১৭৩তম অধ্যায়
বকের পুনর্জ্জীবন—বক-গৌতম-পূৰ্ব্ববৃত্তান্ত
ভীষ্ম কহিলেন, “অনন্তর প্রতাপশালী রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষ নানারত্নসংযুক্ত বস্ত্রালঙ্কারসমলঙ্কৃত সুগন্ধময় চিতা প্রস্তুত ও প্রজ্বলিত করিয়া যথাবিধানে বকপতি রাজধৰ্ম্মের প্রেতকাৰ্য্য করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময়ে বকের মাতা দাক্ষায়ণী সুরভি ঐ চিতার উৰ্দ্ধভাগে আবির্ভূত হইলেন। তাঁহার বদন হইতে অনবরত ক্ষীরমিশ্রিত ফেন নিঃসৃত হইতে লাগিল। সেই ফেন বকরাজের চিতাতে নিপতিত হওয়াতে বকপতি উহার স্পর্শমাত্র পুনর্জ্জীবিত হইয়া চিতা হইতে গাত্রোত্থানপূৰ্ব্বক রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষের নিকট উপস্থিত হইল। ঐ সময় দেবরাজ ইন্দ্র সেই রাক্ষসের ভবনে সমাগত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন রাক্ষসনাথ। তুমি সৌভাগ্যক্রমে রাজধৰ্ম্মকে পুনর্জ্জবিত করিয়াছ। এক্ষণে আমি উহার পূর্ব্ববৃত্তান্ত যেরূপ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
‘পূৰ্ব্বে ঐ বকপতি লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মার সভায় উপস্থিত না হওয়াতে তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া উহাকে এই বলিয়া অভিশাপ দিয়াছিলেন যে, “যখন সে আমার সভায় সমাগত হইল না তখন তাহাকে নিশ্চয়ই দীর্ঘকাল জীবিত থাকিতে হইবে।” হে রাক্ষসনাথ! ভগবান্ ব্রহ্মার সেই বাক্যপ্রভাবেই এই পক্ষী গৌতমকর্ত্তৃক নিহত হইয়াও অমৃতস্পর্শে পুনৰ্ব্বার জীবন লাভ করিয়াছে।’
“সুররাজ এই কথা বলিয়া নিরস্ত হইলে বক তাঁহাকে প্রণিপাত করিয়া কহিল, ‘সুরেশ্বর! যদি আমার প্রতি আপনার দয়া উপস্থিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনি আমার পরমবন্ধু গৌতমকে পুনর্জ্জীবিত করুন।’ তখন দেবরাজ ইন্দ্র বকের প্রার্থনাবাক্যশ্রবণে আহ্লাদিত হইয়া অমৃতনিষেকদ্বারা গৌতমকে জীবনপ্রদান করিলেন। অনন্তর বকপতি রাজধৰ্ম্ম পাপপরায়ণ মিত্র গৌতমকে তাঁহার ধনসম্পত্তির সহিত গমন করিতে আদেশ করিয়া প্রীতমনে স্বীয় আবাসে গমনপূৰ্ব্বক তথা হইতে ব্রহ্মসদনে [১] সমুপস্থিত হইল। ব্রহ্মা মহাত্মা বককে অবলোকন করিয়া বিধানানুসারে তাহার অতিথিসৎকার করিলেন। এদিকে গৌতমও পুনরায় কিরাতভবনে সমুপস্থিত হইয়া সেই শূদ্রার গর্ভে দুষ্কৰ্ম্মকারী পুত্ৰসমুদয় উৎপাদন করিতে লাগিলেন। গৌতম বকবধ করিলে দেবগণ তাঁহাকে এই শাপপ্রদান করিয়াছিলেন যে, ঐ কৃতঘ্ন পাপাত্ম গৌতম বিধবা শূদ্রার গর্ভে কতকগুলি পুত্রোৎপাদন করিয়া পরিশেষে নরকগামী হইবে।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! পূর্বে মহর্ষি নারদ আমার নিকট যে উপাখ্যান কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, আমি তাহা স্মরণ করিয়া তোমার নিকট অবিকল কীৰ্ত্তন করিলাম। কৃতঘ্নের যশ, আশ্রয় বা সুখ কুত্রাপি নাই। কৃতঘ্ন ব্যক্তিরা নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়, উহাদের কোনরূপেই নিষ্কৃতিলাভের সম্ভাবনা নাই। মিত্রের অনিষ্টাচরণ করা কাহারও কৰ্ত্তব্য নহে। মিত্রদ্রোহী ব্যক্তি অনন্তকাল ঘোরতর নরকযন্ত্রণা ভোগ করে। মিত্রের হিতাভিলাষী ও কৃতজ্ঞ হওয়া সৰ্ব্বতোভাবে উচিত। মিত্র হইতে সম্মানলাভ, ভোগ্যবস্তুর উপভোগ ও বিবিধ বিপদ হইতে উদ্ধার হইতে পারে। অতএব বিচক্ষণ ব্যক্তি বিবিধ প্রকারে মিত্রের পূজা করিবেন। সুপণ্ডিত ব্যক্তিমাত্রেরই পাপাত্মা কৃতঘ্ন ব্যক্তিদিগকে পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। মিত্রদ্রোহী ব্যক্তি কুলাঙ্গার, পাপাত্মা ও নরাধম বলিয়া পরিগণিত হয়। হে ধৰ্ম্মরাজ! এই আমি তোমার নিকট মিত্রদ্রোহী ও কৃতঘ্নের বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে তোমার আর কি শ্রবণ করিতে বাসনা আছে, তাহা প্রকাশ কর।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, জনমেজয়! ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মের মুখে এই সমুদয় বাক্য শ্রবণ করিয়া যারপরনাই প্রীতিলাভ করিলেন।
আপদ্ধর্ম্মপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত