১৭২তম অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধে কৌরবপরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর যুদ্ধদুর্ম্মদ কৌরবপক্ষীয় নরপতিগণ সুবর্ণ ও রত্নে খচিত অসংখ্য রথ এবং বহুসংখ্যক হস্তী ও অশ্বারোহীসমভিব্যাহারে ক্রোধভরে সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইলেন। মহারথগণ সত্যবিক্রম সাত্যকির চতুর্দ্দিক বেষ্টনপূর্ব্বক সিংহনাদ ও তর্জ্জনগর্জ্জন করিয়া তাহার বিনাশরাসনায় তীক্ষ্ণ শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। যুদ্ধদুর্ম্মদ মহাধনুর্দ্ধর অরাতিনিপাতন সাত্যকি সেই বীরগণকে সমাগত অবলোকন করিয়া তাহাদের উপর বিবিধ শর পরিত্যাগপূর্ব্বক সন্নতপূর্ব্ব বিশিখনিকরদ্বারা তাঁহাদিগের মস্তক এবং ক্ষুরপ্রদ্বারা গজসমুদয়ের শুণ্ড, অশ্বগণের গ্রীবা ও বীরগণের কেয়ূরযুক্ত বাহু ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় অসংখ্য শ্বেতচ্ছত্র ও চামরনিচয় নিপতিত হওয়াতে সমরভূমি নক্ষত্রমালামণ্ডিত নভোমণ্ডলের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। মহাবীর সাত্যকি এইরূপে সৈন্যগণকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলে প্রেতগণের চীৎকারের ন্যায় তাহাদিগের তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইল। সেই শব্দে রণভূমি পরিপূরিত হইলে সেই ঘোররূপা রজনী অধিকতর ভয়াবহ হইয়া উঠিল।
“হে মহারাজ! তখন মহারথ রাজা দুর্য্যোধন সাত্যকিশরে সৈন্যগণকে উন্মূলিত অবলোকন এবং লোমহর্ষণ তুমুল নিনাদ শ্রবণ করিয়া সারথিকে কহিলেন, ‘হে সূত! যে প্রদেশে ঐ তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইতেছে, সেই স্থানে অবিলম্বে অশ্বসঞ্চালন কর। সারথিও তাঁহার আদেশানুসারে যুযুধানের অভিমুখে রথসঞ্চালন করিতে আরম্ভ করিল। বিজিতক্রম বিচিত্রযোদ্ধা রাজা দুর্য্যোধন এইরূপে সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইলে মহাবীর সাত্যকি শোণিতলোলুপ শাণিত দ্বাদশশর আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার উপর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর দুর্য্যোধন শৈনেয়ের শরে অগ্রে নিপীড়িত হইয়া অমর্ষিতচিত্তে তাঁহাকে দশবাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন সমস্ত পাঞ্চালগণের সহিত কৌরবগণের অতি অদ্ভুত যুদ্ধ উপস্থিত হইল। মহাবীর সাত্যকি ক্রোধাবিষ্টচিত্তে আপনার মহারথ পুত্র দুর্য্যোধনের বক্ষঃস্থলে অশীতি সায়ক নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার অশ্বগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিয়া সারথিকে ভূতলে নিপতিত করিলেন। তখন মহাবাহু দুর্য্যোধন সেই অশ্বশূন্য রথে অবস্থানপূর্ব্বক সাত্যকির রথের প্রতি নিশিত পঞ্চাশৎ শর পরিত্যাগ করিলেন। সাত্যকি লঘুহস্ততা প্রদর্শনপূর্ব্বক সেই দুর্য্যোধনপ্রেরিত শরনিকর নিবারণ করিয়া একভল্লে তাঁহার শরাসনের মুষ্টিদেশ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন রাজা দুর্য্যোধন রথ ও কার্মুকবিহীন হইয়া তৎক্ষণাৎ কৃতবর্ম্মার রথে আরোহণ করিলেন। এইরূপে দুর্য্যোধন সমরপরাঙ্মুখ হইলে সাত্যকি শরনিকরদ্বারা কৌরবসৈন্যগণকে বিদারিত করিতে লাগিলেন।
“এ দিকে মহাবীর শকুনি বহু সহস্র হস্তী, অশ্ব ও রথদ্বারা অর্জ্জুনকে পরিবেষ্টিত করিয়া তাঁহার উপর নানা শস্ত্র প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। কালপ্রেরিত ক্ষত্রিয়গণ অর্জ্জুনের প্রতি দিব্যাস্ত্রজাল পরিত্যাগপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। অর্জ্জুন শকুনিকে সমরে পরাঙ্মুখ করিবার মানসে সেই সহস্র সহস্র রথী, হস্তী ও অশ্বগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন শকুনি রোষকষায়িতলোচনে বিংশতিশরে অরাতিঘাতন অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার রথের উপর শত শত শর নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন বিংশতিবাণে শকুনিকে ও তিন তিন বাণে অপরাপর ধনুর্ধারিগণকে বিদ্ধ করিয়া অরাতিনিক্ষিপ্ত শরনিকর নিবারণপূর্ব্বক বজ্রসম সায়কসমুদয়ে আপনাদের যোধগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তৎকালে, বসুধাতল যোধগণের সহস্র সহস্র ছিন্নভুজ ও কলেবরদ্বারা কুসুমে সমাবৃত, কিরীটকুণ্ডলমণ্ডিত, নিষ্কচূড়ামণিবিভূষিত উদ্বৃত্তলোচন ও দংশিতাধর মস্তকসমুদয়দ্বারা চম্পকবিন্যস্ত পর্ব্বতসমূহে সমাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
“তখন বিপুলবিক্রম অর্জ্জুন সেই দুরূহকর্ম্ম সম্পাদনান্তর নতপর্ব্ব পাঁচবাণে শকুনিকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার সমক্ষে তাঁহার পুত্ৰ উলূকের দেহ বিদারণপূর্ব্বক সিংহনাদে মেদিনীমণ্ডল কম্পিত করিতে লাগিলেন এবং সত্বর শকুনির শরাসন ছেদন করিয়া তাঁহার অশ্বচতুষ্টয় শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। সুবলনন্দন এইরূপে বীতৎসু-শরে অশ্ববিহীন হইয়া অবিলম্বে স্বীয় রথ হইতে অবতরণপুর্ব্বক উলূকের রথে সমারূঢ় হইলেন। তখন সমুত্থিত মেঘদ্বয় যেমন পর্ব্বতে বারিবর্ষণ করে, তদ্রূপ একরথে সমারূঢ় শকুনি ও তাঁহার পুত্র উলূক অর্জ্জুনের উপর অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মেঘাবলি যেরূপ সমীরণপ্রভাবে ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়, তদ্রূপ আপনার সেনাগণ অর্জ্জুনবাণে ছিন্নভিন্ন হইয়া শঙ্কিতচিত্তে দশদিকে পলায়ন করিতে লাগিল। সেই গাঢ়তিমিরাবৃত রজনীতে অনেক যোদ্ধা স্ব স্ব অশ্ব পরিত্যাগ ও অনেকে স্বয়ং অশ্বচালনপূর্ব্বক সন্ত্রস্তচিত্তে সমর হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইল। হে মহারাজ! এইরূপে বাসুদেব ও ধনঞ্জয় আপনার যোদ্ধৃবর্গকে পরাজিত করিয়া প্রসন্নমনে শঙ্খনিনাদ করিতে লাগিলেন।
“ঐ সময় মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তিনবাণে দ্রোণকে বিদ্ধ করিয়া নিশিত শরদ্বারা তাঁহার শরাসনমৌর্ব্বী ছেদন করিলেন। ক্ষত্রিয়মর্দ্দন দ্রোণ তৎক্ষণাৎ সেই ছিন্নচাপ ধরাতলে পরিত্যাগ করিয়া অন্য উৎকৃষ্ট শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক সাতবাণে ধৃষ্টদ্যুম্নকে ও পাঁচবাণে সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন শরনিকরদ্বারা দ্রোণকে নিবারণ করিয়া, দেবরাজ যেমন অসুরসেনা সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ কৌরবসেনাগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তৎকালে অসংখ্য কৌরবসৈন্য নিহত হইলে সমরাঙ্গনে উভয়পক্ষীয় সেনাগণের মধ্যে বৈতরণীসদৃশ ঘোরতর শোণিতনদী প্রবাহিত হইল। সহস্র সহস্র নর, অশ্ব ও হস্তী উহার তরঙ্গে ভাসিতে লাগিল। প্রতাপশালী ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপে সেই কৌরবসৈন্য বিদারণপুর্ব্বক দেবগণকর্ত্তৃক পরিবৃত দেবেন্দ্রের ন্যায় শোভমান হইয়া শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন শিখণ্ডী, নকুল, সহদেব, সাত্যকি ও বৃকোদরপ্রমুখ পাণ্ডবপক্ষীয় মহাবীরগণও কৌরবপক্ষীয় সহস্র সহস্র ভূপতির প্রাণসংহারপূর্ব্বক জয়শালী হইয়া দুর্য্যোধন, কর্ণ, দ্রোণ ও অশ্বত্থামার সমক্ষে বারংবার সিংহনাদ ও শঙ্খনাদ করিতে লাগিলেন।”