১৭. নীতিবোধ (ব্রাহ্মণ)
(প্রথম পাতা মিসিং)
যজ্ঞানুষ্ঠান, প্ৰাণীদের উদ্দেশে অন্নদান এবং অতিথিসেবা। সুতরাং অতীত ঐতিহ্য, দেবতা, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, মানুষের বহির্জগৎ এবং সকল প্রাণিজগতের সঙ্গে জীবন্ত যোগসূত্র রক্ষা করা হত। সে-যুগে আত্মসংস্কৃতির একমাত্র উপায় অর্থাৎ বেদধ্যয়ন থেকে লব্ধ সুফল সম্পর্কে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে প্রচুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বলা হয়েছে যে, বেদধ্যয়ন মনকে পরিশীলিত করে, মনোনিবেশে সহায়ক হয় এবং যেহেতু জ্ঞানই মুক্তি দেয়, তাই শিক্ষার্থী স্বাধীন, আত্মনিয়ন্তা, জ্ঞানে পরিণত এবং ক্ৰমে যশস্বী হয়ে ওঠে। ব্ৰাহ্মণের পক্ষে কাম্য চারটি বস্তু হ’ল : উত্তম বংশপরিচয়, জ্ঞান অর্জন, খ্যাতি ও জনসাধারণের মনকে জ্ঞানে আলোকিত করার দায়িত্ব পালন। নিজ কর্তব্য পালন করে ব্ৰাহ্মণ জনসাধারণের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন, দান গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে ওঠেন এবং সেই সঙ্গে তাদের অন্য যজ্ঞ অনুষ্ঠানের উপযোগী পুরোহিত হওয়ার গুণাবলী অর্জন করে মৃত্যুদণ্ডের পরিসরের বহির্ভুত থাকতে পারেন। [ শতপথ, ১১ : ৫ : ৭ : ১-২ ] ব্রাহ্মণের সমস্ত কর্তব্যের মধ্যে বেদধ্যয়ন অর্থাৎ বেদ বিদ্যাকরাকেই অধিগত সর্বোত্তম ও যোগ্যতম রূপে প্ৰশংসা করা হয়েছে।
সত্য নৈতিক মূল্যের অন্তগতি; সত্যই ব্ৰহ্মা কিংবা দেবতাই সত্য; মানুষ অসত্য : ব্ৰাহ্মণে এধরনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। অতিজাগতিক স্তরে সত্য হ’ল ঋত, যার প্রভাবে প্রকৃতি নির্দিষ্ট ছন্দে নিজেকে ব্যক্ত করে : এ যেন দেবতাদের অকথিত চুক্তি অথবা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের এক অব্যৰ্থ অলঙ্ঘনীয় অপরিবর্তণীয় ও অমোঘভাবে সক্রিয় সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। এই বক্তব্যের নৈতিক তাৎপর্য এই যে, সত্যের অতিজাগতিক নিয়ম সকলকেই আবশ্যিকভাবে অনুসরণ করতে হবে, বাক্যে সত্যের অপলাপ বা কার্যে চুক্তিভঙ্গ পরিহার করতে হবে। বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে উদ্ভূত নুতন ভাববস্তুগুলির অন্যতম হ’ল শ্ৰদ্ধা; ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে প্রথম এর সাক্ষাৎ পাই বলে একে প্রাচীনতর ব্ৰাহ্মণগুলির সমসাময়িক রূপেই গ্ৰহণ করা যায়। আক্ষরিক ভাবে এর অর্থ হল ‘বিশ্বাস’-ইন্দো-ইয়োরোপীয় একটি যে ধাতু (cred ১৪) থেকে এই শব্দটি উদ্ভূত; তার অর্থই বিশ্বাস! তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে শ্রদ্ধাকে বিশেষভাবে প্ৰশংসা করা হয়েছে। যে যুগে কেউ কেউ যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযোগিতা সম্পর্কে অসংকোচে সংশয় প্রকাশ করেছিল, সেই যুগে শ্রদ্ধা স্বভাবতই একটি নূতন তাৎপর্য অর্জন করেছিল। ব্রাহ্মণযুগে তপঃশক্তিকে ব্রহ্মের চূড়ান্ত প্ৰকাশরূপে গ্ৰহণ করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। তপঃশক্তির মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিকাশ। তত্ত্ববিদ্যা, উদ্দেশ্যবাদ ও প্রেততত্ত্ব সম্পর্কে বেশ কিছু নূতন মূল্যবোধও একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পরবর্তী যুগে অর্থাৎ উপনিষদ রচনায় এই সব নুতন চিন্তা দৃঢ়তর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মৃত্যু ও মরণোত্তর জীবন সম্পর্ক্যে নূতন ধরনের চিস্তার উল্লেখ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয় হবার উপায় সম্পর্কেও অভিনিবেশের সূচনা হয়। ব্ৰাহ্মণযুগে অবশ্য আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণই প্রাধান্য লাভ করেছিল। অন্ত্যেষ্টি সংস্কার সম্পর্কে চিন্তাভাবনার সূত্রে জন্মান্তরিবাদেই আত্মসম্পর্কিত দার্শনিক প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে। সেই সঙ্গে দেখা দেয় পাপ সম্পর্কে নূতন সচেতনতা; মরণোত্তর জীবনে পাপমুক্তির সম্ভাব্য প্রক্রিয়া সম্পর্কেও ব্রাহ্মণ সাহিত্যে মননের সূচনা হয়। পাপপূণ্য এবং পরলোক সম্পর্কে যে ভাবনা এতে অভিব্যক্ত হয়েছিল। যেমন-শতপথ (১১ : ২ : ৬ : ১৩ ও ১১ : ২ : ৭ : ৩৩), তার সঙ্গে আমরা মিশরীয় ভাবনার তুলনা করতে পারি। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় যে, ব্রাহ্মণযুগেই মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে নৌবাণিজ্য সামরিক বিরতির পরে আবার নূতন এক পর্যায়ে শুরু হয়েছিল। সম্ভবত, তারই ফলে মিশরীয় প্ৰেততত্বের কিছু কিছু প্রভাব ব্রাহ্মণ সাহিত্যে দেখা দেয়। অবশ্য স্বতন্ত্রভাবেও এর উদ্ভব হওয়া অসম্ভব নয়। ব্ৰাহ্মণযুগের প্ৰেততত্ত্বে মোটামুটি তিনটি ধারণার প্রকাশ ঘটেছে। প্রথমত, পবিত্ৰ যজ্ঞানুষ্ঠানের বিকল্পরূপে জ্ঞানের প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত; দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট যজ্ঞানুষ্ঠান পালনে ব্যৰ্থ বা পাপকর্মে নিরত ব্যক্তির জন্যই পুনর্জন্ম নির্দিষ্ট; তৃতীয়ত, পুণ্যাত্মা ব্যক্তির জন্য পুরস্কাররূপে পুনর্জন্মের নিবারণ নির্দিষ্ট অধিকার, অর্থাৎ চিরন্তন কোনো সত্ত্বার জগতে সেই ব্যক্তির পুনর্জাগরণ। ব্রহ্মো বিলীন হওয়া সম্পর্কিত ধারণার সূত্রপাত তখনো হয়নি; তখনো সবচেয়ে আকাঙ্খিত ভবিষ্যৎ হ’ল আনন্দময় কোনো লোকে অমর মৃত্যুহীন অস্তিত্ব। বস্তুত সুখী পার্থিব জীবনের ভাবগত সম্প্রসারণের দ্বারাই মৃত্যু-অতিক্রান্ত শাশ্বত জীবনের কল্পনা গড়ে উঠেছিল।