১৭৯তম অধ্যায়
ঘটোৎকচকর্ত্তৃক অলায়ুধবধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাত্মা বাসুদেব ভীমসেনকে রাক্ষসগ্রস্ত নিরীক্ষণ করিয়া ঘটোৎকচকে কহিলেন, ‘হে মহাবাহো! ঐ দেখ, রাক্ষসে অলায়ুধ, তোমার এবং সমস্ত সৈন্যগণের সমক্ষে বৃকোদরকে পরাভব করিতেছে; অতএব তুমি সত্বর কর্ণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক অলায়ুধের নিকট গমনপূর্ব্বক অগ্রে তাহাকে বিনাশ কর; পরে সূতপুত্রের বধসাধন করিবে।’
“তখন মহাবীর ঘটোৎকচ বাসুদেবের বাক্যানুসারে কর্ণকে পরিত্যাগ করিয়া বকভ্রাতা রাক্ষসে অলায়ুধের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। অনন্তর দুই রাক্ষসের তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল। বিকটদর্শন অলায়ুধের যোধগণ শরাসনগ্রহণপূর্ব্বক মহাবেগে ধাবমান হইল। গৃহীতাস্ত্র মহারথ সাত্যকি, নকুল ও সহদেব তদ্দর্শনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া নিশিতশরনিকরে তাহাদিগের কলেবর বিদীর্ণ করিতে লাগিলেন। এদিকে মহাবীর অর্জ্জুনও ক্ষত্রিয়পুঙ্গবদিগকে শরনিকরে নিরাকৃত করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীপ্রমুখ পাঞ্চালবংশীয় মহারথগণ সূতপুত্ৰকর্ত্তৃক বিদ্ৰাবিত হইলে ভীমপরাক্রম ভীমসেন শরবর্ষণ করিয়া দ্রুতবেগে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর নকুল, সহদেব এবং মহারথ সাত্যকি রাক্ষসদিগকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক প্রত্যাগত হইয়া কর্ণের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন; পাঞ্চালগণও দ্রোণের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন।
“হে মহারাজ! এদিকে রাক্ষসেন্দ্র অলায়ুধ অরাতিনিপাতন ঘটোৎকচের মস্তকে এক বৃহদাকার পরিঘ নিক্ষেপ করিল। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমতনয় সেই পরিঘের আঘাতে মূর্হিত হইয়া ক্ষণকাল নিস্তব্ধভাবে রহিলেন এবং অনতিবিলম্বেই অলায়ুধের রথ লক্ষ্য করিয়া একশত ঘণ্টাসমলঙ্কৃত, দীপ্তাগ্নিসদৃশ, কাঞ্চনমণ্ডিত গদা নিক্ষেপ করিলেন। সেই গদার আঘাতে অলায়ুধের অশ্ব, সারথি ও মহাস্বনরথ চূর্ণ হইয়া গেল। তখন রাক্ষসেন্দ্র অলায়ুধ সেই অশ্ব, চক্র ও অক্ষবিহীন, বিশীর্ণধ্বজ, ভগ্নকূবর রথ হইতে উর্ধ্বে উত্থিত হইয়া রাক্ষসীমায়া অবলম্বনপূর্ব্বক রুধির বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় নভোমণ্ডল বিদ্যুদ্দামরঞ্জিত নিবিড় জলধরপটলে সমাচ্ছন্ন হইল এবং অনবরত বজ্রনিপাতনির্ঘোষ ও ভীষণ চটাচট শব্দ হইতে লাগিল। মহাবীর হিড়িম্বাতনয় সেই অলায়ুধবিহিত মায়া অবলোকনপূর্ব্বক ঊর্ধ্বে সমুত্থিত হইয়া স্বীয় মায়াপ্রভাবে তাহার মায়া ধ্বংস করিলেন। মায়াবী মহাবীর অলায়ুধ স্বীয় মায়া প্রতিহত নিরীক্ষণ করিয়া ঘটোৎকচের উপর ঘোরতর প্রস্তরবৃষ্টি করিতে লাগিল। ভীমপরাক্রম ভীমতনয় শরনিকরে সেই ভয়ানক প্রস্তর বৃষ্টি নিরাকৃত করলেন, তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। অনন্তর সেই বীরদ্বয় পরস্পরের উপর লৌহময় পরিঘ, শূল, গদা, মুষল, মুদগর, পিনাক, করবাল, তোমর, প্রাস, কম্পন, নারাচ, নিশিত ভল্ল, শর, চক্র, পরশু, ভিন্দিপাল, গজসন্নাহ, গোশীর্ষ, উলুখল এবং মহাশাখাসমাকীর্ণ পুষ্পিত শমী, তাল, করীর [বাঁশের অঙ্কুর—অগ্রভাগ ছুঁচের মত বাঁশের ছাতা], চম্পক ইক্ষুদী, বদরী, রক্তকাঞ্চন, অরিমেদ [খদিরবৃক্ষ-খয়ের গাছ], বট, অশ্বথ ও পিপ্পল প্রভৃতি বিবিধ বৃক্ষ ও গৈরিকাদি ধাতুসমাযুক্ত নানাবিধ পর্ব্বতশৃঙ্গসকল নিক্ষেপ করিতে লাগিল। ঐ সকল অস্ত্রশস্ত্রের সংঘর্ষণে বজ্রনিষ্পেষণের ন্যায় মহাশব্দ সমুত্থিত হইল। হে মহারাজ! পূর্ব্বকালে কপিরাজ বালী ও সুগ্রীবের যেরূপ সংগ্রাম হইয়াছিল, এক্ষণে মহাবীর ঘটোৎকচ ও অলায়ুধের তদ্রূপ ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। তখন সেই বীরদ্বয় করে তরবারি গ্রহণপূর্ব্বক পরস্পরের উপর নিক্ষেপ করিয়া পরিশেষে মহাবেগে ধাবমান হইয়া পরস্পরের কেশ গ্রহণ করিল। তখন তাহাদের গাত্র হইতে জলন্ধরের ন্যায় স্বেদজল ও রুধিরধারা বিগলিত হইতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর হিড়িম্বাতনয় বলপূর্ব্বক অলায়ুধকে উদ্ভ্রামিত করিয়া তাহার কুণ্ডলবিভূষিত মস্তক ছেদনপূর্ব্বক ঘোরতর সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ সেই বকবন্ধু অলায়ুধকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ভীষণ সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবপক্ষে সহস্র সহস্র ভেরী ও অযুত শঙ্খ বাদিত হইল। হে মহারাজ! দীপমালাবিভূষিত রজনী পাণ্ডবগণের অতীব বিজয়াবহ হইয়া উঠিল। অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত ভীমতনয় অলায়ুধের মস্তক লইয়া দুর্য্যোধনসমীপে নিক্ষেপ করিলেন। রাজা দুর্য্যোধন রাক্ষসেকে নিহত অবলোকন করিয়া সৈন্যগণের সহিত সাতিশয় বিমনায়মান হইলেন। মহাবীর অলায়ুধ পূর্ব্ববৈর স্মরণপূর্ব্বক দুর্য্যোধনের সমীপে আগমন করিয়া ভীমসেনকে সংহার করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল; দুর্য্যোধনও তাহার প্রতিজ্ঞাশ্রবণে ভীমকে অলায়ুধের হস্তে নিহত ও ভ্রাতৃগণকে দীর্ঘজীবী বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে অলায়ুধকে ঘটোৎকচের হস্তে নিহত দেখিয়া ভীমসেনের দুঃশাসনপ্রমুখ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের সংহাররূপ প্রতিজ্ঞা সফল হইবে বলিয়া স্থির করিলেন।”