[লণ্ডনে প্রদত্ত বক্তৃতা, ১৮ই নভেম্বর, ১৮৯৬]
আমরা এ পর্যন্ত সমষ্টির আলোচনাই করিয়া আসিয়াছি। অদ্য প্রাতে আমি তোমাদের সমক্ষে ব্যষ্টির সহিত সমষ্টির সম্বন্ধ বিষয়ে বেদান্তের মত বলিতে চেষ্টা করিব। আমরা প্রাচীনতর দ্বৈতবাদাত্মক বৈদিক মত দেখিতে পাই, প্রত্যেক জীবের একটি নির্দিষ্ট স-সীম আত্মা আছে, প্রত্যেক জীবে অবস্থিত এই বিশেষ আত্মা সম্বন্ধে অনেক প্রকার মতবাদ প্রচলিত। কিন্তু প্রাচীন বৌদ্ধ ও প্রাচীন বৈদান্তিকদিগের মধ্যে প্রধান বিচার্য বিষয় ছিল এই যে, প্রাচীন বৈদান্তিকেরা স্বয়ংপূর্ণ জীবাত্মাতে বিশ্বাস করিতেন, বৌদ্ধেরা এরূপ জীবাত্মার অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করিতেন। আমি সেদিন তোমাদিগকে বলিয়াছি, ইওরোপে দ্রব্য-গুণ সম্বন্ধে যে বিচার চলিয়াছিল, এ ঠিক তাহারই মতো। একদলের মতে গুণগুলির পশ্চাতে দ্রব্যরূপী কিছু আছে, যাহাতে গুণগুলি লাগিয়া থাকে, আর এক মতে দ্রব্য স্বীকার করিবার কিছুমাত্র আবশ্যকতা নাই, গুনগুলি নিজেরাই থাকিতে পারে। অবশ্য আত্মা সম্বন্ধে সর্বপ্রাচীন মত ‘আমি আমিই’ ‘আত্মার ঐক্য’-রূপ যুক্তির উপর স্থাপিত; —কল্যকার যে-আমি, আজও সেই আমি, আর অদ্যকার আমি আবার আগামী কল্যের আমি হইব, শরীরে যে-সকল পরিণাম হইয়াছে, সেগুলি সত্ত্বেও আমি বিশ্বাস করি যে, আমি সর্বদাই একরূপ। যাঁহারা সীমাবদ্ধ অথচ স্বয়ংপূর্ণ জীবাত্মায় বিশ্বাস করিতেন, ইহাই তাঁহাদের প্রধান যুক্তি ছিল বলিয়া বোধ হয়।
অপরদিকে, প্রাচীন বৌদ্ধগণ এইরূপ জীবাত্মা স্বীকার করিবার প্রয়োজন অস্বীকার করিতেন। তাঁহারা এই যুক্তি দেখাইতেন যে, আমরা কেবল এই পরিণামগুলিই জানি এবং এই পরিণামগুলি ব্যতীত আর কিছু জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। একটি অপরিবর্তনীয় ও অপরিণামী দ্রব্য স্বীকার করা বাহুল্য-মাত্র, আর বাস্তবিক যদি এরূপ অপরিণামী বস্তু কিছু থাকে, আমরা কখনই উহাকে বুঝিতে পারিব না, আর কোনরূপে কখনও উহাকে প্রত্যক্ষ করিতে পারিব না। বর্তমানকালেও ইওরোপে ধর্মবাদী ও বিজ্ঞানবাদী এবং আধুনিক প্রত্যক্ষবাদী ও অজ্ঞেয়বাদীদের ১ ভিতর সেইরূপ বিচার চলিতেছে। একদলের বিশ্বাস, অপরিণামী পদার্থ কিছু আছে—ইঁহাদের সর্বশেষ প্রতিনিধি হার্বার্ট স্পেন্সার। তিনি বলেন, আমরা যেমন অপরিনামী কোন পদার্থের আভাস পাইয়া থাকি। অপর মতের প্রতিনিধি কোমতের বর্তমান শিষ্যগণ ও আধুনিক অজ্ঞেয়বাদিগণ। কয়েক বৎসর পূর্বে মিঃ ফ্রেডেরিক হ্যারিসন ও মিঃ হার্বার্ট স্পেন্সারের মধ্যে যে তর্ক হইয়াছিল, তোমাদের মধ্য যাহারা উহা আগ্রহের সহিত আলোচনা করিয়াছিলে, তাহারা দেখিয়া থাকিবে ইহাতেও সেই পুরাতন সমস্যা বিদ্যমান; একদল পরিণামী বস্তুসমূহের পশ্চাতে কোন অপরিণামী সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করিতেছেন, অপর দল এরূপ অনুমান করিবার আবশ্যকতাই অস্বীকার করিতেছেন। একদল বলিতেছেন, আমরা অপরিণামী সত্তার ধারণা ব্যতীত পরিণাম ভাবিতেই পারি না; অপর দল যুক্তি দেখান : এরূপ স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নাই, আমরা কেবল পরিণামী পদার্থেরই ধারণা করিতে পারি; অপরিণামী সত্তাকে আমরা জানিতে, অনুভব করিতে বা প্রত্যক্ষ করিতে পারি না।
———-
১ Religionist, idealist, realist agnosticism
ভারতে এই মহান্ প্রশ্নের সমাধান অতি প্রাচীন কালে পাওয়া যায় নাই, কারণ আমরা দেখিয়াছি গুণসমূহের পশ্চাতে অবস্থিত অথচ গুণভিন্ন পদার্থের সত্তা কখনই প্রমাণ করা যাইতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, ‘আত্মার ঐক্য’রূপ প্রমাণ—স্মৃতি হইতে আত্মার অস্তিত্বের যুক্তি—কালও যে আমি ছিলাম, আজও সেই আমি আছি; কারণ আমার উহা স্মরণ আছে, অতএব আমি বরাবর আছি—এই যুক্তিও কোন কাজের নহে। আর একটি যুক্তি, যাহা সচরাচর উপস্থাপিত হইয়া থাকে, তাহা কেবল কথার মারপ্যাঁচ। ‘আমি যাই’, ‘আমি খাই,”আমি স্বপ্ন দেখি’, আমি ঘুমাই,”আমি চলি’—এইরূপ কতকগুলি বাক্য লইয়া তাঁহারা বলেন—করা, যাওয়া, স্বপ্ব দেখা, এ-সব বিভিন্ন পরিণাম বটে, কিন্তু উহাদের মধ্যে ‘আমি’টি নিত্যভাবে রহিয়াছে, এইরূপে তাঁহারা সিদ্ধান্ত করেন যে, ‘আমি’ নিত্য ও নিজেই একটি ব্যক্তি আর ঐ পরিণামগুলি শরীরের ধর্ম। এই যুক্তি আপাততঃ খুব উপাদেয় ও সুস্পষ্ট বোধ হইলেও বাস্তবিক উহা কেবল কথার মারপ্যাঁচের উপর স্থাপিত। এই ‘আমি’ এবং করা, যাওয়া, স্বপ্ন দেখা প্রভৃতি কাগজে-কলমে পৃথক্ হইতে পারে, কিন্তু মনে কেহই ইহাদিগকে পৃথক্ করিতে পারে না।
যখন আমি আহার করি, খাইতেছি বলিয়া চিন্তা করি, তখন আহার-কার্যের সহিত আমার একাত্মভাব হইয়া যায়। যখন আমি দৌড়াইতে থাকি, তখন ‘আমি’ ও ‘দৌড়ানো’ দুইটি পৃথক্ ভাব থাকে না। অতএব এই যুক্তি বড় দৃঢ় বলিয়া বোধ হয় না। যদি স্মৃতিদ্বারা অস্তিত্বের অভিন্নতা প্রমাণ করিতে হয়, তবে আমার যে-সকল অবস্থা ভুলিয়া গিয়াছি, সেই-সকল অবস্থায় আমি ছিলাম না বলিতে হয়। আর আমরা জানি, অনেক বিশেষ অবস্থায় সমুদয় অতীতের কথা একেবারে বিস্মৃত হইয়া যায়। দেখা যায় অনেক উন্মাদরোগ-গ্রস্ত ব্যক্তি নিজেদের কাচনির্মিত অথবা কোন পশু বলিয়া ভাবে। যদি স্মৃতির উপর সেই ব্যক্তির অস্তিত্ব নির্ভর করে, তাহা হইলে সে অবশ্য কাচ অথবা পশুবিশেষ হইয়া গিয়াছে, বলিতে হইবে; কিন্তু বাস্তবিক যখন তাহা হয় নাই, তখন আমরা এই স্মৃতিবিষয়ক অকিঞ্চিৎকর যুক্তির উপর অহংভাবের অভিন্নতা স্থাপন করিতে পারি না। তবে কি দাঁড়াইল? দাঁড়াইল এই যে, সীমাবদ্ধ অথচ সম্পূর্ণ ও নিত্য অহং-এর অভিন্নতা আমরা গুণসমূহ হইতে পৃথক্ভাবে স্থাপন করিতে পারি না। আমরা এমন কোন সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে পারি না, যাহার সহিত গুণগুলি লাগিয়া রহিয়াছে।
অপর পক্ষে প্রাচীন বৌদ্ধদের এই মত দৃঢ়তর বলিয়া বোধ হয় যে, গুণসমূহের অতিরিক্ত কোন বস্তুর সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না এবং জানিতেও পারি না। তাঁহাদের মতে অনুভূতি ও ভাবরূপ কতকগুলি গুণের সমষ্টিই আত্মা। এই গুণরাশিই আত্মা, আর উহারা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। অদ্বৈতবাদের দ্বারা এই উভয় মতের সমন্বয় সাধিত হয়।
অদ্বৈতবাদের সিদ্ধান্ত এই : আমরা বস্তুকে গুণ হইতে পৃথকরূপে চিন্তা করিতে পারি না, এ-কথা সত্য, এবং পরিণাম ও অপরিণাম—এ-দুইটিও একসঙ্গে ভাবিতে পারি না। এরূপ চিন্তা করা অসম্ভব। কিন্তু যাহাকেই বস্তু বলা হইতেছে, তাহাই গুণস্বরূপ। দ্রব্য ও গুণ পৃথক্ নহে। অপরিণামী বস্তুই পরিণামরূপে প্রতিভাত হইতেছে। এই অপরিণামী সত্তা পরিণামী জগৎ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নয়। পারমার্থিক সত্তা ব্যাবহারিক সত্তা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্ বস্তু নয়, সেই পারমার্থিক সত্তাই ব্যাবহারিক সত্তা হইয়াছে। অপরিণামী আত্মা আছেন, আর আমরা যেগুলিকে অনুভূতি, ভাব প্রভৃতি বলিয়া থাকি, এমন কি এই শরীর পর্যন্ত সেই আত্মস্বরূপ, কিন্তু বাস্তবিক আমরা এক সময়ে দুই বস্তু অনুভব করি না, একটিই করিয়া থাকি।
যখন আমি নিজেকে শরীর বলিয়া চিন্তা করি, তখন আমি শরীরমাত্র; ‘আমি ইহার অতিরিক্ত কিছু’ বলা বৃথা। আর যখন আমি নিজেকে আত্মা বলিয়া চিন্তা করি, তখন দেহ কোথায় উড়িয়া যায়, দেহানুভূতি আর থাকে না। দেহজ্ঞান দূর না হইলে কখন আত্মানুভূতি হয় না। গুণের অনুভূতি চলিয়া না গেলে কেহই বস্তু অনুভব করিতে পারে না।
এই পরিষ্কার করিয়া বুঝাইবার জন্য অদ্বৈতবাদীদের প্রাচীন রজ্জু-সর্পের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করা যাইতে পারে। যখন লোকে দড়িকে সাপ বলিয়া ভুল করে, তখন তাহার পক্ষে দড়ি উড়িয়া যায়; আর যখন সে উহাকে যথার্থ দড়ি বলিয়া বোধ করে, তখন তাহার সর্পজ্ঞান কোথায় চলিয়া যায়, তখন কেবল দড়িটিই অবশিষ্ট থাকে। বিশ্লেষণপ্রণালী অনুসরণ করাতেই আমাদের এই দ্বিত্ব বা ত্রিত্বের অনুভূতি হইয়া থাকে। বিশ্লেষণের পর এগুলি পুস্তকে লিখিত হইয়াছে। আমরা ঐ-সকল গ্রন্থ পাঠ করিয়া অথবা উহাদের সম্বন্ধে শ্রবণ করিয়া এই ভ্রমে পড়িয়াছি যে, সত্যই বুঝি আমাদের আত্মা ও দেহ দুয়েরই একত্র অনুভব হইয়া থাকে; বাস্তবিক কিন্তু তাহা কখনও হয় না। হয় দেহ, নয় আত্মার অনুভব হইয়া থাকে। উহা প্রমাণ করিতে কোন যুক্তির প্রয়োজন হয় না। নিজের মনে মনেই ইহা পরীক্ষা করিতে পারা যায়।
তুমি নিজেকে দেহশূন্য আত্মা বলিয়া ভাবিতে চেষ্টা কর, দেখিবে—ইহা প্রায় অসম্ভব, আর যে অল্পসংখ্যক ব্যক্তির পক্ষে ইহা সম্ভব তাঁহারা যখন নিজকিগকে আত্মা-রূপে অনুভব করেন, তখন তাঁহাদের দেহবোধ থাকে না। তোমরা হয়তো দেখিয়াছ বা শুনিয়াছ, অনেক ব্যক্তি সম্মোহন(hypnotism)-প্রভাবে অথবা মৃগীরোগ বা অন্য কোন কারণে সময়ে সময়ে একপ্রকার বিশেষ অবস্থা লাভ করে। তাহাদের অভিজ্ঞতা হইতে জানিতে পারা যায়, তখন তাহারা ভিতরে কিছু অনুভব করিতেছিল, এবং তাহাদের বাহ্যজ্ঞান একেবারেই ছিল না। ইহা হইতেই বোধ হইতেছে—অস্তিত্ব একটি, দুইটি নয়। সেই ‘এক’ নানারূপে প্রতীয়মান হইতেছেন, আর এ-সকলের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধে আছে। কার্যকারণ-সম্বন্ধের অর্থ পরিণাম, একটি অপরটিতে পরিণত হয়। সময়ে সময়ে যেন কারণের অন্তর্ধান হয়, সেই স্থানে কার্য অবশিষ্ট থাকে। যদি আত্মা দেহের কারণ হন, তবে যেন কিছুক্ষণের জন্য তাঁহার অন্তর্ধান হয়, সেই স্থানে দেহ অবশিষ্ট থাকে, আর যখন শরীরের অন্তর্ধান হয় তখন আত্মা অবশিষ্ট থাকেন। এই মতে বৌদ্ধদের মত খণ্ডিত হইবে। আত্মা ও শরীর—এই দুইটি পৃথক্, এই অনুমানের বিরুদ্ধে বৌদ্ধেরা তর্ক করিতে-ছিলেন। অদ্বৈতবাদের দ্বারা এই দ্বৈতভাব অস্বীকৃত হওয়ায় এবং দ্রব্য ও গুণ একই বস্তুর বিভিন্ন রূপ প্রদর্শিত হওয়ায় তাঁহাদের মত খণ্ডিত হইল।
আমরা ইহাও দেখিয়াছি যা, অপরিণামিত্ব কেবল সমষ্টি-সম্বন্ধেই প্রমাণিত হইতে পারে, ব্যষ্টি-সম্বন্ধে নয়। পরিণাম—গতি, এই ভাবের সহিত ব্যষ্টির ধারণা জড়িত। যাহা কিছু সসীম, তাহাই পরিণামী; অপর কোন সসীম পদার্থ বা অসীমের সহিত তুলনায় তাহার পরিণাম চিন্তা করা যাইতে পারে, কিন্ত সমষ্টি অপরিনামী; সমষ্টি ছাড়া অন্য কিছুই নাই, যাহার সহিত তুলনা করিয়া সমষ্টির পরিণাম বা গতি চিন্তা করা যাইবে; পরিণাম কেবল অপর কোন অল্পপরিণামী বা একেবারে অপরিণামী পদার্থের সহিত তুলনায় চিন্তা করা যাইতে পারে।
অতএব অদ্বৈতবাদ-মতে সর্বব্যাপী, অপরিণামী, অমর আত্মার অস্তিত্ব যথাসম্ভব প্রমাণ করা যাইতে পারে। ব্যষ্টি-সম্বন্ধেই গোলমাল। আমাদের প্রাচীন দ্বৈতবাতাত্মক মতগুলির কি হইবে, যে গুলি আমাদের উপর এত প্রভাব বিস্তার করিয়াছে? সসীম, ক্ষুদ্র, ব্যক্তিগত আত্মা সম্বন্ধে কি হইবে?—ইহাই প্রশ্ন।
আমরা দেখিয়াছি, সমষ্টিভাবে আমরা অমর, কিন্তু সমস্যা এই—আমরা ক্ষুদ্র ব্যক্তি-হিসাবেও অমর হইতে ইচ্ছুক। তাহার কি হইবে? আমরা দেখিয়াছি, আমরা অনন্ত আর উহাই আমাদের যথার্থ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আমরা এই-সকল ক্ষুদ্র আত্মাকেই ব্যক্তিরূপে গ্রহণ করিয়া রাখিতে চাই। সেই-সকল ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বের কি হইবে? প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা হইতে আমরা দেখিতে পাই, ইহাদের ব্যক্তিত্ব আছে বটে, কিন্তু এই ব্যক্তিত্ব ক্রমবিকাশশীল; এক বটে, অথচ ঠিক এক নহে, কল্যকার ‘আমি’ অদ্যকার ‘আমি’ বটে, আবার না-ও বটে। একটু পরিবর্তন হইয়াছে। পরিবর্তনের ভিতরে অপরিবর্তনীয় কিছু আছে—এই দ্বৈতবাদী মত পরিত্যক্ত হইল, আর খুব আধুনিক ভাব, যথা ক্রমবিকাশবাদ গ্রহণ করা হইল। সিদ্ধান্ত হইল, উহার পরিণাম হইতেছে বটে, কিন্তু উহারই ভিতরে একটি অভিন্ন-ভাব রহিয়াছে, যাহা সতত বিকাশশীল।
যদি ইহা সত্য হয় যে, মানুষ মাংসল জীববিশেষের (mollusc) পরিণাম-মাত্র, তবে সেই জীব ও মানুষ একই পদার্থ, কেবল মাংসল জীব বহুপরিমাণে বিকশিত হইয়াছে। সেই ক্ষুদ্র জীব ক্রমশঃ বিকাশ প্রাপ্ত হইতে হইতে অনন্তের দিকে চলিয়াছে, এখন মানুষরূপ ধারণ করিয়াছে। অতএব সীমাবদ্ধ জীবাত্মাকেও ব্যক্তি বলা যাইতে পারে; তিনি ক্রমশঃ পূর্ণ ব্যক্তিত্বের দিকে অগ্রসর হইতেছেন। পূর্ণ ব্যক্তিত্ব তখনই লাভ হইবে, যখন তিনি অনন্তে পৌঁছিবেন, কিন্তু সেই অবস্থালাভের পূর্বে তাঁহার ব্যক্তিত্বের ক্রমাগত পরিণাম, ক্রমাগত বিকাশ হইতেছে।
পূর্ববর্তী মতবাদগুলির সমন্বয়-সাধন করাই অদ্বৈতবেদান্তের অন্যতম বিশেষত্ব। অনেক সময় ইহাতে এই দর্শনের অনেক উপকার হইয়াছিল, আবার কোথাও কোথাও ক্ষতিও হইয়াছে। বর্তমান কালে ক্রমবিকাশ-বাদীদের যে মত, আমাদের প্রাচীন দার্শনিকগণ তাহা জানিতেন, তাঁহারা বুঝিতেন, দর্শন-চিন্তাও ধীরে ধীরে গড়িয়া ওঠে। এই কারণেই পূর্ব পূর্ব দর্শন-প্রণালীর মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বিধান করা তাঁহাদের পক্ষে সহজ হইয়াছিল। কোন ভাবই পরিত্যক্তি হয় নাই। বৌদ্ধদের একটি বিশেষ দোষ এই যে, তাঁহারা ক্রমোন্নতি বুঝিতেন না, সুতরাং আদর্শে পৌঁছিবার পূর্ববর্তী সোপান-গুলির সহিত নিজেদের মতের সমাঞ্জস্য করিবার কোন চেষ্টা করেন নাই। বরং পূর্বমতগুলিকে নিরর্থক ও অনিষ্টকর বলিয়া পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।
ধর্মজগতে এই প্রকার মনোভাব অত্যন্ত অনিষ্টকর। কোন ব্যক্তি একটি নূতন ও ভাল ভাব পাইল। তখন সে তাহার পুরাতন ভাবগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সিদ্ধান্ত করে—ঐগুলি অনিষ্টকর ও অনাবশ্যক। সে কখন ভাবে না যে, তাহার বর্তমান দৃষ্টি হইতে সেগুলি যতই বিসদৃশ বোধ হউক না কেন, তাহার পক্ষে এক সময়ে ঐগুলি অত্যাবশ্যক ছিল, তাহার বর্তমান অবস্থায় পৌঁছিতে ঐগুলি বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল, আর আমাদের প্রত্যেককে ঐভাবেই আত্মবিকাশ করিতে হইবে, প্রথমে স্থূলভাব গ্রহণ করিয়া তাহার সাহায্যে উপকৃত হইয়া উচ্চতর অবস্থায় আরোহণ করিতে হইবে। এইজন্য প্রাচীনতম মতগুলির সহিত অদ্বৈতবাদের কোন বিরোধ নাই, এবং দ্বৈতবাদ ও যে-সব মত তাহার পূর্বে ছিল, সকলেরই উপর অদ্বৈতবাদীর প্রীতির ভাব—কোনরূপ অনুগ্রহ বা পৃষ্ঠপোষকতার ভাব নয়। অদ্বৈতবাদীর ধারণা সেগুলিও সত্য, একই সত্যের বিভিন্ন বিকাশ, আর অদ্বৈতবাদ যে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছে, অন্যান্য মতবাদও সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হইবে।
অতএব মানুষকে যে-সকল সোপানশ্রেণী অতিক্রম করিয়া উঠিতে হয়, সেগুলিকে অভিশাপ না করিয়া আশীর্বাদসহ রক্ষা করিতে হইবে। এইজন্য বেদান্তে এই-সকল ভাব যথাযথ রক্ষিত হইয়াছে, পরিত্যক্ত হয় নাই। এইজন্যই দ্বৈতবাদসম্মত সসীম অথচ পূর্ণজীবাত্মার ধারণাও বেদান্তে স্থান পাইয়াছে।
দ্বৈতবাদ অনুসারে মৃত্যু হইলে মানুষ অন্যান্য লোকে গমন করে, এই-সকল ভাবও বেদান্তে সম্পূর্ণ রক্ষিত হইয়াছে, কারণ অদ্বৈতবাদ স্বীকার করিয়া এই মতগুলিকেও তাহাদের যথাস্থানে রক্ষা করা যাইতে পারে,কেবল এইটুকু মানিতে হইবে যে, উহারা প্রকৃত সত্যের আংশিক বর্ণনামাত্র।
যদি তুমি বিশেষ দৃষ্টিকোণ হইতে দেখ তবে একটি দিক—একটি অংশই তোমার চোখে পড়ে, এবং জগৎ তোমার নিকট এইভাবেই প্রতীয়মান হইবে। দ্বৈতবাদীর দৃষ্টি হইতে এই জগৎ কেবল পদার্থ ও শক্তির সৃষ্টিরূপেই দৃষ্ট হইতে পারে; উহাকে কোন বিশেষ ইচ্ছাশক্তির ক্রীড়ারূপেই চিন্তা করা যাইতে পারে, আর সেই ইচ্ছাশক্তিকেও জগৎ হইতে পৃথক্-রূপেই দেখা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গী হইতে মানুষ নিজেকে আত্মা ও দেহ এই দুয়ের সমষ্টিরূপেই চিন্তা করে; এই আত্মা সসীম হইলেও পূর্ণ। এরূপ ব্যক্তির অমরত্ব ও অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে যে ধারণা, তাহাও সেই আত্মাতেই প্রযুক্ত হইবে। এইজন্যই এই মতগুলি বেদান্তে সুরক্ষিত হইয়াছে এবং এইজন্যই দ্বৈতবাদীদের মধ্যে প্রচলিত সাধারণ মতগুলিও তোমাদের নিকট বলা প্রয়োজন।
এই মতানুসারে অবশ্য আমাদের একটি স্থূল শরীর আছে; এই স্থূলশরীরের পশ্চাতে সূক্ষ্মশরীর। এই সূক্ষ্মশরীরও ভৌতিক, তবে উহা খুব সূক্ষ্মভূতে নির্মিত। উহা আমাদের সমুদয় কর্মের আধারস্বরূপ। সমুদয় কর্মের সংস্কার এই সূক্ষ্মশরীরে বর্তমান—সংস্কারগুলি সর্বদাই ফল প্রদান করিতে উন্মুখ হইয়া আছে। আমরা যাহা কিছু চিন্তা করি, আমরা যে-কোন কার্য করি, তাহাই কিছুকাল পরে সূক্ষ্মরূপ ধারণ করে—যেন বীজভাব প্রাপ্ত হয়, এবং এই শরীরে অব্যক্তভাবে অবস্থান করে, কিছুকাল পরে আবার বাহিরে প্রকাশিত হইয়া ফল প্রদান করে। মানুষের সারা জীবনটাই এইরূপ। সে নিজের অদৃষ্ট নিজেই গঠন করে। মানুষ আর কোন নিয়ম দ্বারা বদ্ধ নয়, সে আপনার নিয়মে—আপনার জালে বদ্ধ। আমরা যে-সকল কর্ম করি, আমরা যে-সকল চিন্তা করি, সেগুলি আমাদের বন্ধনজালের সূত্রমাত্র। একবার কোন শক্তিকে চালাইয়া দিলে তাহার শেষ পরিণতি পর্যন্ত আমাদিগকে অবশ্যই ভোগ করিতে হইবে। ইহাই কর্মবিধান। এই সূক্ষ্ম শরীরের পশ্চাতে সসীম জীবাত্মা রহিয়াছেন। এই জীবাত্মার কোন আকৃতি আছে কি-না, ইহা অণু, বৃহৎ বা মাধ্যম আকারের—এ-বিষয়ে অনেক তর্কবিতর্ক চলিয়াছে।
কোন কোন সম্প্রদায়ের মতে ইহা অণু, অপরের মতে ইহা মধ্যম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতে ইহা বিভু। এই জীব সেই অনন্ত সত্তার এক অংশমাত্র, আর উহা অনন্তকাল ধরিয়া রহিয়াছে। উহা অনাদি, উহা সেই সর্বব্যাপী সত্তার এক অংশরূপে অবস্থান করিতেছে। উহা অনন্ত। আর উহা নিজের প্রকৃত স্বরূপ, শুদ্ধভাব প্রকাশ করিবার জন্য নানা দেহের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতেছে। যে-কার্যের দ্বারা এই প্রকাশ ব্যাহত হয়, তাহাকে অসৎ কার্য বলে; চিন্তাসম্বন্ধেও তদ্রূপ। আর যে-কার্য বা যে-চিন্তা দ্বারা তাহার স্বরূপ-প্রকাশের বিশেষ সাহায্য হয়, তাহাকে সৎকার্য বা সচ্চিন্তা বলে। কিন্তু ভারতের অতি নিম্নতম দ্বৈতবাদী এবং অতি উন্নত অদ্বৈতবাদী—সকলেরই মত এই যে, আত্মার সমুদয় শক্তি ও ক্ষমতা তাহার ভিতরেই রহিয়াছে, অন্য কোথাও হইতে আসে না, আত্মাতে ঐ শক্তিপুঞ্জ অব্যক্তভাবে থাকে, আর আমাদের সমুদয় জীবনের কার্য কেবল ঐ অব্যক্ত শক্তিগুলিকে বিকশিত করা।
তাঁহারা পুর্নজন্মবাদও মানিয়া থাকেন—এই দেহের ধ্বংস হইলে জীব আর এক দেহ লাভ করিবে, আবার সেই দেহনাশের পর আর এক দেহ, এইরূপই চলিবে। জীব এই পৃথিবীতেও জন্মাইতে পারে, অন্য লোকেও জন্মাইতে পারে। তবে এই পৃথিবীকেই সকলের আগে পছন্দ করা হয়—আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই পৃথিবীই শ্রেষ্ঠ স্থান। অন্যান্য লোকে দুঃখকষ্ট খুব সামান্য আছে বটে, কিন্তু সাধকেরা বলেন যে, ঐজন্যই সেই-সকল লোকে উচ্চতর বিষয় চিন্তা করিবার সুযোগও অল্প। এই জগতে বেশ সামঞ্জস্য আছে, অনেক দুঃখও আছে, আবার কিছু সুখও আছে, সুতরাং জীবের এখানে কখন না কখন মোহনিদ্রা ভাঙিবার সম্ভাবনা, কখন না কখন তাহার মুক্তিলাভের ইচ্ছার সম্ভবনা আছে। কিন্তু যেমন এই পৃথিবীতে খুব ধনী ব্যক্তিদের উচ্চতর বিষয় চিন্তা করিবার সুযোগ অতি অল্প, সেইরূপ এই জীব যদি স্বর্গে যায়, সেখানে তাহারও আত্মোন্নতির সম্ভাবনা নাই। শুধু এখানে যে-সুখ, সেখানে তাহাই তীব্রতর; সূক্ষ্মদেহে কোন ব্যাধি থাকিবে না, ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকিবে না, সকল বাসনাই পরিপূর্ণ হইবে। জীব সেখানে সুখের পর সুখ সম্ভোগ করে এবং নিজের স্বরূপ ও উচ্চভাব—সব ভুলিয়া যায়। তথাপি এই-সকল উচ্চতর লোকে কেহ আছেন, যাঁহারা এই-সকল ভোগসত্ত্বেও সেখান হইতে আরও উচ্চতর ভাবে আরোহণ করেন। একপ্রকার স্থূলদর্শী দ্বৈতবাদীরা উচ্চতম স্বর্গকেই চরম লক্ষ্য বিবেচনা করিয়া থাকেন, জীবাত্মাগণ সেই স্বর্গে চিরকাল ভগবানের সহিত বাস করিবেন। সেখানে তাঁহারা দিব্যদেহ লাভ করিবেন—তাঁহাদের আর রোগ শোক মৃত্যু বা অন্য কোনরূপ অশুভ থাকিবে না। তাঁহাদের সকল বাসনা পরিপূর্ণ হইবে; এবং তাঁহারা চিরকাল সেখানে ভগবানের সহিত বাস করিবেন। সময়ে সময়ে তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ পৃথিবীতে আসিয়া দেহধারণ করিয়া লোকশিক্ষা দিবেন, আর জগতের শ্রেষ্ঠ ধর্মাচার্যগণ সকলেই স্বর্গ হইতে আসিয়াছিলেন,—এই তাঁহাদের মত। পূর্বেই মুক্ত হইয়া এই লোকগুরুগণ ভগবানের সহিত এক লোকে বাস করিতেছিলেন, কিন্তু দুঃখার্ত মানবজাতির প্রতি অত্যন্ত কৃপাবশতঃ তাঁহারা এখানে আসিয়া পুনরায় দেহধারণ করিয়া মানুষকে স্বর্গের পথ-সম্বন্ধে উপদেশ দেন। তাঁহারা অন্যান্য উচ্চতর—দেবতাদের লোকসমূহেও গমন করিয়া থাকেন।
অবশ্য অদ্বৈতবাদী বলেন, এই স্বর্গ কখন আমাদের চরম লক্ষ্য হইতে পারে না। দেহশূন্যভাবই আমাদের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমাদের লক্ষ্য বা আদর্শ কখন সসীম হইতে পারে না। অনন্ত ব্যতীত আর কিছুই আমাদের চরম আদর্শ হইতে পারে না, কিন্তু দেহ তো কখন অনন্ত হয় না। ইহা হওয়াই অসম্ভব, কারণ সীমাবদ্ধ ভাব হইতেই শরীরের উৎপত্তি। চিন্তাও অনন্ত হইতে পারে না, কারণ সসীম ভাব হইতেই চিন্তা আসিয়া থাকে। অদ্বৈতবাদী বলেন, আমাদিগকে দেহ এবং চিন্তার বাহিরে যাইতে হইবে। আমরা আরও দেখিয়াছি অদ্বৈতবাদের মতে—মুক্তি লভ্য নয়, উহা পূর্ব হইতেই রহিয়াছে। আমরা কেবল ভুলিয়া যাই ও উহা অস্বীকার করি। পূর্ণতা লাভ করিতে হইবে না, উহা আমাদের মধ্যেই রহিয়াছে। এই অমরত্ব ও আনন্দ লাভ করিতে হইবে না, ঐগুলি পূর্ব হইতেই বর্তমান—ঐগুলি আমাদের বরাবরই রহিয়াছে।
যদি তুমি সাহস করিয়া বলিতে পারো—’আমি মুক্ত’,এই মুহূর্তে তুমি মুক্তই হইবে। যদি তুমি বলো—’আমি বদ্ধ,’ তবে তুমি বদ্ধই থাকিবে। যাহা হউক, দ্বৈতবাদী ও অন্যান্যবাদীদের মত ইহার বিপরীত। তোমরা ইহার মধ্যে যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করিতে পারো।
বেদান্তের এই আদর্শটি বুঝা বড় কঠিন, আর সাধারণ লোকে সর্বদা ইহা লইয়া বিবাদ করিয়া থাকে। প্রধান মুশকিল এই যে, ইহার মধ্যে যে একটি মত অবলম্বন করে, সে অপর মত একেবারে অস্বীকার করিয়া সেই মতাবলম্বীর সঙ্গে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়। তোমার পক্ষে যাহা উপযুক্ত, তাহা গ্রহণ কর; অপরের উপযোগী মত তাহাকে গ্রহণ করিতে দাও। যদি তুমি এই ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব—এই সসীম মানবত্ব রাখিতে এতই ইচ্ছুক হও, তবে তুমি তাহা অনায়াসে রাখিতে পারো, তোমার সকল বাসনাই রাখিতে পারো এবং তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া থাকিতে পারো। যদি মানুষভাবে থাকিবার সুখ তোমার নিকট এতই সুন্দর ও মধুর লাগে, তবে তুমি যতদিন ইচ্ছা উহা রাখিয়া দাও, কারণ তুমি জানো তুমিই তোমার অদৃষ্টের নির্মাতা, কেহই তোমাকে বাধ্য করিয়া কিছু করাইতে পারে না; তোমার যতদিন ইচ্ছা ততদিন মানুষরূপে থাকিতে পারো, কেহই তোমাকে অন্য কিছু করিতে বাধ্য করিতে পারে না। যদি দেবতা হইতে ইচ্ছা কর, দেবতাই হইবে—সংক্ষেপে ইহাই বক্তব্য। কিন্তু এমন অনেক মানুষ থাকিতে পারেন, যাঁহারা দেবতা হইতেও অনিচ্ছুক। তাঁহাদিগকে কি তোমার বলিবার অধিকার আছে যে, এ ভয়ানক কথা? তোমার এক শত টাকা নষ্ট হইবার ভয় হইতে পারে, কিন্তু এমন অনেক লোক থাকিতে পারে, যাহাদের পৃথিবীতে যত অর্থ আছে, সব নষ্ট হইলেও কিছু কষ্ট হইবে না। এই ধরণের মানুষ পূর্বকালে অনেক ছিলেন, এবং এখনও আছেন। তুমি তাঁহাদিগকে তোমার আদর্শ অনুসারে বিচার করিতে যাও কেন? তুমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ জাগতিক ভাবে বদ্ধ হইয়া আছ। ইহাই তোমার সর্বোচ্চ আদর্শ হইতে পারে। তুমি এই আদর্শ লইয়া থাকো না কেন? তুমি যেমনটি চাও তেমনাটি পাইবে; কিন্তু তুমি ছাড়া এমন অনেক লোক আছেন, যাঁহারা সত্যকে দর্শন করিয়াছেন—তাঁহারা ঐ স্বর্গাদিভোগে তৃপ্ত হইয়াছেন, তাঁহারা আর উহাতে আবদ্ধ হইয়া থাকিতে চান না, তাঁহারা সকল সীমার বাহিরে যাইতে চান, জগতের কিছুই তাঁহাদিগকে পরিতৃপ্ত করিতে পারে না। জগৎ ও উহার সমুদয় ভোগ তাঁহাদের পক্ষে ডোবার মতো। তুমি তাঁহাদিগকে তোমার ভাবে বদ্ধ করিয়া রাখিতে চাও কেন? এই ভাবটি একেবারে ছাড়িতে হইবে, প্রত্যেককে নিজের ভাবে চলিতে দাও।
কয়েক বৎসর পূর্বে ‘সচিত্র লণ্ডন সমাচারে’ (Illustrated London News) একটি সংবাদ পাঠ করি। কতকগুলি জাহাজ১প্রশান্ত মহাসাগরে ‘সাউথ সী’ দীপপুঞ্জের নিকট ঝটিকাক্রান্ত হয়। ঐ পত্রিকায় জাহাজ-গুলির একটি চিত্রও ছিল। একখানি ব্রিটিশ জাহাজ ছাড়া সব গুলিই ভগ্ন হইয়া ডুবিয়া যায়। সেই জাহাজখানি ঝড় কাটাইয়া চলিয়া আসে। ছবিতে দেখাইতেছে—যে-জাহাজগুলি ডুবিয়া যাইতেছে, সেগুলির মজ্জমান আরোহিদল ডেকের উপর দাঁড়াইয়া ঐ জাহাজের লোকগুলিকে উৎসাহ দিতেছে। অপর লোককে টানিয়া নিজের স্তরে নামাইয়া আনিও না।
আর একপ্রকার নিবুর্দ্ধিতা আছে : যদি আমরা আমাদের এই ক্ষুদ্র আমিত্ব হারাইয়া ফেলি, তবে জগতে কোনরূপ নীতিপরায়ণতা থাকিবে না, মনুষ্যজাতির কোন আশাভরসা থাকিবে না। যাঁহারা উহা বলেন, তাঁহাদের যেন মনুষ্যজাতির জন্য সর্বদা প্রাণ যায় যায় হইয়াছে। যদি প্রত্যেক দেশে মানুষের যথার্থ কল্যাণকামী অন্ততঃ দুই শত নরনারী থাকে, তবে পাঁচদিনে সত্যযুগ উপস্থিত হইবে। আমরা জানি, মনুষ্যজাতির জন্য আমাদের প্রাণ কিরূপ ছটফট করিতেছে। এ-সব অভিসন্ধি-প্রণোদিত লম্বা লম্বা কথামাত্র। জগতের ইতিহাসে দেখা যায়, এই ক্ষুদ্র ‘আমি’কে যাঁহারা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছেন, তাঁহারাই মনুষ্যজাতির শ্রেষ্ঠ হিতকারী, আর নরনারী যত বেশী নিজেদের কথা ভাবিবে, তত কম পরের উপকার করিতে পারিবে। দুটির মধ্যে একটি নিঃস্বার্থপরতা, অপরটি স্বার্থপরতা। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভোগসুখে আসক্ত থাকা এবং চিরকাল এইভাবে চলা এবং একই অবস্থার পুনরাবর্তন ঘোর স্বার্থপরতা। উহা সত্যানুরাগ হইতে উৎপন্ন নয়, অপরের প্রতি দয়াও এই ভাবের উৎপত্তির কারণ নয়—উহার কারণ ঘোর স্বার্থপরতা; অপর কাহারও দিকে দৃষ্টি না রাখিয়া নিজেই সমস্ত ভোগ করিব—এই ভাব হইতে উহার উৎপত্তি। আমার তো এইরূপই বোধ হয়। আমি জগতে প্রাচীন মহাপুরুষ ও সাধুগণের তুল্য চরিত্রবান্ পুরুষ আরও দেখিতে চাই—তাঁহারা একটি ক্ষুদ্র পশুর উপকারে জন্য শত শত জীবন ত্যাগ করিতে প্রস্তুত ছিলেন। নীতি ও পরোপকারের কথা কি বলিতেছ? ইহাতো আধুনিক কালের বাজে কথামাত্র।
———-
১ প্রশান্ত মহাসাগরে সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের নিকট ব্রিটিশ জাহাজ ক্যালিয়োপি (Calliope)ও আমেরিকার কতকগুলি যুদ্ধজাহাজ।
আমি সেই গৌতম বুদ্ধের ন্যায় চরিত্রবান্ লোক দেখিতে চাই, যিনি সগুণ ঈশ্বর বা ব্যক্তিগত আত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন না, যিনি ঐ বিষয়ে কখন কোন প্রশ্নই করেন নাই, যিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন, কিন্তু সকলের জন্য নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন—সারা জীবন সকলের উপকার করিতে নিযুক্ত ছিলেন, সারা জীবন কিসে অপরের কল্যাণ হয়, ইহাই তাঁহার চিন্তা ছিল। তাঁহার জীবনচরিত-লেখক বেশ বলিয়াছেন, তিনি ‘বহুজনহিতায় বহুজন-সুখায়’ জন্মগ্রহণ করিযাছেলেন। তিনি বনে গিয়া ধ্যান করিয়াছিলেন, তাহাও নিজের মুক্তির জন্য নয়। জগৎ জ্বলিয়া গেল—বাঁচিবার পথ বাহির করিতেই হইবে। জগতে এত দুঃখ কেন?—তাঁহার সারাজীবন এই এক চিন্তা ছিল। তোমরা কি মনে কর, আমরা তাঁহার মতো নীতিপরায়ণ?
* * * *
যীশুখ্রীষ্ট যে-ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন, সেই খাঁটি খ্রীষ্টধর্মে ও বেদান্ত-ধর্মে অতি অল্পই প্রভেদ। খ্রীষ্টধর্মে বিকৃতভাব অতি অল্পই ছিল। যীশু অদ্বৈতবাদ প্রচার করিয়াছেন, আবার সাধারণের উপযোগী এবং উচ্চতম আদর্শ ধারণা করিবার সোপানরূপে দ্বৈতবাদের কথাও বলিয়াছেন। ‘আমাদের স্বর্গস্থ পিতা’ বলিয়া যিনি প্রার্থনা করিতে উপদেশ দিয়াছেন, তিনিই আবার প্রচার করিয়াছেন, ‘আমি ও আমার পিতা এক’; আর তিনি ইহাও জানিতেন, এই স্বর্গস্থ পিতারূপে দ্বৈতভাবে উপাসনা করিতে করিতেই এই বোধ আসিয়া থাকে যে ‘আমি ও আমার পিতা এক’ তখন ঐ ধর্মে ছিল কেবল প্রেম ও আশীর্বাদ, কিন্তু অবশেষে নানাবিধ মত উহাতে প্রবিষ্ট হওয়ায় উহা বিকৃত ভাব ধারণ করিয়া অবনত হইল।
এই যে ক্ষুদ্র ‘আমি’র জন্য মারামারি, ‘আমি’র প্রতি অতিশয় ভালবাসা, শুধু এই জীবনে নয় মৃত্যুর পরও এই ক্ষুদ্র ‘আমি’—এই ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব লইয়া থাকিবার ইচ্ছা, ইহা ধর্মের বিকৃতভাব হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। অনেকে বলেন, ইহাই নিঃস্বার্থপরতা—ইহাই নীতির ভিত্তিস্বরূপ। ইহা যদি নীতির ভিত্তি হয়, তবে আর দুর্নীতির ভিত্তি কি? স্বার্থপরতা নীতির ভিত্তি! আর যে-সকল নরনারীর নিকট আমরা অধিকতর জ্ঞানের আশা করি, তাঁহারা ঐ কথা শুনিয়া হতবুদ্ধি হইয়া যান এবং মনে করেন এই ক্ষুদ্র ‘আমি’র নাশ হইলে সব নীতি একেবারে ধ্বংস হইবে। এই সর্বপ্রকার শুভভাবের, সর্বপ্রকার নৈতিক মঙ্গলের মূলমন্ত্র—’আমি নয়, তুমি’।
কে ভাবিতে যায়—স্বর্গনরক আছে কি না? কে ভাবিতে যায়—আমার আত্মা আছে কি-না? কে ভাবিতে যায়—কোন অপরিণামী অপরিবর্তনীয় সত্তা আছে কি-না? কে ভাবিতে যায়— এই সংসার পড়িয়া রহিয়াছে, ইহা মহাদুঃখে পরিপূর্ণ। বুদ্ধের মতো এই সংসার-সমুদ্রে ঝাঁপ দাও। দুঃখ লাঘব করিবার জন্য—হয় সংগ্রাম কর, নয় ঐ চেষ্টায় প্রাণ বিসর্জন দাও। আস্তিক হও বা নাস্তিক হও, অজ্ঞেয়বাদী হও বা বৈদান্তিক হও, খ্রীষ্টান হও বা মুসলমান হও, নিজেকে ভুলিয়া যাও—ইহাই প্রথম শিক্ষার বিষয়। এই শিক্ষা, এই উপদেশ সকলেই বুঝিতে পারে, ‘নাহং নাহং, তঁহু তুঁহু’—অহংনাশ ও প্রকৃত ‘আমি’র বিকাশ।
দুইটি শক্তি সর্বদা সমান্তরালভাবে কার্য করিতেছে। একটি ‘অহং’, অপরটি ‘নাহং’। শুধু মানুষের ভিতর নয়, জীবজন্তুর ভিতর এই দুইটি শক্তির বিকাশ দেখা যায়—এমন কি, ক্ষুদ্রতম কীটাণুর মধ্যেও এই দুই শক্তির প্রকাশ। নরশোণিতপানে লোলজিহ্ব ব্যাঘ্রী তাহার শাবককে রক্ষা করিবার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। অতি অধঃপতিত ব্যক্তি, যে অনায়াসে তাহার ভ্রাতৃ-সমান অন্যান্য মানুষকে হত্যা করিতে পারে, সেও অনাহারে মুমূর্ষু স্ত্রী অথবা পুত্র-কন্যার জন্য সব করিতে প্রস্তুত। অথবা দেখা যায়; সৃষ্টির ভিতরে এই দুই শক্তি পাশাপাশি কার্য করিতেছে—যেখানে একটি শক্তি দেখিবে, সেখানে অপরটিও দেখিবে। একটি স্বার্থপরতা, অপরটি নিঃস্বার্থপরতা। একটি গ্রহণ, অপরটি ত্যাগ। ক্ষুদ্রতম প্রাণী হইতে উচ্চতম প্রাণী পর্যন্ত সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডই এই দুই শক্তির লীলাক্ষেত্র। ইহার কোন প্রমাণের প্রয়োজন নাই, ইহা স্বতঃপ্রমাণ।
সমাজের এক সম্প্রদায়ের লোকের বলিবার কি অধিকার আছে যে, জগতের সমুদয় কার্য ও বিকাশ ঐ দুই শক্তির অন্যতম—শুধু স্বার্থ-শক্তির উপর, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংগ্রামের উপর স্থাপিত? জগতের সমুদয় কার্য রাগ-দ্বেষ, বিবাদ ও প্রতিযোগিতার উপর স্থাপিত, এ-কথা বলিবার তাঁহাদের কি অধিকার আছে? এই-সকল প্রবৃত্তি যে আছে, তাহা অস্বীকার করি না।
কিন্তু অপর শক্তিটির অস্তিত্ব ও ক্রিয়া অস্বীকার করিবার কি অধিকার তাঁহাদের আছে? আর তাঁহারা কি অস্বীকার করিতে পারেন যে, এই প্রেম—এই অহংশূন্যতা, এই ত্যাগই জগতের একমাত্র পরা শক্তি? অপর শক্তিটি এই প্রেমশক্তিরই বিপরীতভাবে প্রয়োগের ফল, এবং এই ভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার উৎপত্তি। অশুভের উৎপত্তিও নিঃস্বার্থপরতা হইতে—অশুভের পরিণামও শুভ বই আর কিছুই নয়। উহা কেবল কল্যানশক্তির অপব্যবহার মাত্র। একব্যক্তি যে অপর ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহাও হয়তো নিজের সন্তানের প্রতি স্নেহের প্রেরণায়—তাহাদিগকে ভরণ-পোষণ করিবে বলিয়া। তাহার প্রেম অন্য লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি হইতে প্রত্যাহূত হইয়া ঐ একটি শিশু-সন্তানের উপর পড়িয়া সসীম ভাব ধারণ করিয়াছে। কিন্তু সীমাবদ্ধই হউক, অসীমই হউক, ভালবাসা সেই ভগবান, অন্য কিছুই নহে।
অতএব সমগ্র জগতের প্রেরণাশক্তি, জগতের মধ্যে একমাত্র প্রকৃত ও জীবন্ত শক্তি সেই অদ্ভুত ভাব—উহা যে-কোন আকারে ব্যক্তি হউক না কেন, উহা সেই প্রেম, নিঃস্বার্থপরতা, ত্যাগ বই আর কিছুই নয়। বেদান্ত এইজন্যই অদ্বৈতভাবের উপর ঝোঁক দেন, দ্বৈতভাবের উপর নয়। আমরা এই ব্যাখ্যার উপর বিশেষ জোর দিই কারণ, আমরা জানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অহমিকা সত্ত্বেও আমাদের মানিতে হইবে, যেখানে একটি কারণ দ্বারা কতকগুলি কার্য ব্যাখ্যা করা যায়, আবার অনেকগুলি কারণ দ্বারাও যদি সেই কার্যগুলি ব্যাখ্যা করা যায়, তবে অনেকগুলি কারণ স্বীকার না করিয়া সেই একটি কারণই সত্য বলিয়া স্বীকার্য। এখানে যদি আমরা স্বীকার করি যে, সেই এক অপূর্ব সুন্দর প্রেমই সীমাবদ্ধ হইয়া অশুভ বা অসৎরূপে প্রতীয়মান হয়, তবে আমরা এক প্রেম শক্তি দ্বারাই সমুদয় জগতের ব্যাখ্যা করিতে সমর্থ হইলাম। নচেৎ আমাদিগকে জগতের দুইটি কারণ মানিতে হয়—একটি শুভ শক্তি , অপরটি অশুভটি -একটি প্রেম শক্তি , অপরটি দ্বেষশক্তি। এই দুই সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনটি অধিক যুক্তিসঙ্গত? অবশ্য একটি কারণ মানিয়া লওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
আমি এমন সব বিষয়ে গিয়া পড়িতেছি, যাহা সম্ভবতঃ দ্বৈতবাদীদের অধিকার-বহির্ভূত। ভয় হইতেছে, দ্বৈতবাদের আলোচনা লইয়া আমি বোধ হয় বেশীক্ষন কাটাইতে পারি না। আমার ইহাই দেখানো উদ্দেশ্য যে, উচ্চ-তম দার্শনিক ধারণার সহিত নীতি ও নিঃস্বার্থপরতার উচ্চতম আদর্শ পাশাপাশি যাইতে পারে। আমার ইহাই দেখানো উদ্দেশ্য, নীতিপরায়ণ হইতে গেলে তোমার দার্শনিক ধারনাকে খাটো করিতে হয় না; বরং নীতির ভিত্তি-ভূমি লাভ করিতে হইলে উচ্চতম দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণা-সম্পন্ন হইতে হইবে। মানুষের জ্ঞান মানুষের কল্যানের বিরোধী নয়। বরং জীবনের প্রত্যেক বিভাগেই জ্ঞান আমাদিগকে রক্ষা করিয়া থাকে; জ্ঞানই উপাসনা। আমরা যতই জ্ঞানলাভ করিতে পারি, ততই আমাদের মঙ্গল। বেদান্তী বলেন, এই আপাতপ্রতীয়মান অশুভের কারণ—অসীমের সীমাবদ্ধ ভাব। যে-প্রেম সীমাবদ্ধ হইয়া ক্ষুদ্রভাবাপন্ন হইয়া যায় এবং অশুভ বলিয়া প্রতীয়মান হয়, তাহাই আবার অপর প্রান্তে অসীম হইয়া ব্রহ্মরূপে প্রকাশ পায়। আর বেদান্ত ইহাও বলেন, এই আপাত প্রতীয়মান সমুদয় অশুভের কারণ আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে অতিপ্রাকৃত কোন সত্তার উপর দোষারোপ করিও না, নিরাশ বা বিষন্ন হইয়া পড়িও না, অথবা মনেকরিও না আমরা গর্তের মধ্যে পড়িয়া আছি—অপর কেহ আসিয়া আমাদিগকে সাহায্য না করিলে আমরা আর উঠিতে পারিব না। বেদান্ত বলেন, এ-ধারণা ঠিক নহে; আমরা গুটিপোকার মতো! নিজের শরীর হইতে জাল প্রস্তুত করিয়া কালক্রমে তাহাতে আবদ্ধ হইয়াছি। কিন্তু এ বদ্ধভাব চিরকালের জন্য নয়। উহার মধ্যে প্রজাপতিতে পরিণত হইয়া আমরা বাহিরে আসিব, মুক্ত হইব। আমরা আমাদের চতুর্দিকে এই কর্মজাল জড়াইয়াছি, আমরা অজ্ঞানবশতঃ মনে করিতেছি আমরা যেন বদ্ধ, আর কখন কখন সাহায্যের জন্য চীৎকার ও ক্রন্দন করিতেছি। কিন্তু বাহির হইতে কোন সাহায্য পাওয়া যায় না, সাহায্য পাওয়া যায় ভিতর হইতে। জগতের সকল দেবতার নিকট উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতে পারো। আমি অনেক বৎসর ধরিয়া এইরূপ ক্রন্দন করিয়াছি; অবশেষ দেখিলাম, সাহায্য পাইয়াছি। কিন্তু এই সাহায্য ভিতর হইতে আসিল , আর ভুলবশতঃ এতদিন যাহা করিতেছিলাম, তাহা নষ্ট করিতে হইল। ইহাই একমাত্র উপায়। নিজের চারিদিকে যে-জাল বিস্তার করিয়াছিলাম, তাহা আমাকেই ছিন্ন করিতে হইবে, আর তাহা করিবার শক্তিও আমার ভিতরে রহিয়াছে। এ-বিষয়ে আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি যে, আমার জীবনের ভালমন্দ কোন ভাবই বৃথা যায় নাই—আমি সেই অতীত শুভাশুভ উভয়বিধ কর্মেরই সমষ্টি-স্বরূপ। আমি জীবনে অনেক ভুল করিয়াছি, কিন্তু ঐগুলির একটিও যদি বাদ পড়িত, তাহা হইলে আমি আজ যাহা হইয়াছি, তাহা হইতাম না। আমার জীবনে আমি বেশ সন্তুষ্ট। আমার এ-কথা বলিবার উদ্দেশ্য ইহা নয় যে, তোমরা বাড়ি গিয়া নানাপ্রকার অন্যায় কাজ করিতে থাকো, আমার কথা এইরূপে ভুল বুঝিও না। আমার বলিবার উদ্দেশ্য এই, কতকগুলি ভুলচুক হইয়া গিয়াছে বলিয়া একেবারে বসিয়া পড়িও না, কিন্তু জানিও পরিণামে তাহাদের ফল শুভই হইবে। অন্যরূপ হইতে পারে না, কারণ মঙ্গল ও পবিত্রতা আমাদের প্রকৃতিসিদ্ধ ধর্ম, আর কোন উপায়েই সেই প্রকৃতির অন্যথা হয় না। আমাদের যথার্থ স্বরূপ সর্বদা একই-প্রকার।
আমাদের ইহা বুঝা আবশ্যক যে, আমরা দুর্বল বলিয়াই নানাবিধ ভ্রমে পড়িয়া থাকি, আর অজ্ঞান বলিয়াই আমরা দুর্বল। আমি পাপ-শব্দ ব্যবহার না করিয়া ‘ভ্রম’-শব্দ ব্যবহার করাই পছন্দ করি। আমাদিগকে ভ্রমে বা অজ্ঞানে ফেলিয়াছে কে? আমরা নিজেরাই। আমরা নিজ নিজ চোখে হাত দিয়া ‘অন্ধকার, অন্ধকার’ বলিয়া চীৎকার করিতেছি। হাত সরাইয়া লও, দেখিবে আলোক আমাদের জন্য সর্বদাই রহিয়াছে, সেই জীবাত্মার স্বপ্রকাশ আলোক। দেখিতে পাইতেছ না আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ কি বলিতেছেন? এই-সকল ক্রমবিকাশের হেতু কি? বাসনা। কোন জীবজন্তু যেভাবে আছে, তাহার অতিরিক্ত কিছু করিতে চায়—সে দেখে, তাহার পরিবেশ উপযোগী নহে, সুতরাং সে একটি নূতন শরীর গঠন করিয়া লয়। নিম্নতম জীবাণু হইতে নিজ ইচ্ছাশক্তিবলে তুমি উৎপন্ন হইয়াছ—আবার সেই ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ কর, আরও উন্নত হইতে পারিবে। ইচ্ছা সর্বশক্তিমান্। বলিতে পরো, ইচ্ছাই যদি সর্বশক্তিমান্, তবে অনেক কিছুই আমি করিতে পারি না কেন? যখন তুমি এ-কথা বলো, তখন তুমি তোমার ক্ষুদ্র ‘আমি’র দিকে লক্ষ্য করিতেছ মাত্র। ভাবিয়া দেখ, ক্ষুদ্র জীবণু হইতে তুমি এই মানুষ হইয়াছ। কে তোমাকে মানুষ করিল? তোমার নিজের ইচ্ছাশক্তি। তুমি কি অস্বীকার করতে পারো, ইচ্ছা সর্বশক্তিমান? যাহা তোমাকে এতদূর উন্নত করিয়াছে, তাহা তোমাকে আরও উন্নত করিবে। আমাদের প্রয়োজন—চরিত্র ও ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা, এ-গুলির দুর্বলতা নয়।
অতএব যদি তোমাকে উপদেশ দিই যে, তোমার প্রকৃতিই অসৎ, আর তুমি কতকগুলি ভুল করিয়াছ বলিয়া তোমাকে অনুতাপ ও ক্রন্দন করিয়া জীবন কাটাইতে হইবে, তাহাতে তোমার বিশেষ কিছুই উপকার হইবে না, বরং উহা তোমাকে আরও দুর্বল করিয়া ফেলিবে, আর তাহাতে তোমাকে ভাল হইবার পথ না দেখাইয়া বরং আরও মন্দ হইবার পথ দেখানো হইবে। যদি সহস্র বৎসর ধরিয়া এই গৃহ অন্ধকার থাকে. আর তুমি সেই গৃহে আসিয়া ‘হায়, বড় অন্ধকার! বড় অন্ধকার!’ বলিয়া রোদন করিতে আরম্ভ কর, তবে কি অন্ধকার চলিয়া যাইবে? একটি দিয়াশলাই জ্বালিলে এক মুহূর্তেই ঘর আলোকিত হইবে। অতএব সারা জীবন ‘আমি অনেক দোষ করিয়াছি, আমি অনেক অন্যায় কাজ করিয়াছি’ বলিয়া অনুশোচনা করিলে কি তোমার উপকার হইবে? আমরা নানা দোষে দোষী, ইহা কাহাকেও বলিয়া দিতে হয় না। জ্ঞানের আলো জ্বালো, এক মুহূর্তে সব অশুভ চলিয়া যাইবে। নিজের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ কর, প্রকৃত ‘আমি’কে—সেই জ্যোতির্ময়, উজ্জ্বল, নিত্যশুদ্ধ ‘আমি’কে প্রকাশ কর; প্রত্যেক ব্যক্তিতে সেই আত্মাকে প্রকাশ কর। আমি ইচ্ছা করি, সকলেই এমন অবস্থা লাভ করুক যে, অতি জঘন্য পুরুষকে দেখিলেও তাহার বাহিরের দুর্বলতার দিকে লক্ষ্য না করিয়া অন্তর্যামী ভগবানকে দেখিতে পারে,, আর তাহার নিন্দা না করিয়া বলিতে পারে, ‘হে স্বপ্রকাশ, জ্যোতির্ময় ওঠ! হে সদাশুদ্ধ স্বরূপ ,ওঠ ! হে অজ , অবিনাশী , সর্বশক্তিমান্ , ওঠ ! আত্মস্বরূপ প্রকাশ কর। তুমি যে-সকল ক্ষুদ্র ভাবে আবদ্ধ হইয়া রহিয়াছ, তাহা তোমাতে সাজে না।’ অদ্বৈতবাদ এই শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা শিক্ষা দিয়া থাকেন। ইহার একমাত্র প্রার্থনা—নিজস্বরূপ-স্মরণ, সদা সেই অন্তর্যামী ঈশ্বরের স্মরণ, তাঁহাকে সর্বদা অনন্ত সর্বশক্তিমান্ সদামঙ্গলময় বলিয়া স্মরণ। এই ক্ষুদ্র অহং তাঁহাতে নাই, ক্ষুদ্র বন্ধনসমূহ তাঁহাতে নাই। আর এই প্রার্থনা নিঃস্বার্থ বলিয়াই ভয়শূন্য ও শক্তিসম্পন্ন; কারণ স্বার্থ হইতেই ভয়ের উৎপত্তি। যাহার নিজের অন্য কোন কামনা নাই, সে কাহাকে ভয় করিবে? কোন্ বস্তুই বা তাহাকে ভীত করিতে পারে? মৃত্যু তাহাকে কী ভয় দেখাইতে পারে? অশুভ, বিপদ তাহাকে কী ভয় দেখাইতে পারে? অতএব যদি আমরা অদ্বৈতবাদী হই, আমাদিগকে অবশ্য চিন্তা করিতে হইবে যে, আমরা এই মুহূর্ত হইতেই মৃত। তখন আমাদের পুরাতন ব্যক্তিপরিচয় চলিয়া যায়, ও-গুলি কেবল কুসংস্কারমাত্র; অবশিষ্ট থাকেন সেই নিত্যশুদ্ধ সর্বশক্তিমান্ সর্বজ্ঞ-স্বরূপ এবং তখন সব ভয় চলিয়া যায়। সর্বব্যাপী ‘আমার’ অনিষ্ট কে করিতে পারে? এইরূপে আমার সমুদয় দুর্বলতা চলিয়া যায়, তখন অপর সকলের ভিতর এই ভাব জাগাইয়া তোলাই আমার কার্য হয়। আমি দেখিতেছি, সকলেই সেই আত্মস্বরূপ, কিন্তু সকলে তাহা জানে না। সুতরাং প্রত্যেককে ইহা শিখাইতে হইবে, সেই অনন্তশক্তির জাগরণে তাহাকে সহায়তা করিতে হইবে। আমি দেখিতেছি, জগতে এই ভাব প্রচার করাই বিশেষ প্রয়োজন। এই-সকল মত অতি পুরাতন—সম্ভবতঃ অনেক পর্বত অপেক্ষা পুরাতন। সকল সত্যই সনাতন। সত্য কাহারও একার সম্পত্তি নয়। কোন জাতি, কোন ব্যক্তিই সত্যকে নিজস্ব বলিয়া দাবি করিতে পারে না। সত্যই সকল আত্মার যথার্থ স্বরূপ। উহার উপর কে বিশেষ দাবি করিতে পারে? কিন্তু উহাকে কার্যে পরিণত করিতে হইবে, সরলভাবে উহা প্রচার করিতে হইবে, কারণ তোমরা দেখিবে—উচ্চতম সত্য অতি সহজ ও সরল। খুব সহজ ও সরলভাবে উহার প্রচার করিতে হইবে, যাহাতে ঐ ভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবিষ্ট হয়, যাহাতে উহা উচ্চতম মস্তিষ্ক হইতে আরম্ভ করিয়া অতি সাধারণ মনেরও অধিকারের বিষয় হইতে পারে, যাহাতে আবালবৃদ্ধবনিতা একই কালে উহা বুঝিতে পারে। এই-সকল ন্যায়ের কূটবিচার, দার্শনিক মতবাদ, এই-সকল দেবতাতত্ত্ব ও ক্রিয়াকাণ্ড এক সময়ে উপকার করিয়া থাকিতে পারে, কিন্তু এস আমরা একমনে ধর্মকে সহজ করিবার চেষ্টা করি, আর সেই সত্যযুগ আনিবার সহায়তা করি, যখন প্রত্যেকটি মানুষ উপাসক হইবে, আর প্রত্যেক মানুষের অন্তর্নিহিত সত্যবস্তু উপাস্য হইবেন।