১৭৯তম অধ্যায়
সংসারের অনিত্যতাবোধে বৈরাগ্যোদয়—আজগরহাদসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মনুষ্য কিরূপ চরিত্র আশ্রয় করিলে শোকশূন্য হইয়া পৃথিবীতে পর্য্যটন করে এবং কিরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিলেই বা উৎকৃষ্ট গতিলাভে সমর্থ হয়?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই স্থলে আজগর-প্রহ্লাদ-সংবাদ নামে এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, শ্রবণ কর। একদা দানবরাজ প্রহ্লাদ এক ব্রাহ্মণকে স্থিরচিত্তে পরিভ্রমণ করিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ব্ৰহ্মন্! আপনি বিষয়বাসনাশূন্য, নিরহঙ্কার, পরমদয়ালু, জিতেন্দ্রিয়, নিরুদ্যোগী [সর্ব্বপ্রকার চেষ্টাহীন], অসূয়াবিহীন, সত্যপরায়ণ, প্রতিভাসম্পন্ন, মেধাবী ও প্রাজ্ঞ হইয়া বালকের ন্যায় সঞ্চরণ করিতেছেন। আপনার বিষয়লাভের প্রার্থনা নাই, ক্ষতি হইলেও আপনি কিছুমাত্র সন্তপ্ত হন না এবং কোন বস্তুতে অনাদরও করেন না। প্রজাসকল বিষয়স্রোতে প্রবাহিত হইতেছে, কিন্তু আপনি বিমনস্ক [বিমনা—অভিনিবেশশূন্য] হইয়া নিত্যপরিতৃপ্তের ন্যায় ধর্ম্মার্থকামেও ঔদাসীন্য প্রকাশ করিতেছেন। ঐ ত্রিবর্গসাধনে আপনার কিছুমাত্র অধ্যবসায় নাই। আপনি রূপ, রস প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমুদয়ে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক সাক্ষীর ন্যায় সঞ্চরণ করিতেছেন। অতএব যদি কোন বাধা না থাকে, তবে আপনার প্রজ্ঞা, শাস্ত্রজ্ঞান ও ব্যবহার কিরূপ, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’
“তখন সেই লোকধৰ্ম্মবিধানজ্ঞ ব্রাহ্মণ প্রহ্লাদকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে মধুরবাক্যে কহিলেন, ‘দানবরাজ! সেই অনাদি পরব্রহ্ম হইতেই এই ভূতসমুদয়ের উৎপত্তি, হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিনাশ হইতেছে, এই কারণে আমি হৃষ্ট বা ব্যথিত হই না। প্রবৃত্তিসমুদয় স্বভাব হইতেই প্রবর্ত্তিত হইতেছে; স্বভাব ব্যতিরেকে প্ৰজাসকলের অন্য আশ্রয় নাই; এই নিমিত্ত আমি ব্রহ্মলোকের ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিলেও পরিতুষ্ট হই না। সংযোগসকল বিয়োগের বশীভূত এবং সঞ্চয়সমুদয় বিনাশের অধীন; এই নিমিত্ত আমি কোন বস্তুলাভেই মনোনিবেশ করি না। গুণযুক্ত, ভূতসমুদয় যাহা হইতে উৎপন্ন হয়, তাহাতেই লয় প্রাপ্ত হইয়া থাকে, ইহা বুঝিতে পারিলে মনুষ্য কোন কার্য্যেই লিপ্ত হয় না। সাগরগর্ভে কি মহৎ ও কি সূক্ষ্ম সকল জন্তুরই পৰ্য্যায়ক্রমে বিনাশ হইয়া থাকে; পৃথিবীস্থ স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূতসমুদয় বিনাশের বশীভূত এবং অন্তরীক্ষচর, দুর্ব্বল ও বলবান্ পক্ষিগণও মৃত্যুর আয়ত্ত। নভোমণ্ডলচারী ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জ্যোতিঃপদার্থসমুদয় কালক্রমে নিপতিত হইয়া থাকে। আমি এইরূপে সকল ভূত মৃত্যুর বশীভূত হইতেছে দেখিয়া সকলের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হইয়া পরমসুখে নিদ্রিত হইয়া থাকি। আমি যদৃচ্ছাক্রমে লব্ধ হইলে প্রভূত ভোজও ভোজন করি এবং কিছুমাত্র আহার না করিয়াও বহু দিন অতিক্রম করিয়া থাকি। লোকে আমাকে কখন সুস্বাদু প্রচুর ভোজ্য, কখন বা, অল্পমাত্ৰ অন্ন ভোজন করাইয়া থাকে; কখন কখন আমাকে অনাহারেও কালযাপন করিতে হয়। আমি কখন তণ্ডুলকণা, কখন তিলক, কখন বা পলান্ন ভোজন করিয়া থাকি। কোন সময়ে প্রাসাদোপরি পর্য্যঙ্কে, কখন বা ভূতলে শয়ন করি; কোন দিবস চীর, কখন ক্ষৌম, কখন অজিন এবং কখন বা মহামূল্য সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করিয়া থাকি। আমি কখনই যদৃচ্ছালব্ধ ধৰ্ম্মানুগত উপভোগে অনাস্থা প্রদর্শন করি না এবং যাহা দুর্ল্লভ, তাহা লাভ করিতেও আমার অভিরুচি হয় না।
কামনাত্যাগে আসক্তিত্যাগ
‘হে দানবরাজ! আমি পবিত্রভাবে এইরূপ অবিনশ্বর মঙ্গলজনক শোকাপনোদক আজগরব্রত [আহারে নিশ্চেষ্টতারূপ অজগরের জীবিকার্জ্জন নিয়ম] অনুষ্ঠান করিয়া থাকি। মূঢ় ব্যক্তিরা কদাচ এই ব্রত অবলম্বন করিতে পারে না। ইহা, ব্রহ্মলাভের অতি উৎকৃষ্ট উপায়। আমার বুদ্ধি এই ব্রত হইতে কদাচ বিচলিত হয় না। আমি স্বধৰ্ম্মপরিভ্রষ্ট নহি। আমার জীবিকা অতি পরিমিত। আমি পূৰ্ব্বাপর সমস্তই অবগত আছি এবং ভয়, ক্রোধ, লোভ ও মোহে কদাচ অভিভূত হই না। আমি যে ব্রত ধারণ করিয়াছি, ইহাতে পানভোজনের নিয়ম নাই। এই ব্রতপরায়ণ হইয়া আমি বিলক্ষণ সুখসম্ভোগ করিতেছি। দুরাত্মারা কখন ঐ সুখ আস্বাদন করিতে সমর্থ হয় না। মূঢ় ব্যক্তিরা তৃষ্ণাপ্রভাবে অভিভূত হইয়া অর্থান্বেষণে প্রবৃত্ত হয়, কিন্তু অর্থ অধিকৃত না হইলে যারপরনাই বিষন্ন হইয়া থাকে। আমি তত্ত্ববুদ্ধিদ্বারা ইহা সবিশেষ পর্য্যালোচনা করিয়া ব্রত অবলম্বন। করিয়াছি। দীন ব্যক্তি অর্থাগমের নিমিত্ত আৰ্য্য ও অনাৰ্য্য উভয়বিধ ব্যক্তিরই আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকে, ইহা দর্শন করিয়াই আমি শান্তিনিষ্ঠ ও ব্রহ্মপরায়ণ হইয়াছি। সুখ, অসুখ, লাভ, অলাভ, অনুরাগ, বিরাগ এবং মৃত্যু ও জীবনসমুদয়ই বিধিনির্দ্দিষ্ট; ইহা আমার বিলক্ষণ বোধগম্য হইয়াছে।
‘এক্ষণে আমি ভয়, অনুরাগ, মোহ ও অহঙ্কার পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রশান্তভাব অবলম্বন করিয়া অজগর সর্পের ন্যায় সমীপে সমুপস্থিত ফলভোগে প্রবৃত্ত হইয়াছি। আমি সততই ধৈৰ্য্যসম্পন্ন ও সন্তুষ্টচিত্ত হইয়া পদার্থের আলোচনা ও পদার্থ নির্ণয় করিয়া থাকি! শয়নভোজনাদি বিষয়ে আমার কিছুমাত্র নিয়ম নাই। আমি স্বভাবতঃ ইন্দ্রিয়নিগ্রহশীল, ব্রতনিয়মপরায়ণ, শুচি ও সত্যবাদী। কাৰ্য্যফলসঞ্চয় করিতে আমার কিছুমাত্র প্রবৃত্তি নাই। বিষয়বাসনা আমার চিত্তকে পরিণামে দুঃখ প্রদান করিবার নিমিত্ত আকর্ষণ করিতেছিল, আমি তাহার সেই দুঃখ দূরীকৃত করিবার নিমিত্ত তাহাকে সুসংযত করিতে অভিলাষী হইয়াছি এবং বাক্য, মন ও বুদ্ধির অসাধারণ ধৰ্ম্ম কামাদির উপেক্ষা না করিয়া ঐ সমুদয় হইতে যে সুখ উৎপন্ন হয়, তাহা দুর্ল্লভ ও অনিত্য বলিয়া অবধারণপূর্ব্বক এই আজগরব্রত অবলম্বন করিয়াছি। কবিগণ এই ব্রত লক্ষ্য করিয়া আপনার ও অন্যের মত লইয়া বুদ্ধিপ্রভাবে নানাপ্রকার তর্কবিতর্ক করিয়াছেন। মূর্খ মনুষ্যেরা এই বিষয়ে নানাপ্রকার দোষারোপ করিয়া থাকে, কিন্তু আমি তাহাদের সেই বাক্যে অনাদর করিয়া শাস্ত্রযুক্তি অনুসারে বিষয় বাসনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জনসমাজে এইরূপে পরিভ্রমণ করিতেছি।
“হে যুধিষ্ঠির! যে ব্যক্তি আসক্তিশূন্য এবং ভয়, লোভ, মোহ ও ক্রোধবর্জ্জিত হইয়া এই আজগরচরিত ব্ৰত অবলম্বন করে, সে নিশ্চয়ই সুখভোগে সমর্থ হয়।”