবারে কতকগুলি উকিল আছে, সে পরিবারকে নিশ্চয়ই দুর্দশায় পড়তে হবে। আমাদের দেশ উকিলে ছেয়ে গেছে—প্রত্যেক বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত শত উকিল বার হচ্ছে। আমাদের জাতের পক্ষে এখন দরকার সাহস ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভা। সুতরাং আমার ইচ্ছা ম—তড়িত্তত্ত্ববিৎ হয়। সফল হতে না পারলেও সে যে বড় হবার এবং দেশের যথার্থ উপকারে আসবার চেষ্টা করেছিল—এইটুকু ভেবেই আমি সন্তুষ্ট হব। শুধু আমেরিকার বাতাসেই এমন একটি গুণ আছে যে, সেখানকার প্রত্যেকের ভেতর যা কিছু ভাল সমস্তই ফুটিয়ে তোলে। আমি চাই সে অকুতোভয় ও সাহসী হোক এবং তার নিজের ও স্বজাতির জন্য একটা নূতন পথ বার করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করুক। একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়র ভারতে অনায়াসে করে খেতে পারে।
পুঃ—গুডউইন আমেরিকায় একখানি মাসিক পত্র বার করা সম্বন্ধে তোমাকে এই ডাকে একখানা চিঠি লিখেছে। আমার মনে হয়, কাজটি বজায় রাখতে হলে এই রকমের একটা কিছু দরকার। আর সে যেভাবে কাজ করবার প্রস্তাব করছে, তাকে সেইভাবে ঐ বিষয়ে সাহায্য করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। … আমার মনে হয়, সে খুব সম্ভব সারদানন্দের সঙ্গে যাবে।
তোমাদের প্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
২৭১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬
কল্যাণীয়া মিস নোব্ল্,
আমার আদর্শকে বস্তুতঃ অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা চলে, আর তা এইঃ মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত দেবত্বের বাণী প্রচার করতে হবে এবং সর্বকার্যে সেই দেবত্ব-বিকাশের পন্থা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
কুসংস্কারের শৃঙ্খলে এই সংসার আবদ্ধ। যে উৎপীড়িত—সে নর বা নারীই হোক—তাকে আমি করুণা করি; আর যে উৎপীড়নকারী, সে আমার আরও বেশী করুণার পাত্র।
এই একটা ধারণা আমার কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সকল দুঃখের মূলে আছে অজ্ঞতা, তা ছাড়া আর কিছু না। জগৎকে আলো দেবে কে? আত্মবিসর্জনই ছিল অতীতের কর্মরহস্য; হায়! যুগ যুগ ধরে তাই চলতে থাকবে। যাঁরা জগতে সবচেয়ে সাহসী ও বরেণ্য, তাঁদের চিরদিন ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ আত্মবিসর্জন করতে হবে। অনন্ত প্রেম ও করুণা বুকে নিয়ে শত শত বুদ্ধের আবির্ভাব প্রয়োজন।
জগতের ধর্মগুলি এখন প্রাণহীন মিথ্যা অভিনয়ে পর্যবসিত। জগতের এখন একান্ত প্রয়োজন হল চরিত্র। জগৎ এখন তাঁদের চায়, যাঁদের জীবন প্রেমদীপ্ত এবং স্বার্থশূন্য। সেই প্রেম প্রতিটি কথাকে বজ্রের মত শক্তিশালী করে তুলবে।
এটা আর তোমার কাছে কুসংস্কার নয় নিশ্চিত। তোমার মধ্যে একটা জগৎ-আলোড়নকারী শক্তি রয়েছে, ধীরে ধীরে আরও অনেক শক্তি আসবে। আমরা চাই—জ্বালাময়ী বাণী এবং তার চেয়ে জ্বলন্ত কর্ম। হে মহাপ্রাণ, ওঠ, জাগ! জগৎ দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে—তোমার কি নিদ্রা সাজে? এস, আমরা ডাকতে থাকি, যতক্ষণ না নিদ্রিত দেবতা জাগ্রত হন, যতক্ষণ না অন্তরের দেবতা বাইরের আহ্বানে সাড়া দেন। জীবনে এর চেয়ে আর বড় কি আছে? এর চেয়ে মহত্তর কোন্ কাজ আছে? আমার এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গেই আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি সব এসে পড়বে। আমি আটঘাট বেঁধে কোন কাজ করি না। কার্যপ্রণালী আপনি গড়ে ওঠে ও নিজের কার্য সাধন করে। আমি শুধু বলি—ওঠ জাগ।
তুমি চিরকাল অফুরন্ত আশীর্বাদ জানবে। ইতি
শুভাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২৮২
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
২৪ জুন, ১৮৯৬
প্রিয় শশী,
শ্রীজীর৯৬ সম্বন্ধে ম্যাক্সমূলারের লিখিত প্রবন্ধ আগামী মাসে প্রকাশিত হবে। তিনি তাঁর একখানি জীবনী লিখতে রাজী হয়েছেন। তিনি শ্রীজীর সমস্ত বাণী চান। সব উক্তিগুলি সাজিয়ে তাঁকে পাঠাও—অর্থাৎ কর্মসম্বন্ধে সব এক জায়গায়, বৈরাগ্য সম্বন্ধে অন্যত্র, ঐরূপ ভক্তি, জ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি সম্বন্ধে। তোমাকে এ কাজ এখনই শুরু করতে হবে। শুধু যে সব কথা ইংরেজীতে অচল, সেগুলি বাদ দিও।* বুদ্ধি করে সে-সকল জায়গায় যথাসম্ভব অন্য কথা দিবে। ‘কামিনী-কাঞ্চন’কে ‘কাম-কাঞ্চন’ করবে—lust and gold etc.—অর্থাৎ তাঁর উপদেশে সর্বজনীন ভাবটা প্রকাশ করা চাই। এই চিঠি কাহাকেও দেখাবার আবশ্যক নাই। তুমি উক্ত কার্য সমাধা করে সমস্ত উক্তি ইংরেজী তর্জমা ও classify (শ্রেণীবিভাগ) করে ‘প্রফেসর ম্যাক্সমূলার, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইংলণ্ড’—ঠিকানায় পাঠাবে।
শরৎ কাল আমেরিকায় চলল। এখানকার কাজ পেকে উঠেছে। লণ্ডনে একটি centre-এর (কেন্দ্রের) জন্য টাকা already (এর আগেই) উঠে গেছে। আমি next (আগামী) মাসে Switzerland (সুইজরলণ্ড) গিয়ে এক দুই মাস থাকব। তারপর আবার লণ্ডনে। আমার শুধু দেশে গিয়ে কি হবে? এই লণ্ডন হল—দুনিয়ার centre (কেন্দ্র)। India-র heart (ভারতের হৃৎপিণ্ড) এখানে। এখানে একটা গেড়ে না বসিয়ে কি যাওয়া হয়? তোরা পাগল নাকি? সম্প্রতি কালীকে আনাব, তাকে তৈয়ার থাকতে বলো। পত্রপাঠ যেন চলে আসে। দুই চারি দিনের মধ্যে তার জন্য টাকা পাঠাব ও কাপড়-চোপড় প্রভৃতি যা যা দরকার সমস্তই লিখে দেব। সেইমত সমস্ত ঠিক করা হয় যেন।
মাতাঠাকুরাণী প্রভৃতি সকলকে আমার অসংখ্য প্রণাম দিবে। মান্দ্রাজে তারকদাদা যাচ্ছেন—উত্তম কথা।
মহাতেজ, মহাবীর্য, মহা উৎসাহ চাই। মেয়ে-নেকড়ার কি কাজ? যে রকম লিখে- ছিলাম পূর্বপত্রে, সেই রকম ঠিক চলতে চেষ্টা করবে। Organization (সঙ্ঘ) চাই।
Organization is power and the secret of that is obedience (সঙ্ঘই শক্তি, আর আজ্ঞাবহতাই হল তার গূঢ় রহস্য)। কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
২৮৩
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
কেভার্শ্যাম রিডিং,
৩ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয় শশী,
এই পত্রপাঠ কালীকে ইংলণ্ডে পাঠাইয়া দিবে। পূর্বের পত্রে সংবাদ পাইয়াছ। কলিকাতার মেসার্স গ্রিণ্ডলে কোম্পানীর নিকট তাহার 2nd class passage (দ্বিতীয় শ্রেণীর পাথেয় খরচ) গিয়াছে ও কাপড়-চোপড় কিনিতে যাহা কিছু লাগে তাহাও গিয়াছে। কাপড়-চোপড় অধিক কিছু আবশ্যক নাই।
কালীকে কতকগুলি বই আনতে হবে। আমার কাছে কেবল ঋগ্বেদ-সংহিতা আছে। কালী যজুর্বেদ সামবেদ অথর্ব-সংহিতা ও শতপথাদি যতগুলি ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় এবং কতকগুলি সূত্র ও যাস্কর নিরুক্ত যদি পায়, সঙ্গে করেই যেন আনে। অর্থাৎ ঐ বইগুলি আমার চাই। … ঐ বই একটা কাঠের বাক্সয় পুরে আনলেই হবে।
গড়িমসি যেমন শরতের বেলায় হয়েছিল, তা যেন না হয়; পত্রপাঠ চলে আসবে। শরৎ আমেরিকায় চলে গেছে। আর এখানে কোন কাজ ছিল না—অর্থাৎ ছ-মাস বাদে এল, তখন আমি এখানে। সে প্রকার না হয় যেন। চিঠি হারিয়ে যেন না যায়—শরতের বেলার মত। তৎপর পাঠিয়ে দিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
২৮৪*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৬ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয় ফ্র্যাঙ্কিন্সেন্স,৯৭
… আটলাণ্টিকের এপারে এসে আমি বেশ আছি এবং আমার কাজকর্ম খুব ভালভাবেই চলছে।
আমার রবিবারের বক্তৃতাগুলি লোকের খুব হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল, ক্লাসগুলিও বেশ চলেছিল। এখন কাজের মরসুম শেষ হয়ে গেছে—আমিও সম্পূর্ণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন মিস মূলারের সঙ্গে সুইজরলণ্ডে বেড়াতে যাচ্ছি। গলস্ওয়ার্দিরা আমার সঙ্গে খুবই সদয় ব্যবহার করেছেন। জো বড় অদ্ভুতভাবে তাঁদের এদিকে ফিরিয়েছেন। আমি জো-র বুদ্ধিমত্তা ও নীরব কার্য-প্রণালীর প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। তিনি একজন মহিলা রাজনীতিবিদ্, একটা রাজ্য চালাতে পারেন। মানুষের ভেতর এমন তীক্ষ্ণ অথচ কল্যাণকর সহজ বুদ্ধি খুব অল্পই দেখেছি।
গত পরশু সন্ধ্যায় আমি মিসেস মার্টিনের বাড়ীতে একটা পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম। উক্ত মহিলা সম্বন্ধে তুমি নিশ্চয়ই ইতোমধ্যেই জো-র পত্রে অনেক খবর পেয়েছ।
যা হোক ইংলণ্ডে কাজ খুব আস্তে আস্তে অথচ সুনিশ্চিতভাবে বেড়ে চলেছে। এখানকার অন্ততঃ অর্ধেক নরনারী আমার সঙ্গে দেখা করে আমার কাজ সম্বন্ধে আলোচনা করেছে। এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যতই ত্রুটি থাকুক, এটি যে চারিদিকে ভাব ছড়াবার সর্বশ্রেষ্ঠ যন্ত্র, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। আমার সংকল্প—এই যন্ত্রের কেন্দ্রস্থলে আমার ভাবরাশি প্রচার করব—তাহলেই সেগুলি সমগ্র জগতে ছড়িয়ে যাবে। অবশ্য সব বড় বড় কাজই খুব আস্তে আস্তে হয়ে থাকে। বিশেষ আমাদের হিন্দুদের—বিজিত জাতি বলে কাজের বাধাবিঘ্নও অনেক। কিন্তু এও বলি, যেহেতু আমরা বিজিত, সেইহেতু আমাদের ভাব চারিদিকে ছড়াতে বাধ্য! কারণ দেখা যায়, আধ্যাত্মিক আদর্শ চিরকালই বিজিত পদদলিত জাতির মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দেখ না, য়াহুদীরা তাদের আদর্শে রোম সাম্রাজ্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
তুমি জেনে সুখী হবে যে, আমিও দিন দিন সহিষ্ণুতা ও সর্বোপরি সহানুভূতির শিক্ষা আয়ত্ত করছি। মনে হয়, প্রবল-প্রতাপশালী এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের মধ্যেও যে ভগবান্ রয়েছেন, আমি তা উপলব্ধি করতে আরম্ভ করেছি। মনে হয়, আমি ধীরে ধীরে সেই অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যেখানে শয়তান বলে যদি কেউ থাকে, তাকে পর্যন্ত ভালবাসতে পারব।
বিশ বছর বয়সের সময় আমি এমন গোঁড়া বা একঘেয়ে ছিলাম যে, কারও প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারতাম না—আমার ভাবের বিরুদ্ধে হলে কারও সঙ্গে বনিয়ে চলতে পারতাম না, কলিকাতার যে ফুটপাতে থিয়েটার, সেই ফুটপাতের উপর দিয়ে চলতাম না পর্যন্ত। এখন এই তেত্রিশ বৎসর বয়সে বেশ্যাদের সঙ্গে অনায়াসে এক বাড়ীতে বাস করতে পারি—তাদের তিরস্কার করবার কথা একবার মনেও উঠবে না!, এ কি আমি ক্রমশঃ খারাপ হয়ে যাচ্ছি—না, আমার হৃদয় ক্রমে উদার হয়ে অনন্ত প্রেম বা সাক্ষাৎ সেই ভগবানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে? আবার লোকে বলে, শুনতে পাই, যে ব্যক্তি চারদিকে মন্দ ও অমঙ্গল দেখতে পায় না, সে ভাল কাজ করতে পারে না—এক রকম অদৃষ্টবাদী হয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে যায়! আমি তো তা দেখছি না; বরং আমার কর্মশক্তি প্রবলভাবে বেড়ে যাচ্ছে—সঙ্গে সঙ্গে কাজের সফলতাও খুব হচ্ছে। কখনও কখনও আমার এক ধরনের ভাবাবেশ হয়—মনে হয়, জগতের সবাইকে—সব জিনিষকে আশীর্বাদ করি, সব জিনিষকে ভালবাসি, আলিঙ্গন করি। তখন দেখি—যাকে মন্দ বলে, সেটা একটা ভ্রান্তিমাত্র! প্রিয় ফ্র্যান্সিস, এখন আমি সেই রকম ভাবের ঘোরে রয়েছি, আর তুমি ও মিসেস লেগেট আমায় কত ভালবাস ও আমার প্রতি তোমাদের কত দয়া, তাই ভেবে সত্যসত্যই আনন্দাশ্রু বিসর্জন করছি। আমি যেদিন জন্মগ্রহণ করেছি, সেই দিনটিকে ধন্যবাদ! আমি এখানে কত দয়া, কত ভালবাসা পেয়েছি! আর যে অনন্ত প্রেমস্বরূপ থেকে আমার আবির্ভাব, তিনি আমার ভাল মন্দ (‘মন্দ’ কথাটিতে ভয় পেও না) প্রত্যেক কাজটি লক্ষ্য করে আসছেন। কারণ আমি তাঁর হাতের একটা যন্ত্র বৈ আর কি—কোন্ কালেই বা তা ছাড়া আর কি ছিলাম? তাঁর সেবার জন্য আমি আমার সর্বস্ব ত্যাগ করেছি, আমার প্রিয়জনদের ত্যাগ করেছি, সব সুখের আশা ছেড়েছি, জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছি। তিনি আমার সদালীলাময় আদরের ধন, আমি তাঁর খেলার সাথী। এই জগতের কাণ্ডকারখানার কোনখানে কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না—সব তাঁর খেলা, সব তাঁর খেয়াল। কোন্ কারণে তিনি আবার যুক্তির দ্বারা চালিত হবেন? লীলাময় তিনি—এই জগৎ-নাট্যের সব অংশেই তিনি এই সব হাসিকান্নার অভিনয় করছেন। জো যেমন বলে—ভারি মজা, ভারি মজা!
এ তো বড় মজার জগৎ! আর সকলের চেয়ে মজার লোক তিনি—সেই অনন্ত প্রেমাস্পদ প্রভু! সব জগৎটা খুব মজা নয় কি? আমাদের পরস্পরের ভ্রাতৃভাবই বল আর খেলার সাথীর ভাবই বল, এ যেন জগতের ক্রীড়াক্ষেত্রে একদল স্কুলের ছেলেকে খেলতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আর সকলে চেঁচামেচি করে খেলা করছে! তাই নয় কি? কাকে সুখ্যাতি করব, কাকে নিন্দা করব? এ যে সবই তাঁর খেলা। লোকে জগতের ব্যাখ্যা চায়, কিন্তু তাঁকে ব্যাখ্যা করবে কেমন করে? তাঁর তো মাথা-মুণ্ডু কিছু নেই—বিচারের কোন ধার ধারেন না। তিনি ছোটখাট মাথা ও বুদ্ধি দিয়ে আমাদের বোকা সাজিয়েছেন; কিন্তু এবার আর আমায় ঠকাতে পারছেন না, আমি এবার খুব হুঁশিয়ার ও সজাগ আছি।
আমি এতদিনে দু-একটা বিষয় শিখেছি। শিখেছি—ভাব, প্রেম, প্রেমাস্পদ সব যুক্তিবিচার বিদ্যা-বুদ্ধি ও বাক্যাড়ম্বরের বাইরে, ও-সব থেকে অনেক দূরে। ‘সাকি’,৯৮ পেয়ালা পূর্ণ কর—আমরা প্রেমমদিরা পান করে পাগল হয়ে যাই। ইতি
তোমারই
সদাপাগল বিবেকানন্দ