১৭৮তম অধ্যায়
অম্বাগ্রহণে ভীষ্মের প্রতি পরশুরামের উপদেশ
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে রাজন! মহাব্ৰত জমদগ্ন্য তৃতীয় দিবসে রাজধানীতে আগমন করিয়া আমার নিকট আমার “প্রিয়ানুষ্ঠান কর”—এই আদেশের সহিত আগমনসংবাদ প্রেরণ করিলে আমি উহা শ্রবণমাত্র অতিমাত্ৰ প্রীত হইয়া ব্ৰাহ্মণ, দেবতুল্য ঋত্বিক [হোতা আদি বহু ব্যক্তি-সাধ্য যজ্ঞের যাজনকারী পুরোহিতগণের মধ্যে প্রধান যাজক], ও পুরোহিতগণের সহিত এক ধেনু পুরষ্কৃত [একটি গাভী অগ্ৰে চালিত] করিয়া অনতিবিলম্বে অতিতেজস্বী ভগবান জমদগ্ন্যের নিকট গমন করিলাম। তিনি আমাকে উপস্থিত দেখিয়া মদ্দত্ত [আমার প্রদত্ত] পূজা গ্রহণপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভীষ্ম! কাশিরাজনন্দিনী অম্বা তোমার প্রতি অনুরাগিণী ছিল না, তুমি কি বিবেচনায় ইহাকে হরণ করিয়া পুনরায় বিসর্জ্জন করিয়াছ? অম্বা তোমা হইতেই ধর্ম্মপরিভ্রষ্টা [নারী-ধৰ্মচ্যুত] হইয়াছে। বিশেষতঃ তুমি বলপূর্ব্বক ইহাকে গ্রহণ করিয়াছিলে, সুতরাং এক্ষণে আর কে ইহার পাণিগ্রহণ করিবে? তুমি হরণ করিয়াছিলে বলিয়া শাল্বরাজ ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। অতএব তুমি আমার নিয়োগানুসারে ইহাকে গ্ৰহণ কর, তাহা হইলে এই রাজকন্যা আপনার ধর্ম্মলাভ করিতে সমর্থ হইবে। হে ভীষ্ম! ইহাকে এইরূপ অবমাননা করা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে না।”
“অনন্তর আমি তাঁহাকে নিতান্ত বিমনায়মান [চঞ্চলচিত্ত] দেখিয়া কহিলাম, ভগবন! আমি এই কন্যাকে কদাচ বিচিত্ৰবীৰ্য্যের হস্তে সম্প্রদান করিব না। পূর্ব্বে এই কন্যা আমাকে কহিয়াছে, আমি শাল্বরাজের প্রতি অনুরাগিণী হইয়াছি। পরে আমার অনুমতি লাভ করিয়া শাল্বরাজের নগরাভিমুখে গমন করিল। আমার এইরূপ – একটি ব্ৰত আছে যে, আমি ভয়, অনুকম্পা [দয়া], অর্থলোভ বা অন্য কোনো অভিলাষের বশীভূত হইয়া কখনই ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিব না।
ভীষ্মের সহিত পরশুরামের যুদ্ধোগযোগ
“ ‘অনন্তর জামদগ্ন্য রোষকষায়িতলোচনে [ক্ৰোধ-কুটিল-নেত্রে] আমাকে বারংবার কহিতে লাগিলেন, “হে ভীষ্ম! তুমি যদি আমার বাক্য রক্ষা না কর, তাহা হইলে আজই অমাত্যগণের সহিত তোমাকে সংহার করিব।” আমি তখন প্রিয়বাক্যে পুনঃ পুনঃ তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিলাম; কিন্তু তিনি কিছুতেই ক্ষান্ত হইলেন না। পরে আমি তাহার চরণে নিপতিত হইয়া পুনর্ব্বার অভিলাষ করিতেছেন, তাহার কারণ কি? আমি বালক ও আপনার শিষ্য; আপনি আমাকে চতুর্ব্বিধ অস্ত্ৰে উপদেশ প্রদান করিয়াছেন।”
“ ‘তখন তিনি ক্রোধারাক্তনয়নে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! তুমি আমাকে গুরু বলিয়া মানিতেছ; তবে কি নিমিত্ত আমার প্রিয়ানুষ্ঠানের জন্য কাশিরাজকন্যাকে গ্ৰহণ করিতেছ না? এক্ষণে আমার বাক্য রক্ষা না করিলে আমি কখনই ক্ষান্ত হইব না। তুমি ইহাকে গ্ৰহণ করিয়া আপনার কুলরক্ষা কর। এই রাজকন্যা তোমাকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া নিতান্ত নিরাশ্রয় হইয়াছে।”
“ ‘আমি কহিলাম, “হে মহর্ষে। আপনার যত্ন ও পরিশ্রম নিতান্ত নিষ্ফল হইতেছে; আমি কখনই এ কাৰ্য্য করিব না। আপনি আমার পূর্ব্বতন গুরু; আমি এই বিবেচনা করিয়াই আপনাকে প্রসন্ন [স্তবস্তুতিদ্বারা প্ৰসন্ন] করিতেছি; আমি পূর্ব্বেই এই রাজকন্যাকে পরিত্যাগ করিয়াছি। কোন ব্যক্তি স্ত্রীলোকদিগের ক্ষয়মূলক [বিনাশসাধক] দোষসকল অবগত হইয়া ভুজঙ্গীর ন্যায় পরপ্রণয়িনী [অপরের প্রতি আসক্ত] রমণীকে স্বগৃহে বাস করাইবে? আমি ইন্দ্রের ভয়েও স্বধৰ্ম পরিত্যাগ করিব না। এক্ষণে আপনি প্রসন্ন হউন, অথবা অনতিবিলম্বেই স্বকর্ত্তব্য অনুষ্ঠান করুন। পুরাণে মহাত্মা মরুত্ত কহিয়াছেন, কাৰ্য্যাকাৰ্য্যজ্ঞানশূন্য, নিতান্ত গর্ব্বিত, কুপথগামী গুরুকেও পরিত্যাগ করিবে। আপনি আমার গুরু, এই নিমিত্ত আমি প্রীতিপূর্ব্বক আপনাকে সবিশেষ সম্মান করিতাম, কিন্তু এক্ষণে আপনি গুরুর ন্যায় ব্যবহার করিতেছেন না; অতএব আমি আপনার সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইব। গুরু, ব্রাহ্মণ, বিশেষতঃ তপোবৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে যুদ্ধে বিনাশ করিব না, এই নিমিত্ত আপনাকে ক্ষমা করিয়াছিলাম। কিন্তু ধর্মে এইরূপ নিৰ্ণীত আছে যে, যে ব্যক্তি ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া ব্রাহ্মণকে ক্ষত্ৰিয়ের ন্যায় সমরে অবস্থান, রোষপ্ৰকাশ ও শরবর্ষণ করিতে সন্দর্শন করে, সে তাহাকে বিনাশ করিলে ব্ৰহ্মহত্যাপাতকে লিপ্ত হয় না। আমিও ক্ষত্ৰিয়; যে ব্যক্তি যে প্রকার ব্যবহার করে, তাহার সহিত সেইরূপ ব্যবহার করিলে কখনই অধর্ম্ম ও অমঙ্গল হয় না। ধর্ম্ম ও অর্থের বিচারে সমর্থ দেশ ও কালের অবস্থাভিজ্ঞ পুরুষ যদি অর্থবিষয়ে অথবা ধর্ম্মবিষয়ে সংশয়াপন্ন হন, তবে অর্থের অনুষ্ঠান না করিয়া ধর্মের অনুষ্ঠান করিলেই তাহার শ্রেয়োলাভ হইবে। কিন্তু আপনি সংশয়িত অর্থেও [সংশয়াপন্ন প্রয়োজনেও] অযথা ন্যায়ে প্রবৃত্ত [অন্যায়রূপে] হইতেছেন; অতএব আপনার সহিত যুদ্ধ করিব। আপনি যুদ্ধে আমার অলৌকিক বিক্রম ও অদ্ভুত ভুজবীৰ্য্য সন্দর্শন করিবেন। এক্ষণে আপনি যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হউন; আমিও কুরুক্ষেত্রে আপনার সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইয়া সামৰ্থ্যানুসারে কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিব। আপনি আমার শরশতদ্বারা জর্জ্জরিত ও নিহত হইয়া নির্জিত লোকসমুদয় প্রাপ্ত হইবেন। এক্ষণে সমরক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে গমন করুন; আমি যুদ্ধার্থে সেই স্থানে আপনার সহিত সমাগত হইব। পূর্ব্বে আপনি যেস্থানে পিতার ঔর্দ্ধদেহিক [পারলৌকিক—শ্ৰাদ্ধ তৰ্পণাদি] ক্রিয়াকলাপ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, আমিও আপনাকে বিনাশ করিয়া তথায় ক্ষত্ৰিয়কুলের বৈরীশুদ্ধিকাৰ্য্য [পিতৃহন্তা ক্ষত্ৰিয়ের রক্তে পরশুরাম পিতার তৃপ্তিসাধন করিয়াছিলেন, ভীষ্মও ক্ষত্ৰিয়হন্তা পরশুরামের রক্ত দিয়া ক্ষত্ৰিয়কুলের শ্ৰাদ্ধসম্পাদনে সমুৎসুক],সমাধান করিব। আপনি অনতিবিলম্বে কুরুক্ষেত্রে গমন করুন; আমি আপনার পূরাকৃত [পূর্ব্ব প্রতিশ্রুত] দৰ্প দূরীকৃত করিব। আপনি একাকী ক্ষত্ৰিয়গণকে পরাজিত করিয়াছিলেন বলিয়া চিরকাল অহঙ্কার প্রকাশ করিয়া থাকেন; কিন্তু তৎকালে আমার সদৃশ কোন ক্ষত্ৰিয় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন নাই; পশ্চাৎ তেজসমুদয় প্রাদুর্ভূত হইয়াছে; সুতরাং আপনি তৃণমধ্যে প্রজ্জলিত হইয়াছিলেন। যে আপনার এই যুদ্ধময় দৰ্প অপনীত করিবে, সেই শত্রুবিজয়ী ভীষ্ম জন্মগ্রহণ করিয়াছে। এক্ষণে নিশ্চয়ই কহিতেছি, আমি রণস্থলে আপনার দর্পচূৰ্ণ করিব।”
“ ‘অনন্তর জমদগ্ন্য সহাস্যমুখে আমাকে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! তুমি ভাগ্যবলে আমার সহিত যুদ্ধ করিতে অভিলাষ করিয়াছ; এক্ষণে আমি তোমার সহিত কুরুক্ষেত্রে গমন করিয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইব; তুমিও তথায় গমন কর। তোমার জননী জাহ্নবী [গঙ্গা] তোমাকে আমার শরজালে নিহত এবং গৃধ্র [শকুনি], কঙ্ক [হাড়গিলে] ও কাককর্ত্তৃক ভক্ষিতকলেবর নিরীক্ষণ করিবেন। সিদ্ধচারণসেবিত ভগবতী ভাগীরথী কখনো শোকাকুল হয়েন নাই, কিন্তু এক্ষণে তাঁহাকে শোকাভিভূত হইতে হইবে; আজি তিনি তোমাকে আমার শরজালে নিহত দেখিয়া অবশ্যই রোদন করিবেন। তুমি নিতান্তই যুদ্ধকামুক [সমরাভিলাষী] ও একান্ত আতুর হইয়াছ; এক্ষণে যুদ্ধার্থ আমার সহিত সমবেত হও এবং রথপ্রভৃতি সমস্ত সামরিক দ্রব্য গ্ৰহণ করা।” তখন আমি তাঁহাকে নমস্কার করিয়া কহিলাম, “ভগবান! আপনি যাহা কহিলেন, তাহাই হইবে।”
প্রতিযুদ্ধে সমুদ্যত ভীষ্মের যুদ্ধযাত্ৰা
“ভীষ্ম কহিলেন, ‘অনন্তর পরশুরাম সংগ্রামাভিলাষে কুরুক্ষেত্রে গমন করিলে আমি পুনরায় নগরে প্রবেশপূর্ব্বক জননী সত্যবতীকে এই বৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া এবং তৎকর্ত্তৃক অনুমোদিত ও কৃতস্বস্ত্যয়ন [যুদ্ধজয়ার্থ অনুষ্ঠিত মঙ্গলকাৰ্য্য] হইয়া পাণ্ডুরবর্ণ বর্ম্ম ও পাণ্ডুরবর্ণ কার্মুক[ধনু]সহকারে অশ্বসংযুক্ত, সুন্দর অবয়বশোভিত, ব্যাঘ্রচর্ম্মপরিবৃত, উৎকৃষ্ট অধিষ্ঠানসহকৃত [রথমধ্যস্থ কক্ষযুক্ত] শস্ত্রোপপন্ন [বিবিধ অস্ত্রশস্ত্রসমন্বিত] রজতময় রথে আরোহণ করিলাম। অশ্বশাস্ত্ৰবিশারদ, সুপরীক্ষিত, সুশীল, মহাবীর সারথি বায়ুবেগে অশ্বচালনা করিতে লাগিল। ভৃত্যগণ আমার মস্তকে শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করিল এবং আমাকে শ্বেতচামরদ্বারা বীজন করিতে লাগিল। শুক্ল বসন, শুক্ল উষ্ণীষ [পাগড়ী] ও শুক্ল অলঙ্কারপরিশোভিত সূত-মাগধেরা জয়াশীর্ব্বাদ প্রয়োগ করিয়া আমার স্তুতিবাদে প্রবৃত্ত হইল। ব্রাহ্মণগণ পুণ্যাহধ্বনি [শুভসূচক ধ্বনি—শুভকাৰ্য্যের আরম্ভে শাস্ত্রীয় ‘পূণ্যাহ-স্বস্তিঋদ্ধি’ অথবা ‘স্বস্তি ঋদ্ধি-পুণ্যাহ’ এই প্রকার স্বস্তিবাচনসূচক বচনত্রয়ের উচ্চারণ।] করিতে লাগিলেন। অনন্তর আমি হস্তিনানগর হইতে কুরুক্ষেত্রে উপনীত মহাবলপরাক্রান্ত রামের দর্শনপথে অবস্থিত হইয়া শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলাম। বনবাসী তপস্বী, ব্রাহ্মণ ও ইন্দ্ৰ প্রভৃতি দেবগণ যুদ্ধদৰ্শনার্থ আগমন করিলেন। তখন দিব্যমাল্যসকল নিপতিত, বাদিত্ৰ [বাদ্য] বাদিত ও মেঘমণ্ডল ধ্বনিত [গর্জ্জনযুক্ত] হইতে লাগিল। জমদগ্ন্যের নির্দ্দেশ অনুযায়ী তাপসগণ যুদ্ধদৰ্শনার্থ রণক্ষেত্র বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন।
গঙ্গার ভীষ্মভৎসনা
“ ‘ইত্যবসরে সর্ব্বভূতহিতৈষিণী [সকল প্রাণীর হিতকারিণী] জননী গঙ্গা স্বীয় মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া আমাকে কহিলেন, “বৎস! তুমি কিরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছ? আমি জমদগ্ন্যসন্নিধানে গমন করিয়া বারংবার প্রার্থনা করিব যে, ভীষ্ম তোমার শিষ্য, তুমি তাহার সহিত যুদ্ধ করিও না। হে ভীষ্ম! তুমি ব্রাহ্মণ পরশুরামের সহিত যুদ্ধ করিতে অধ্যবসায়ারূঢ় [যত্নবান] হইও না। তুমি কি ব্যোমকেশ[মহাদেব]তুল্য ভীষণপরাক্রম ক্ষত্রিয়াঘাতী জমদগ্ন্যকে বিদিত হও নাই? তবে কি নিমিত্ত তাঁহার সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইতেছ?” তিনি এই বলিয়া আমাকে ভৎসনা করিতে লাগিলেন।
“ ‘অনন্তর আমি কৃতাঞ্জলিপুটে জননী জাহ্নবীকে অভিবাদন করিয়া আদ্যোপান্ত স্বয়ংবরবৃত্তান্ত নিবেদনপূর্ব্বক জামদগ্ন্যকে যেরূপ কহিয়াছিলাম এবং কাশিরাজদুহিতা অম্বা যেরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, সমস্তই তাঁহার কর্ণগোচর করিলাম। তখন তিনি আমার নিমিত্ত পরশুরামের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে প্রসন্ন করিবার আশায় কহিলেন, “হে পরশুরাম! তুমি স্বশিষ্য ভীষ্মের সহিত যুদ্ধ করিও না।” পরশুরাম কহিলেন, “হে দেবি! তুমি ভীষ্মকে নিবৃত্ত কর; সে আমার মনোভিলাষ সফল করিতেছে না; এই নিমিত্তই আমি তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে আগমন করিয়াছি।’ ”
“অনন্তর জাহ্নবী পুত্রস্নেহপরবশ হইয়া পুনরায় ভীষ্মসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু ভীষ্ম ক্রোধাভরে তাঁহার বাক্যের অনুরূপ কাৰ্য্য করিলেন না। তখন জমদগ্ন্য তাঁহাকে যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত আহ্বান করিলেন।”