১৭. একটি বিচিত্র লোকগাথা

সতেরো – একটি বিচিত্র লোকগাথা

জুহা মৌলবির মধ্যে সেইসব মোগল কিংবা হূণ সর্দারদের হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়ার বেগ ছিল। ‘ভিনি ভিডি ভিসি—এলাম দেখলাম জয় করলাম।’ মৌলবি এইরকম বলেন। করেনও অনেক। গ্রামের মুসলমানরা তাঁর হাতে ‘তৌবা’ (ক্ষমাপ্রার্থনা) ‘ফরাজি’ মতে দীক্ষা নিয়েছে। সঙ্গীত শুনলে চল্লিশ বছরের ‘বন্দেগী (উপাসনা) বরবাদ হয়, মেনেছে। মেয়েদের পর্দানসীন করেছে। হিন্দু জমিদারদের মাটিতে গোরু কোরবানিও অনেক জায়গায় চালু হয়েছে। ব্রিটিশ রাজা খ্রিস্টান। সদরে কালেকটার বাহাদুর, পুলিশ সায়েব প্রমুখ আমলা—ফয়লা সাদা চামড়া ও খ্রিস্টান। জুহা মৌলবি মুখে ফতোয়া দিয়েছেন—ব্রিটিশরাজ জালেম (অত্যাচারী), তার বাদশাহি হারাম (নিষিদ্ধ), তার শাসনে বাস করা মুসলমানের গোনাহ (পাপ); কিন্তু গুরুতর সাম্প্রদায়িক গোলযোগের হাওয়া উঠলেই সোজা দরবার করেছেন কালেকটার বাহাদুরের কাছে। বলেছেন, ‘স্যার—ইওর প্রফেট ইজ মাই প্রফেট। দি সেইম অরিজিন স্যার।’ কলেকটার তাই শুনে হেসেছেন।—’রাইট’ রাইট মৌলানা। দেয়ার ইজ এ সেইয়িং—ইসলাম ইজ এ ড্র্যাসটিক ফর্ম অফ দি খ্রিস্টিয়ানিটি’। এবং ক্রমশ ইংরেজ ততদিনে মুসলমানদের চুপি চুপি কোলে টানতে শুরু করেছিল। এর মোদ্দা কারণ, কংগ্রেসের ব্যাপক অভ্যুত্থান আর তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ!’ ইংরেজও যেন জুহা মৌলবির সুরে গলা মিলিয়ে বলতে চাইছিল—উই আর অফ দি সেইম অরিজিন! তোমরা এসেছ, দেখেছ, জয় করেছ—আমরাও এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। এতে জোর কাজ হচ্ছিল। ওহাবি আন্দোলনের তীব্রতা হারাল। ইংরেজ শেখাল এবং জুহা মৌলবিরা মুসলিম নেতাদের প্রতিনিধি হয়ে গ্রামে—গঞ্জে বলতে শুরু করলেন—আমরা মুসলমান, বাদশাহের জাত! কংগ্রেস হিন্দুদের কারবার! অতএব……

নিজের মধ্যে এক বাদশাহকে নিশ্চয় দেখতে পেতেন জুহা মৌলবি। তাঁর বাদশাহি এক ইসলামি সাম্রাজ্যের। এটা বড় জোর তাঁর অবচেতন স্বপ্নের বেশি কিছু নয়। এবং এর আভাস পেলেই গোরাং ডাক্তার মুখোমুখি বলতেন—’ইস! ঢাল নেই তরোয়াল নেই—নিধিরাম সর্দার!’

গোরাং ডাক্তারকে কিন্তু শেষ অব্দি বাদশাহি দাপট সইতে হল।—’খামোকা পড়ে—পড়ে লোকটা পাগল হবে, আর জুহা তাই দেখবে চুপচাপ?’ মৌলবি দাপটে এসে গোরাংবাবুকে এক প্রত্যুষে টেনে তুললেন।….’তিনপাহাড়ি নিয়ে যাবার লোক নেই, এ কি কাজের কথা মা স্বর্ণলতা? আমি তবে আছি কী করতে? যাবি তো সোজা সঙ্গে চলে আয়, নয়তো বাপের দায়দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে নিজের ডাক্তারি কর।’

জুহা মৌলবির চেহারায় যখন ওই রোখ বা দাপট ঠেলে ওঠে, সবাই ভড়কে যায়। স্বর্ণ চুপচাপ রইল। এদিকে গোরাংবাবু ত্রাহি ত্রাহি চেঁচাচ্ছেন। লোক জড়ো হয়েছে গাছপালার আনাচে—কানাচে। সবাই অবশ্য মজাটাই দেখছে। মৌলবি একা বীরবিক্রমে তাঁকে টেনে— হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন। গোরাংবাবু প্রচণ্ড গালাগালিও করছিলেন। জাতধর্ম তুলেও বটে। জুহাসায়েব নির্বিকার। আপ ট্রেন এসে গেল। তারপর সব অদৃশ্য। খাঁ খাঁ প্ল্যাটফর্ম। তরুণ শিরীষ পিপুল কৃষ্ণচূড়ার ডালপালায় বাতাস খেলছে। জর্জ হ্যারিসন স্টেশনের উঁচু বারান্দায় আপের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিশান হাতে ঘরে ঢুকে গেল।

ময়রাবুড়ির আখড়ায় এ নিয়ে কিছু চাপা মন্তব্যও শোনা গিয়েছিল। মৌলবির একটা মতলব আছে মাথায়। বুড়ি বলেছিল, ‘ও মোছলমান করতে নিয়ে গেল বুড়োকে। দেখো, এ যদি না হয়, আমার নামে কুকুর পুষে ছেড়ে দিয়ো তোমরা। আর—এর পর কী হবে জানো? ওর মেয়েটা খেরেস্তানে জাত দেবে। বাপ হবে মোছলমান, মেয়ে হবে খেরেস্তান।’

তাই নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে রটেও গেল কিছুটা। জুহা মৌলবির মোক্ষম শিকার এবার স্টেশনধারের গোরাং ডাক্তার! সবাই আশা করতে লাগল যে অদূর ভবিষ্যতে গোরাংবাবু ট্রেন থেকে নামবেন গোরাই মিয়া হয়ে, মাথায় থাকবে লাল ফেজ টুপি, পরনে পায়জামা, গালে দাড়ি, মুখে ‘বিসমিল্লা!’ তবে অন্য কোনো সজ্জন ভদ্র মানুষ হলে এই নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপ ও ভট্টাচার্যরা গোল পাকাতে বসতেন। কিন্তু গোরাং ডাক্তার! রাম কহো, রাম কহো।

ডাকুর সর্দার। দাগীর রাজা। ছত্রিশজাতের এঁটো খাওয়া জাতনাশা বামুন। ম্লেচ্ছের হদ্দ। না মানে মনু, না মানে মানুষ। সমাজছাড়া সৃষ্টিছাড়া এবং হতচ্ছাড়া জীব।

তার মেয়ে ম্লেচ্ছ খেরেস্তানের গলা ধরে রাতে শুয়ে থাকে, দিনে ঢলাঢলি করে। বাপের ধ্বন্বন্তরীবিদ্যার ‘টুকুনটাকুন (একটু—আধটু) পেয়েছিল, তাই রক্ষে। পেটে পাপের পোকা জন্মাতে দেয় না। ঘটকঠাকুর বলে বেড়িয়েছে গাঁয়ে গাঁয়ে—হোমোপেথি কঠিন জিনিস! শুনেছি, এট্টুকুন দুটো গুলি বহরমপুর ঘাটে ফেলে চৌরিগাছার ঘাটে একঘটি শরবত তুলে খেয়ো, এমন ব্রহ্মতেজ! আর সামান্য স্ত্রীলোকের জঠর!’

পুনশ্চ সেই ‘দারোগার হাসি’ কর্ণসুবর্ণ পরিমণ্ডলে। আসলে সে আমলের গ্রামসমাজে ‘কেলেঙ্কারি’ নামক ব্যাপারটা ছিল সংস্কৃতির এক অবিভাজ্য ও চমৎকার অংশবিশেষ। এ না থাকলে গ্রামের মানুষ শূন্যতা অনুভব করত। পুজো—আচ্চা মেলাপার্বণ গানবাজনা পুঁথি কথকতা মালামো—গ্রামসংস্কৃতির এইসব পুরোনো স্তম্ভের সঙ্গে ‘কেলেঙ্কারি’ ছিল অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কেলেঙ্কারি নেই, তো এবার চৈত্রের গাজনে সঙ বাঁধবে কীসে? আড্ডায় মাঠেঘাটে বাটে কী নিয়ে কথা বলবে গ্রামীণ মানুষেরা? তাই কেলেঙ্কারি আবিষ্কারের তালে থাকতেই হত। তৈরি করে নিতে হত বাতাসের মৃদু গন্ধ থেকে।

এবং কদাচিৎ এই কেলেঙ্কারিকে দরদি মরমি পুঁথিকার গীতিকার অথবা কোনো লোককবি বা লোকসাহিত্যিক পুঁথিতে কাব্যে গীতিকায় তুলে ধরতেন—তাঁরা নমস্য। তা থেকে তাঁরা সামাজিক ঘৃণার অংশ ধুলোবালির মতো সাফ করে তুলে নিতেন যেন অবহেলিত পথের অমল—ধবল পবিত্র শিশুকে বুকের কাছে। সে এক গভীরতর সমাজদ্রোহ নিশ্চয়। কিন্তু আশ্চর্য, একদা সমাজ তা মেনেই নিত। কেলেঙ্কারি হত বিশুদ্ধ প্রেম—নিকষিত হেম। আর একদা তাই হয়েছিলও স্বর্ণলতা ও গোরাং ডাক্তারকে নিয়ে, জুহা মৌলবি, পাদরি সাইমন, জর্জ হ্যারিসন আর সুধাময়কে নিয়ে—হয়েছিল ইয়াকুব সাধু আর তার ছেলে ইসমাইলকে নিয়ে। এবং এই বিস্তারিত কাহিনীর কেন্দ্রে ছিল এক বাউরি ডাকাত।

পঞ্চাশ বছর পরে কর্ণসুবর্ণে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শিবিরের তরুণ অধ্যাপক এক জ্যোৎস্নারাতে টিলায় বসে শুনেছিলেন লোকগীতিকার মদন শেখের মুখে—গানের সুরে, ছড়ায়। আল্লাতালা মা সরস্বতী পীরপয়গম্বর তেত্রিশকোটি দেবতা ও দশদিক বন্দনার পর মদন শেখ শুরু করেছিল :

বাউরিকুলে জন্ম লিলে রূপেতে কন্দর্প

ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো বাপের বড় গর্ব….

সব লোককাহিনীর হালচালই এমন। মদন শেখের কল্পনা তার বাইরে যায়নি। কিন্তু যখন সে স্বর্ণলতার সঙ্গে বাউরিছেলের প্রেম লড়িয়ে দিল, তরুণ অধ্যাপক হে হো করে হেসে ফেলেছিলেন।

…ব্রাহ্মণের বিধবা তিনি নাম স্বর্ণলতা

মনে বড় অনুরোগ মুখে সরে না কথা

ধিকধিক আগুন জ্বলে জলে না নেভায়

চলে গো বাউরির ছেলে ভিন্নদ্যাশে যাই….

হাস্যকর! কিন্তু মদন শেখ হাসেনি। সে বুকে দম নিয়ে আকাশে মুখ তুলে তখন গানের জায়গায় টান দিয়েছে :

নিশিরেতে কানপাশা আর

 পরব নাকো সই লো

 (আমার) মনের মানুষ ‘জেহেলখানায়’ বাসরো পোহায়।।

তারপর কিনা বাউরির ছেলের মনে সেই টান লেগেছে, সে পাগলের মতো গরাদ ভেঙে পাঁচিল টপকে পালিয়ে স্বর্ণলতার কাছে যেতে চায়, বুকে লাগল গুলি। …

তারপর দিন যায়, রাত যায়।

তারপর এল : ‘জাতিতে খেস্তান তিনি, হার্সন নামে গোরা

সামোনে দেখেন কন্যা রূপেরো পশরা

আমি তো বিদেশি তুমি বিদেশিনী নারী

মনের কথা বলতে যেয়ে মুখের কথা বৈরী (অর্থাৎ ভাষা)

অ আ ক খ শেখাও কন্যা তোমার পাঠশালায়

তখন বলিব কথা প্রাণে যাহা চায়।।

এবার হাসেন না অধ্যাপক। দৃষ্টি তীক্ষ্নতর করে তাকান ধূ ধূ জ্যোৎস্নার মধ্যে দূরের স্টেশনে—সেই প্রাচীন বট কালো হয়ে মাথা তুলে আছে এখনও। তিনি বলতে চান—বল তো কালের সাক্ষী পিতামহী, জর্জ হ্যারিসন একটা বাঘ মারতে পাগল হয়ে উঠেছিল কেন? কে সেই বাঘ? কী সেই বাঘ—যা ওই অস্ট্রেলিয়ান গোঁয়ার মানুষটিকে বারবার ধূর্ততায় পরাজিত করছিল আর ক্ষেপিয়ে দিচ্ছিল, হন্যে করে মারছিল? ওই বাঘটার জন্যে তার চোখে ঘুম ছিল না। সারাক্ষণ সে দেখত, আলোছায়ার মধ্যে বিভ্রম, ডোরাকাটা এক হিংস্র চতুর শয়তান—নীল উজ্জ্বল দুটি চোখ—মৃদু নড়াচড়াতেই সে সাঁৎ করে হারিয়ে যায়। রাতদুপুরে সে বিছানায় লাফিয়ে উঠে বসত—বন্দুক হাতে নিত। বিড়বিড় করে গাল দিত। রাগে বেরিয়ে ঝোপ লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে বসত হঠাৎ। খানখান হয়ে যেত রাত্রির গভীরতর নৈঃশব্দ! গ্রামের ঘরে কেউ জেগে থাকলে বলে উঠত : পাগল সায়েব বাঘ মারতে বেরিয়েছে।

মদন শেখ গায় :

স্বর্ণলতা বলেন শোন সায়েবের ছেলে

আমাকে পাইবেন বনের রাজাকে মারিলে

বড় সাধের চৈতক আমার এমন আস্পর্ধা

কন্ধেতে বসাইল থাবা ব্যাঘ্র হারামজাদা

পায়ে ধরি সায়েব তোমার করিলাম প্রতিজ্ঞা

বাঘছাল পিন্ধাইলে তবে করব সাঙ্গা।। …(স্যাঙা বা দ্বিতীয় বিয়ে)

প্রতিজ্ঞা করেছিল নাকি স্বর্ণলতা? সত্যি কি তাই? রোমান্টিক অধ্যাপক তীব্রতর অনুসন্ধানে লিপ্ত হন।

….এদিকে কিনা জুহা মৌলবি দিনের পর দিন বাবামেয়ের পিছনে লেগে রয়েছে—তোমাদের জাত সমাজ বৈরী, কেন এমন একঘরে হয়ে কাটাবে? কলমা পড়ো। আমার ইসলাম সমাজ তোমাদের মাথায় করে ঘরে ঢোকাবে। যুবতীমেয়ের বিয়ে দেবে। আর তাই শুনে সুরসিকা স্বর্ণলতা মনে মনে হেসে বলেন,

শোন শোন মৌলুবি গো মোছলমানের ছেলে

আমাকে পড়াবেন কলমা বাঘেরে মারিলে…।।

তাই শুনে নির্বোধ মৌলুবি করলে কিনা এলাকার তাবৎ মুসলমানদের জড়ো করল। তাবৎপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে আঁরোয়া জঙ্গলে চড়াও হল। আর তখন বাঘটা বের হল। বাজবিজলীর ছটা আর কানফাটানো মেঘের গর্জন যেন। বাঘ যায় উত্তরে, একবার করে কালো আকাশ ঝিলিক দিয়ে যেন বাজ পড়ে। বাঘ যায় দক্ষিণে, ফের বজ্রপাত হয়। বাঘ লাফ দেয় পূর্বে, পশ্চিমে আর :

মোমিনগণ ভাগে ডরে কাতারে কাতার।

মৌলুবি ভাগেন আগে শোনেন সমাচার

কাঁটাঝোড়ে রইল লুঙ্গি জলে দিলেন ঝাঁপ

ডাঙায় বাঘ বসে ডাকে, কী হল রে বাপ

মৌলুবি চেঁচান ওরে উল্লুকের বেটা

তোকে কলমা পড়াতে এসে এত হল ল্যাঠা

বাঘ যত ডাকে, শোন ও গুণের চাচা

মৌলুবি পাড়েন গালি কাফের হারামজাদা….।।

হ্যাঁ—জুহা মৌলুবি সত্যি বাঘটা মারতে ফতোয়া দিয়েছিলেন বটে। তবে স্বর্ণলতা বা গোরাংবাবুকে কলমা পড়ানোর গূঢ় সংকল্প মনে ছিল না। তাছাড়া মৌলুবির এ ব্যাঘ্র অভিযানপর্ব অনেক পরের ঘটনা। তবে বাঘ মারতে গিয়ে মৌলবির বিলক্ষণ দুর্দশা ঘটেছিল।

মদন শেখের লোকগাথার বিবরণ আলাদা। বাস্তব কাহিনীর সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। তবু তরুণ অধ্যাপক শোনেন সেই গান, শুনতে শুনতে মনে হয়—না, ভুল করছি। লোকগাথায় যা আছে, তা যেন গভীরতর বাস্তবতা। তাই তার মধ্যে সত্য আছেই কিছু। সেই সত্য বড় সহজে ধরা দেবার নয়। লোকগাথা যখন বলে, জর্জ হ্যারিসনের বাংলা শেখার তাগিদ স্বর্ণলতাকে মনের কথা খুলে বলার উদ্দেশ্যে, তখন হয়তো সেই গভীরতর বাস্তবতাকে ছোঁয়া যায়—যা জর্জের অবচেতনায় স্ফোটকের মতো জেগে উঠেছিল!

আর চৈতককে বাঘটা ধরেছিল, এ ঘটনাও অবশ্য সত্য।

গোরাং ডাক্তারকে তিনপাহাড়ি নিয়ে গেলেন জুহা মৌলবি। সেখানে মিশনারিদের উন্মাদ আশ্রম রয়েছে। মৌলবিরও শিষ্য আছে সে এলাকায়। তার কদিন পরে এক বিকেলে বাঘে ধরল চৈতককে।

বাঘটা কেন কে জানে যেন দিনে দিনে জঘন্য কাণ্ড শুরু করেছিল। দিনদুপুরে গোরুবাছুর কুকুর বেড়াল সামনে যা পেত, থাবা হানত। লোকজনের উপস্থিতি গ্রাহ্য করত না। হয়তো তাড়া খেয়ে খেয়ে সেও খুব খেপে গিয়েছিল।

চৈতকের দুপা বেঁধে বরাবর যেমন দিঘিতে ছেড়ে দিয়ে আসত, তেমনি সেদিনও দিয়ে এসেছিল স্বর্ণলতা। পা বাঁধা না থাকলে চৈতক পালিয়ে আসতে পারত হয়তো। পারেনি। বেচারা পড়ে পড়ে মার খেল।

কাঠকুড়োনি মেয়েরা ইদানীং বাঘের ভয়ে জঙ্গলে ঢুকত না। তবে বিন্নি কি না চৌকিদারের মেয়ে। তার বাবা সরকারি লোক। সে বাঘকে ভয় করবে কেন? জঙ্গলের দিঘিতে গেছে পদ্মগাছের গোড়া তুলতে—তাকে বলে ‘মুলান।’ ভারি মিষ্টি স্বাদ সেই মূলের। ধবধবে সাদা রঙ, রসে ভরা, কুড়মুড় করে চিবিয়ে খেতে ভালো লাগে। রান্না বা সেদ্ধ করেও লোক খায়।

বিন্নি আপন মনে ‘মুলান’ তুলেছে সারা দুপুর। তারপর উঠে এসেছে। এসেই ভয় পেয়েছে। সামান্য দূরে ঘোড়াটা পড়ে আছে। আর বাঘটা তার লেজের দিকটা খাচ্ছে। বিন্নিকে তাকাতে দেখেই সে গরগর করে উঠে সরে গেছে পাড়ে ঝোপের আড়ালে। আর বিন্নি পড়ি কী মরি করে মুলানগুলো ফেলে অনেক ঘুরে ফাঁকায়—ফাঁকায় স্টেশনে এসেছে। হাঁফাতে হাঁফাতে খবর দিয়েছে স্বর্ণকে।

স্বর্ণ আবেগে অনেক সময় অনেক কিছু করে বসে বটে, এবার কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখেছিল। ধীরে সুস্থে জর্জকে গিয়ে জানায় দুঃসংবাদটা। তখন জর্জ সেজেগুজে বেরিয়ে আসে।

দুজনে গিয়ে চৈতককে আবিষ্কার করে ওই অবস্থায়। তারপর কিন্তু স্বর্ণ আর পারে না। হু হু করে কেঁদে ভেঙে পড়ে ঘোড়াটার ওপর। জর্জ বলে—’আমি বালো ঘোরা দেব তোমাকে, ডোন্ট ক্রাই।’

কতক্ষণ পরে স্বর্ণ উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে চোখ রেখে শান্তভাবে বলে—’জর্জ, আমার চৈতককে যে মেরেছে, তাকে তুমি যদি মারতে পারো….’

হঠাৎ তাকে থামতে দেখে জর্জ একটু হাসে। ….’তো? বোলো?’

স্বর্ণর চোয়াল আঁটো হয়। তার নাকের ফুটো কাঁপে। ঠোঁটদুটোয় ভাঁজ পড়ে।

জর্জ ফের বলে—’বোলো? বখশিস দেবে?’

স্বর্ণ হিসহিস করে বলে—’দেব। যা চাইবে, তাই দেব’

—’প্রমিজ?’

—’প্রমিজ।’

হা হা করে হাসে অস্ট্রেলিয়ান স্টেশনমাস্টার। আর কাছাকাছি কোথাও গরগর করে গর্জে ওঠে বাঘটা, খাওয়ায় বাধা পড়ছে বলে ক্রুদ্ধ সে। জর্জ একটু পরে গম্ভীর হয়ে বলে—’চলো তোমাকে রেখে আসি। তারপর মাচান বাঁধতে হোবে। আই থিংক, ইট ইজ দা গ্রেটেস্ট চান্স নাও! মিস করলে আমি নিজের বুকে ঘোলি মারব।’

স্বর্ণ যেতে যেতে একবার তার দিকে তাকিয়ে নেয়। কিন্তু কিছু বলে না।

স্টেশনের কাছে এসে জর্জ একটু হেসে ডাকে—’মিস রয়!’

‘উঁ?’

‘—তুমি প্রমিজ করেছ, যা চাইবে।’

‘হঁ, করেছি তো।’

‘—তো বোলো, আমি কী চাইতে পারব তোমার কাছে! হোয়াট ইউ এক্সপেক্ট? বোলো মিস রয়?’

‘—আমি কি কিছু দিতে পারিনে, ভাবছ?’

‘—না, নো। আই নেভার স্যে দ্যাট। বাট হোয়াট? আমি কী চাইবে তোমার নিকট, বোলো। তুমি বলে দাও।’

‘—বা রে! সে তোমার খুশি। দ্যাটস আপ টু ইউ—ইওর চয়েস।’

‘—ইফ আই ওয়ান্ট ইউ?’

‘—পাবে।’

জর্জ খেপে যায় সঙ্গে সঙ্গে।—’ডাম ইট! আমি বুঝেসে। সব বুঝেসে।’

‘—কী বুঝেছ তুমি?’

‘—তুমি জানো আমি বাঘ মারতে পারব না। দা স্যাটান লেট লুজ! আমি হেরে যাব, সো ইউ থিংক! দেয়ারফোর ইউ প্রমিজ দ্যট! ইয়েস, আই নো। চরণ চৌকিদার বলছিল, দা টাইগার ইজ এ হিন্দু গড। কেউ তাকে মারতে পারবে না। ইউ প্রমিজড অন দা বেস অফ দ্যাট ফেইথ।’

‘—না।’

‘—ইউ আর জাস্ট প্লেয়িং মিস রয়।’

‘—না।’

জর্জ কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ হন হন করে চলে যায় জঙ্গলের দিকে। তার কাঁধে একটা মস্তো দড়ির বান্ডিল ঝুলতে ঝুলতে যায়। সন্ধ্যার আবছায়ায় তাকে দেখে মনে হয়, সারা গায়ে লোভী ব্যগ্র মূল বাড়িয়ে একটা কী বিদেশি অচেনা পরগাছা ঘুরছে উপযুক্ত মাটির সন্ধানে।….

ঘরে ঢুকে আর বাগ মানাতে পারে না স্বর্ণ। দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদে ফের। চৈতকের শোকে তার বুক ফেটে যায়। এই নিঃসঙ্গ জীবনে তবু তো একজন সঙ্গে ছিল, যার সঙ্গে ছিল, যার সঙ্গে নির্জনে কথা বলেছে, সুখদুঃখের কথা। কত নির্জন মাঠ ও পথ মন ভরে গেছে ওই চতুষ্পদ প্রাণীটির সঙ্গে আলাপে। জ্যোৎস্নার রাতে হঠাৎ অস্পষ্ট শব্দে ঘুম ভেঙে বেরিয়ে দেখেছে। কীভাবে আটচালা থেকে বেরিয়ে পড়েছে চৈতক, উঠোনে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হয়েছে, দুঃখের দিনরাতের এক পক্ষীরাজ। এখন জ্যোৎস্নায় তার পিঠে চেপে বসলেই গজিয়ে উঠবে দুটো চমৎকার ডানা। উড়িয়ে নিয়ে যাবে কোথাও—যেখানে পৃথিবীটা অন্যরকম।

ধুলোবাড়ির মাঠের বুকে চৈত্রের সন্ধ্যায় ঘোড়া ছুটিয়ে আসায় স্মৃতি স্বর্ণকে যত বিহ্বল করল, স্বর্ণ কচি মেয়ের মতো কাঁদল তত। সে—রাতে রান্নাও চাপাল না। খেল না। অনেক রাতে বাবার ঠিকানায় চিঠি লিখতে বসল। জুহা মৌলবির চিঠি এসেছে। ভর্তি হয়েছেন বাবা, চমৎকার বন্দোবস্ত হচ্ছে। মৌলবির ফিরতে দেরি হবে। স্বর্ণমা যেন শিগগির এসে দেখা করে যায়। স্বর্ণ চোখের জলে লিখল: বাবা, বড় দুঃসংবাদ দিচ্ছি। আমাদের প্রাণের চৈতক আজ….

চিঠি লিখে স্বর্ণ শুল কিন্তু ঘুম এল না। এই বুঝি জর্জ মরা বাঘটা টানতে টানতে ফিরে এসে ডাকবে জানলায়। এই বুঝি তার রাইফেলের আওয়াজ শোনা যাবে। সে কান পেতে রইল। বাইরে আজ হু—হু হাওয়া দিচ্ছে। শনশন করছে গাছপালা। তালগাছের বাগড়া দুলছে খড় খড় সর সর। শিস দিয়ে চলে গেল রেলগাড়ি। কিছুক্ষণ বিকট অস্থির শব্দপুঞ্জ। তারপর ফের হাওয়ার শনশন, তালপাতার খড়খড় ধারাবাহিক।

জর্জ তাকে কী চাইতে পারে?

একথা যত ভাবল, শিউরে উঠল সে। ক্রমশ একটা অপরিচিত অস্বস্তি জেগে উঠল তার মধ্যে। শরীর ভারী লাগল। ঠোঁট কামড়ে ধরল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, না—না—না! তারপর চিত হয়ে শুয়ে চোখ বুজল। মনে মনে প্রার্থনা করল, বাঘটা যেন না মরে—সে দেবতার বাহন হয়ে যেন বেঁচে থাকে।

একটা আত্মপ্রকাশের লজ্জা থেকে আত্মরক্ষার জন্যে অনেককাল পরে স্বর্ণ ঈশ্বরকে ডাকতে থাকল। মাথা কুটতে লাগল মনে মনে। এ আমার মনের পাপ। আমাকে তুমি বাঁচাও, ঠাকুর!

কখন আবছা যেন গুলির শব্দই কানে এল। লাফিয়ে বিছানায় বসল সে। লন্ঠনের দম বাড়িয়ে দিল। কানের ভুল? আরে কোনো শব্দ শোনা গেল না।

একটু পরে একটা মালগাড়ির আওয়াজ এল। অনেকটা সময় লাগল সেটা পেরিয়ে যেতে। স্বর্ণ ফের শুয়ে পড়ল। এবার চোখ ভরে ঘুম এসে গেল তার। কিছুতেই জেগে থাকতে পারল না। ….

না, বাঘ মারা পড়েনি।

সে এত ধূর্ত, এত ক্ষিপ্রগতি, গাছের ডালে দড়ির মাচায় বলে জর্জের পা ফুলে ঢোল হয়েছে, কিন্তু তার অস্তিত্বও টের পায়নি—অথচ ঘোড়াটার অনেক মাংস খেয়ে গেছে। জর্জকে পরে স্বর্ণ বলেছিল, ‘তোমার মন বাঘে ছিল না—তাই।’

তাও হতে পারে। অন্ধকারে জর্জ স্বর্ণকে দেখেই রাত কাটিয়েছে হয়তো। তার কথাই ভেবেছে। ভেবে তোলপাড় হয়েছে, কী চাইবে সে স্বর্ণকে, কী চাওয়া উচিত, এবং স্বর্ণ—ই বা কী দিতে পারে, কী আছে স্বর্ণর…এইসব গুরুতর চিন্তা।

এদিকে লোককবি মদনচাঁদ শেখ বলছে অন্যকথা :

স্বর্ণলতা গেছে গহন জঙ্গলে। বাঘের কাছে মিনতি করে বলেছে, হে দেবতার বাহন, আমাকে লজ্জা থেকে বাঁচাও।

কন্যা বলেন, শোন বাঘা, আমার মাথার কিরে

এ দ্যাশ ছাড়িয়া তুমি যাও দ্যাশান্তরে

তোমার গেলে জান বাছা আমার যাবে মান

সে বড় পাপিষ্ঠ গোরা জেতে কেরেস্তান

কুক্ষণেতে ওরে বাঘা, করছিলাম পিতিজ্ঞা।

বামুনের বিধবা হয়ে ক্যামনে করি স্যাঙ্গা!…

অধ্যাপক আবার হো হো করে হেসে উঠেন। বুড়ো লোককবি বলে, ‘এবার সিগারেট দিন। গলার রসকষ শুকিয়ে গেল। এরপর ধরব এয়াকুব সাধুর পালা। হেরুর ছেলের কী হল তাও বলব। আর বলব পাদরিবাবার সঙ্গে জুহা মৌলবির জব্বর লড়াই।’…