১৭. একেশ্বরবাদ

একেশ্বরবাদ

সৰ্বেশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদে রূপান্তর যে কোন ক্রমবিবর্তনের ফলে ঘটেনি, এটা অবশ্যই কৌতুহলপ্ৰদ তথ্য। ঋগ্বেদের চূড়ান্ত পর্যায়ে (অর্থাৎ প্রথম মণ্ডলের প্রথম অংশ এবং অষ্টম ও দশম মণ্ডলে) আমরা একেশ্বরবাদী চিন্তাকে দৃঢ়প্রোথিত অবস্থায় দেখতে পাই। অবশ্য অন্যান্য মণ্ডলেও কোথাও কোথাও এমন কথা পাই যাতে মনে হয় অস্পষ্টভাবে হলেও একেশ্বরবাদের দিকে ঋষিদের প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। কিছু কিছু নুতন দেবনাম প্রবর্তিত হয়ে শ্রেষ্ঠ দেবতার পদবীতে উন্নীত হয়েছে এবং বিমূর্ত সৃষ্টিতত্ত্বরূপে গৃহীত হয়েছে। এই সংশয়ের তাৎপৰ্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে যদি আমরা স্মরণে রাখি যে প্রচলিত ধর্মীয় বাতাবরণ তত্ত্বপ্রতিষ্ঠ হওয়ার পরিবর্তে প্ৰত্নকথা ও অনুষ্ঠান-চর্যার উপর নির্ভরশীল ছিল। সেই সময়ে কোন পথসন্ধানী একেশ্বরবাদীর পক্ষে প্ৰত্নকথা ও রহস্য-নিষজ্ঞাত পরিমণ্ডল থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা অত্যন্ত কঠিন ; তাই কিছু কিছু বহুদেববাদী ও প্রত্ন-পৌরাণিক বৈশিষ্ট্য প্ৰকাশমান একেশ্বরবাদী ভাবনার সঙ্গে সংলগ্ন হয়েছিল।

যদিও ঋগ্বেদের সমস্ত প্ৰধান দেবতাকেই কোথাও না কোথাও সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সংহিতার শেষ পর্যায়ে জগৎ স্রষ্টা রূপে সম্পূর্ণ নূতন কয়েকটি দেবনাম প্রবর্তিত হয় ; যেমন প্ৰজাপতি, বিশ্বকৰ্মা, হিরণ্যগৰ্ভ, ব্ৰহ্মণস্পতি, পুরুষ ও পরমাত্মা। কোন কোন সূত্তে সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গেই তাদের সম্পর্কিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত হল ভাবসূক্ত— (১০ : ১৯০), নাসদীয় সূক্ত (১০ : ১২৯) এবং অস্যবামীয় সূক্ত (১ : ১৬৪)। অধিকাংশ অধ্যাত্মবিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক সূক্তে অতীন্দ্ৰিয়বাদী উপাদান স্পষ্টই দৃষ্টিগোচর হয় ; এর কারণ হিসাবে আমরা আদিম দার্শনিকের দৃষ্টিতে দুর্জ্ঞেয়তার অভিব্যক্তি এবং বিষয়বস্তুর নিজস্ব অন্তর্নিহিত রহস্যের কথা উল্লেখ করতে পারি। এই সব রহস্যময় অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির স্পষ্টীকরণে পরবর্তী ভাষ্যগুলি সহায়তা করতে সর্বদা সমর্থ হয় নি ; এদের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে কোনো অকাট্য যুক্তি এখনও উপস্থাপিত করা যায় নি।

পরমেশ্বর যখন সৃষ্টি করেন, তাঁকে সাধারণত ধ্যানরত যোগী রূপে কল্পনা করা হয়-পরবর্তী বৈদিক সমাজের ধর্ম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নূতন দৃষ্টিভঙ্গি যে দেখা দিয়েছে, তার একটা ইঙ্গিত এখানে পাওয়া যায়। এমন কি দিকসমূহ (আশাঃ) এবং যে সমস্ত দেবতার সঙ্গে নিদানবিদ্যাবিষয়ক প্রত্নকথা সম্পূক্ত—তাদের উত্তানপাদ। যোগী রূপে বর্ণনা হয়েছে। সেই সঙ্গে সৃজন-প্রক্রিয়ায় নিরত স্ৰষ্টা দেবতাদের ‘তপস্‌’- এর উল্লেখ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে ‘স্রষ্টা যোগী’ একটি নূতন সামাজিক ধারণা রূপে বৈদিক সাহিত্যের শেষ অংশে দেখা দিযেছিল। এই প্রসঙ্গে মহেঞ্জোদারোতে প্ৰাপ্ত ধ্যানমগ্ন দেবতার মূর্তির কথা আমাদের মনে পড়বে। সম্ভবত যোগী দেবতার এই আদিমতম রূপটি ঋগ্বেদের দমশ মণ্ডল রচিত হওয়ার সময়ে অধিকতর সমৃদ্ধ হয়ে ভারতীয় ধর্মীয জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছিল।

নাসদীয় সূক্তে (১০ : ১২৯) ‘অসৎ’ বা অনস্তিত্ব থেকে সৎ বা অস্তিত্বের সৃষ্টি কল্পনা। কবি তাঁর কল্পনাকে মহাসময়ের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যখন সৃষ্টির সূচনাও হয়নি। অনস্তিত্বের আদিমতম অন্ধকার এবং সময় ও পরিসরের সার্বিক শূণ্যতা তার কবিদ্যুষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। কবি-দৃষ্টির এই উদ্ভাসনেই সূক্তটির গৌরব নিহিত কেননা আধ্যাত্মিক ভাবনা এতে অস্পষ্ট ও বিশৃঙ্খল। প্রজাপতি মাত্র চারবার উল্লিখিত হয়েছেন যদিও পরবর্তী সাহিত্যে তাঁকে শক্তিমান স্রষ্টার ভূমিকায় দেখা গেছে। স্রষ্টারূপে তিনি কালের প্রতীক ; অন্যদিকে সর্বাতিগ আকাশ দেবতারূপে পরিকল্পিত মহাপরিসরের মানবায়িত রূপ আমরা বৃহস্পতির মধ্যে দেখতে পাই। আবার ইন্দ্ৰ, অগ্নি, সোম, বরুণ, প্রজাপতি, বৃহস্পতি প্রমুখ প্রধান দেবতাদের বিশ্বস্রষ্টার ভূমিকায় বিমূর্তায়িত প্রকাশ লক্ষ্য করি বিশ্বকর্মার মধ্যে। এছাড়া, হিরণ্যগৰ্ভ স্বর্ণোজ্জ্বল অন্ত বা সৃষ্টির আদিকণিকারূপে জগৎপ্রক্রিয়ার একটি বিশেষ স্তরের প্রতিভূ।

যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে দর্শনে উত্তরণের স্তরের প্রামাণ্য রচনা হল পুরুষসূক্ত (১০ : ৯০) ; এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সূক্তে পুরুষ স্রষ্টারূপে প্ৰশংসিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি স্বয়ং সৃষ্টি করেন নি , দেবতারা তাকে যজ্ঞে হব্যরূপে অৰ্পণ করেছিলেন ; তাঁর সেই বলিপ্রদত্ত শরীর থেকে ক্ৰমে ক্রমে সমগ্র সৃষ্টি উদ্ভূত হয়েছিল। অধিবিদ্যার স্তরে পুরুষসূক্ত যজ্ঞের মাধ্যমে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির চূড়ান্ত প্রতীকী বিবরণ দিয়ে যজ্ঞানুষ্ঠানকে মৌলিক আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে ভূষিত করেছে যা আরণ্যক ও উপনিষদের স্তর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সুক্তের ষোড়শ মন্ত্রের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসামান্য কেননা সেখানে পুরুষের মুখ, বাহু, উরু ও চরণ থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য, শূদ্ৰ—এই চার বর্ণের উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে। সমগ্র ঋগ্বেদে এটাই একমাত্র নিদর্শন যেখানে সামাজিক শ্রেণীভেদের ইঙ্গিত-সহ চতুবৰ্ণ উল্লিখিত-যদিও ‘বর্ণ’ শব্দটি এখানে উচ্চারিত হয় নি।

অম্ভৃণ ঋষির কন্যা ‘বাক্‌’-বিরচিত পরমাত্ম-সূক্ত (১০ : ১২৫) বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। যেহেতু এখানেই প্ৰথম এক নারী কবি সমস্ত দেবতার সঙ্গে আপনি সত্তার একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। পরবর্তী বহু ভারতীয় দর্শনে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যে একাত্মতা ঘোষিত হয়েছে তার প্রথম উচ্চারণ যেন এই নারী কবিটির রচনায়। উপনিষদ ও বেদান্তে অভিব্যক্ত দার্শনিক ভাবনার উৎস রূপে একে গ্রহণ করা যায়। রচয়িতা ‘বাক্‌’ যেহেতু নারী এবং উত্তম পুরুষের বাচনিকভঙ্গিতে নিজের সঙ্গে দেবসঙ্ঘ ও বিশ্বজাগতিক তাবৎ উপাদানকে একাত্মীভূত করে যেহেতু তিনি কাব্য প্ৰণয়ন করেছেন, তাই পরমাত্মার সমতুল্য আদ্যশক্তির প্রতি নিবেদিত প্ৰথম স্তোত্র হিসাবে এই সূক্তকে গ্ৰহণ করা যায়। পরবর্তীকালে তাই এর জনপ্রিয় নামান্তর হল ‘দেবীসূক্ত’। যদিও এখানে ভ্ৰান্তির সম্ভাবনা থেকে গেছে। কারণ ‘বাক্‌’ নিজেকে দেবী বলেন নি, পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্নই বলেছেন।

সংক্ষিপ্ত ভাবসূক্ত (১০ : ১৯০) সৃষ্টিতত্ত্ব-বিষয়ক তিনটি মাত্র মন্ত্রে গঠিত ; এতে সৃষ্টির ক্রমপর্যায় বিবৃত হয়েছে। বহু পরবর্তী দার্শনিক চিন্তার ভ্রূণ এতে পাওয়া যায়। ‘অস্যবামীয়’ সূক্তের (১ : ১৬৪) নামকরণ হয়েছে মন্ত্রের প্রারম্ভিক দুটি শব্দ দিয়ে (অস্য’ ও ‘বামস্যা, বিখ্যাত ব্যাবিলনীয় কাব্য ‘এনুমা এলিশ’-এর মতো) ; এর উপযুক্ত টীকা ও ব্যাখ্যা এখনো রচিত হয়নি। বিষয়বস্তুর অর্ধ-অতীন্দ্ৰিয় দুর্জেয়তা ও গৃঢ় বিদ্যার বৈশিষ্ট্য ভাষ্যকারকে বিমূঢ় করে। মূলত এটি সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক সূক্ত ; বহু প্ৰাচীন কালের ঋষিতুল্য কোনো যজমান। এখানে স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ। গভীর বিনয়ের সঙ্গে কবি সৃষ্টির বস্তুগত কারণ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে মৌলিক হেতুতাত্ত্বিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কবিত্বশক্তির গুণে কিছু কিছু মন্ত্র অসামান্য, বিশেষত বিংশতিতম মন্ত্রটি (দ্বা সুপর্ণা…) বিভিন্ন বর্গীয় পাঠকের মধ্যে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অধিবিদ্যাগত তাৎপর্যের সন্ধান না করেও আমরা অনায়াসে এর কাব্যাস্বাদ গ্ৰহণ করতে পারি ; সেই সঙ্গে জীবনের প্রতি প্ৰত্যক্ষনিবিড় ও নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গির সার্থক অভিব্যক্তিকে তার কাব্য মর্যাদায় উপলব্ধি করতে সমর্থ হই। আবার, সৰ্বেশ্বরবাদ ও একেশ্বরবাদের মধ্যে সমন্বয়-প্ৰয়াস পরিস্ফুট হয়েছে এই সূক্তের ষটচত্বারিংশৎ মন্ত্রে।