১৭৮তম অধ্যায়
অজগরকর্ত্তৃক ভীমাক্রমণ
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন! যিনি দীপিতিচিত্তে পুলস্ত্যতনয় কুবেরকে যুদ্ধে আহ্বান করিয়া সম্মুখীন হইয়াছিলেন, যিনি কুবের-সরসীতীরে অসংখ্য যক্ষ ও রাক্ষসগণের প্রাণসংহার করিয়াছিলেন, সেই অযুতসাগতুল্য বলশালী ভীমপরাক্রম ভীমসেন কি নিমিত্ত অজগরের আক্রমণে ভীত হইয়াছিলেন, উহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতুহল জন্মিয়াছে; অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া আদ্যোপান্ত বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য পাণ্ডুতনয়গণ রাজর্ষি বৃষপর্ব্বার আশ্রম হইতে আগমন করিয়া সেই দ্বৈতবনে বাস করিলে পর মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর যাদৃচ্ছাক্রমে শরাসন ও খড়গ গ্রহণপূর্ব্বক সেই দেবগন্ধর্ব্বসেবিত পরমরমণীয় বন ও হিমাচলের রম্যপ্রদেশ-সমুদয় অবলোকন করিলেন। কোন স্থানে দেবর্ষি, সিদ্ধ ও অপ্সরাগণ সতত বিচরণ করিতেছেন; কোথাও চকোর, চক্ৰবাক, জীবঞ্জীবক ও কোকিলসকল সুমধুর ধ্বনি করিতেছে; কোথাও সিংহযূথ ভীষণ নিনাদ করিতেছে; কোথাও সতত পুষ্পফলে সমাকীর্ণ মনোনয়নানন্দন পাদপসমুদয় অসাধারণ শোভা সম্পাদনা করিতেছে, কোথাও বৈদূৰ্য্যমণিসন্নিভ সলিলসম্পন্ন হংসকারণ্ডববিরচিত গিরিনদী-সমুদয় শোভা পাইতেছে, কোথাও দেবদারুবিনরাজি জলদজালের ন্যায় বিরাজিত হইতেছে; কোথাও বা হরিচন্দন ও উত্তঙ্গ কালীয়বৃক্ষসমুদয় একত্র মিলিত হইয়া শোভিত হইতেছে।
মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন সেই প্রদেশের এইরূপ শোভা নিরীক্ষণ করিয়া বিশুদ্ধ বাণদ্বারা বিবিধ মৃগ, মহাকায় হস্তী, বরাহ ও মহিষ-সমুদয়কে সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন; বেগে পাদপসমুদয় উৎপাটন ও ভগ্ন করিয়া কানন প্ৰতিধ্বনিত করিয়া প্রফুল্লচিত্তে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক পর্ব্বতাগ্র মর্দ্দন এবং পাদপসমুদয় দূরে নিক্ষেপ করিলেন। পরে তিনি নিৰ্ভয়-হৃদয়ে আস্ফোটন, সিংহনাদ ও তলধ্বনি করিয়া কখন বা উপবিষ্ট হইয়া মৃগ অন্বেষণপূর্ব্বক সেই গহনকাননে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাসত্ত্ব গজেন্দ্র ও মৃগেন্দ্ৰগণ ভীমসেনের ভীষণ নিনাদশ্রবণে ভীত হইয়া গুহা পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল এবং তত্ৰত্য অন্যান্য প্রাণীগণ বিত্ৰাসিত ও গুহাশায়ী সৰ্পকূল সাতিশয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল।
মানুজশ্রেষ্ঠ ভীমসেন এইরূপে মৃগান্বেষণপূর্ব্বক ক্রমে ক্রমে বনচারের ন্যায় পাদচারে সেই নিবিড় অরণ্যানীমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক অতিবেগে অতিক্রমণ করিয়া পরিশেষে শনৈঃ শনৈঃ গমন করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া গিরিদুর্গমধ্যে অবস্থিত লোমহর্ষণ মহাকায় এক ভুজঙ্গম অবলোকন করিলেন। ঐ সর্প পর্ব্বতাকার স্বীয় বিপুল কলেবর দ্বারা গিরিকদের আবরণ করিয়াছে। উহার অঙ্গ চিত্ৰবিচিত্রিত ও হরিদ্রাবর্ণ, মুখবিবর গুহার ন্যায়, দন্তচতুষ্টয় অতি ভীষণ, নয়ন-যুগল উজ্জ্বল ও রক্তবর্ণ এবং আকার কালান্তক যমের ন্যায়; দেখিলে সমস্ত লোকেরই হৃদয়ে ভয় জন্মে। ঐ ভুজঙ্গ মুহুর্মুহুঃ সৃক্কণী লেহন ও ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক যেন প্রাণীগণকে ভৎসনা করিয়া দৰ্প প্ৰকাশ করিতেছে।
সেই ঘোরদর্শন অজগর ক্ৰোধান্বিতচিত্তে সহসা ভীমসেনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া বলপূর্ব্বক তাঁহার করদ্ধয় আক্রমণ করিল। তিনি তখন বিষধরের গাত্ৰস্পৰ্শ করিয়া, বরংপ্রভাবে একেবারে বিমোহিত হইলেন; ব্রাহ্মণবরের কি আশ্চৰ্য্য প্রভাব! দশসহস্ৰনাগতুল্য বলশালী ভীমসেনের তাদৃশ বাহুবল তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হইয়া গেল। তিনি ভুজঙ্গের আক্রমণে বিমোহিত হইয়া একেবারে নিশ্চেষ্ট হইলেন; আত্মমোচনের নিমিত্ত প্ৰাণপণে যত্ন করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোনক্রমেই ভুজঙ্গকে পরাস্ত করিতে পারিলেন না।