১৭. একটি কালো টেবিলের সামনে

একটি কালো টেবিলের সামনে বসে আছে একজন বয়স্ক মানুষ। মানুষটির হাতে পাঁচটি উজ্জ্বল লাল তারা। রিশান এত উচ্চপদস্থ মানুষকে আগে কখনো সামনাসামনি দেখেছে কি না মনে করতে পারল না। মানুষটির দুপাশে বসেছে আরো দুজন, একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। তাদের হাতে চারটি করে লাল তারা। বয়স্ক মানুষটির মুখে কেমন জানি এক ধরনের যন্ত্রণার চিহ্ন, অন্য দুজন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। হাতে লাল তারাগুলো না থাকলে এই মানুষগুলোকে নিশ্চিতভাবে রবোট হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত।

রিশান টেবিলের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বয়স্ক মানুষটির মুখে যন্ত্রণার চিহ্নটি হঠাৎ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সে খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বস রিশান।

রিশান শক্ত লোহার চেয়ারটিতে সোজা হয়ে বসল। বৃদ্ধ মানুষটি এক ধরনের দুঃখী গলায় বলল, আমার নাম কিহি। আমি মহাকাশ কাউন্সিলের সভাপতি।

রিশান ভদ্রভাবে বলল, তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে আনন্দিত হলাম।

বৃদ্ধ মানুষটি খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে এখানে ডেকে আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আমার খুব কৌতূহল হয়েছে তোমাকে নিজের চোখে দেখার।

কথাটি প্রশংসাও হতে পারে এক ধরনের শ্লেষও হতে পারে তাই রিশান কোনো কথা বলে চুপ করে রইল। কিহি আবার একটি বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি জান তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

রিশান মাথা নাড়ল, জানি মহামান্য কিহি।

তুমি জান তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে খুব শিগগিরই।

জানি

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে তোমার কিছু চাইবার আছে?

রিশান মাথা নাড়ল, না নেই। তবে—

তবে কী?

রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, মহাকাশ অভিযান নয় নয় শূন্য তিনে আমরা সানি নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে উদ্ধার করে এনেছিলাম। যদি তার সাথে একবার কথা বলা যেত তবে চমৎকার হত।

কিহি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মনে হয় আমি তার ব্যবস্থা করতে পারব।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

কিহি আবার চুপ করে বসে রইল, তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, রিশান, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?

কর

আমি তোমার সমস্ত রিপোর্টটি দেখেছি, তুমি কী বলবে আমি জানি। তবু আমি তোমার নিজের মুখ থেকে শুনতে চাই।

ঠিক আছে।

তুমি কেন গ্রুনি কলোনিকে ধ্বংস করতে দিলে না?

তারা বুদ্ধিমান প্রাণী। বুদ্ধিমান প্রাণীকে ধ্বংস করা যায় না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমাদের যেটুকু অধিকার তাদের ঠিক সমান অধিকার

তুমি জান এরা মানুষের মস্তিষ্কের অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করে।

জানি।

তুমি জান এরা শুধু মানুষের মস্তিষ্কের প্রতিরূপ নয় এরা একে অন্যের সাথে জুড়ে থাকে?

জানি।

যার অর্থ তারা একজন মানুষের মস্তিষ্ক নয়, তারা একসাথে অসংখ্য মানুষের মস্তিষ্ক?

জানি।

যার অর্থ তারা মানুষ থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হবার ক্ষমতা রাখে।

জানি

যার অর্থ তারা ইচ্ছে করলে মানুষকে পরাভূত করতে পারে? যার অর্থ তারা মানুষকে ধ্বংস করে মানুষের পৃথিবী দখল করে নিতে পারে?

রিশান মাথা তুলে স্থির দৃষ্টিতে কিহির দিকে তাকাল, তারপর বলল, অভিযান নয় নয় শূন্য তিনে পৃথিবীর মানুষ ইচ্ছে করলে রুনিকে ধ্বংস করে দিতে পারত। তারা কি ধ্বংস করেছে?

কিহি কোনো কথা বলল না, তারপর নিচু গলায় বলল, তোমার কি মনে হয় গ্রুনিদের মাঝে তোমার মতো মানুষ থাকবে?

নিশ্চয় থাকবে।

যদি না থাকে? যদি শুধু আমার মতো মানুষ থাকে?

তাহলে পৃথিবীর মানুষ তাদের থেকে বুদ্ধিমান একটি প্রাণীর কাছে পরাজিত হবে। পৃথিবীর মানুষ তিন মিলিয়ন বছর বুদ্ধিমত্তায় সবার ওপরে থেকে সমস্ত প্রাণীদের ওপর প্রভুত্ব করেছে। এখন সে বুদ্ধিমত্তায় নিচের সারিতে গিয়ে তাদের নির্ধারিত স্থান নেবে। ধরে নিতে হবে সেটাই প্রকৃতির নিয়ম।

কিহি কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে তার দুই পাশে বসে থাকা দুজনের দিকে তাকাল, তাদের মুখে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হল না। রিশান মুখে একটা হাসির ভঙ্গি করে বলল, প্রায় এক আলোকবর্ষ দূরের একটা গ্রহ থেকে যদি সেই প্রাণী পৃথিবীতে হানা দিতে পারে তাদের সম্ভবত পৃথিবীতে খানিকটা স্থান করে দেয়াই উচিত।

কিহি শক্ত গলায় বলল, তাদের এক আলোকবর্ষ দূর থেকে আসতে হবে না, তারা সম্ভবত তোমাদের মহাকাশযানে করে তোমাদের সাথেই এসেছে।

গ্রুনি যেন আসতে না পারে সেজন্যে আমাদের দীর্ঘ কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে মহামান্য কিহি। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানবিজ্ঞান–প্রযুক্তি তার পিছনে ব্যয় করা হয়েছে।

হ্যাঁ। কিহি মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানবিজ্ঞান–প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেই জ্ঞানবিজ্ঞান–প্রযুক্তি গড়ে তোলা হয়েছে বুদ্ধিহীন নিম্নস্তরের প্রাণী থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে রক্ষা করার জন্যে নয়।

কিহির পাশে বসে থাকা মহিলাটি নিচু গলায় বলল, আমি বলেছিলাম এই মহাকাশযানটিকে সৌরজগতের বাইরে বিস্ফোরণ করে উড়িয়ে দিতে। আমি এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হত।

কিহি মাথা ঘুরে মহিলাটির দিকে তাকাল তারপর ঘুরে রিশানের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, রিশান, তুমি এখন যেতে পার।

রিশান উঠে দাঁড়াল, প্রায় সাথে সাথেই দুপাশ থেকে দুটি নিচু স্তরের রবোট তার দিকে এগিয়ে এল। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষকে কখনো একা একা যেতে দেয়া হয় না। বিশেষ করে রিশানের মতো একজন মানুষকে।

কিহি তার নরম চেয়ারটি থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, বাইরে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এসেছে, দিনের এই সময়টিতে কেন জানি অকারণে মন বিন্ন হয়ে যায়। কিহি বিষণ্ণভাবে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

.

আজকে রিশান নামের মানুষটির মৃত্যুদণ্ডাদেশ পালন করার কথা। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর একজন মানুষের যেটুকু বিচলিত হবার কথা এই মানুষটি মনে হয় ততটুকু বিচলিত নয়। আজ ভোরে সানি নামের বাচ্চা ছেলেটি এসেছিল রিশানের কাছে, দুজনকে দেখে কে বলবে এটি তার জীবনের শেষ কয়টি মুহূর্ত! তার কথা বলার উৎফুল্ল ভঙ্গি, উচ্চৈঃস্বরের হাসি আর আনন্দোজ্জল চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল খুব বুঝি একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। সানি নামের ছেলেটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন ঘুরে এসে হঠাৎ রিশানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না, এক রকম জোর করে তাকে সরিয়ে নিতে হল–তখন হঠাৎ মনে হচ্ছিল মানুষটি বুঝি ভেঙে পড়বে, কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে নি। কিছু কিছু মানুষ ইস্পাতের মতো শক্ত নার্ভ নিয়ে জন্মায়।

কিহি হেঁটে হেঁটে নিজের চেয়ারের কাছে ফিরে এল, কিছুক্ষণ থেকে মাথাটি কেমন জানি ভার ভার লাগছে। ভোতা এক ধরনের ব্যথার অনুভূতি, বিশেষ করে বাম পাশে কেমন জানি চিনচিনে এক ধরনের তীক্ষ্ণ ব্যথা।

কিহি মাথা স্পর্শ করার জন্যে ডান হাতটা উপরে তুলতে গিয়ে থেমে গেল, হাতটি কেমন জানি অবশ অবশ লাগছে, মনে হচ্ছে কোনো অনুভূতি নেই।

কিহি অন্যমনস্কভাবে বাইরে তাকাল, কোথায় জানি এ রকম একটা উপসর্গের কথা শুনেছে কিন্তু সে ঠিক মনে করতে পারল না।